ভাষান্তর: জিললুর রহমান
পশ্চিমের বিষয়কে কিংবা পশ্চিমকে বিষয় হিসেবে চর্চার আকাঙ্ক্ষার ফল আজ পশ্চিমে সবচেয়ে র্যাডিকেল সমালোচনা হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে। বহুবাচক ‘বিষয়-বিক্রিয়া’র যাওয়ার এক তত্ত্ব যখন এই জ্ঞানের বিষয়কে আধার করছে, তখন বিষয়গত কর্তৃত্বের গোড়া ক্ষয়ে যাওয়ার এক ইল্যুশনও সৃষ্টি হচ্ছে। যদিও বিষয় হিসেবে ইউরোপের ইতিহাস আজ আইন, রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং পশ্চিমা আদর্শ দিয়ে বিবৃত হয়, তবু এই বিষয়টিই গোপনে দাবি করে—তার কোনো ভৌগোলিক রাজনৈতিক দৃঢ়তা নেই। ফলে সার্বভৌম বিষয়ের অতি-জননন্দিত সমালোচনা মূলত এমনতর একটি নাজুক ‘বিষয়’কেই উদ্ঘাটিত করে। এই নির্দিষ্ট ‘বিষয়’গুলো একটা স্বচ্ছতার মধ্যে একত্রে সযত্নে গাঁথা আছে ডি-নেগেশনের মাধ্যমে এবং শ্রমের আন্তর্জাতিক বিভাজনে শোষকের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার মাধ্যমে। সমসাময়িক বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে ক্ষমতা ও আকাঙ্ক্ষার প্রকৃতি কল্পনা করাই অসম্ভব, যা ইউরোপের ‘অন্য’ অংশের শিরোনামহীন বিষয়কে আভাসের সুযোগ দেয়। এটা শুধু এই নয় যে, জটিল কিংবা অজটিল যা কিছুই তারা পড়ছে, সবকিছুই ‘অন্য’ উৎপাদন-বিতর্কের আওতায় ধরা পড়েছে—বিষয় হিসেবে ইউরোপ এটার সংগঠনকে সমর্থন করুক বা না করুক। এটাও সত্য যে, ‘অন্য’ ইউরোপের সংগঠনে সব সময়ই বিশেষ যত্ন নেওয়া হয় টেক্সট-এর মসলাকে অবরুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে। এর সঙ্গে এমন একটি বিষয় জড়িত হতে পারতো, যার ভ্রমণ বৃত্তান্তে স্থান পেতে পারতো আদর্শিক বা বৈজ্ঞানিক উৎপাদন প্রসঙ্গ নয়, বরং আইনের সহায়ক। ইন্টেলেকচুয়াল জগতের জন্য রাজনীতি চর্চার সম্ভাবনা কেবল অর্থনৈতিক অপনোদনের মাধ্যমেই হওয়ার কথা। অর্থনৈতিক ব্যাপারকে যেভাবে সামাজিক টেক্সট রূপে দাবি করা হয়, ততটা অপরিবর্তনীয় রূপে দেখা সম্ভব, যখন এটা ভুলভাবে হলেও চূড়ান্ত নির্দেশক হিসেবে দাঁড়াতে পারে, যদিও তা অপনোদিত। এ ধরনের সহিংসতার সুস্পষ্ট উদাহরণ হচ্ছে, ‘অন্য’ হিসেবে ঔপনিবেশিক বিষয়কে সংগঠন করার জন্য দূর থেকে সুর সংযোজিত সুদূর প্রক্ষিপ্ত বিপ্রতীপ প্রকল্প। এই