(পর্ব-১৩)
[ড. মায়া অ্যাঞ্জেল্যু—আমেরিকান কবি। তার জন্ম ১৯২৮ সালের ৪ এপ্রিল। মিসোরি রাজ্যের সেন্ট লুইস শহরে। ছিলেন একাধারে, কণ্ঠশিল্পী, অভিনেত্রী, নাট্যকার, শিক্ষক ও একজন জীবনীকার। তার পুরো নাম মার্গারেট অ্যানি জনসন।
১৯৯৩ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি তার নিজের লেখা কবিতা ‘পালস অব মর্নিং’ আবৃত্তি করেন। এজন্য পরে গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডও পান। ইতোপূর্বে ১৯৬১ সালে একমাত্র কবি রবার্ট ফ্রস্টই প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘দ্য গিফট আউটরাইট’ কবিতাটি আবৃত্তি করার সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন।
১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা নিজের অভিষেক অনুষ্ঠানে মায়া এঞ্জেলোর কবিতা পাঠ করে তাকে সম্মান দেখান। কর্মজীবনে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। সমগ্র পৃথিবীর ৭০টিরও বেশি ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি সম্মাননা পান। প্রায় ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট বা ডক্টর উপাধি পান।
১৯৬৯ সালে তার প্রথম আত্মজীবনী ‘আই নো হোয়াই দ্য কেজড বার্ড সিংস’ বইটি প্রকাশিত হলে বিশ্বব্যাপী তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। বইটি পরবর্তী দুবছর ধরে নিউ ইয়র্ক টাইমস এর বেস্ট সেলার তালিকায় সর্বোচ্চ স্থান দখল করে ছিল। ২০১৪ সালের ২৮ মে সকালে অ্যাঞ্জেল্যু চিরনিদ্রায় চলে যান। চিন্তাসূত্রের জন্য এই মহান লেখকের আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড ‘আই নো হোয়াই দ্য কেজড বার্ড সিংস’-এর বাংলা অনুবাদ করেছেন কথাশিল্পী-কবি-অনুবাদক ফারহানা রহমান। নাম দিয়েছেন, ‘আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়’। আজ প্রকাশিত হলো ১৩তম পর্ব]
রূপালি সুতো আর রঙবেরঙের নানা বল দিয়ে আমরা যে গাছটি সাজিয়েছিলাম, মোমা সেটির সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের উদ্দেশে বলতে শুরু করলেন, ‘আমি দেখছি তোমরা খুব অকৃতজ্ঞ দুটি বাচ্চা। তোমাদের কী মনে হয়? তোমারা কী ভাবছ? এত দূর থেকে এত কষ্ট করে তোমাদের মা-বাবা যে এইসব দারুণ-দারুণ খেলনা পাঠিয়েছেন কেন? যেন তোমরা দুজন ঘরের বাইরে বসে বসে ঠাণ্ডার মধ্যে কান্নাকাটি করো? এই জন্য না কি?’
আমরা দুজনের কেউ কোনো কথা বললাম না। মোমাই অনেক কথা বলতে লাগলেন। তিনি বললেন, ‘ছোট্ট আপু আমার! আমি জানি তুমি খুবই কোমল মনের মেয়ে। তুমি কেঁদেছ ঠিক আছে। কিন্তু বেইলি জুনিয়র! তুমি কী কারণে এমন পুষি ক্যাটের মতো বসে বসে মিউমিউ করে কান্নাকাটি করছ? ভিভিয়ান আর বিগ বেইলির কাছ থেকে কিছু গিফট পাওয়াতেই কি এমন করছ তোমারা দুজন?’ আমরা যখন কোনো কিছুতেই কোনো উত্তর দিচ্ছিলাম না, তখন তিনি জানতে চাইলেন, ‘ওহ! তাহলে কি তোমরা এই চাচ্ছো যে, আমি সান্তা ক্লোজকে ডেকে এনে এসব গিফট ফিরিয়ে দেই?’ তীব্র যন্ত্রণার এক অনুভূতি আমাকে ভেঙে চুরমার করে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। আমি চিৎকার করে বলতে চাইলাম, ‘হ্যাঁ, তাই করুন! তাকে বলুন যে এসব কিছু ফিরিয়ে নিয়ে যাক!’ কিন্তু আমি কিছুই কোর্টে পারলাম না শুধু পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে থাকা ছাড়া।
পরে বেইলির সঙ্গে ব্যাপারটি নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা করলাম। ও বললো, ‘এগুলো যদি সত্যি সত্যি আমাদের মা পাঠিয়ে থাকেন, তাহলে এর মানে দাঁড়াচ্ছে যে, তিনি আমাদের কাছে আসার জন্য রেডি হচ্ছেন। আর শিগগিরই তার কাছে আমাদের নিয়ে যাবেন। হয়তো বা আমরা এমন কিছু ভুল করেছিলাম, যার জন্য তিনি এতদিন আমাদের ওপর খুব রেগে ছিলেন। আর এখন মনে হয়, তার রাগ পড়ে গেছে। তাই তিনি সবকিছু মাফ করে দিয়ে আমাদের খুব তাড়াতাড়ি তার কাছে নিয়ে যাবেন।’
ক্রিসমাসের পরের দিন আমি আর বেইলি মিলে পুতুলের সবকিছু টেনে হিঁচড়ে ছিঁড়ে ফেললাম। কিন্তু বেইলি আমাকে বারবার এই বলে সাবধান করলো যে, আমি যেন কাপ-পিরিচের সেটটা খুব যত্ন করে তুলে রাখি। ওটা নষ্ট করা যাবে না। কারণ, যেকোনো দিন মা এসে হাজির হতে পারেন।
কোনো খবর না দিয়ে ঠিক এক বছর পর বাবা এসে হাজির হলেন। হঠাৎ কোনো এক সকালে এমন একটি ভয়ানক বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে আমরা দুজন হতবাক হয়ে গেলাম। আমরা দুজনেই; অন্তত আমি তো অবশ্যই অলীক কল্পনার এক বাবাকে নিয়ে এবং অস্তিত্বহীন এক মা সম্পর্কে মনের ভেতর দারুণ দারুণ সব কাল্পনিক রাজ্যের বিস্তার করেছিলাম। আর বাবাকে এভাবে রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে চোখের সামনে দেখার পর আবিষ্কার করলাম যে, আমার সমস্ত কাল্পনিক স্বপ্ন বালির বাঁধের মতোই চুরমার হয়ে গুঁড়িয়ে গেলো। একদিন ভোরে একটি স্বচ্ছ ধূসর গাড়িতে করে তিনি আমাদের স্টোরের সামনে এসে হাজির হলেন (তিনি নিশ্চয়ই এখানে এমন রাজকীয়ভাবে প্রবেশের করবেন বলেই শহরে ঢোকার আগে গাড়িটি পরিষ্কার করার জন্য পথে থেমেছিলেন)। বেইলি এসব ব্যাপারে খুব আগ্রহী। ও বলেছিল, গাড়িটি ছিল ‘ডি সোটো’ ব্র্যান্ডের। তার অতিকায় সাইজ দেখে আমি যারপরনাই বিস্মিত হলাম। তার কাঁধ এতই চওড়া ছিল যে, ভেবেছিলাম তিনি দরজা দিয়েই ঢুকতে পারবেন না। আমি জীবনেও তার মতো এত লম্বা কোনো লোক দেখিনি। আর তিনি যদি এত মোটা নাও হোতেন, কারণ আনি জানতাম যে, তিনি আগে এত মোটা ছিলেন না। কিন্তু তাও মনে হয়, তাকে এমনই একটি ভোঁটকা লোকের মতোই দেখতে লাগতো। তিনি তার তুলনায় খুব ছোট আর টাইট জামাকাপড় পরেছিলেন। স্ট্যাম্পের লোকজন যে ধরনের পোশাক পরতো তিনি সে ধরণের পোশাক পরে ছিলেন না। বরং তার পোশাক ছিল অনেক বেশি টাইট এবং উলেন (শীতকালে পরার পশমের তৈরি পোশাকের মতো)। তিনি ছিলেন আশ্চর্যরকমভাবে সুদর্শন।
মোমা কাঁদতে লাগলেন, ‘বেইলি আমার বাচ্চা! হে মহান ঈশ্বর! আমার বেইলি!’ এদিকে আংকেল উইলিও তোতলাতে লাগলেন, ‘বু-বাহ-বেইলেই।’ আমার ভাই বলে লাগলো, ‘ওহ হট ডগ! ড্যাম! এটাই তাহলে উনি! আমাদের বাপজান।’ আর আমার সাত বছর বয়সী হামটি-ডামটির সেই স্বপ্নের জগৎটি! সেই যে চিরতরে হারিয়ে গেলো, আর তাকে কখনোই জীবনে খুঁজে পাইনি।
তিনি ইংরেজিতে কথা বলছিলেন। আর তার গলার স্বর এমনই গমগম করছিল যে, মনে হচ্ছিল কোনো ধাতব দণ্ড দিয়ে কেউ স্টিলের বালতির গায়ে বাড়ি দিয়ে চলেছে। তিনি এতই শুদ্ধ ইংরেজিতে কথা বলছিলেন, মনে হচ্ছিল কোনো স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল কথা বলছিলেন। তারচেয়েও স্পষ্ট ও শুদ্ধ। আমাদের বাবা হেসে হেসে স্বাধীনভাবে যথেচ্ছ মুখভঙ্গি করে তার বাক্যগুলোতে অনেক শব্দেরই ভুলভাল উচ্চারণ মজা করে করেই করছিলেন। তিনি তার ঠোঁটগুলো স্বাভাবিক না রেখে সেগুলোকে উঁচু করে ফুলিয়ে ফুলিয়ে কথা বলছিলেন। যেভাবে আংকেল উইলিও কথা বলে। কিন্তু তিনি কথা বলছিলেন মুখ বেঁকিয়ে আর মাথা যেকোনো একদিকে হেলিয়ে স্টাইল করে করে। কিন্তু তিনি কখনোই তার ঘাড়টি সোজা রেখে কোনো কথাই বলছিলেন না। তিনি এমনই একজন বায়বীয় মানুষ ছিলেন, যিনি যা কিছু নিজের কানে শুনতেন, তার কিছুই বিশ্বাস করতেন না। এমনকী নিজে যা বলতেন, সেটাও না। আমার জীবনে দেখা তিনিই ছিলেন প্রথম একজন অস্থির ও ছিদ্রান্বেষী মানুষ।
‘ওহ তাই! এর! এটি বাবার এর! ছোট্ট বাচ্চা? বাবুটা, কেউ কি তোমাকে বলেনি এরের যে তুমি এর যে আমার মতোই দেখতে?’ তার এক হাত দিয়ে বেইলিকে আর অন্য হাত দিকে আমাকে আঁকড়ে ধরে ছিলেন।
‘আর এই যে তুমি বাবার ছোট্ট মেয়ে। তুমি হচ্ছ এরের খুব ভালো একটা বাচ্চা। এর তুমি কি সত্যি ভালো বাচ্চা না? হয়তো বা আমার মনে হয় এর আমি কথাটি শুনেছি, এর সান্তা ক্লোজের কাছ থেকে।’ আমি তাকে নিয়ে ভীষণ গর্বিত হতে শুরু করলাম। তিনি যে আমাদের শহরে এসেছেন, সেই গল্পটি সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ার জন্য অপেক্ষা করা আমার পক্ষে আসলেই দুঃসহ হয়ে উঠলো। শহরের সব বাচ্চারা কি হতবাক হয়ে যাবে না, যখন দেখবে আমাদের বাবা কী ভীষণ হ্যান্ডসাম? আর তিনি আমাদের এতই ভালোবাসেন যে, স্ট্যাম্প শহরে আমাদের শুধু একবার দেখতেই চলে এসেছেন। সবাই হয়তো বা তার কথা বলার ধরনধারণ নিয়ে আলোচনা কোরতে থাকবে। আর তিনি যে কত ধনী ব্যক্তি, সেটা তো তার গাড়ি ও পোষাকআষাকেই বোঝা যায়। নিশ্চয়ই ক্যালিফোর্নিয়াতে তার একটি দুর্গ আছে। (যদিও পরবর্তী সময়ে আমি অবশ্য জানতে পেরেছিলাম যে, তিনি আসলে সান্তা মনিকা’স প্লাস ব্রেকারস হোটেলের দারোয়ান।) আর তারপরেই নিজেকে তার সঙ্গে তুলনা করার ব্যাপারটা মনে হলো। আমি চাই না, যে-কেউ তাকে দেখে ফেলুক। আমি এতই সাধারণ যে, তার মতো অসাধারণ একজন মানুষ কখনো আমার সত্যিকার বাবা হতে পারে না। বেইলি ভীষণ স্মার্ট। সে নিশ্চয়ই তারই ছেলে। আর আমি? আমি নিশ্চয়ই একজন এতিম বাচ্চা। শুধু বেইলির খেলার সঙ্গী হিসেবে যাকে এতিমখানা থেকে নিয়ে এসে লালনপালন করা হচ্ছে।
চলবে…
খাঁচার পাখিরা কেন গান গায় আমি জানি-১২॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু