অনুবাদ: মোস্তাফিজ ফরায়েজী
(আমেরিকান গল্পকার রে ব্রাডবেরির একটি বিখ্যাত গল্প ‘দ্য পেডেস্ট্রিয়ান’। সায়েন্স ফিকশনটি ১৯৫১ সালে ‘দ্য রিপোর্টার’—এ প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৫৩ সালে গল্পটি লেখকের ‘দ্য গোল্ডেন অ্যাপলস অব দ্য সান’ গল্পগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।)
নভম্বরের কুয়াশাচ্ছন্ন সন্ধ্যায় কংক্রিটের রাস্তায় পা রেখে পকেটে হাত দিয়ে হাঁটলে তোমার মনে হবে তুমি ঘাসেভরা অবারিত মাঠে বিচরণ করছ। আর এই কাজটাই লিওনার্ড মিড করতে ভালোবাসে। সময়টা ২০৫৩। সে একাকী দাঁড়িয়ে আছে চৌরাস্তার মোড়ে। চারটি রাস্তার কোন রাস্তা ধরে সে যাবে, সেটা কোনো বিষয় নয়। তবু অনেক চিন্তার পর সে একটা পথ বেছে নেয়। তারপর তার মনে একটা কথাই আসে—সেটা হলো, তাকে সিগারেটের ধোঁয়ার মতো তুষারকণাযুক্ত বায়ু অঞ্চল থেকে দ্রুত পায়ে বের হয়ে যেতে হবে।
মাঝে মাঝে সে কয়েক ঘণ্টা ধরে কয়েক মাইল হাঁটে, তারপর রাত গভীর হলে বাড়িতে ফিরে আসে। আসার পথে সে আশেপাশের বাড়ি—ঘরগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করে। তার কাছে মনে হয়, সে যেন কোনো কবরস্থানের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলছে। বাড়িগুলোর জানালা দিয়ে মিটমিটে ক্ষীণ আলো বের হয়ে পরিবেশ আরও ভারী করে তুলেছে; হঠাৎ হঠাৎ ধূসর ছায়ামূর্তি ঘরের ভেতর দৃশ্যমান হয়, এটাও বেশ ভূতুড়ে। এছাড়া বিস্ময়কর কানাকানি ফিসফিসানি পরিবেশটাকে শ্মশানের চেয়েও ভয়ঙ্কর করে তোলে।
লিওনার্ড মিড সেসব ফিসফিসানি শুনে থেমে যায়। কান খাড়া করে ছায়ামূর্তিগুলো কী বলছে, তা শুনতে চেষ্টা করে, এদিক-ওদিক উৎকণ্ঠার সঙ্গে তাকায়, তারপর আবার নিঃশব্দে গুটিগুটি পায়ে সে চলতে থাকে। তার পদচারণায় যেন শব্দ না হয়, এজন্য অনেক আগেই সে শক্ত হিলের জুতো পাল্টে স্নিকার ব্যবহার করা শুরু করেছে। এর একটা অন্য কারণও আছে। শক্ত হিলের জুতো পরলে সে যেদিকে যায়, কুকুরগুলো তার পিছু পিছু যায়। এটা তার একদমই পছন্দ না।
একদিন সন্ধ্যায় সে চৌরাস্তার মোড় থেকে পশ্চিম দিকের হিডেন সি-এর ওদিকটাতে যাত্রা শুরু করে। সেদিন বাতাসে খুব বেশি পরিমাণ তুষারকণা ছিল। এটা তার নাকটাকে ক্ষতবিক্ষত করছিল; শ্বাসযন্ত্রকে ক্রিসমাস ট্রি’র মতো জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। এমন অবস্থায় তোমার মনে হবে, শীতল আলোগুলো জ্বলছে আর নিভছে, আর গাছের শাখাগুলো অদৃশ্য তুষারে ভরে আছে। মিস্টার মিড শরতের ঝরা পাতার ওপর দিয়ে চলছে আর তার নরম জুতোর ভীরু ধ্বনি তৃপ্তিসহকারে শুনছে। এছাড়া মাঝে মাঝে সে তার দাঁতের ফাঁক দিয়ে ক্ষীণ হুইসেল দিচ্ছে। চলতি পথে মাঝে মধ্যে সে গাছের পাতা হাতে তুলে নেয়। খুব গুরুত্বসহ হালকা আলোয় সে পাতার পত্রবিন্যাস দেখে অথবা তার তিক্ত গন্ধ শুঁকে দেখে।
সেদিন সে যে বাড়ির পাশ দিয়েই যাচ্ছিল না কেন, ফিসফিস করে বলছিল, হ্যালো, কেউ ভিতরে আছ? অথবা বলছিল, আজকে রাতে চ্যানেল ফোর, চ্যানেল সেভেন, চ্যানেল নাইনে কী অনুষ্ঠান আছে? কাউবয়রা এত তড়িঘড়ি করে কোথায় যাচ্ছে?
