গত শতকের ৪৫/৪৬ সালের দিকে আরব ভূখণ্ডে আধুনিক কবিতার উত্থান ঘটে। বাংলা সাহিত্যের মতোই এই আধুনিকতার মৌল লক্ষণ প্রথম প্রকাশ পায় কবিতার ফর্মে। হাজার বছরের নিরূপিত ছন্দের ধাঁচ ভেঙে দিয়ে, এ সময়ে আরবের কবিরা ফ্রি ভার্স বা মুক্তছন্দে লিখতে আরম্ভ করেন। ইলিয়াস আবু শাবাকাহ (১৯০৩-১৯৪৭), নাযিক আল মালাইকা(১৯২৩-২০০৭), বদর শাকির আল শায়াব (১৯২৬-১৯৬৪), আব্দুল ওয়াহাব আল বায়াতি (১৯২৬-১৯৯৯), নিযার কাব্বানি (১৯২৩-১৯৯৮)সহ যেসব কবি এই ফ্রি ভার্স মুভমেন্টে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, তাদের মধ্যে বুলান্দ আল হায়দারি (১৯২৬-১৯৯৬) অন্যতম।
বুলান্দ আল হায়দারি ১৯২৬ সালের ২৬ শে সেপ্টেম্বর উত্তর ইরাকের এক সম্ভ্রান্ত কুর্দি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১০ বছর বয়সে সপরিবারে বাগদাদে যান। বাগদাদের পথে পথে কেটেছে তার শৈশব। হায়দারি যখন ছোট, ইরাকে তখন চলছে ব্রিটেন-সমর্থিত ও প্রভাবিত হাশিমি রাজবংশের শাসন। হাশেমি রাজতন্ত্রে কুর্দিদের জন্য পার্লামেন্টে ২টি সিট বরাদ্দ ছিল। হায়দারির চাচা ছিলেন হাশিমি মন্ত্রিসভার আইনমন্ত্রী। ফলে রাজনৈতিক সচেতনতার বীজ তাঁর মধ্যে প্রোথিত হয়েছিল শৈশবেই।
যৌবনে বুলান্দ আল হায়দারি, তাঁর সমসাময়িক দেশি-বিদেশি অনেক তরুণ কবি-সাহিত্যিকের মতোই কম্যুনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯৪০-৫০ সালে যখন বুলান্দ তরুণ কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন, তখন ইরাকে বুদ্ধিজীবী বলতে বামপন্থীদেরই বোঝাতো। বিশ্বব্যাপী ঔপনিবেশিক আগ্রাসন ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে, নৃতাত্ত্বিক বা ধর্মকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের চে সেক্যুলার ও বামধারার প্রগতিশীল চিন্তা, অন্য অনেক দেশের কবি-লেখকদের মতোই, আরব লেখকদেরও বেশি আকর্ষণ করেছিল। আর তাই, ১৯৫৮ সালে ইরাকে রাজতন্ত্রের অবসানের পর যখন সাদ্দামের বাথ পার্টি ক্ষমতায় আসে, তখন, এই নব্য জাতীয়তাবাদী একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধেও হায়দারি ছিলেন সোচ্চার। এর ফলে, ইরাকের প্রশাসন তাকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়। কিন্তু, কী এক অদৃশ্য ইশারায়, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার মাত্র পাঁচ মিনিট আগে তাকে প্রাণভিক্ষা দেওয়া হয়। এরপরে তিনি লেবানন চলে যান।
শুরু হয় হায়দারির প্রবাসজীবন। এর পরবর্তী ঘটনাক্রমে আমরা দেখব যে, এই প্রবাস থেকে তিনি আর কখনোই ফিরতে পারেননি স্বদেশের মাটিতে। লেবাননযাত্রার আগে–১৯৫৩ সালে তিনি দালাল আল মুফতিকে বিয়ে করেন। পরবর্তী সময়ে তাদের সংসারে জন্ম নেয় একটি পুত্র সন্তান। লেবাননে তাঁর নির্বাসিত জীবন মোটামুটি ১৩ বছরের (১৯৬৩-১৯৭৬)। এ সময় তিনি সাংবাদিকতা, বুকশপের ম্যানেজমেন্ট, শিক্ষকতা ইত্যাদি পেশায় নিয়োজিত থেকে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। লেবাননের নির্বাসিত জীবনে তাঁর সম্পাদনায় ‘আল-উলুম’ নামে একটি সাময়িকীও বের হতো।
১৯৭৬ সালে তিনি আবার ইরাকে ফিরে আসেন। কিন্তু বেশিদিন থাকতে পারেননি। ১৯৮০ সালের শুরুর দিকে তিনি আবারও লন্ডন চলে যান। এরপর থেকে আমৃত্যু তিনি লন্ডনেই ছিলেন। এসময় তিনি ‘ফুনুন আল আরাবিয়া’ নামক একটি শিল্পবিষয়ক ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিলেন। পাশাপাশি ‘আল মাজাল্লাহ’ পত্রিকায় নিয়মিত সাপ্তাহিক কলামও লিখতেন। ১৯৯৬ সালের ৬ আগস্ট মঙ্গলবার, ৭০ বছর বয়সে তিনি লন্ডনের ব্রোম্পটন হসপিটালে মারা যান।
বুলান্দ আল হায়দারি প্রথম জীবনে কুর্দিশ ভাষায় লিখতেন। এরপরে আরবিতে লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম কাব্য ‘খাফাকাতুত ত্বিন’ (The Throb of Clay, মৃত্তিকাস্পন্দন) প্রকাশিত হয় ১৯৪৬ সালে। আরব ভূখণ্ডের কবিতায় তখন চলছে আধুনিকতার কাল। আধুনিকতার শুরু বরং বলা যায়, কারণ, মন্ট্রিলের ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির ইংলিশের সাবেক প্রফেসর জন মিখাইল উসফুর (১৯৪৫-২০১৪, লেবানিজ-কানাডিয়ান কবি ও সমালোচক), ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘An Anthology of Modern Arabic Poetry With A Critical Introduction’-এ ১৯৪৫ সাল থেকেই আধুনিক আরবি কবিতার সূচনা বলে উল্লেখ করেছেন। বুলান্দ আল হায়দারির প্রথম কাব্য প্রকাশিত হয় ১৯৪৬ সালে, ফলে আধুনিক আরবি কবিতার একজন অগ্রপথিকই তাকে বলা চলে। হায়দারি তার সাহিত্যিক জীবন শুরু করেন ‘The Lost Groupe’ নামে একটি শিল্পসংঘ গঠনের মাধ্যমে, যারা মূলত মার্ক্সবাদ, অস্তিত্ববাদ ও পশ্চিমের নতুন নতুন সাহিত্য আন্দোলনের সমন্বয়ে তৈরি এক আধুনিকবাদী চেতনার প্রতিনিধিত্ব করতেন। হায়দারি তাঁর কবিজীবনের সূচনালগ্নেই প্রভাবিত হয়েছিলেন লেবানিজ কবি ইলিয়াস আবু শাবাকাহ (১৯০৩-১৯৪৭) এবং শেষ-চল্লিশের কবিদের দ্বারা।, যারা মূলত রোমান্টিকদের মধ্যে ছিলেন কিছুটা প্রাগ্রসর চিন্তার এবং আধুনিক আরবি কবিতার ভিত্তিপ্রস্তরের স্থাপক, যেমন বাংলা কবিতায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ইলিয়াস আবু শাবাকাহ কবিতায় প্রচলিত প্রথাগত যে, এলিটিজম ও স্টাব্লিশমেন্ট তাঁকে ভেঙে দিয়ে কবিতাকে জনতার কাতারে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন। ফলে আরবি কবিতায় আধুনিকতা ছিল গণমুখী, বাংলা কবিতার মতো সমাজবিমুখ নয়।
হায়দারির প্রথম কাব্যগ্রন্থ সমালোচক মহলে চমক সৃষ্টি করে। সমালোচকরা একে ‘আধার ও আধেয়—উভয় দিক থেকেই একেবারে আলাদা ধরনের’ বলে গণ্য করেছেন। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় ‘আগানিল মাদিনাতিল মাইতাহ’ (মৃত শহরের গান, ১৯৫১), ‘জি’তুম মায়াল ফাজর’ (তোমরা ভোর নিয়ে এলে, ১৯৬১), ‘খুতুওয়াত ফিল গুরবাহ’ (প্রবাসের পদচিহ্নাবলি, ১৯৬৫), ‘রিহলাতুল হুরুফুস সুফর’ (হরিদ্র বর্ণের অভিযাত্রা, ১৯৬৮), ‘আগানিল ফারিসিল মুতয়াব’ (রণক্লান্ত যোদ্ধার গান, ১৯৭১)। শেষ কাব্য passages to exile (দূর পরবাসে) প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর বছর, ১৯৯৬ সালে। মৃত্যুর চার বছর আগে, ১৯৯২ সালে, তখন পর্যন্ত প্রকাশিত তাঁর মোট ৯টি কবিতার বই নিয়ে কুয়েতের সুয়াদ আল সাবাহ প্রকাশনী থেকে ২ খণ্ডে কবিতাসমগ্র প্রকাশিত হয়।
