লেখালেখির সময়-অসময়বিষয়ক একটি চমৎকার ও প্রয়োজনীয় নিবন্ধ লিখেছেন ছোটগল্প লেখক ও ঔপন্যাসিক লিয়া লুইস। তার Writing When Time Runs From You শিরোনামের নিবন্ধটি রাইটার্স অ্যান্ড আর্টিস্টস অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে। চিন্তাসূত্রের জন্য নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন তরুণ অনুবাদক মোস্তাফিজ ফরায়েজী।
এক বছর বয়সী আমার বাচ্চাটা পাশে নাক ডেকে চলছে, আমার ঘাড়ে ফিকে ব্যথা, রেইনফরেস্টের প্রবল বর্ষণ চার দেওয়ালের মাঝে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, আর আমি আমার বিছানায় অন্ধকারে বসে আছি। আজকাল এ রকম পরিস্থিতিতেই আমি লিখি। সবসময় নয়, মাঝে মাঝে। আমি যথেষ্ট ভাগ্যবা। নিস্তব্ধ নীরবতার মাঝে আমার নোটগুলো ও কফির সঙ্গে একটা কাঠের তক্তার ওপর বসতে পারি। কিন্তু বেশিরভাগ সময়, আমি এভাবেই লেখালেখি করি। আমার মোবাইলের নোটস অ্যাপে সাধারণত লেখালেখি করে থাকি। সময়ের পরিবর্তনে আমি আমার দুই হাত দিয়ে গাড়ি চালানোর মতো কনভেয়ার বেল্ট ধরেছি, যেটা ব্যতিক্রমী এবং অসুবিধাজনক।
তিন সন্তানের জননী হওয়ার আগে আমি এখনকার মতো এত ব্যস্ত ছিলাম না। আমি আমার ল্যাপটপে নিরবচ্ছিন্নভাবে লিখতাম। তখন নিজেকে সত্যিকারের লেখক মনে হতো। আপনারা তো অনেককেই চেনেন, যারা ওয়ালনাট ডেস্কে বসে, মোজার্ট শোনে, ছোট ছোট মগের ছোট হাতল ধরে কফি খায় আর লেখে, আমিও টুকটাক ওই রকমই ছিলাম। আমাকে শুধু হাতের আঙুল দিয়ে টোকা দিতে হতো, স্ক্রিনের নিচের কোণে শব্দ পরিমাপক সংখ্যা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকত, আর পাশের স্ক্রল বারটি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে থাকত। আমি আমার ডকুমেন্টটি নিজের সামনে ফুলে ফেঁপে উঠতে দেখতাম। একেকটি পৃষ্ঠা লিখতাম আর নিজে উজ্জীবিত হতাম। দীর্ঘ সময় অবিরাম লিখতাম, নির্জন পরিবেশে লিখতাম, যখন নিজেকে প্রস্তুত মনে করতাম, তখনই লিখতাম। কম্পিউটারের সামনে বসে একঘণ্টায়ও যদি কিছু না বের করতে পারতাম, তাহলে মন খারাপ করে ঘুমাতে যেতাম। এমনটি অবশ্য খুব কম ঘটত।
আমার প্রথম সন্তান হওয়ার পর কাজটা কঠিন হয়ে যেতে লাগল, কিন্তু আমি সবকিছু সামলে নিলাম। আমি সব লেখাই শেষ করতাম, যদিও সেটা ছিল ধীর গতিতে। বাচ্চাটা যেদিন রাতে ভালো করে ঘুমাতো অথবা আমার মা বিকালে তাকে ঘুরতে নিয়ে যেত, সেসময় আমি কাঠের তক্তার ওপর বসতাম। অবশ্যই নির্জনতার মাঝে, পাশে থাকত নোটস আর আমার ব্ল্যাক কফি।
তারপর যখন জমজ বাচ্চা দুটি পৃথিবীতে এলো, কঠিন দিনগুলো শুধু বাড়তে থাকলো তা নয়, আমার দিনগুলো হারিয়ে গেল। সময় আর আমার থাকলো না, আমাকে ছেড়ে পালিয়ে গেল। দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম, গোসল, খাওয়া-দাওয়া, আরও নানা কাজের পেছনে তাড়া করে বেড়ানো আমার প্রতিদিনের কাজ হয়ে উঠলো। দুটি বাচ্চাকে কাঁধে নিয়ে সোফায় দীর্ঘ সময় বসে থাকতে হতো, তাদের সরিয়ে দিলেই তারা কেঁদে উঠত। সে সময় কোনো অবসর সময়ই ছিল না আমার। একমুহূর্ত সময়ও ছিল না। তাই আমার মন খারাপ থাকত। আমি যেটা করতে চাই, সেটাই করতে পারছিলাম না। আমি একজন লেখক কিন্তু আমি লিখতে পারছিলাম না। আমি নিদারুণভাবে না লিখতে পারার বেদনা অনুভব করতে লাগলাম।