তার বিচ্ছিন্ন প্রশ্নগুলো শোনার মতো কেউ যদি থাকতো, তাহলে হয়তো লিওনার্ড মিডকে কেউ পাগল সম্ভাষণ করতো। কিন্তু তার কথা শোনার মতো কেউ অবশিষ্ট নেই।
দীর্ঘ রাস্তাটি একদম নিস্তব্ধ, জনমানবশূন্য। শুধু তার ছায়ামূর্তি বাজপাখির ছায়ার মতো তার পিছু পিছু চলছে। এমন স্তব্ধ মুহূর্তে সে যদি চোখ বন্ধ করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তার হয়তো মনে হবে সে কোনো একটা বিরাট সমভূমি, মরুভূমি অথবা বরফাচ্ছন্ন অঞ্চলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে; যেখানে হাজার মাইলের মধ্যে কোনো বসতি নেই; শুধু শুকনো নদী আর রাস্তা সঙ্গ দেওয়ার জন্য তার রয়ে গেছে।
লিওনার্ডের পাগলামো থামে না। সে তার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বাড়িগুলোকে জিজ্ঞাসা করে, এখন কয়টা বাজে? তারপর সে শুনতে পায়, সন্ধ্যা আটটা ত্রিশ? এক ডজন মার্ডার করার জন্য যথেষ্ট সময়? একটা কুইজ? না, না, একটা গীতিনাট্য? একজন কমেডিয়ানের স্টেজ থেকে পড়ে যাওয়ার সময়?
এটা কি একটা বাড়ির অট্টহাস্য কিংবা রসিকতা? না কি তার ভ্রম? তার মনে দ্বিধা জাগ্রত হয়। কিন্তু যখন সে দেখে আর কোনো কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে না, সে পুনরায় চলতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পরে সে ফুটপাতের অমসৃণ একটা অংশে হোঁচট খায়। তার মন ক্ষণিকের জন্য উদাসীনতায় ভরে ওঠে। দশ বছর ধরে তার দিবারাত্রির এই পদযাত্রায় সে দ্বিতীয় কোনো মানুষকে একটিবারের জন্যও দেখেনি। বিষয়টা কতটা নিষঙ্গতার, তা শুধু লিয়নার্ড মিডই অনুভব করতে পারে।
তারপর সে শহরের দুই প্রধান রাস্তার মোড়ে আসে। রাস্তা দুটোর মাধ্যমে শহরটা বিভক্ত হয়েছে। একসময় দিনের বেলায় এই হাইওয়ে দুটো গাড়িতে ভরে থাকতো। গ্যাস স্টেশনগুলো খোলা থাকতো। এখন আর কিছুই আগের মতো নেই। সবকিছু নিস্তব্ধতায় ডুবে রয়েছে।
লিয়নার্ড পাশের একটা ফুটপাতের দিকে ফিরে চক্কর দিয়ে নিজের বাড়ির দিকে হাটতে শুরু করে। তার বাড়ি ফেরার সময় হয়েছে। তাকে এখন বাড়ি ফিরতে হবে। সে হাঁটতে থাকে। তবে একসময় সে থমকে দাঁড়ায়। এমন কিছু ঘটে যার জন্য তাকে থেমে যেতে হয়। সে যখন তার গন্তব্যস্থানের একদম কাছে চলে আসে, সেই সময় একটা নিঃসঙ্গ কার গাড়ি হঠাৎ করেই কোথা থেকে এসে তার ওপর আলো ফেলে। লিওনার্ড চমকে ওঠে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, তারপর গাড়িটির দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু না। তাকে আবার থমকে দাঁড়াতে হয়।
একটা ধাতব কণ্ঠ তাকে বলে ওঠে, যেখানে আছ সেখানেই দাঁড়াও। একদম নড়বে না।
সে থেমে গেল।
—তোমার হাত দুটো ওপরে তোলো!
—কিন্তু…
সে কিছু একটা বলতে চায়। কিন্তু তার কথা শেষ না হতেই ধাতব কণ্ঠ বলে ওঠে, হাত ওপরে তোলো! তা না হলে গুলি করব!
অবিশ্বাস্য বিষয়। একটা পুলিশ কার? তিন মিলিয়নের শহরটাতে শুধু এই একটা পুলিশ কারই অবশিষ্ট আছে! বিষয়টা ভাবা যায়? একবছর আগে, ২০৫২ সালে, নির্বাচনের বছর শহরে পুলিশ কারের সংখ্যা তিনটা থেকে একটাতে নামিয়ে আনা হয়েছে। শহরে অপরাধকর্ম একদম কমে গিয়েছে, তাই এখন আর পুলিশের দরকারই নেই বললেই চলে। তবু এই একটি নিঃসঙ্গ কার নিঃসঙ্গ রাস্তায় বিচরণ করে বেড়াচ্ছে, ভেবেই অবাক হয় লিওনার্ড। পুলিশ কারটিও তার মতোই নিঃসঙ্গ এক অভিযাত্রী।
ধাতব কণ্ঠস্বরে পুলিশ কারটি বলে, তোমার নাম?
লিওনার্ডের চোখে আলো পড়ায় গাড়ির ভেতর কেউ আছে কি না, সে বুঝতে পারে না। সে বলে, লিওনার্ড মিড।
—জোরে বলো!
—লিওনার্ড মিড!
—ব্যবসা করো না চাকরিজীবী?
—তুমি আমাকে একজন লেখক বলতে পারো।
—তাহলে, কোনো পেশা নেই?
আলোটি লিওনার্ডকে মিউজিয়ামের দর্শনীয় কোনো বস্তুর মতো একদম স্থির করে রেখেছে। সে সামান্য নড়াচড়াও করতে পারছে না। মিস্টার মিড বলে, তোমার আমাকে লেখক বলে উল্লেখ করা উচিত।
যদিও সে অনেক বছর ধরে কিছু লেখেনি, তবু কথাটা সে বলে ফেলে। বর্তমানে ম্যাগাজিন অথবা বই আর বিক্রি হয় না। সবাই কবরের মতো ঘরে আবদ্ধ হয়ে থাকে। কবরগুলো ক্ষীণ টেলিভিশনের আলোয় আলোকিত, যেখানে মানুষগুলো মৃতের মতো বসে থাকে। মনে হবে যেন, ধূসর অথবা বহুরঙা আলো তাদের মুখাবয়ব স্পর্শ করছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেগুলো তাদের স্পর্শ করে না।
ধাতব কণ্ঠ দৃঢ়তার সঙ্গে বলে ওঠে, কোনো পেশা নেই। এখন বলো, বাইরে তুমি কী করতে বের হয়েছো?
—হাঁটতে।
—হাঁটতে!
—শুধুই হাঁটতে।
—হাঁটতে, শুধুই হাঁটতে?
—জি, স্যার।
—কোথায় হেঁটে যাও? কেন হাঁটো?
—মুক্ত বাতাস উপভোগের জন্য হাঁটি। বাইরের দৃশ্যপট দেখার জন্য হাঁটি।
—তোমার ঠিকানা?
—ইলেভেন সাউথ সেইন্ট জেমস স্ট্রিট।
—তাহলে তো তোমার বাড়িতেও বাতাস আছে, তোমার একটা এয়ার কন্ডিশনার আছে, তাই না মিস্টার মিড?
—হ্যাঁ।
—এছাড়া দেখার জন্য তোমার বাসায় একটা স্ক্রিন আছে, তাই না?
—না।
—না?
—তুমি বিবাহিত, মিস্টার মিড?
—না।
পুলিশ কারটি অবাক হয়ে বলে, বিবাহিত নও!
লিওনার্ড মুখে হাসি এনে বলে, কেউ আমাকে বিয়ে করতে চায়নি।
—যা জিজ্ঞাসা করছি তার বাইরে কিছু বলো না!
লিওনার্ড স্থিরভাবে পুলিশ কারের নির্দেশে দাঁড়িয়ে রইলো। পুলিশ কারটি আবারও বলে উঠলো, শুধু হাঁটার জন্য, তাই না মিস্টার মিড?
—হ্যাঁ।
—কিন্তু কী কারণে সেটা তুমি বলোনি!
—বলেছি; মুক্ত বাতাসের জন্য, বাইরের দৃশ্য দেখার জন্য এবং শুধু হাঁটার জন্য।
—এটা কি তুমি মাঝে মাঝেই করো?
—অনেক বছর ধরে প্রতি রাতেই আমি হাঁটি।
পুলিশ কারটি রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে আর তার রেডিওর মতো কণ্ঠস্বর অস্পষ্টভাবে বিড়বিড় করে চলেছে। পুলিশ কারটি বলে ওঠে, আচ্ছা ঠিক আছে, মিস্টার মিড।
লিওনার্ড বিনয়ের সঙ্গে পুলিশ কারকে জিজ্ঞাসা করলো, শুধু এটুকুই?
কণ্ঠটি বলে, হ্যাঁ।
লিওনার্ড একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলো, তারপর একটা পট শব্দ শুনলো। পুলিশ কারের পেছনের দরজা খুলে গেলো। কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো, এখানে উঠে পড়ো।
—একমিনিট অপেক্ষা করুন, আমি তেমন কিছু করিনি! আমাকে উঠতে হবে কেন?
—উঠে পড়ো।
—আমি উঠতে অস্বীকার করছি।
—মিস্টার মিড।
হঠাৎ করেই সে মাতাল মানুষের মতো হাঁটতে শুরু করে। সে কারের সামনের জানালাটা পার হ্ওয়ার সময় কারের ভেতরের দিকে তাকায়। সে যেটা আশা করেছিল তাই, সামনের সিটে কেউ নেই, এমনকি কারের ভেতর একজন মানুষও নেই।
—উঠে পড়ো।
লিওনার্ড কারের পেছনের দরজায় হাত দিয়ে সিটের দিকে তাকায়। ওটা দেখতে একটা জেলের সেলের মতো, অনেকটা মদের বারবিশিষ্ট একটা ছোট কালো জেলখানার সেলের মতো। ঝাঁঝালো জীবাণুনাশকের মতো গন্ধ বের হচ্ছে ওখান থেকে। গন্ধটা বেশ তীব্র, ধাতব প্রকৃতির।
কণ্ঠটি বলে ওঠে, এখন যদি ঘটনাস্থলের দৃশ্য দেখার জন্য তোমার একটা বউ থাকতো, তাহলে সে কিছু একটা বলতে পারতো, তাই না মিস্টার মিড?
—তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
কারটি দ্বিধায় পড়ে গেলো। দ্রুত কোনো কিছু ঘোরার শব্দ হতে লাগলো। তারপর ধাতব কণ্ঠটি বললো, মানসিক চিকিৎসার জন্য।
লিওনার্ড মিড গাড়িতে উঠে বসে। দরজাটা ধপাস করে বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ কারটি তার নিভু নিভু আলো ফেলে চলতে শুরু করে।
তারা একটি বাড়ি পার হয়। তারপর তারা এমন একটা বাড়ির সামনে পৌঁছালো, যেটা পুরো শহরের অন্ধকার বাড়িগুলো থেকে আলাদা। শুধু এই বাড়িটিতে সব আলো উজ্জ্বলভাবে জ্বলছে, প্রতিটি জানালা দিয়ে হলুদ আলোকরশ্মি জ্বলজ্বল করে বের হচ্ছে। শীতল অন্ধকারের মাঝে শুধু এই বাড়িটিই উষ্ণ, শুভ্র।
লিওনার্ড মিড বলে ওঠে, এটা আমার বাড়ি। তার কথার কেউ উত্তর দেয় না। কারটি চলতে থাকে। পেছনে পড়ে থাকে শূন্য রাস্তা, শূন্য ফুটপাত; নভেম্বরের সেই রাত থেকে ওই রাস্তায় আর কোনো মৃদ্যু শব্দ অথবা পদধ্বনি শোনা যায় না।