প্রকল্পটিও সেই ‘অন্য’-এর সঙ্গে তার অনিশ্চিত বৈষয়িকতায় এক বিসদৃশ, বিঘ্ন। এটা সুবিদিত যে, ফুকো চিহ্নিত করেন উন্মুক্ত সহিংসতাকে-ইউরোপের অষ্টাদশ শতকের শেষে সুস্থতার পুনর্বিশ্লেষণে উন্মত্ততার একটি সম্পূর্ণ অনুসন্ধান কর্মে। কিন্তু সেই বিশেষ পুনর্বিশ্লেষণ যদি ইউরোপ ও সেইসঙ্গে উপনিবেশের ইতিহাসের বর্ণনার একটি অংশমাত্র হয়? সহিংসতার অনুসন্ধানে দু’টি প্রকল্প যদি দু’হাত-বিশিষ্ট সুবিশাল ইঞ্জিনের স্থানচ্যুত ও অপ্রশংসিত অংশরূপে কাজ করে তবে? এটা অবশ্য সর্বজ্ঞাত যে সাম্রাজ্যবাদের পুনরোল্লিখিত বর্ণনার অনুটেক্সট ‘বশীভূত জ্ঞান’ হিসেবে সুপরিচিত, যা এক সম্পূর্ণ জ্ঞানভাণ্ডার, যদিও তার কাজে অসম্পূর্ণরূপে বর্ণিত বলে গ্রহণযোগ্য হয়ে পড়েছে। এই জ্ঞান পৌরহিত্যের নিচে অবস্থান করছে। প্রয়োজন ও বৈজ্ঞানিকতার জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রার তুলনায় পেছনে অবস্থিত। (ফুকো ১৯৮০ : ৮২)
এ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাসের উৎকৃষ্টতম সংস্করণ, যা ঘটনা যেভাবে ঘটেছে, সেভাবে না বলে বরং বর্ণনার সুযোগ নিয়ে সাম্রাজ্যবাদকে বিশ্লেষণ করেছে। এর থেকে বোঝা যায় বাস্তবতার বিশ্লেষণ ও বর্ণনা কিভাবে স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়। এখন চোখ ফেরানো যাক এই উন্মত্ত সহিংসতার ক্ষেত্রভূমির নীরব কেন্দ্রের প্রান্তিক অঞ্চলে, যেখানে রয়েছে গ্রামবাসী নারীপুরুষ, আদিবাসী এবং শহরের নীচুস্তরের সাব-প্রলেতারিয়েতরা। ফুকো ও ডিল্যুজের মতে, প্রথম বিশ্বের মতো সামাজিকীকৃত রাজধানীর আদর্শায়ন ও রেজিমেন্টেশনের দেশেও সুযোগ পেলেই নিপীড়িত জনগণ জোটবদ্ধ রাজনীতির সলিডারিটির মাধ্যমে কথা বলতে পারে এবং তাদের অবস্থা সম্যক জানতে পারে (যদিও তারা তা উল্লেখ করতে চায় না), কেননা সমস্যার উপস্থাপনকে এখানে এড়ানো যায় না, আর এক ধরনের মার্কসীয় চিন্তাও এক্ষেত্রে ক্রিয়াশীল। আমাদের অবশ্যই এ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে যে, সামাজিকীকৃত মূলধন থেকে শ্রমের আন্তজার্তিক বিভাজনের অন্য পাশে, সাম্রাজ্যবাধী আইন ও শিক্ষার মাধ্যমে সৃষ্ট অর্থনীতির প্রাথমিক টেক্সট-এর উন্মত্ত সহিংসতার সার্কিটের বাইরে ও ভেতরে সাব অলটার্ন কথা বলতে পারে কি?
আমার ধারণায় প্রথম অংশ হলো- সাবঅলটার্ন-এর ধাপে ধাপে উন্নতি সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্পের কারণে জটিল হয়ে পড়ে। পাশাপাশি একদল বুদ্ধিজীবীর মুখোমুখি হয়, যারা ‘সাবঅলটার্ন স্টাডিজ’ গ্রুপ নামে অভিহিত। এরা অবশ্যই এ প্রশ্ন রাখে যে, ‘সাবঅলটার্ন কথা বলতে পারে কি?’ এখানে আমরা এখন ইতিহাসের ফুকোর তরিকার আওতাধীন এবং যে সব লোক তার প্রভাব স্বীকার করে, তাদের সঙ্গেই অবস্থান করছি। তাদের প্রকল্প হচ্ছে উপনিবেশের ওপর কাজ করার সময়ে ক্ষুদ্র কৃষকদের বিদ্রোহের পরম্পরাহীন শেকলের ভারতীয় ঔপনিবেশিক ইতিহাস-তত্ত্বকে পুনর্পাঠ করা। এটাও মূলত সাঈদ (১৯৮৪) আলোচিত ‘বর্ণনার অনুমোদন’-এর সমস্যা।
রনজিৎ গুহ যেভাবে প্রশ্ন করছেন তা হলো: ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসতত্ত্বে বহুকাল ধরে আভিজাত্যবাদের প্রাধান্য ছিল—উপনিবেশবাদী আভিজাত্যবাদ এবং বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী আভিজাত্যবাদ উভয়েই এই ধারণা পোষণ করে যে, ভারতীয় জাতি এবং সচেতন জাতীয়তাবাদের উন্নয়নের গঠনপদ্ধতি এটাই প্রমাণ করে যে, এটা সম্পূর্ণরূপে এবং প্রধানত অভিজাতদেরই অর্জন। উপনিবেশবাদী ও নব্য-উপনিবেশবাদী ইতিহাসতত্ত্বে এই অর্জনগুলির জন্য ব্রিটিশ উপনিবেশের আইন, প্রশাসন, রাজনীতি, প্রতিষ্ঠান এবং সংস্কৃতিকে বাহবা দেওয়া হয়েছে। তবে জাতীয়তাবাদী ও নব্য-জাতীয়তাবাদীদের লেখায় বাহবা পেয়েছে অভিজাতগণের ব্যক্তিত্ব, প্রতিষ্ঠান, কার্যক্রম এবং চিন্তা-চেতনা।’ (গুহ; ১৯৮২ : ১)
অন্য স্বরের প্রতি আগ্রহী প্রথম বিশ্বের বুদ্ধিজীবীদের কাছে নিদেনপক্ষে দেশীয় সংবাদ সরবরাহকারীরাও বিশেষ ধরনের ভারতীয় এলিট। কিন্তু কেউই স্বীকার করবে না যে, উপনিবেশীকৃত সাবঅলটার্ন বিষয়গুলো অপরিবর্তনীয়ভাবে বিপ্রতীপ।
দেশীয় অভিজাতদের বিপরীতে আমরা বসাতে পারি, গুহের ভাষায়, ‘জনগণের রাজনীতি’কে। উপনিবেশ-সৃষ্ট চক্রের বাইরে এবং ভেতরের উভয় ক্ষেত্রেই। চক্রের বাইরে জনগণের রাজনীতি স্বায়ত্তশাসিত ব্যাপার, কেননা এটা না অভিজাত রাজনীতি থেকে জাত, না তার ভেতরে অবস্থান করে। চক্রের ভেতরে এটা শক্তিশালীভাবে অনবরত ক্রিয়াশীল থাকে উপনিবেশ সত্ত্বেও—নিজেকে সিংহাসন এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ফর্ম ও বিষয়ের পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে। (গুহ ; ১৯৮২:৪)। আমি সম্পূর্ণরূপে নথিভুক্ত করতে পারি না স্বায়ত্তশাসনের শক্তিমান ও সম্পূর্ণ অনুষঙ্গগুলোকে, কেননা বাস্তবিক ইতিহাসতত্ত্বের অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গগুলো এ ধরনের অন্তর্ভুক্তিগুলোকে মেনে নেবে না জনগণকে সংজ্ঞায়িত করে, যা নানা পার্থক্যের মধ্যে একমাত্র চিহ্নায়ক হতে পারে। তিনি বৃহদাকারে ঔপনিবেশিক সমাজের উৎপাদনকে বিস্তৃত করে একটি গতিময় স্তরবিন্যাসের প্রস্তাব রাখেন। এই তালিকার তৃতীয় পক্ষ হচ্ছে ভারসাম্যরক্ষাকারী দল, যার অবস্থান জনগণ ও বৃহৎ চক্ষুষ্মান শক্তিশালী প্রধান দলের মাঝখানে-দেরিদা এই মধ্যবর্তী অবস্থানকে বলেন antre(১৯৮১):
১। প্রাধান্যকারী বিদেশি দল, অভিজাত ,
২। প্রাধান্যকারী দেশীয় দল, সর্বভারতীয় পর্যায়ে,
৩। প্রাধান্যকারী দেশীয় দল, আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ে,
৪। জনগণ
গুহের ভাষায় জনগণ ও সাবঅলটার্ন শ্রেণী একই অর্থবাচক। সামাজিক দল ও প্রসঙ্গগুলো এই শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা প্রতিভাত করে ভারতীয় জনগোষ্ঠী ও অভিজাত শ্রেণীর মধ্যকার পার্থক্যকে। এই তালিকার তৃতীয় দলকে পরিস্থিতির অনির্ধারকরূপে ধরে নিয়ে সচেতন ঐতিহাসিকেরা পূর্ব ধারণার ভিত্তিতে প্রশ্ন রাখেন—সাবঅলটার্ন কি কথা বলতে পারে ?
