অনুবাদ: কাজী মহম্মদ আশরাফ
[মুনির মুমিন—প্রধানত কবি। তিনি সমকালীন বালুচি কবিতার অন্যকম সেরা কবি। গল্প ও গান রচনায়ও তিনি সিদ্ধহস্ত। জন্ম ১৯৬৬ জন্ম পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের পিদরাকে। তিনি বেলুচিস্তান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৬ সালে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। বর্তমানে তিনি বেলুচিস্তানের আত্তা সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যাপক। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: নিগাই ই বাত ই সফর, দরিয়া চমকি হুশাম এন ইত্যাদি। রুমাল গল্পটি বালুচি ভাষা থেকে উর্দুতে অনুবাদ করেছেন ওয়াহিদ বখশ বাজদার।—অনুবাদক]
আমি অনেক চেষ্টা করেছিরাম তার জানাজায় অংশ নেওয়ার। খুব ইচ্ছা ছিল তার লাশ কাঁধে নিয়ে জানাজা থেকে গোরস্তানে যাওয়ার। কিন্তু ভিড় এত বেশি ছিল যে, তার দাফনে কাঁধই দিতে পারিনি। তিনি অনেক বিখ্যাত লোক ছিলেন। লোকজনের মনে, চিন্তায় এবং আলাপ-আলোচনায় বিশেষ স্থান দখল করেছিলেন। আজ তার লাশের জানাজা পড়া, তাকে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত লোকজন তার সততা, ন্যায়নিষ্ঠা ও তার স্বপ্নগুলোর কথা স্মরণ করে আলাপ করছিল। কিন্তু আমার মনে পড়েছে তার সঙ্গে আমার কোনো স্মৃতি নেই। কিছু ঘটেছে বলেও মনে পড়ছে না। তোমরা জানো না, এই লোক বেঈমানদের এক খোলা পুস্তক ছিলেন। তোমরা হয়তো এমন কিছুই জানতে না। যার বেঈমানি ছাড়া আর কোনো অস্তিত্ব নেই। কিন্তু আমি তোমাদের সামনে আছি। কারণ এই লোক সততার সঙ্গে নিজের কিছু গল্পের মধ্যে আমার নামও লেখেননি।
লোকজন বলাবলি করে, এই লোক বড় একজন গল্পকার ছিলেন। রচনাশৈলীতে নিজস্বতা দেখাতে দক্ষ ছিলেন। এসবই তাকে অমর করে রাখবে। চির নতুন করে রাখবে। কিন্তু তার মধ্যে কোনো দোষ-ত্রুটি ছিল না। কারণ আপনাদের কাছে আমার কোনো পরিচিতি লাভ করতে পারিনি। আমি আমার সব গল্পে তাকে রেখেছি। সর্বত্র তাকে সসম্মানে প্রতিনিধি করে রেখেছি।
হোটেলে এক দফা চা খাওয়ার পরে আমি তাকে দেখি। দেখেই তাকে চিনে ফেলেছি কিন্তু তিনি আমাকে চিনতে পারেননি। তিনি একা ছিলেন। আমি চেয়েছিলাম তার একাকিত্ব এবং একাগ্রতায় কোনো আঘাত করব না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম তার একাগ্রতা বড় বাধা পড়ছে এবং নিঃসঙ্গতার মনোরাজ্যে আঘাত লাগছে। চায়ের কাপ কাত হয়ে পড়ে তার পোশাকের কিছু অংশ ভিজে গেছে। আমি পকেট থেকে রুমাল বের করে তাকে মুছে দিলাম। রুমালটা তিনি নিজের হাতে নিয়ে সবকিছু ভালোভাবে মুছলেন। এরপরে নিজের পকেটে রুমালটা ভরে রাখলেন। তাকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, জনাব, আপনি কি আমাকে চেনেন?
তিনি বললেন, না।
আমি তাকে জানালাম যে, আমি তার লেখার একজন ভক্ত। আমার নাম গুল মোহাম্মদ।
কিছুক্ষণ চিন্তা করে তিনি বললেন, মনে হয় এখন পর্যন্ত তোমার লেখা কোনো চিঠি পড়ি নাই।
আমি তাকে কিছু প্রমাণের কথা উল্লেখ করে উত্তর দিলাম। তিনি বললেন, এবার ঠিক আছে।
আমি জয়নাবের কাছে লেখার কথা ভাবছিলাম।
কিছুক্ষণ পরে তিনি বললেন, জয়নাবকে আমি ভালোভাবেই চিনি। বলেই তিনি মুচকি হাসলেন।
আমি আমার গল্প খোঁজ করছিলাম। তিনি যেন আহতবোধ করছিলেন। আমি তাকে গল্প থেকে ফিরিয়ে আনলাম। যেন তিনি বেদনায় মারা যাচ্ছিলেন। মুখের হাসি যেন স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে।
আমি অনুরোধ করে বললাম, তুমি তো এক জয়নাবের গল্প অনেক আগে লিখেছিলে। সে জয়নাব—তৃষ্ণায় যার পা নদীর দিকে ঝুঁকেছে।
—না, সেটা অন্য কেউ ছিল। তার অশ্রু আমার মানসিক প্রশান্তি কেড়ে নিয়েছিল। সে গল্প আমি আমার ইচ্ছাতে লিখিনি। বরং বলা যায় ভয় থেকে লিখেছিলাম।
কথাবার্তার মাঝে আমি তাকে মনে করিয়ে দিলাম, আমার রুমালটা তার পকেটে রয়ে গেছে। গল্পকার উত্তরে বললেন, তোমার রুমাল আমার পকেটে রেখেছি এ কারণে যে, আমি যেন তোমাকে চিঠি লিখতে না ভুলি।
গল্পকারের সঙ্গে দ্বিতীয়বার দেখা হয়েছিল ঠিক পাঁচ বছর পরে। এর মধ্যে তিনি অনেক গল্প লিখেছেন। তাকে ঘিরে অনেক গল্প সৃষ্টিও হয়েছে। তিনি কথা বলেছিলেন। অনেক কথা। কারণ অন্যজন শোনার জন্য উদগ্রীব ছিল। আমিও তাঁর কাছে গিয়ে বসেছিলাম। এরমধ্যে একজন লোক পরিচিত হতে এসে লেখককে বলে, হুজুর, আপনার লেখাগুলোর উৎস কোথায়? নাকি কেউ কেউ দেয়?
উত্তরে তিনি বললেন, আমি সেখান থেকেই পাই, যেখানে গল্প শেষ হয়।
পরে হঠাৎ তার দৃষ্টি আমার ওপর পড়ে। কিছুক্ষণ বিরতির পরে তিনি আবার কথা বলা শুরু করেন, আমার গল্প রচনার কৌশল আমার মধ্যেই লুকানো থাকে। আসলে কৌশল অবলম্বন করে আমি গল্প রচনা করি না। আমি জানি না, কোথা তেকে আমি গল্পের উৎস পাই। মানুষের অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। তারা শুধু পুস্তকে ছাপা গল্পই পড়ে। বাতাসের শিয়রে কত সমাধি রয়েছে, যেকানে আমি জীবন্ত কৌশল লুকিয়ে রেখেছি। জামার প্রান্তে, রুমালের কিনারে কত গল্প বুনন করা থাকে। বাতাসে, পানিতে কত গল্প পড়ে আছে। এমনকি বাতাস এবং পানির নকশাও চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো গল্প বলে। কিন্তু মানুষেরা এসবের খোঁজ-খবর রাখে না।
উপস্থিত লোকদের মধ্যেকার এক তরুণের দিকে তিনি হাত ইশারা করলেন। তারপরে বললেন, যে মোরগ কঁক কঁক করে উড়াল দিয়ে বেড়ায় সে তোমার কাছে একটা অতি সামান্য প্রাণী, সেও আমার কাছে গল্পের উৎস। সেও একটি স্বপ্ন, আমার কাছে একটি স্বপ্নের মতো। যে স্বপ্নের জন্য তোমার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে। তোমার গল্পটি শোনানোর জন্য আমার কাছে এসে সারারাত কাটিয়ে দিয়েছ। আমি আমার তেলের প্রদীপের সলতে সারারাতে উঁচু করে দিয়েছি বার বার। একজন লেখকের সৃষ্টিশীল মন কিসে স্বাধীন হয়ে ওঠে আর কিসে প্রশান্তি লাভ করে, কে তা বলতে পারে?
কিছুক্ষণ পরে আলাপচারিতা যেন বাসি হয়ে ওঠে। এমন নীরস সময়ে তিনি পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছলেন।
সেদিন থেকে আমারও ব্যক্তিসত্তা আর লেখকসত্তা ভিন্ন হয়ে গেছে। তবে আজ যখন তার মৃত্যুসংবাদ পেলাম, তখন কবরস্থানের দিকে যাওয়া শুরু করলাম। অসংখ্য লোকের উপস্থিতি দেখলাম। উচ্চপদস্থ অফিসার থেকে শুরু করে দীনহীন অতি সাধারণ মানুষ পর্যন্ত। লোকজনের কথাবার্তা আর চোখের পানি মোছার মধ্য দিয়ে তাকে সমাহিত করা হলো।
দাফনের পরে সব লোক যার যার গন্তব্যে চলে গেল। মুধু লেখকের ছেলে কবরের মাথার দিকে বসে রয়েছে। আমি মাত্র চার কদম দূরে দাঁড়িয়ে আছি। মৃত লেখকের ছেলে পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখের পানি মুছছে। রুমাল দেখে কৌতূহলে এর মধ্যে আমি আরেকটু কাছে চলে এসেছি। হঠাৎ দেখি রুমালটার এক কোনায় জয়নাবের নামটি ঘন কালো সুতায় লেখা রয়েছে। আমি পিছিয়ে এলাম। এর চেয়ে বড় অকৃতজ্ঞতা, কপটতা, কৃপণতা আর কী হতে পারে?