সালমান রুশদি (জন্ম: ১৯জুন, ১৯৪৭) একজন ব্রিটিশ ভারতীয় ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস মিডনাইটস চিলড্রেনের জন্য তিনি ১৯৮১ সালে বুকার প্রাইজ পান। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে ভারতীয় উপমহাদেশের নানা বিষয়। বলা হয়ে থাকে, তিনি জাদু বাস্তবতার সঙ্গে ঐতিহাসিক কল্পকাহিনী একত্রিত করে লেখেন। পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে অসংখ্য সংযোগ, বিচ্ছিন্নতা ও অভিপ্রয়াণ তার লেখার অন্যতম বিষয়বস্তু। সালমান রুশদি তার পঞ্চম গ্রন্থ ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’-এর জন্য অধিক পরিচিত, যেখানে তিনি ১৯৮৯ সালে তার উপর ফতোয়া জারি করা সম্পর্কে লিখেছেন। গত চল্লিশ বছর ধরে তিনি আরও ১৬টি গ্রন্থ লিখেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন হার্ভাড বিজনেসের সম্পাদক অ্যালিসন বেয়ার্ড, চিন্তাসূত্রের জন্য অনুবাদ করেছেন মোস্তাফিজ ফরায়েজী।
অ্যালিসন বেয়ার্ড: আপনি আরেকটি নতুন গ্রন্থ লেখার জন্য প্রস্তুত, আপনি এটা কী করে বলছেন?
সালমান রুশদি: আসলে একটা গল্পের ধারণা আমার নাকের ডগায় পিল পিল করছে। মাঝে মাঝে তুমি কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে লিখতে চাইবে, আবার কখনো কখনো কোনো ঘটনা সম্পর্কে সব প্রকাশ করতে চাইবে। জোসেফ হেলার বলেছিলেন, তার সমস্ত উপন্যাস শুরু হয় একটি বাক্য দিয়ে, একজন তার কাছে আসে এবং সেই আগন্তুক হয়তো জানে তাতে কী কী আছে। একটা ধারণা যদি চারপাশে বিচরণ করতে থাকে, এখনো যদি আমাকে আকর্ষিত করে, প্রতিদিন সকালে যদি আমাকে নাড়ায়, তাহলে বুঝতে হবে বিষয়টাতে আমার দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। মাঝে মাঝে এটা করতে অনেক বছর লেগে যায়। দ্য ইনচ্যান্ট্রেস অব ফ্লোরেন্স লেখার আগে, আমি সম্রাট আকবর এবং নিকোলো ম্যাকাইভেলি সম্পর্কে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চিন্তাভাবনা করেছি। আমি সবসময় ভাবতাম, ‘আমি একদিন না একদিন এদের নিয়ে কিছু একটা লিখব।’ আমি ভাবতেই পারিনি একই উপন্যাসে তারা আসবে। কিন্তু একসময় তারা একে অন্যের সঙ্গে কথা বলা শুরু করল এবং আমি বুঝতে পারলাম, এটাই তো সেই গ্রন্থ।
অ্যালিসন বেয়ার্ড: আপনি কিভাবে লেখালিখি করেন? সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কী লেখার প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন এসেছে?
