(পর্ব-১১)
কালো মানুষদের শিল্প-সংস্কৃতির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে আরকান্সাসের স্ট্যাম্পস। সুইচটি আছে জর্জিয়াতে। অনেক উঁচুতে ঝুলন্ত এলাবামা। মিসিসিপির নিগার! তোমরা তোমাদের ওপরে এসে পড়া সূর্যের আলোটাকে কখনো ডুবতে দিও না। কালোদের সম্পর্কে বর্ণনা করার মতো আর কোনো শহরের নাম কি তোমরা জানো? স্ট্যাম্পসের লোকজন বলাবলি করতো যে, আমাদের শহরের সাদারা এতই কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিল যে, শুধু ৪ জুলাই (আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস) অন্য কোনো সময়েই একজন নিগ্রো ভ্যানিলা আইসক্রিম কিনতে পারতো না। শুধু চকলেট আইসক্রিম খেয়েই তাদের অন্য সময়ে খুশি থাকতে হতো।
শুধু একটু ফ্যাকাসে রঙের কারণেই পুরো কালো সম্প্রদায় সাদা সবকিছু থেকে অনেক পিছিয়ে পড়েছিল। আর যে কারও জন্য এটাই যথেষ্ট স্বচ্ছ একটি কারণ ছিল সাদাদের প্রতি গদগদ ভাব দেখানোর জন্য। যেকোনো সাদার প্রতিই কালোদের ছিল অবজ্ঞা ও ভীতিমিশ্রিত উচ্চপ্রশংসার মনোভাব। এটি যেমন ছিল শাদা মানুষদের প্রতি ঠিক তেমনই ছিল তাদের সাদা ঝকঝকে বাড়ি গাড়ির প্রতিও। একইসঙ্গে সাদা নারী ও বাচ্চাদের প্রতিও। সর্বোপরি সাদাদের কাছে এতই ধনসম্পত্তি ছিল যে, তারা যথেষ্ট বেহিসাবি হয়ে খরচ করতো। আর এটাই ছিল ভীষণ ঈর্ষার কারণ। তাদের কাছে এত এত ড্রেস ছিল যে, তারা সম্পূর্ণ ভালো জামাগুলোও সেলাই ক্লাসে ডান করে দিতো। যেগুলো দিয়ে বড় মেয়েদের জন্য জামার নিচে পরার সেমিজ বা ব্রা তৈরির প্র্যাকটিস করা হতো।
এটা ঠিক যে নিগ্রো পাড়ায় নিজেদের মধ্যে খুব উদারতার চর্চা করা হতো। কিন্তু এটি আসলে ছিল কষ্টের দগদগে ঘায়ের ওপর মলম লাগানোর মতোই। যা-কিছু একজন কালো মানুষ আরেক জন কালো মানুষকে দিতো, তা ছিল মূলত একজন দাতা যেভাবে একজন গ্রহিতাকে দান করে, অনেকটা সেই রকম ব্যাপার। বাস্তবিক অর্থেই অনেক মূল্য দিয়েই এই দেওয়া-নেওয়ার প্রক্রিয়াকে জিইয়ে রাখা হয়েছিল।
সাদারা এত রাজকীয়ভাবে খরচাপাতি করার শক্তি ও সাহস কোথা থেকে পায়, তা আমি আসলে বুঝতে পারতাম। আমি নিশ্চিতভাবেই জানতাম যে আল্লাহ নিজেই একজন সাদা মানুষ! কিন্তু কেউ হাজার চেষ্টা করেও আমাকে এটা বোঝাতে পারেনি যে তিনিও প্রকৃতপক্ষে পক্ষপাতদুষ্ট একজনই।
আর এই সময়টিতে তাদের জুতো, জামা, বইপত্র ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্র কেনার জন্য তাদের ক্যাশ টাকার দরকার পড়তো।
ভাবতে অবাক লাগে যে ফকিন্নি সাদাদের তুলনায় আমার দাদির অনেক অনেক বেশি সহায়সম্পত্তি ছিল। আমাদের নিজেদের বিস্তৃত জমিজমা ও বাড়িঘরও ছিল। কিন্তু তা স্বত্বেও প্রতিদিন আমাকে আর বেইলিকে এই বলে সতর্ক করা হোতো যে, ‘আরও বেশি হিসাবী হও! কোনোরকম অপচয় করো না।’
প্রতিবছর গ্রীষ্মকাল ও শীতকালের জন্য মোমা দু’প্রস্ত কাপড় কিনে আনতেন। সেই কাপড় দিয়েই তিনি আমার জন্য স্কুল ড্রেস, জামার ভেতরে পরার সেমিজ, গ্রীষ্মে পরার ছোট পাতলা জামা, রুমাল, বানিয়ে দিতেন। আর বেইলির জন্য সার্ট ও ছোট প্যান্ট সেলাই করে দিতেন। আর নিজের জন্য তৈরি করতেন ঘরে পরার ড্রেস ও অ্যাপ্রন। আর সবার ব্যবহারের পর কাপড়ের রোলে যাকিছু অবশিষ্ট থাকতো সেই কাপড়টুকু সিয়ারস অ্যান্ড রোবাকের মাধ্যমে স্ট্যাম্পসে চলে যেতো। আমাদের পরিবারের মধ্যে শুধু আংকেল উইলিই ছিলেন যিনি সারাবছর রেডিমেইড ড্রেস পরতেন। প্রতিদিন তিনি ফ্রেস ধোয়া সাদা সার্ট আর ফুল তোলা ফ্লোরাল সাস্পেন্ডারস (কাঁধের ওপর দিয়ে ঝোলানো প্যান্ট আটকে রাখার বেল্ট) পরতেন। সেইসঙ্গে ২০ ডলার দিয়ে কেনা বিশেষভাবে তৈরি জুতো তিনি পায়ে দিতেন। আমি আংকেল উইলিকে মনে মনে একজন পাপিষ্ঠ-বাজে একজন লোক ভাবতাম। বিশেষকরে যখন সাতবার করে মাড় দেওয়া তার সার্টগুলোকে নিখুঁতভাবে টানটান করে আইরন করতে হতো আমাকে।
গ্রীষ্মকালে শুধু রোববার ছাড়া আমরা সবসময় খালি পায়ে চলাফেরা করতাম। আর আমরা শিখে ফেলেছিলাম কী করে জুতার তলা ক্ষয়ে গেলে নতুন তলা লাগাতে হয়। মোমা সবসময় বলতো অর্থনৈতিক মন্দা সাইক্লোনের মতো করে স্ট্যাম্পের শাদাদের ওপর আছড়ে পড়বে। কিন্তু কালোদের ওপর খুব ধীরে ধীরে ভীতসন্ত্রস্ত চোরের মতো করে এর প্রভাব আসবে। সত্যি সত্যি তাই হলো। পুরো দেশ যখন অর্থনৈতিক মন্দার তীব্র কষাঘাতে জর্জরিত তখনো স্ট্যাম্পের কালোরা তার কিছুই টের পায়নি। মন্দা শুরু হওয়ার দু’বছর পর তারা খুব ধীরে ধীরে ডিপ্রেশনের প্রভাব টের পেয়েছিল। আমার ধারণা অন্য সবকিছুর মতোই কালোরা ভাবতো যে, এসব মন্দা-ফন্দা আসলে শুধু সাদাদের জন্যই প্রযোজ্য। ফলে তাদের আসলে এখানে কিছুই বলা কওয়ার নেই।
বাস্তবিক অর্থেই আমাদের কালো মানুষগুলো মূল শহর থেকে অনেক দূরে বাস করতো। তারা তুলো তুলতো এবং সেগুলো কেটে ভাঁজে ভাঁজে সাজিয়ে রাখার মতো কাজগুলো করতো। আর এই সময়টিতে তাদের জুতো, জামা, বইপত্র ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্র কেনার জন্য তাদের ক্যাশ টাকার দরকার পড়তো। আর টাকা সংগ্রহের সময় যখন তুলো কোম্পানির মালিকরা এক পাউন্ড তুলো তোলার জন্য দশ সেন্ট থেকে কমিয়ে প্রথমে আট, সাত, ছয় এভাবে কমাতে কমাতে পাঁচ সেন্টে এসে পৌঁছালো তখনই প্রথম নিগ্রো সম্প্রদায়ের লোকজন বুঝতে পারলো যে অ্যামেরিকায় শেষপর্যন্ত অর্থনৈতিক মন্দা এসে গেছে। এই ডিপ্রেশন অন্তত শাদা-কালোর মধ্যে কোনো প্রকার বৈষম্য দেখায়নি।
চলছে…
খাঁচার পাখিরা কেন গান গায় আমি জানি-১০॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু