[ভূমিকার বদলে
আল-মাআরি (৯৭৩-১০৫৭), যার পুরো নাম আবু আল আলা আহমাদ ইবনে আবদুল্লাহ আল-মাআরি, তিনি আলেপ্পোর দক্ষিণে মাআরায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি আরব কবিদের মধ্যে একজন শ্রেষ্ঠ কবি হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আল-মাআরি চার বছর বয়সে গুটি বসন্তে আক্রান্ত হয়ে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আলেপ্পো, এন্টিওক ও সিরিয়ার অন্যান্য শহরে ভ্রমণ করেন। সেখানে বিদ্যা অর্জন করে অর্জিত জ্ঞান হৃদয়ে রেখে দেন।
আল-মাআরি তৎকালীন শিক্ষা ও কবিতার কেন্দ্রবিন্দু বাগদাদে ১৮ মাস কাটিয়েছিলেন, তারপর ফিরে গেলেন জন্মশহরে। সেখানে তিনি ‘লুজুমিয়াত’ রচনা করেন। লুজুমিয়াত হচ্ছে একটি বিশাল শ্লোকের সংগ্রহ। তার রচনাগুলো প্রচলিত কাঠামোর রচনাগুলোর গঠনশৈলীর বিপরীত এবং এর মধ্যে থাকা অভিমতগুলোও প্রচলিত মতের বিপরীত। মাআরায় তার উপস্থিতি অনেক লোককে আকৃষ্ট করেছিল, যারা তার কবিতা সংবলিত বক্তৃতা শুনতে আসতো।
নিজের সম্পর্কে আল-মাআরি লিখেছেন ‘তীব্র মনোভাব সম্পন্ন মানুষেরা আমাকে কঠোর তপস্বী বলে জানে, তবে তারা তাদের নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ভুল। যদিও আমি আমার আকাঙ্ক্ষাগুলো শৃঙ্খলাবদ্ধ করেছিলাম, তবে আমি কেবল জাগতিক আনন্দকেই ত্যাগ করেছি কারণ তাদের সেরাগুলো আমার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল।’
লুজুমিয়াতের চিন্তাগুলোর মধ্যে এমন ভাবপ্রবণতা রয়েছে যেগুলো যদি বহু ধর্মীয় বিশ্বাসের দ্বারা ঘেরাও করা না হতো, তবে সেগুলো ধর্মবিরোধের জন্য দায়ী হতো। আল-মাআরি বলেছিলেন, ‘আমি কল্পকাহিনি দ্বারা আমার শ্লোকগুলো সজ্জিত করতে চাইনি বা আমার পৃষ্ঠাগুলোকে প্রেমের প্রতিমা, যুদ্ধের দৃশ্য, মদ্যপানের বিবরণ দিয়ে পূরণ করতে চাইনি। আমার উদ্দেশ্য সত্য কথা বলা। তাই এর জন্য অবশ্যই আমার পাঠকদের আনুকূল্য প্রার্থনা করি নৈতিক কবিতার জন্য।’
সব ধরনের ধর্ম সম্পর্কে আল-মাআরির সংশয় আমাদের জেনোফেনস, কারভাকা ও লুক্রাটিয়াসের স্মরণ করিয়ে দেয়। একইসঙ্গে আলোকিত হওয়া অবধি পশ্চিমা চিন্তায় পুনরায় হাজির হয় না। তিনি মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের ধর্মের প্রতি সমানভাবে কৌতুকপূর্ণ ছিলেন। আল-মাআরি মন্তব্য করেছিলেন যে, তাদের উপাসনালয়ে সন্ন্যাসীরা বা তাদের মসজিদে উপাসনাকারীরা তাদের লোকালয়ের বিশ্বাসকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে চলেছে: যদি তারা অগ্নি উপাসক বা সাবিয়ানদের মধ্যে জন্মগ্রহণ করে, তবে তারা অগ্নিউপাসক বা সাবিয়ান হতে পারতো। আল-মা’আরি হলেন এক যুক্তিবাদী, যিনি ঐতিহ্য বা দৈববাণীর ওপরে যুক্তিকে মূল্যবান বলে গণ্য করেছিলেন। বুদ্ধ ও জৈনদের মতো আল-মাররি জীবনের পবিত্রতায় বিশ্বাসী ছিলেন। অনুরোধ করেছিলেন, যেকোনো জীবিত প্রাণীর ক্ষতি না করতে। তিনি নিরামিষভোজী হয়েছিলেন। সব ধরনের প্রাণীহত্যা এবং পোশাকের জন্য পশুর চামড়া ব্যবহারের বিরোধিতা করেছিলেন।
আল-মাআরি তার রচনায় এমন কিছু বিষয় স্বাধীনভাবে উত্থাপন করেছিলেন, যা অবশ্যই তার সমাজের বিশেষ সুবিধাভোগী সদস্যদের অসন্তুষ্ট করেছিল। তার রচনায় ‘মানব ট্র্যাজেডির ওপর তার ধ্যানমগ্নতার মধ্যে অন্যায়, ভণ্ডামি এবং কুসংস্কারের প্রতি চরম ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে।’ —অনুবাদক]
গুছিয়ে বলতে পারা একজন বন্ধু
গুছিয়ে বলতে পারা এক বন্ধুর কথা শুনতে শুনতে
নিরবে কেটে যাওয়া সময়ই দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত।
প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত জীবন কত দুর্দান্ত!
