অনুবাদ: মোস্তাফিজ ফরায়েজী
বেশিরভাগ মানুষ মনে করে বিড়াল একটা আঁতেল প্রাণী। তাদের বুদ্ধি-শুদ্ধি কিছু নেই। তারা শুধু পারে শুয়ে শুয়ে আরাম-আয়েশ করতে। ইঁদুর আর দুধ দেখলেই তারা শুধু সজাগ হয়। কিন্তু একটা কথা জেনে অবাক হবে, বিড়াল খুব গুণী প্রাণী। এমনকি তাদের গুণের সংখ্যা নাকি মানুষের চেয়েও বেশি। এমনও শোনা যায়, পুরো প্রাণীজগতের মধ্যে বিড়ালই সবচেয়ে বিচিত্র ও গুণী প্রাণী।
একটি বিড়াল একইসঙ্গে একজন ক্রীড়াবিদ, একজন গায়ক, একজন ব্যায়ামবিদ, একজন প্রেমিক ও একজন দুর্দান্ত যোদ্ধা। তোমার কাছে মনে হতে পারে, একটা বিড়াল সারাটা দিন অলসতায় কাটিয়ে দেয়, আগুনের পাশে শুয়ে শুয়ে বিশ্রাম নেওয়া ছাড়া এদের কাজই নেই। বাড়ির মেয়ে মানুষ কিংবা বাচ্চারা তাকে জ্বালাতন করলেও সে কিছু বলে না। সময় কাটানোর জন্য মাঝে মাঝে হয়তো একটা ইঁদুরের গর্তের দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকে। তবে এটাও কাজের কাজ নয়। বিড়ালেরা এটা মূলত করে একঘেয়েমি থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য। আমরা তো এসব দেখে মনে করে বসি, একটা বিড়ালের সারাটা জীবন এভাবেই পার হয়ে যায়। কিন্তু ধারণাটা একদম ভুল। বিড়ালের আসল রূপ দেখতে হলে, সন্ধ্যার আলো যখন ঘনিয়ে আসে তখন তার দিকে খেয়াল করো। সে কী কী করে লক্ষ রাখো, তাহলেই বুঝবে বিড়াল আসলে কতটা সংগ্রামী প্রাণী।
একটা পরিবার যখন চা খেতে বসে, বিড়ালটিকে তোমরা ঘুর ঘুর করতে দেখবে, আসলে তার নিজের ভাগ নেওয়ার জন্যই বিড়ালটি এমন করে। শুধু কি ঘুর ঘুর! গর গর করে শব্দও করতে থাকে। পরিবারের সদস্যদের পায়ের সঙ্গে ঘষে গর গর শব্দ করতে করতে সে যেন বলে ওঠে—প্লিজ, আমাকে একটু খাবারের ভাগ দাও। এসব করার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একটু দুষ্টামিও করতে চায় বিড়ালটি। সঙ্গে একটু আদর পেলে তো কথাই নেই। তার ওপর খাবার টেবিলে যদি একজন অতিথি থাকে, তাহলে ঘটাবে আরেক কাণ্ড! বিড়ালটি খুব ভদ্রভাবে তার কাছে খাবারের ভাগ চাইবে। কিছু কিছু অতিথি বিড়ালের খাবারের প্রতি আগ্রহ বুঝতে পারে না। অতিথিটি হয়তো তখন বিরক্ত হয়ে আস্তে করে বিড়ালটিকে এক ঘা বসিয়ে দেয়। তারপর বলে, পাজি ম্যাও কোথাকার! পাজি বিড়াল! সর!
বিড়ালটিও দ্রুত বিরক্ত হয়। সে তার থাবার নখ দিয়ে আস্তে আস্তে অতিথির পা আঁকড়ে ধরে। মই বেয়ে ওপরে ওঠার মতো করে ওপরের দিকে উঠতে থাকে।
বিড়ালের এমন কাণ্ডে অতিথিটি আঁতকে উঠে পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশে বলে উঠবে, আউচ! এই দেখো, তোমাদের পাজি বিড়াল থাবা দিয়ে আমার পা ধরে রেখেছে।
এ কথা শুনে পরিবারের সদস্যরা মজা পাবে, একগাল হেসে পরিবারের কেউ একজন বলে বসবে, বিড়ালটা কত মিষ্টি দেখো! কত বুদ্ধিমান! সে তোমার কাছ থেকে কিছু খেতে চাচ্ছে। এটুকু বুঝছো না?
অথিতিটির তখন মন চাইবে বিড়ালটিকে লাথি মেরে জানালার বাইরে পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু সে সাহস তার হবে না, হাজার হলেও অতিথি। তাই চোখে মুখে দুঃখ-কষ্ট নিয়েই সে বিড়ালটির সুনাম করা শুরু করবে। এমনকি নিজের প্লেটের মাছের একটা অংশ নিচে নামিয়ে বিড়ালকে দেবে। বিড়ালটি ক্ষীপ্র গতিতে সেটা লুফে নেবে। তবে অতিথির দিকে এমনভাবে তাকাবে যেন সে বলছে, হে আমার বন্ধু, অন্য কোনো সময় তুমি আর আমার নাগাল পাবে না, আমাকে মারতেও পারবে না।
কিছু সময় বিড়ালটি একা একাই রাগে গরগর করতে থাকবে। মাছটি খাবার আগে অতিথির বুট জুতোর কাছ থেকে দূরে সরে যাবে। একটা কথা স্পষ্টভাবে মনে রেখো, বিড়াল কোনোভাবেই বোকা প্রাণী নয়।
পরিবারটি যখন চা খাওয়া শেষ করে খাবার হজম করার জন্য আগুনের পাশে বসে বিশ্রাম করবে, বিড়ালটি সেসময় উধাও হয়ে যাবে। মূলত তখন থেকেই বিড়ালটির প্রকৃত জীবন শুরু হবে।
বিড়ালটি তার অলস জীবন পরিত্যাগ করে গতিময় জীবন শুরু করে। খুব সহজে বাড়ির সীমানার বেড়া টপকায়। ঘরের ছাদের ওপর দুলকি চালে দ্রুতগতিতে চলতে থাকে। ছাদের ওপর কোনো ভাঙা জায়গা থাকলে এক লাফে পার হয়ে যায়। এককথায়, ক্ষীপ্রতার সঙ্গে চলতে থাকে সে। অনেকটা চিতাবাঘের মতো। তাকে একইসঙ্গে দ্রুত গতিতে ও সতর্কতার সঙ্গে চলতে হয়। তার শত্রুর অভাব নেই। এজন্য তাকে নিঃশব্দে চলতে হয়। খিটখিটে কুকুরেরা, চাবুক হাতে গাড়োয়ানরা এবং পাথর হাতে ছোট বাচ্চারা তাকে আক্রমণ করার জন্য সব সময় মুখিয়ে থাকে।
ছাদের ওপর উঠে বিড়ালটি তার পিঠ ধনুকের মতো বাঁকা করে। নখ দিয়ে পুরনো ছাদের নরম দেয়াল বেয়ে এক-দুই বার ওঠার চেষ্টা করে। ব্যায়ামবিদের মতো একটা চক্কর দেয়। নিজেকে প্রসারিত করে কসরত করে, তার মাথাটা থাবার কাছে নিয়ে আসে। মাংসপেশীগুলো ঠিকঠাক মতো কাজ করছে কি না, এটা জানার জন্যই বিড়ালটি এসব করে থাকে। এরপর হয়তো ভাব জমানোর জন্য কিংবা কুস্তির খেলার জন্য বিড়ালটি তার স্বজাতিদের তার বাড়ির পেছনে আমন্ত্রণ জানায়।
কচ্ছপের খোলার মতো, বাদামি ডোরাকাটা দাগওয়ালা এবং কালো রঙের কালটুস বিড়ালেরাও সেখানে আসে। সব পোষা বিড়ালই আসে। তবে সবাই আসে পরিবর্তিত রূপে, তাদের প্রকৃত রূপে। তারা এক ঘণ্টা আগের মতো নম্র-ভদ্র প্রাণী থাকে না। তারা মাছ ও দুধের ভিক্ষুকও থাকে না। তারা বরং বিক্ষুব্ধ প্রাণীতে পরিণত বয়। তারা তো তাদের অস্ত্রের ফলায় ধার দিয়ে নিজেদের মর্যাদা প্রদর্শন করতে এসেছে, কুস্তি করতে এসেছে। তাদের কুস্তিগুলো ভয়ানক প্রকৃতির হয়। এটার পেছনে কারণও আছে, একটা বিড়াল তার দেহে একবিন্দু শক্তি থাকতে কখনো আত্মসমর্পণ করে না।
ভেবে অবাক হবে, একটা তরুণী বিড়াল একজন পূর্ণবয়স্ক মেয়ে মানুষের চেয়েও বেশি গুণসম্পন্ন। তাদের ভেতর হিংসা কিংবা ঘৃণা কোনোটাই নেই। তারা ছাদের ওপর পুরুষ বিড়ালদের মতোই কুস্তি করে। সত্যি কথা বলতে সব বিড়ালই কুস্তি করে। ছোটবেলা থেকেই তারা কম-বেশি কুস্তির প্রশিক্ষণ নেয়। বিড়ালদের কুস্তি প্রতিযোগিতায় তোমার বিড়াল হয়তো তোমার জেলার লাইটওয়েট চ্যাম্পিয়ান। এটা তুমি জানতেও পারবে না কোনোদিন।
তুমি শুধু একবার ভাবো, একটা বিড়াল সারা জীবনে যত কিছু করে, সেসব কিছু তুমি তোমার জীবনে করো কি না। এটা ভাবতে গেলে তুমি লজ্জায় লাল হয়ে যাবে। বিড়ালেরা তাদের জীবনে সাইক্লোনের মতো যুদ্ধ করে, অনেকের সঙ্গে প্রেম করে। তোমার জীবনে তুমি কিই বা করো? তোমার জীবনে একটা ছোট্ট প্রেমের সম্পর্ক থাকে, এই তো? আর কুস্তির কথা নাই বা বললাম- ভালোমতো কুস্তি মনে হয় জীবনে একবারও করোনি তুমি।
বিড়ালেরা যেসব খেলা করে সেগুলোর দিকেও ভালো করে খেয়াল করো। তুমি কী এত খেলা করো? একটা বিড়াল যখন বয়স্ক হয়, তারা কুস্তির রিং থেকে অবসর গ্রহণ করে। তখন তারা অন্য ধরনের খেলা শুরু করে। শহরতলির বাড়ির পেছনে তারা শিকার করা শুরু করে। আর যদি একবার বিড়ালটি প্রেমিক-প্রেমিকাদের দেখা করার জায়গার সন্ধান পায়, তাহলে তারা কিং আর্থারের সৈন্য কিংবা রবিন হুডের মেরি ম্যানদের চেয়েও বেশি উদ্যমে দুঃসাহসিক অভিযানে অবতীর্ণ হয়।
বুড়ো বিড়ালটি হয়তো প্রতিবেশীর বারান্দায় খাঁচাবন্দি ছোট্ট হলুদ পাখিকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। এর নিকৃষ্টতার দিকে না তাকিয়ে মুগ্ধতার দিকে লক্ষ করো। নিঃশব্দে বেড়া ডিঙানো, পাহারাদার কুকুরের ঘুম না ভাঙিয়ে নিঃশব্দে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাওয়া, তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে পাখিটাকে খাঁচা থেকে বের করে আনার চেষ্টা, এগুলো দুঃসাহসিক কাজ। এতকিছু করার পর যথাসময়ে সকালের নাস্তার টেবিলে বিড়ালটি বাড়ির ম্যাডামের মুখে শুনতে পায়, টমকে অসুস্থ দেখাচ্ছে। ওর মনে হচ্ছে ক্ষুধা নেই।
বিড়ালদের বিরুদ্ধে সচরাচর আরেকটি অভিযোগ করা হয়ে থাকে। সেটা হচ্ছে তারা বাড়ির মানুষের তুলনায় বাড়িটাকে বেশি পছন্দ করে। কিন্তু আসল বিষয়টা কিন্তু ভিন্ন। সাধারণত বিড়াল তার দেশ ছাড়তে চায় না। তারা যেখানে বসবাস করে সেখানে তাদের অনেক বন্ধু-বান্ধব থাকে। বাড়ির আনাচে-কানাচের সব কিছুই তার জানা থাকে। এখন হঠাৎ করে নতুন জায়গায় গেলে তাকে সেখানকার ভূগোল সম্পর্কে শিখতে হবে, নতুন কুকুরদের চোখ ফাঁকি দেওয়া শিখতে হবে। এছাড়া একদম নতুন ধরনের বিড়ালদের সঙ্গে তাকে কুস্তি করতে হবে। নতুন বিড়ালদের সঙ্গে তাকে ভাব জমাতে হবে। তাদের জীবনটা এতসব করার মতো দীর্ঘ নয়। তাই একটা পরিবার যখন তাদের বাসস্থান পাল্টে ফেলে, বিড়ালটি যদি পারে তাহলে সেই পুরনো বাড়িতেই থেকে যায়। সেই পুরনো বাড়ির নতুন বাসিন্দাদের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়। সে আস্তে আস্তে তাদের পোষা বিড়ালে পরিণত হয়। নিজের মতো করে জীবনটা উপভোগ করতে থাকে বিড়ালটি। আগের মনিবের প্রতি আনুগত্যে ও ভালোবাসার জন্য সে কেনই বা তার পুরো জীবনটা ধ্বংস করতে যাবে।