‘সংশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এই শ্রেণী-বিভাজন তার গাঠনিক দিক থেকে অসদৃশ এবং আঞ্চলিক অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নের সেসব চরিত্রকে ধন্যবাদ দিতে হয়, যারা স্থানভেদে বিভিন্ন। একই শ্রেণী বা বস্তু যা এক এলাকায় প্রাধান্য রাখছে, তারাই আবার অন্যত্র নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এই প্রবণতাগুলোও ঐক্যের ক্ষেত্রে অনেক ঝামেলা ও বিপ্রতীপতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে, বিশেষত গ্রামীণ অশিক্ষিত ভূস্বামী, ধনী কৃষক ও উচ্চ মধ্যবিত্ত চাষাদের নীচুস্তরে, যারা প্রকৃত অর্থে জনগণ বা সাবঅলটার্ন শ্রেণীভুক্ত। (গুহ : ১৯৮২ : ০৮)
এই গবেষণাকর্মের ভূমিকা এখানে তৃতীয় গ্রুপের সুনির্দিষ্ট চরিত্র, আদর্শিক ও ঐতিহাসিক অবস্থান থেকে বিচ্যুতির মাত্রা নির্ণয়, চিহ্নায়ন ও পরিমাপ করা—এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এখনও উৎসুক পদ্ধতিগত অনুজ্ঞা কার্যরত। আমি বলতে চেয়েছি যে, ফুকো ও জিল্যুজের আলাপচরিতায় একটি পোস্ট-রিপ্রেজেন্টেশনালিস্ট বক্তব্য একটি এসেনশিয়ালিস্ট এজেন্টকে গোপন করে। সাবঅলটার্ন জ্ঞানচর্চায়-সাম্রাজ্যবাদী সহিংসতা, সামাজিক ও শৃঙ্খলাগত বিবরণের কারণে-আবশ্যকতাবাদী সংজ্ঞায় বিশ্লেষিত একটি প্রকল্প অবশ্যই র্যাডিকেল তত্ত্বের বহুবর্ণিল চর্চার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। এই দলের অনুসন্ধানের উদ্দেশ্য কেবল জনগণই নয়, বরং আঞ্চলিক অভিজাত সাবঅলটার্নের আদর্শবিচ্যুত ভাসমান বাফার জোন। বস্তুত জনগণ বা সাবঅলটার্নকে অভিজাত থেকে ভিন্ন রূপেই সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এই গবেষণা প্রথম বিশ্বের র্যাডিকেল বুদ্ধিজীবীদের স্বনির্ণীত স্বচ্ছতা থেকে ভিন্ন এক অবস্থানকে নির্ণয় করে। কোন তত্ত্বটা নির্ধারিত করে তেমন একটা অবস্থানকে? তারা কি তা আদৌ অনুমান করতে পারে ? বস্তুত গুহ তার সংজ্ঞায় জনগণকে দেখেন মালিক-ক্রীতদাসের দ্বান্দ্বিকতার মধ্যে। তাদের তত্ত্ব সংযোজন করে নিজস্ব পরিস্থিতির অসম্ভাব্যতাকে সম্ভ্যাব্য পরিস্থিতিরূপে পুনর্লেখনের কঠিন কাজকে। আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ে প্রাধান্যকারী দেশীয় দলের ক্ষেত্রে তারা সামাজিক স্তরে প্রাধান্যকারী সর্বভারতীয় দলের নিচে অবস্থান এবং তাদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে। প্রকৃত অর্থে তারা নিজেদের সামাজিক অবস্থানের স্বার্থে সাযুজ্যপূর্ণ কাজ করে না। এই লেখকেরা যখন তাদের আবশ্যকতাবাদী ভাষায় বলেন, এই অন্তর্বর্তী দলটির স্বার্থ ও কাজের মধ্যে একটি ফারাক থেকে যায়, তখন তাদের অনুসিদ্ধান্ত এই প্রসঙ্গে ডিল্যুজের আত্মসচেতন নেটিভদের তত্ত্বের চেয়ে বরং মার্কস-এর কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ায়। মার্কসের মতো গৃহ-ও জৈবিক তাড়নার চেয়ে সামাজিক প্রনোদনাকেই বেশি গুরুত্ব দেন, যখন তিনি স্বার্থ সম্পর্কে বলেন।
অতএব তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত অন্তর্বর্তী দলের ক্ষেত্রে যারা প্রকৃত সাবঅলটার্ন, যাদের পরিচয় হচ্ছে তাদের ভিন্নতা, বস্তুত তাদের কোনও উপস্থাপনযোগ্য সাবঅলটার্ন বিষয় নেই, যা তারা জানে বা তার কথা বলে। এক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের সমাধান হচ্ছে, উপস্থাপনা থেকে পলায়ন করা যাবে না। সমস্যাটা হচ্ছে যে, বিষয়ের বৃত্তান্ত বা কিতাবের খোঁজ পাওয়া যায়নি, যাতে প্রতিনিধিত্বকারী বুদ্ধিজীবীদের নিকট প্রলোভনের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করা যায়। ভারতীয় দলের অদূর অতীতের ভাষায় প্রশ্নটি হচ্ছে—আমরা কিভাবে জনগণের সচেতনতাকে স্পর্শ করতে পারি, এমনকি যদি আমরা তাদের রাজনীতিকেও অনুসন্ধান করি ? কোন্ স্বরচেতনায় সাবঅলটার্নরা কথা বলতে পারে? সর্বোপরি এদের প্রকল্প হচ্ছে ভারতীয় জনতার চেতনার উন্নয়নকে পুনর্লেখন করা। সাম্রাজ্যবাদের পরিকল্পিত যতি এই প্রকল্পকে প্রবলভাবে চিহ্নিত করে, যদিও পুরনো ধাঁচের সংশ্লেষণ মেডিক্যাল ও জুরিব্যবস্থার পদ্ধতিকে দৃশ্যায়িত করে, যা পিয়েরে রিভেরে-এর গল্প জুড়ে আছে।
ফুকো সঠিকভাবেই বলেছেন যে, ‘অদৃশ্যকে দৃশ্যায়িত করা মানে স্তরের ক্ষেত্রে একটি পরিবর্তন সাধন; বস্তুজগতের একটি স্তরে যেখানে ইতিহাসের কোনো পরম্পরা নেই এবং যার নেই কোনো নৈতিক, নান্দনিক বা ঐতিহাসিক মূল্য তেমন কোনো ক্ষেত্রে।’ এটা হচ্ছে প্রতিনিয়ত সমস্যাসংকুল বিষয়টি সম্পর্কে যে কোনো ধরনের বিশ্লেষণ, তা মানসিক, মনেবিশ্লেষক বা ভাষাতাত্ত্বিক-যা-ই-হোক, তাকে পাশ কাটিয়ে দৃশ্যায়িত হওয়ার ব্যবস্থা থেকে স্বতস্ত্র হওয়ার দিকে ছিটকে যাওয়া।