কিন্তু পুরোনো সময়গুলো মুখের তারুণ্যে ভরপুর:
তার ধ্বংস তাদের মূল জাতিকে করে খণ্ডিত।
প্রতিটি অঞ্চলের সময়প্রস্তুত করে তাদের কবর
কেউ কখনো রচনা করে না সময়ের কবর।
ভাষণ থেকে বিরত থাকো
যখনই মানুষ ভাষণ থেকে বিরত থাকে, তার শত্রু থাকে কম,
যদিও সে ভাগ্যের পরিহাসে নিচ দিকে পতিত হয় নির্মম।
নীল মাছি মানুষের রক্তে নিজেকে পূর্ণ করে নিঃশব্দে চুমে,
এভাবেই তার পাপের জঘন্যতা আসে কমে:
একটি ক্ষুধার্ত মশাকে সে করে না অনুসরণ,
সর্বত্র তোমাকে বিরক্ত করে মশার গুনগুন।
যদি একজন দুর্বিনীত মানুষ তোমাকে বিদ্ধ করে কথার তলোয়ারে,
তার প্রান্তটি ভেঙে দিতে, ধৈর্য্যের সঙ্গে বিরোধিতা করো তারে।
পুনর্জন্মকে অস্বীকার করো
আত্মারা বলে পূনর্জন্ম হতে
শরীর থেকে শরীরে, শুদ্ধ হওয়া পর্যন্ত;
সে আহ্বান সম্ভবত ভুল ভেবে তাকে অবিশ্বাস করো,
যদি না তোমার মন এই তথ্য করে নিশ্চিত।
যদিও তারা মাথা উঁচু করে, তাল গাছের মতো,
দেহগুলো কিন্তু তৃণের মতো বড় হয় আর যায় বিলীন হয়ে।
অতি মসৃণ উগ্র ধারালো তলোয়ারও হয়ে যায় ক্ষয়,
তোমার আত্মার বাসনাকে কমিয়ে দাও, বাঁচো শান্ত নির্ভয়ে।
বিজয়প্রতিশোধকে নিয়ে আসবে
যদি সময় তোমাকে বিজয়ী হতে সাহায্য করে, সে সাহায্য করবেই
তোমার বেনামী শত্রু হয়ে অচিরেই আসবে সম্পূর্ণ প্রতিশোধ নিতে।
দিনগুলোর মধ্যাহ্ন ভাগ আঘাতে ধ্বংস হয়ে অপসারিত হবে
যা ছায়া হয়ে আসবে অতীতের ভেজা স্যাঁতসেঁতে ভোর হতে।
দেহ তোমার ধারক
এই দেহ, যা তোমার জীবনকে আকৃতি দেয়,
সে তোমার ধারক: প্রতারিত হয়োনা, আমার আত্মা!