এরপর একদিন ভোর ৫টায় আমি লিখতে বসলাম, আমার মাথায় একটা গল্পের ধারণা ঘুরঘুর করছিল, কিন্তু আমি পারলাম না। অবসাদে ভেঙে পড়লাম, সেসময় আমার বুকে আমার অসুস্থ ছোট্ট বাচ্চাটি ছিল। গল্পটা আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতে লাগল, আমি অনুভব করলাম, গল্পটি মন থেকে হারিয়ে যাওয়ার আগেই আমাকে তা লিপিবদ্ধ করতে হবে। আমার একটা ফোন ছিল (আগে থেকেই), আমি তাতে নোটস অ্যাপ্লিকেশন ওপেন করলাম। আমি আমার মনের কথাগুলো তাৎক্ষণিকভাবে লিখে ফেললাম কয়েক মিনিটে। তারপর আমি লিখতেই থাকলাম, লিখতেই থাকলাম; আমার বুড়ো আঙুল দ্রুতিগতিতে চলতে লাগল। ৪৫ মিনিটে ১০০০ শব্দের একটি দৃশ্য আমি লিখে ফেলেছিলাম সেদিন। সেগুলো খরখরে টাইপের ছিল। টাইপে অনেক ভুল ছিল, যেখানে ছোটহাতের বর্ণ হবে সেখানে অনেক জায়গায় বড়হাতের বর্ণ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমি লিখেছিলাম। আমি আমার মনের কথা ভাষায় প্রকাশ করার উপায় খুঁজে পেলাম। কয়েক সপ্তাহ পরে আমি খুশি ছিলাম, কেননা আমি সাহিত্যচর্চায় ফিরে এসেছিলাম।
তাই লেখার আদর্শ, নিয়ম-নীতি, কাঠের তক্তা এবং নির্জনতা সবকিছুকে ত্যাগ করলাম। আমি এমনভাবে লিখতে শুরু করলাম, যেভাবে আগে কখনো চেষ্টাই করিনি।
নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করলাম, যেখানে যেভাবে হোক আমি আমার মনের কথাগুলো লিপিবদ্ধ করব। আমি যদি মোবাইলে বার্তা লিখতে পারি, টুইট লিখতে পারি; আমি সাহিত্যচর্চাও করতে পারব। এমনকি লেখাটি যদি অগোছালো হয়ে থাকে, অটোকারেক্ট দিয়ে মেরামত করা লাগে, তাতেও সমস্যা নেই। আমার নিস্তব্ধ কক্ষের প্রিয় ডেস্কের ওপর নাইবা লিখলাম; বিছানার ওপর, টয়লেটে, পার্কের বেঞ্চের ওপর কিংবা গাড়ির ভেতরে বসেই না হয় লিখলাম। এটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই নয়। মনের ভাব তো প্রকাশিত হলো। আমি এটা পরবর্তী সময়ে পরিমার্জন করতাম। পরিমার্জন করতে প্রয়োজন ছিল শুধু একটা শব্দের পরে আরেকটা শব্দ বসানো।
আমি এখন আমার চূড়ান্ত খসড়া করার শেষ মুহূর্তে। এর চার ভাগের তিন ভাগ মোবাইলে লেখার পর আমি নিজেকেই সেটা ইমেইল করেছিলাম। এই তিন ভাগের হয়তো অস্তিত্বই থাকত না যদি আমি আমার যা কিছু আছে তা নিয়ে কাজে না লেগে পড়তাম। লেখার স্থানের কথা বলতে গেলে সর্বত্র। বিছানায় বসে রাত ১টায়, ডাক্তারের চেম্বারের বিশ্রামাগারে, অথবা বিকাল ৩টায় স্কুল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে লিখতে হয়েছে। আমি শতাধিক অদ্ভুত জায়গার কথা বলতে পারি, যেখানে আমি লিখেছি, তারপরেও অনেক জায়গার কথা না বলা থেকে যাবে।
যদি সময় তোমাকে ফেলে পালাতে চাই, মনে রেখো, সাহিত্য সাহিত্যই। এখানকার ওখানকার দশ মিনিটের কাজ; যেটা গল্পের সঙ্গে, দৃশ্যের সঙ্গে, চরিত্রের সঙ্গে, পৃথিবীর সঙ্গে দশ মিনিটে যুক্ত করা যেতে পারে। শব্দ শব্দই। আমরা যেভাবেই এগুলো পাই না কেন, যেভাবেই লেখি না কেন। আমাদের একটা মুগুর নিয়ে শব্দের পেছনে ছুটতে হবে। কাঠের তক্তা এবং কফির মগের কথা অগ্রাহ্য করে মনে রেখো, প্রকৃত লেখক তারাই, যারা নিজের পথ খুঁজে নিতে পারে, শত ঝড়-ঝঞ্ঝা কিংবা ঝামেলার ভেতরেও লিখতে পারে।