বুলান্দ আল হায়দারি আধুনিক আরবি কবিতার ইতিহাসে এক চিরস্মরণীয় নাম। ‘ফ্রি ভার্স মুভমেন্ট’ ও আরবি কবিতার আধুনিকীকরণে তার অবদান অনস্বীকার্য। অন্য অনেক আরব কবির মতোই তাঁর জীবন মূলত রাজনীতি ও কবিতার এক যুগলযাপনের ইতিহাস। তিনি ইরাকের সাদ্দামবিরোধী ‘ইরাকি গণতান্ত্রিক জোট’-এর ভাইস প্রেসিডেন্টও নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু রাজনীতি তার জন্মগত স্বভাব ছিল না বরং জীবনের বাস্তবতা তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল রাজনীতির সামনে। একজন মার্ক্সবাদী হওয়া সত্ত্বেও তিনি কবিতাকে কখনোই স্লোগান করে তোলেননি, বরং আর্টকে আর্টের জায়গা থেকেই বিচার করেছেন, যা বাংলার অনেক কম্যুনিস্ট কবিই করতে পারেননি।
তাঁর কবিতার মূলসুর ছিল বামপন্থী মানবতাবাদ, যা তুরস্কের নাজিম হিকমাত, চিলির পাবলো নেরুদা, ফ্রান্সের লুই আরাগঁ ও পল এলুয়ার এবং স্পেনের ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার সঙ্গে তুলনীয়। সঙ্গে-সঙ্গে, ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহও ছিল তাঁর কবিতার একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। তার কবিতায় চিত্রায়িত জীবন মূলত তৃতীয় বিশ্বের মানুষেরই জীবন। তাঁর কবিতা একইসঙ্গে অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী, গীতল ও রুক্ষ, শীতল ও রুদ্র। অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর জীবনের প্রতি করুণ আর্তনাদ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে তার কবিতায়। ব্যক্তিক অন্তর্গত অভিজ্ঞতা ও সামাজিক উদ্বেগ-এই দুই প্রবণতাই মূলত তার কবিতার প্রাণ। ফিলিস্তিনি লেখক ও সমালোচক ঈসা জে বুল্লাতা (১৯২৯-) বুলান্দের কবিতার ব্যাপারে বলেন-‘তার কবিতা মূলত আরব কবিদের সের পৌনঃপুনিক উদ্বেগ, যা প্রায়শই পৃথিবীতে মানুশের অবস্থা, গন্তব্য এবং আরবভূমির প্রতি আন্তরিক স্বগোতোক্তি ও অন্তর্নিবিষ্ট অনুধাবন রূপে প্রকাশিত হয়েছে।’ মন্ট্রিলের ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির সাবেক ইংরেজির প্রফেসর জন মিখাইল উসফুর তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘An Anthology of Modern Arabic Poetry’-তে বুলান্দের কবিতার ব্যাপারে বলেন—’হায়দারির কবিতা জীবন্ত সব রূপকের এক ঝর্ণা, বলা যায়, একেবারে সচিত্র। তিনি আরবি কবিতায় প্রচলিত আড়ম্বরপূর্ণ কাব্যিক ভাষাকে এড়িয়ে গিয়েছেন এবং সরল ভাষায় অকপট ভঙ্গিতে ভাবপ্রকাশের মাধ্যমে সফলভাবে কাব্যরস সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছেন। ফ্রি ভার্স মুভমেন্ট এর একজন পথপ্রদর্শক, আল হায়দারি, অন্তর্গত স্বগতোক্তি ও মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বকে অভিনব সৃজনশীল কবিতা কাঠামোয় অনন্য দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপন করতে পেরেছেন।’ বুলান্দ আল হায়দারির কবিতা আধুনিক আরবি কবিতার প্রধান সংকলনগুলোতে এবং কবিতা বিষয়ক গবেষণাপত্রগুলোতে গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে। তাঁর কবিতা ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, রুশ, কুর্দিশ, চাইনিজ, তুর্কিশসহ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
বুলান্দ আল হায়দারি আজীবন মানুশ ও মানবতার স্বপ্ন দেখেছেন। তাঁর সেই স্বপ্নভঙ্গও হয়েছে দ্রুত, জীবদ্দশায়ই কম্যুনিজমের দাফন হয়েছে, বেরিয়ে এসেছে পশ্চিমা আধুনিকতার করাল রূপ। প্রবাসের একাকী বিষণ্ন দিনগুলোতে এসব কথা নিভৃতে বসে তিনি ভাবতেন কি না, আমরা তা জানি না। হয়ত ভাবতেন, হয়ত ভাবতে চাইতেনই না। হয়ত এই জীবনের সবকিছুকে ব্যর্থ ধরেই চাইতেন, আবার যদি নতুন করে শুরু হতো সব! আর তাই, তার শেষ কাব্য ‘দূর পরবাসে’ (১৯৯৬)-এর শেষে ঝরে পড়ে তার স্বপ্ন হয়ে পুনর্জন্মের আকুতি-‘ইশ! কী সুন্দর হতো, স্বপ্ন হয়ে ফের জন্ম নিলে,/ সেই স্বপ্ন, যা আমাদের ভুলে যেতে সাহায্য করবে/ তীর ও ধনুকের ছিলার মাঝে অপেক্ষারত যাবতীয় অপমানবোধ!’
বার্ধক্য
০১.
আরেকটি শীত এসে যাবে
আর আমি, এখানে
এই চুলোর পাশে বসে
ভাবব এক নারীর কথা।
যে হয়তো আমার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে
তার স্তনের নিভৃতে আমি লুকিয়ে রাখছি
একটি রহস্য,
যাকে সে কখনো ঘৃণা করবে না!
ভাবব আমার ম্লান দিনগুলোতে
হয়ত আমি আলোর গতিতে হেঁটে চলেছি সামনের দিকে,
আর পেছন থেকে সে বলছে:
এই আলো আমার,
অন্য কোনো নারী এই আলোর কাছে না আসুক!
০২.
এখানে
এই চুলোর পাশে
আরেকটি শীতকাল আসবে!
আর আমি, এখানে বসে
ঘুরে-ফিরে সেই একই স্বপ্ন দেখতে থাকব
এবং তাদের ভয় পাব;
সেই নারীর ভীত চোখ
আমার টাকপড়া কুচ্ছিত মাথা
আর বুড়ো ধূসর আত্মার দিকে
ঘৃণা ভরে তাকাবে,
তার ভীত পা
আমার ভালোবাসায় লাথি মেরে চলে যাবে
আর এখানে, এই চুলোর পাশে
আমি ধীরে ধীরে এক নারীর
উপহাসের পাত্র হয়ে উঠব!
০৩.
একাকী পড়ে থাকব
প্রেম স্বপ্ন কিংবা নারীবিহীন
আর তারপর একদিন
হৃদয়ের তাপমাত্রাহীনতায় হয়ত আমার মৃত্যু হবে
এখানে, এই চুলোর পাশে!
ডাকপিওন
আমার কাছে কী চাও, ডাকপিওন?
আমি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন, বহুদূরে।
নির্ঘাত তুমি পথ হারিয়েছ,
এই নির্বাসনে পৃথিবীর তো নতুন কিছু নিয়ে আসার কথা নয়!
পৃথিবী তেমনই রয়ে গেছে যেমন আগে ছিল!
সে স্বপ্ন দেখে, দেখায়
সেই স্বপ্নকে খুন করে মাটিচাপা দেয়
এবং ফের পুনর্জন্মের অপেক্ষা করে!
মানুষ এখনো আহ্লাদিত হয়ে উৎসবে মেতে থাকে
আর দুঃখ শোক আর্তনাদ
তাদের আরেকটি উৎসবের কথা মনে করিয়ে দেয়!