ধারণ করার জন্য বাটিটি অনেক মূল্যবান,
যদিও মধু সংরক্ষণ করার বাটি অনেক সস্তা।
প্রকৃতি থেকে আর চুরি নয়
তোমাদের উপলব্ধি এবং ধর্ম অসুস্থ।
আমার কাছে আসো, যাতে তুমি কিছু ধ্বনি শুনতে পারো সত্যের।
পানিতে ছেড়ে দেয়া মাছ অযথা খেয়োনা,
আর করোনা ইচ্ছা জবাইকৃত পশুর গোস্তখাওয়ার ,
অথবা যারা বিশুদ্ধ মনে করে মায়েদের সাদা দুধ
নিজ সন্তানদের জন্য নেয়, তারা নয় অভিজাত।
সরল পাখিদের দুঃখ দিও না তাদের ডিম কেড়ে নিয়ে আর;
অপরাধের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অপরাধ হচ্ছে অবিচার।
আর মধুকে নিষ্কৃতি দাও যা মৌমাছিরা পায় কঠোর পরিশ্রমে
সুবাসিত গাছের ফুল থেকে;
কারণ তারা এটি অন্যের জন্য সঞ্চয় করে না,
তারা এটি অনুগ্রহ আর উপহারের জন্যও জমা করে না।
আমি এইসব থেকে হাত ধুয়ে ফেলেছি; আর আশা করছি
আমার পথ আমি অনুভব করেছি আমার চুল ধূসর হওয়ার আগে।
মিথ্যা হলো অবিরাম ক্ষতি
যুক্তি আমাকে অনেক কিছু নিষেধ করেছে,
প্রবৃত্তিগতভাবে, আমার স্বভাব আকৃষ্ট হয়েছিল তাতে;
আর একটি ক্ষতি অনুভব করি যদি জানতে পারি,
আমি মিথ্যাকে বিশ্বাস করি অথবা অস্বীকার করি সত্যকে।
মানুষের পছন্দ কী?
লোকেরা যদি আমাকে পছন্দ করতো, তারা হতো বিস্মিত,
তাদের সুন্দরভাবে সত্যের পথে করেছি পরিচালিত।
অথবা কিছু সরল পথ যার দ্বারা
শিগগিরই সেখানে পৌঁছে যেতে পারে তারা।
এখানে বেঁচে আছি অক্লান্ত সময়ের ভেতর,
আর এটি আমার;
তারপর আমার হৃদয় চুমুক দিয়েছে
জীবনের অভিজ্ঞতার নির্যাসে।
মানুষের কীই-বা পছন্দ আছে নির্জনতা আর নিঃসঙ্গতা ছাড়া?
যখন ভাগ্য তাকে কিছুই দেয় না প্রার্থনা করা ছাড়া?
তুমি যা চাও তা করো,
শান্তি অথবা যুদ্ধ প্রতিষ্ঠা করো:
দিনগুলো করো অর্পণ খামখেয়ালি হাতের
হে মানুষ আর শান্তির যোদ্ধারা পরিমাপ করো তাদের।
নেতৃত্ব কিছুই নয় যুক্তি ছাড়া
তোমাদের দীর্ঘ পথ দীর্ঘ সময় কাটিয়েছ তোমরা,
হে রাজা ও অত্যাচারীরা,
আর এখনো তোমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা করো অবিচার,
যা পথে গর্বের পদধ্বনি আনে না, তা কি পীড়িত করে তোমাদের?
একজন মানুষ বিস্তৃত মাঠ নিতে পারে অধিকারে,
যদিও সে নিশ্চিত ভালোবাসে নিজের গৃহরে।
তবে কেউ কেউ আশাবাদী কণ্ঠের ঐশ্বরিক নেতার প্রত্যাশা করে
যিনি নীরবতার মাঝে জেগে উঠবেন চকচক করে।
এক নিরর্থক ভাবনা! নেতৃত্ব দেওয়ার কেউ নেই যুক্তি ছাড়া,
সকাল আর সন্ধ্যার রাস্তা নির্ধারণ করা।
মৃত্যুর বড় উপহার
একটি শহরে বসবাস থেকে কে আমাকে উদ্ধার করবে
যেখানে আমাকে প্রশংসার অযোগ্য বলা হয়েছে?
ধনী, ধার্মিক, জ্ঞানী: এইসব আমার খ্যাতি,
কিন্তু আমার আর এইসবের মাঝে অনেক বাধা দাঁড়িয়ে রয়েছে।
তবুও আমাকে জ্ঞানী ভেবেছিল কিছু মানুষ যদিও আমি অজ্ঞতা করি স্বীকার
এটি কি নয় আমাদের একটি অবাক করা নজির?
আসলে আমরা ভালো কিন্তু অকার্যকর সকলেই
অথচ আমি মহিমান্বিত নই বা তাদেরও ভিত্তি নেই।
জীবনের সরল বন্ধনীর দুর্লভ আলিঙ্গনে আবদ্ধ শরীর আমার
আমি কিভাবে চালিয়ে যাব ক্ষয় হওয়া আলিঙ্গন বৃত্তাকার?
হে মৃত্যুর বড় উপহার!
যন্ত্রনার পর
সে আমাদের জন্য শান্তি নিয়ে আসে,
আর শব্দের পর নীরবতা আনে।
আরও পড়ুন: