কোরিয়ান কবি কিম চুন সু’র জন্ম চুঙমু শহরে। ১৯২২ সালে একটি বিত্তশালী পরিবারে। সিউলের একটি মানসম্পন্ন হাই স্কুলে তিনি ছাত্র হিসেবে কাটান কিছুদিন। তবে সেখানে জাপানি এক শিক্ষকের সঙ্গে দ্বন্দ্বের পরিণামে সমাপণী পরীক্ষার আগেই বিদ্যালয় ত্যাগ করে চলে যান টোকিওতে। নিহন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব আর্টসে ভর্তি হন। কিছুদিন পর কবি সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেফতার হলে ডিগ্রি অর্জন করা সম্ভব হয়নি। সাত মাস কারাবাসের পর স্বদেশে ফেরেন। সেখানেও পরোয়ানা ঝুলছিল। তাই কবি ডায়মন্ডস্ মাউন্টেনস্ নামক নিসর্গনন্দিত একটি পার্বত্য অঞ্চলে আত্মগোপনে চলে যান।
১৯৪৫ সালে জাপানি ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে কোরিয়া স্বাধীনতা অর্জন করলে কবি তার জন্মশহর চুঙমুতে গিয়ে কিছু দিনের মতো থিতু হন। পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন হাই স্কুলে শিক্ষকতা। ওই সময় চুঙমু শহরে বাসরত অন্যান্য সাহিত্যিক, কবি, চিত্রকর ও সংগীত কলাকারের সঙ্গে মিলেমিশে সংযুক্ত হন একাধিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত কবি দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। অতপর জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে কবি ‘ব্রডকাস্টিং ডেলিবারেশন কমিটি’র সভপতির দ্বায়িত্বও পালন করেন।
পেশগত দায়-দায়িত্বের ব্যাপক ব্যস্থতার মধ্যেও কখনো কবিতার সঙ্গে কবি কিম চুন সু-এর সম্পর্কচ্যুতি ঘটেনি। তার প্রথম কবিতার বই ‘দ্য ক্লাউড অ্যান্ড দ্য রোজ’ প্রকাশিত হয়েছিল নিজ ব্যয়ে ১৯৪৮ সালে। ১৯৫০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘সোয়াম্প’ শিরোনামে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থটি। পরবর্তী জীবনে অনেক কবিতার বই ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশের ফলে কবি অর্জন করেন, ‘এশিয়ান ফ্রি লিটারেচার অ্যাওয়ার্ড (১৯৫৯)’ ও ‘কিয়াংসাঙ কালচার্যাল অ্যাওয়ার্ড ৯১৯৬৬)’ প্রভৃতি পদক। ১৯৮৮ সালে তিনি কোরিয়ার অ্যাকাডেমি অব আর্টসের সদস্য নির্বাচিত হন।
চিত্রকলার একজন মনযোগী পর্যবেক্ষক কবি। পাশ্চাত্যের কয়েকজন যশস্বী চিত্রকর যথা মার্ক শ্যাগাল, মিরো এবং গয়া প্রমূখের সৃষ্টিসম্ভার নিয়ে কবি প্রবন্ধ নিবন্ধ লিখেছেন। বোধ হয় এ কারণে—তার কবিতার কিছু বাকপ্রতিমা চিত্রকলার অনুরূপ। চিত্রকর পল সেজান বা জ্যাকসন পলাকের চিত্রশৈলীর কিছু কলাকৌশল তার পদাবলী সৃজনে ব্যবহার করেছেন বলে কবির স্বীকারোক্তি পাওয়া যায়। তবে বোদ্ধারা তার কবিতায় শনাক্ত করেন নীরিক্ষাধর্মিতার বৈশিষ্ট্য।
নিচে কবি কিম চুন সু’র পাঁচটি কবিতা অনুবাদ করা হলো। কোরিয়ান ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন কিম জং-গিল। ইংরেজি থেকে বাংলায় ভাষান্তর করেছেন মঈনুস সুলতান।
অনুপস্থিতি
যখন আউলা ঝাউলা বাতাস নাড়িয়ে দেয় তুমুল
কাঠের ফেন্সটি আওয়াজ তুলে, শব্দ হয় শোকাতুর।
কুঞ্জলতায় ফুটে ওঠা লোহিত কুসুম বা অপরাজিতার শুভ্র সুনীল
ফুটেছে আরও যারা এ মৌসুমে
শুকিয়ে ম্রিয়মান হয় নিঃশব্দে।
এমনকি কনকনে শীত ঋতুর মাঝামাঝি
যে নিঃসঙ্গ রোদ সিঁড়ির পাথরে বসে ঝিমাচ্ছিল
তাও অপসৃত হয় নিঃশব্দে।
শুধু সময় বয়ে যায়—নিস্তেজ…উদ্দীপনাহীন
বসবাস করে মানুষ স্বপ্নপল্লীতে,
থাকে না তারাও—চলে যায় একদিন নীরবে।
পুষ্প
তাকে নাম ধরে ডাকার আগে
কেবল একটি ভঙ্গি ছাড়া তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু্ ছিল না সে।
কিন্তু আমি যখন তাকে নির্দিষ্ট নামে সম্বোধন করলাম
কাছে এলো—
ফুটে উঠলো ফুল হয়ে।
এবার উচ্চারিত হয় আমার নাম
এ বর্ণের সাথে যার আছে মিল
এবং আমার গন্ধের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে
আমি তাকে নাম ধরে ডাকি—
যেন আমি যেতে পারি তার কাছে
এবং হতে পারি তার আপন কুসুম।
আমাদের সকলের এই আকাঙ্ক্ষা
কিছু একটা যেন হয়ে উঠি আমরা
তুমি আমার কাছে আর আমি তোমার
ইচ্ছা হয় হয়ে উঠি—ভোলা যায় না যে দৃষ্টিপাত।
পুষ্পের পূর্বরঙ্গ
আমি হচ্ছি এখন এক হিংস্র জন্তু।
যে মুহূর্তে আমার হাত স্পর্শ করে তোমাকে,
অন্ধকারে বিবর্তিত হও তুমি, অচেনা এবং অনেক দূরবর্তী।
কম্পমান পল্লবের অগ্রভাগে
প্রস্ফুটিত হও তুমি,
মিইয়ে আসো,
অনামা—রেখে যাও না কোনো নিশানা।
সারারাত আমি কাঁদি
নামহীন অন্ধকারে,
চোখের পাতা চুঁইয়ে গড়িয়ে নামে অশ্রু,
জ্বেলে যাই স্মরণের পিদিম।
আমার ক্রমশ ক্রন্দনে তৈরি হয় ঘূর্ণিঝড়,
কেঁপে উঠে মিনার,
আর প্রস্তরে প্রবিষ্ট হয়ে বিবর্তিত হয় স্বর্ণে।
মসলিনের নেকাবে অনন আচ্ছাদিত কনে আমার!
নিষ্পত্র বৃক্ষ; কবিতার একটি ভূমিকা
শীতের আকাশ হারিয়ে যায় রহস্যময়তার গহন গভীরে;
নিঃসীম, যা হয়তো—নিশ্চিত করে বলা মুশকিল—
বিলাসবহুল পত্রপল্লব ও ফল ঝরিয়ে
ফিগ প্রজাতির তরুবরটিকে করে তুলেছে নিষ্পত্র নগ্ন,
কিন্তু হয়তো বা পদাবলি প্রায় পৌঁছে যাচ্ছে
সংবেদনশীল শাখার অগ্রভাগে।
যে মুহূর্তে ঘুমিয়ে আছে ভাষা শব্দহীন,
হাসিমুখে এগিয়ে আসে অসীম
বিলাসবহুল পত্রপুষ্প ঝরে যায় যেন বিগত দিনের
হারিয়ে যাওয়া ঘটনা ঐতিহাসিক |
মার্ক শ্যাগালের গ্রামে তুষারপাত
মার্চ মাসে—মার্ক শ্যাগালের গ্রামে তুষারপাত হয় নিদারুণ।
মন্দিরের প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে একটি মানুষ প্রত্যাশা করে বসন্ত,
কেঁপে ওঠে পাথরের অভ্যন্তরে চুল চিকন শিরা,
কম্পমান মন্দিরে যেন পরশ বুলিয়ে দেয় শুভ্র তুষার,
নেমে আসে সহস্র ডানায় স্বর্গ থেকে—
ঢেকে যায় শ্যাগালের গ্রামটির প্রতিটি ছাদ ও চিমনি,
মার্চ মাসে যখন তুষারপাত হয়—
গ্রামের গাছপালায় রসালো হয়ে ওঠে ফল পাকুড়
আর চুল্লি-তন্দুরে নারীরা তৈরি করে সবচেয়ে উষ্ণ আগুন।