সালমান রুশদি: আমি সবসময় বলি, এটা একটি ফুলটাইম জবের মতো। তুমি একদিন কতটা ভালো অনুভব করছো এটা কোনো বিষয় নয়। আমি মনে করি না, লেখক কিংবা শিল্পীরা সৃজনশীল মেজাজ সৃষ্টি করতে পারে অথবা অনুপ্রেরণার জন্য অপেক্ষা করতে পারে। তোমাকে অতি সাধারণভাবে ডেস্কে বসতে হবে এবং তোমার কাজ করতে হবে। অনেক বছর ধরে এই অভ্যাসটা আমি করেছি। আমি প্রতিদিন আমার ডেস্কে বসি এবং আমার কাজ করি, এটা না করার জন্য কোনো অনুমতি আমি নিজেকে দেই না। যখন তোমার মন বুঝবে এটাতে কোনো অজুহাত চলবে না, তখন এটা একটা চমকপ্রদ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। সম্ভবত আমি লেখকদের মধ্যে একটু ব্যতিক্রম, আমি নির্জনতাপ্রিয় নই। অনেক লেখক আছেন, যারা কোনো লেখায় মনোনিবেশ করলে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। আমি আসলে অন্য কাজেও পটু, আপনজনদের যত্ন নেওয়া, যা মন চাই তা করা, এগুলো ভালো লাগে। এটা আমাকে পুনর্জীবিত ও উদ্যমী করে তোলে এবং পরের দিন উৎফুল্ল মনে কাজ করতে সাহায্য করে। এর ব্যতিক্রম হয় তখন, যখন আমি কোনো কিছু নতুনভাবে লেখা শুরু করি। তখন একদিনে এখনকার চেয়ে আমাকে অনেক বেশি লিখতে হয়- চার থেকে পাঁচ পৃষ্ঠা। এখন আমি ৪০০ থেকে ৫০০ শব্দ করে লিখি। ব্যতিক্রমটা হলো, ওই কাজটাকে আমার অনেকবার সংশোধন করতে হয়। এখন আমি অনেক কম লিখি কিন্তু যেটুকু লিখি সেটা প্রায় চূড়ান্ত লেখ্যরূপ। একটা গল্প লেখা শুরু করার আগে আমি গল্পটির অবকাঠামো সম্পর্কে আগে থেকে চিন্তাভাবনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। যত বয়স হচ্ছে, তত অপরিকল্পিতভাবে গল্প লেখার প্রবণতা বাড়ছে। মাঝে মাঝে গল্পটা এমনভাবে শেষ হচ্ছে যেটা আমি শুরুতে চিন্তাও করিনি। আসলে লেখালিখি কোনো কিছু আবিষ্কারের একটি প্রক্রিয়া।
অ্যালিসন বেয়ার্ড: নিয়মানুবর্তিতা কিংবা অনুশীলনের কারণেই কি আপনি ভালো গদ্য লেখার সক্ষমতা অর্জন করেছেন?
সালমান রুশদি: অনুশীলনটা একটা বিষয়। কিন্তু এখানে আরও বিষয় আছে। একটা সময় আছে যখন তুমি জানতে শুরু করবে আসলে তুমি কে, কোন দিকে তোমাকে কাজ করতে হবে বলে তুমি আশা করো। এটা তোমাকে আত্মবিশ্বাস ও নির্মলতা দেবে।
অ্যালিসন বেয়ার্ড: আপনি কখন আপনার কাঙ্ক্ষিত দিকটা সম্পর্কে জেনেছিলেন?
সালমান রুশদি: আমার বয়স যখন চল্লিশের ঘরে তখন, চল্লিশের প্রথম দিকের একসময় হবে। মিডনাইটস চিলড্রেন, শেইম, এবং দ্য স্যাটানিক ভার্সেস উপন্যাসের মাধ্যমে আমি নিজেকে ও নিজের পৃথিবীকে বিকশিত করেছিলাম। ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ মূলত ভারত, ‘শেইম’ পাকিস্তান এবং ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে পশ্চিমে অভিবাসন সম্পর্কিত। আমি যখন উপন্যাস তিনটি লিখেছিলাম, তখন অনুভব করতাম, নিজেকে আত্ম-বিকশিত করছি। লেখক হিসেবে এটা জানতাম, তাই সেই আত্মবিকাশের কাছ থেকে সামনে এগিয়ে চলতে পারতাম।
অ্যালিসন বেয়ার্ড: একটা উপন্যাস লেখার সমাপ্তিটা আপনি কিভাবে বোঝেন?
সালমান রুশদি: নিঃশেষিত হওয়া থেকে। এটা এমন নয় যে আমি শারীরিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ি, কিন্তু আমার কল্পনা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। একটা উপন্যাসে এমন একটা বিন্দু আসে, যখন এটাকে তুমি আর ভালো করতে পারবে না; তুমি শুধু এটাকে ব্যতিক্রমী করতে পারবে। তোমাকে সেই বিন্দুটিকে নির্ণয় করতে পটু হতে হবে। আর্নেস্ট হ্যামিংওয়ে লেখকের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একটা কথা বলেছিলেন, একজন লেখকের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তুমি যদি শব্দকে অনুগ্রহ করো, তাহলে সেটা একটি ভালো শিট-ডিটেক্টর। আমি মনে করি, এটা সত্য। একজন লেখকের এমন ক্ষমতা থাকা উচিত, যেটা দ্বারা সে বুঝতে পারবে, কখন কোনটা ঠিক আর কোনটা ঠিক নয় এবং কখন এটার সমাপ্তি টানতে হবে।
অ্যালিসন বেয়ার্ড: আপনি কি লেখার সময় প্রতিক্রিয়া অনুসন্ধান করেন?
সালমান রুশদি: লেখা চলার সময় আমি কাউকে দেখাই না, কেননা এটা ভঙ্গুর। আমি যদি একটা মজার দৃশ্য লিখি আর সেটা তোমাকে দেখায়, তাতে তুমি যদি না হাসো, আমার মন খারাপ হয়ে যাবে, আমি আত্মবিশ্বাস হারাব। কাউকে না দেখিয়ে যতদূর সম্ভব আমি লেখার চেষ্টা করি। তারপর লেখাটি সম্পর্কে প্রকাশকেরা এবং আমার বন্ধুরা কী বলে, এটা জানার জন্য আমি খুব উদগ্রীব হয়ে উঠি। এটা এমন নয় যে তাদের আমার লেখা পছন্দ করতেই হবে, যদিও সবাই পছন্দ করে থাকে। আমি তাদের দিয়ে বলাতে চাই, আমার লেখাটির সমস্যা থেকে থাকলে সেটা কোথায়? আমি সাধারণত প্রকাশের আগে আধাডজন লোককে আমার উপন্যাসটি দেখায়। এক্ষেত্রে তোমার এমন মানুষ প্রয়োজন হবে, যারা তোমাকে সত্যটা বলবে।
অ্যালিসন বেয়ার্ড: আপনার অনেক লেখকের সঙ্গে সখ্য আছে। আপনি কিভাবে তাদের সহায়তা ও অনুপ্রাণিত করেন?
সালমান রুশদি: যদি বলি আমরা একত্রিত হই এবং সাহিত্য সম্পর্কে কথাবার্তা বলি, তাহলে সেটা মিথ্যে বলা হবে। আমরা প্রায় সব বিষয়ে কথাবার্তা বলি। কিন্তু আমাদের একে-অন্যের ভেতর স্বতঃস্ফূর্ত বোঝাপড়া আছে, কেননা আমরা সবাই একই কাজ করি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, নতুনদের সম্পর্কে জানা। নিজের প্রজন্মে প্রলিপ্ত হওয়ার একটা প্রবণতা বর্তমান। তাই পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভুলে যাওয়াটা সহজ। কিন্তু এসব তরুণ লেখকে পুরনো বন্ধুর মতোই উপকারী। তারা তোমাকে সতেজতায় ভরিয়ে দেবে। এক অন্য পৃথিবী, সময়, চিন্তাধারা, কার্যাদি তোমার চোখের সামনে তারা তুলে ধরবে।
অ্যালিসন বেয়ার্ড: আপনার কাজের সবচেয়ে কঠিন অংশ কোনটি?
সালমান রুশদি: জগৎটাকে বুঝতে পারাটা খুব কঠিন একটি কাজ। বইয়ের পৃষ্ঠার ওপর মানব চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলাটাও খুব কঠিন। আমি সবসময় অনুভব করি, একজন লেখকের সঙ্গে পরিবর্তনীয় ভাষার কিছু সম্পর্ক থাকা উচিত। যেমন, নতুন কণ্ঠস্বর, নতুন রচনাশৈলী, নতুন রীতিনীতি। এটা অনেকটা কুস্তির মতো। সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে, তুমি যা লিখছ, সেটা পাঠকের কাছে সহজবোধ্য হতে হবে। মোটের ওপর আমি বলি, এটা শুধু কঠিন কাজ। আবার এটা কঠিন নয়। আমি যা করি, তার ভেতর লেখালিখি করতেই বেশি উপভোগ করি। আমি সেই মুহূর্তে সবচেয়ে সুখী মানুষ, যখন আমি একটি বই লিখি। এটা একটা আনন্দের ব্যাপার, বই প্রকাশ করার চেয়েও এতে বেশি আনন্দ। আসলে সময় যত যাচ্ছে, আমি বই প্রকাশ করার মুহূর্তে বেশি ভয় পাচ্ছি।
অ্যালিসন বেয়ার্ড: কেন? চারপাশে এত বইয়ের প্রচার, এ জন্য?
সালমান রুশদি: হ্যাঁ, আংশিকভাবে তোমার কাছে থেকে সবাই কী আশা করে, এটার জন্য। আবার অন্যদিক থেকে, এটা একটা ভেদ্য সময়। তুমি যখন লেখো, তুমি নিজেকে বোকা বানাও এই ভেবে যে, এটা একটা ব্যক্তিগত বিষয়। তুমি তোমার কক্ষের ভেতর একা থাকো সে সময়। অন্য কেউ সেটা পড়ছে না। শুধু তুমি আর পৃষ্ঠা, তুমি সেটাকে ভালো করার চেষ্টা করছ। অনেক বছর সময় লাগতে পারে, তিন বার একটা বই লিখতে আমার পাঁচ বছর করে সময় লেগেছে। তখন বিষয়টা এমন যে সেটা শুধু তোমার, আর কারও নয়। তারপর যখন বইটি প্রকাশিত হয়, তখন সেটা জনগণের পণ্য হয়ে যায়। তখন তুমি নগ্নভাব অনুভব করো। এটা সবার সম্মুখে জামা-কাপড় খুলে নগ্ন হওয়ার মতো। আবার, তুমি তাদের বইটি প্রেসক্রাইব করতে পারো না, অথবা এটাও বলতে পারো না, এতে কী আছে এবং এটি কিভাবে পড়তে হবে। তুমি তাদের কল্পনাকে এর ভেতর প্রবেশ করাতে চাও। আসলে যে প্রক্রিয়ায় এখন বই মার্কেটিং করা হয়, এটা আমার সহজাত প্রবৃত্তিবিরুদ্ধ। তুমি যদি অষ্টাদশ শতাব্দী দিকে তাকাও, একজন কম চেনা কিংবা অচেনা লেখকের বইও বিখ্যাত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। গালিভারস ট্রাভেল, রবিনসন ক্রুসো, ট্রিস্ট্রাম শ্যান্ডির কথা ভাবো। সেগুলো অধিক বিক্রিত বই কিন্তু এই বইগুলোর প্রচারের জন্য তাদের কিছুই করা লাগেনি।
অ্যালিসন বেয়ার্ড: আপনি কিছুদিন একটা বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছিলেন। ওই অভিজ্ঞতা থেকে আপনি কী শিখেছিলেন?
সালমান রুশদি: একটা জিনিস, নিয়মানুবর্তিতা। তোমাকে যদি বৃহস্পতিবার ২টা ৩০মিনিটে কোনো কিছু সরবারহ করতে হয়, তবে তোমাকে শিখতে হবে কিভাবে সেটা উৎপাদন করতে হবে। কেননা তোমার খরিদ্দার যথাসময়ে এসে হাজির হবে।
অ্যালিসন বেয়ার্ড: আপনার প্রথম বইটি তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছিল। আপনি কেন এটা এখনো বাজার থেকে তুলে নেননি?
সালমান রুশদি: সাহিত্যচর্চা একটা প্রকৃতিজাত ব্যাপার। একজন লেখকের এটা করা প্রয়োজন। পৃথিবীটা বইয়ের ভেতর ডুবে যাচ্ছে। তুমি যদি শুধু সেরা গ্রন্থগুলো বেছে বেছে প্রতিদিন পড়তে থাকো, যেগুলো ইতোমধ্যে আছে সেগুলোই পড়ে শেষ করতে পারবে না। তাই তুমি যদি ওই পর্বতে একটি বই যুক্ত করতে চাও, এটা অবশ্যই প্রয়োজনীয় হতে হবে।
অ্যালিসন বেয়ার্ড: লেখক জীবনের প্রথমের দিকের সমালোচনার জবাব কিভাবে দিতেন, এই জবাব দেওয়াটা কি পরিবর্তিত হয়েছে?
সালমান রুশদি: কেউ যদি দাবি করে, তারা বিষয়গুলো অগ্রাহ্য করে, তাহলে তারা মিথ্যা বলছে। আমি খুব বিস্মিত হয়েছিলাম যখন আমার প্রথম বইটা কেউ ভালোভাবে গ্রহণ করল না। এটা ছিল বিপর্যস্ত সময়। কিন্তু এটা আমাকে সাহায্যও করেছে, কেননা আমি সাহিত্যচর্চাকে কিভাবে ভাবি, এটা আমাকে সেই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে এবং আমি ভিন্নভাবে আবার লেখার চেষ্টা করেছি। এবং এটাই মিডনাইটস চিলড্রেন সৃষ্টির পেছনের রহস্য। যাই হোক না কেন, আমার প্রথম বইটির সংস্করণ এখনো বাজারে আছে এবং ভালোই বিক্রি হচ্ছে। মাঝে মাঝে তোমাকে ছোট খেলায় হারতে হবে কিন্তু বড় খেলায় জিততে হবে।
অ্যালিসন বেয়ার্ড: মিডনাইটস চিলড্রেন অনেক সুনাম কুড়িয়েছে। আপনি কী কখনো এটার সাফল্যকে অতিক্রম করার কথা অনুভব করেন?
সালমান রুশদি: আমার জন্য ওই বইটা একটা অপূর্ব জিনিস। এটা আমাকে মানুষের কাছে লেখক বানিয়েছে। এটা আমাকে আর্থিকভাবে স্বাধীন করেছে। কিন্তু আমি ওরকমভাবে আর লিখি না। ওই বইটা তরুণদের জন্য। আমি যখন ওটা লেখা শুরু করেছিলাম আমার বয়স তখন ২৭ বা ২৮। ওটা প্রকাশিত হলো আমার ৩৩ বছর বয়েসে। এখন আমার বয়স ৬৮ বছর। ওটা অনেক আগের কথা। লেখক জীবনের মহান দিক হলো, এটা থেকে অবসরগ্রহণের কোনো বয়স নেই। তুমি যেটা করো, সেটা হলো পরের বইটি লিখে যাও।
অ্যালিসন বেয়ার্ড: আপনার লেখালেখিকে ফতোয়া কিভাবে প্রভাবিত করেছে?
সালমান রুশদি: আমার লেখালেখি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করার যথেষ্ট সময় অথবা মস্তিষ্কে জায়গা নেই, পুরো পৃথিবীটা আমার কানের কাছে চিৎকার করছে। কিন্তু আমি একজন শিল্পী হিসেবে লাইনচ্যুত হতে পারি না। তাই আমি আমাকে দৃঢ়ভাবে বলি, ‘তুমি যেমন লেখক ছিলে তেমনই থেকে যাও।’ তুমি যদি কালানুসারে আমার বইগুলো কাউকে দেখাও যে আমার জীবন সম্পর্কে জানে, আমি মনে করি না সেই পাঠক বলবে, ‘দেখো, ১৯৮৯ সালে মারাত্মক কিছু একটা ঘটেছিল, এবং এরপরের সব বই-ই এটা দ্বারা প্রভাবিত।’ আমি মনে করি, তারা সাহিত্যের গতিশীলতা দেখতে পারবে আমার বইগুলোতে।
অ্যালিসন বেয়ার্ড: আপনি টুইটারে খুব সক্রিয়। কারণটা কী?
সালমান রুশদি: খুব সহজ ব্যাপার- যা বলা প্রয়োজন, তা খুব দ্রুত বলা যায়। জানোই তো, একটা বই লিখতে অনেক সময় লাগে। বইতে সমসাময়িক, উত্তপ্ত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হাস্যকর। কেননা আমরা খুব দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে বসবাস করছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বইয়ের পুরোটা উল্টো। টুইটের দীর্ঘমেয়াদি জীবন নেই, কিন্তু টুইটের স্বাভাবিক প্রয়োজনীয়তা আছে। প্রথমের দিকে আমি টুইটারে আসতে চাইনি, কিন্তু আমার একটা বন্ধু আমাকে অনুরোধ করেছিল, তাই আমি চেষ্টা করলাম, আমি পুরোপুরিভাবে বিস্মিত হলাম, আমার এখন মিলিয়নের ওপর অনুসরণকারী। এটা তোমার হাতে একটা মেগাফোন তুলে দিয়েছে। যখন কোনোকিছু চিৎকার করে বলা দরকার তখন তুমি এখানে বলতে পারো, এটা খুবই উপকারী একটা মেগাফোন।
অ্যালিসন বেয়ার্ড: এমোরিতে সাম্প্রতিক একটা বক্তৃতায় আপনি শ্রোতাদের বলেছেন, সুখের ঊর্ধ্বে কোনো কিছুর জন্য সংগ্রাম করো। আপনি কিসের জন্য সংগ্রাম করেন?
সালমান রুশদি: আমার বন্ধু মার্টিন অ্যামিসের একটা সুন্দর বাক্য আছে, ‘তুমি যেটা করার আশা করতে পারো, সেটা হচ্ছে তোমার পেছনে বইয়ের একটা তাক ফেলে যেতে পারো।’ তুমি একটা বইয়ের দোকানে গিয়ে বলতে পারবে, ‘এখান থেকে ওখান পর্যন্ত, এটাই আমি।’ জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকেরা সেই সব বইয়ের খুঁজে থাকে, যেগুলো অধিক-সংখ্যক পাঠক পড়তে চাই এবং উপভোগ করে। আমি খুব খুশি এই কারণে যে মিডনাইটস চিলড্রেনের বয়স এখন ৩৪ বা ৩৫ এবং সেই সব মানুষ যারা তখন জন্মায়নি তারাও বইটির সঙ্গে নিজেদের সংযোগ স্থাপন করতে পারে।
অ্যালিসন বেয়ার্ড: ব্যবসায়ীরা কেনো কথাসাহিত্য বা ফিকশন পড়বে?
সালমান রুশদি: নন-ফিকশন ধাঁচের গ্রন্থগুলো এখন ফিকশনের চেয়ে বেশি বিক্রি হয়। কিন্তু ইতিহাস থেকে একটা জিনিস শেখার আছে, তা হলো ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো কতটা দ্বন্দ্বপূর্ণ। তথ্য অনেকটা পিচ্ছিল প্রকৃতির। সত্য বলতে অসম্পূর্ণ। কথাসাহিত্য বা ফিকশন সেটা বুঝতে পারে। এখানে আরও এক ধরনের সত্য আছে যেটা তুমি শুধু উপন্যাসে খুঁজে পাবে। সত্যটা হচ্ছে আমরা মানুষেরা কিভাবে একে অন্যের সঙ্গে, একটা স্থান, মতাদর্শ কিংবা বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এখন তো ভালো অনুবাদ মানুষের নাগালে, তাই তারা পৃথিবীর অন্য অংশে কী ঘটছে, তা জানতে পারে। তারা সাহিত্য পাঠ করে পৃথিবীর অন্য অংশ সম্পর্কে বুঝতে পারে। তুমি যদি খবরে আফগানিস্তান দেখো, তাহলে তুমি শুধু দেখবে বোমা বিস্ফোরণ এবং আতঙ্কিত মানুষদের চিৎকার। কিন্তু তুমি যদি কাইট রানার পড়, তাহলে আফগানিস্তানে বসবাসরত মানুষের জীবনে মূলত কী ঘটছে, তা তুমি বুঝতে শুরু করবে।