তাদের চোখ বোধের গোরস্থান খুঁড়ে চলে
নতুন কোন সুখের খোঁজে,
নতুন কোন প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার খায়েশে!
চীনের প্রাচীর এখনো তেমনি দাঁড়িয়ে
মুছে যাওয়া রূপকথারা সময়ের সাথে
আবার ফিরে ফিরে আসছে,
পৃথিবীতে এখনো রয়ে গেছে সেই সিসিফাস
আর একটি পাথর, যে তার গন্তব্য জানে না।
ডাকপিওন
নির্ঘাত তুমি ভুল পথে এসেছ
আমাকে খবর দেওয়ার মতো নতুন তো কিছু নেই!
যে পথে এসেছিলে
যে পথে প্রায়ই আসো
সে পথেই ফিরে যাও,
আমার কাছে তুমি কী চাও?
ভুল পদক্ষেপ
শীতের তীক্ষ্ণতায় টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে প্লাটফর্ম
বেড়ালের মতো মিউমিউ শব্দে বইছে ঝোড়ো হাওয়া
রেললাইনের ওপরে, দুলছে এক প্রাচীন প্রদীপ
আর আমাদের ছোট্ট গ্রামটা
সেই অগ্নিশিখার আলোয় দুলে দুলে উঠছে!
‘এই শহরে বসে আমি কী করব?’
সে আমাকে প্রশ্ন করে—
‘এই শহরে থেকে তুমি কী করবে?’
কিন্তু, ফিরেই বা যাব কেন? কার জন্য?
গ্রামের জন্য?
ধারালো শীতে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া প্লাটফর্মের জন্য?
আমার ছোট্ট গ্রামটা যে দীপশিখার তোড়ে, দুলতে থাকে অবিরাম
সেই আলোটুকুর জন্যে?
নাকি লজ্জা-অপমানে আত্মহত্যা করা নারীদের জন্য?
না, আমি আর ফিরে যাব না। কেন ফিরে যাব? কার জন্য?
আমার গ্রাম তো শহর হওয়ারই পথে!
প্রত্যেক প্রান্ত থেকেই, একেকটি নতুন প্রদীপের কর্কশ আলো
চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে আমাকে বলে—
‘আসলে তুমি কী চাও?’
-তাইতো, আমি কী চাই!
এখানকার কোনোকিছুই আমার মনে পড়ে না
আর আমার কথাও তো মনে নাই কারো!
সুবিশাল রাজপথে
ধীরস্থির পদক্ষেপগুলোকে টেনে নিয়ে চলি
আবার কখনো হারিয়ে যাই কানাগলির অন্ধকারে!
না, আমি কখনোই ফিরব না। কার জন্য ফিরব?
আমার গ্রাম তো শহর হয়ে গেছে!
দূর পরবাসে
এই সুমিত আবহাওয়ার দেশগুলোতেও
আমরা ক্রমশ অস্পষ্ট হতে থাকি!
মুক্ত অনাবিল বাতাসের বিপরীতে
আমি মাতালের মতো হেঁটে যাই,
অবিরাম দ্বিধার দুলুনিতে দুলতে দুলতে ক্রমাগত ঘুরতে থাকি
গতিবিধির প্রতারণাময় জীবিত ভ্রম হওয়া
তীক্ষ্ণধার ছায়াদের চারপাশে!
নিখাদ নিরাভরণ সত্য আমাদের আতঙ্কিত করে।
শেষ কবে প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে
ঠাট্টা-বিদ্রূপ ছাড়া অন্য সুরে কথা বলেছি—মনে পড়ে না।
ভালোবাসার কথা বলতে হয় সর্বোচ্চ সতর্ক হয়ে
কারণ,
এখানে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় আমাদের গতিবিধি নিয়ত নীরিক্ষণ করছে
অবশ পায়ের দেবদূতগণ!
এখানে আমাদের বাচ্চারা চক-শ্লেটে
‘জল্লাদ জল্লাদ’ খেলে চলেছে!
শোন, কবিরা এই পৃথিবীতে ঘৃণিত, কারণ
গোলাপ না থাকলে টবের শূন্যতাই হয়ে ওঠে তাদের হাতিয়ার
আর তারা আমাদের মুহুর্মুহু মনে করিয়ে দেয়
আমরা আমাদের স্বপ্ন থেকে নির্বাসিত!