যখন আমরা সাবঅলটার্ন চেতনার সহবর্তী প্রশ্নের সম্মুখীন হই, তখন কোনো কাজের প্রণোদনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তা বলতে পারি না। সামাজিক টেক্সট-এর পর্বগুলোতে প্রজাবিপ্লবের বিশ্লেষণ অনেকটা কথনের পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়। প্রেরক-কৃষক চিহ্নিত হয় পুররুদ্ধারকৃত চেতনার সূচকরূপে। গ্রহণকারীর ব্যাপারে আমরা অবশ্যই জানতে চাইব যে, একটি প্রজাবিপ্লবের ফসলের প্রকৃত প্রাপক কে ? একজন ঐতিহাসিক যিনি প্রজাবিপ্লবকে জ্ঞানের টেক্সট-এ রূপান্তর করেন, তিনি কেবল যেকোনো সমন্বিত সামাজিক কর্মের একজন ‘গ্রহণকারী’ মাত্র। সেই হারানো উৎসের প্রতি কোনো নস্টালজিয়ার সম্ভাবনা ছাড়াই ঐতিহাসিক যদ্দুর সম্ভব নিজস্ব চেতনাকে পরিত্যাগ করবেন, যেন প্রজাবিপ্লবের ব্যাখ্যা, বিপ্লবের চেতনাসমেত একটি তদন্তের বিষয়বস্তুতে পরিণত না হয়। প্রজাবিপ্লবের টেক্সট থেকে উদ্ভূত বিষয়টি কেবল উপনিবেশের প্রাধান্যকারী দলের বিপ্রতীপ ধারণারূপেই দাঁড়াতে পারে। উত্তর ঔপনিবেশিক বুদ্ধিজীবীদের শিক্ষা হচ্ছে—তাদের এতদিনের ত্যাগ বঞ্চনা-ই তাদের বর্তমান সুবিধাজনক অবস্থানের প্রেরণা। এক্ষেত্রে তারাই হচ্ছেন বুদ্ধিজীবীদের আদর্শ।
এটাই সর্বজনবিদিত যে সাম্রাজ্যবাদের সাবঅলটার্ন অপেক্ষা নারীবাদী প্রণোদনা একইভাবে ডিকনস্ট্রাকটিভ সমালোচনা এবং বেম কিছু নারীবাদী সমালোচনায় ব্যবহৃত হয়েছে। ডিকনস্ট্রাকশন তত্ত্বে এমন নারীর চরিত্রকে মূর্ত করা হয়, যার সামান্য উক্তিই যৌনবাদী ট্রাডিশনে নগণ্যরূপে দেখা হয়। সাবঅলটার্ন ইতিহাসতত্ত্ব এমন এক পদ্ধতির প্রসঙ্গ উত্থাপন করে, যা এ ধরনের প্রবঞ্চনাকে প্রতিহত করে। নারীর জন্য, নারী ও নীরবতার মধ্যকার সম্পর্কটার ছক নারীর নিজেকেই তৈরি করতে হবে। জাতি ও গোত্রের শ্রেণীভাগ তার ভিত্তিতেই তৈরি করতে হবে। সাবঅলটার্ন ইতিহাসতত্ত্ব তেমন অবস্থানের অসম্ভাব্যতার অবশ্যই বিরোধিতা করবে। সাম্রাজ্যবাদের এই সংকীর্ণ অথচ প্রচণ্ড সন্ত্রাস আমাদের নিকট সাধারণ সন্ত্রাসের একটি অসঠিক রূপকের উপস্থাপন করে, যা একটি উদ্ভ্রান্তির মধ্যেই সম্ভব।
সাবঅলটার্ন বিষয়ের এই নাতিদীর্ঘ ভ্রমণ শেষে দেখা যাচ্ছে যে, লিঙ্গভেদের ট্রাকটি দ্বিগুণ আহত হয়েছে। প্রশ্নটা প্রজাবিপ্লবে নারীর অংশগ্রহণ নয়, কিংবা শ্রমের ক্ষেত্রে লিঙ্গভেদের প্রকৃত কানুন নয়, বরং এটি উপনিবেশবাদী ইতিহাসতত্ত্ব এবং প্রজাবিপ্লব—উভয়ক্ষেত্রেই লিঙ্গের আদর্শ গঠনটি পুরুষকে প্রাধান্য দিয়েছে। যদি এই হয় যে উপনিবেশের উৎপাদন প্রসঙ্গে সাবঅলটার্নদের কোনো ইতিহাসই নেই এবং তারা কোনো বক্তব্যও রাখতে পারে না, তবে নারী তো সাবঅলটার্ন হিসেবে আরও অনেক অন্ধকার ছায়ার গভীর তলদেশে অবস্থান করছে।