[বিশ শতককেই যেখানে বলা হয় মানবসভ্যতা-সাহিত্যের অগ্রগতির শ্রেষ্ঠ শতক, সেই বিশ শতক তো বটেই এবং একুশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত একনায়কদের স্বৈরশাসনের ফলে মানবাধিকার, রাজনীতি, বাকস্বাধীনতা প্রায় রুদ্ধ হয়ে পড়েছিল আরব দেশগুলোয়। নির্যাতন আর শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি পাননি লেখকেরাও। নিজেদের অধিকারের কথা বলার কারণে বহু আরবি সাহিত্যিক জেলখানায় বন্দি হয়েছিলেন, অনেকে হয়েছিলেন নির্বাসিতও।
২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিউনিশিয়ার ফলবিক্রেতা বু আজিজির আত্মহননের মধ্য দিয়ে প্রথমে তিউনিশিয়ায় ব্যাপক গণজাগরণ বা আরববসন্তের সূচনা ঘটে। তারপর একে-একে মরক্কো, মিশর, ইয়েমেন, লিবিয়াসহ সব আরব দেশে তা ছড়িয়ে পড়ে। স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একে-একে বিদায় নেন অনেক আরব স্বৈরশাসক। আরববসন্তের পালাবদলে এখন সেসব দেশে এসেছে নতুন সরকার। এ পালাবদলে আরবি লেখকদের প্রত্যাশা কতটা পূর্ণ হয়েছে, তারা কতটা স্বাধীনভাবে লিখতে পারছেন—এসব নিয়ে আরবি লেখকদের মনোভাব জানিয়ে সম্প্রতি জার্মানির বার্লিন লিটারারি ফেস্টিভ্যালে আরব লেখকদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রেখেছিলেন মরক্কোর বিখ্যাত কবি ও ঔপন্যাসিক তাহার বেন জিলন।
১৯৪৪ সালে মরক্কোর ফেজ শহরে জন্মগ্রহণকারী তাহার ১৯৬৬ সালে দেশটির শাসকগোষ্ঠীর হাতে কারাবন্দি হন। এরপর ১৯৭১ সালে ফ্রান্সে নির্বাসিত হন এবং এখনো তিনি ফ্রান্সেই বসবাস করছেন। তাঁর বিখ্যাত দুটি গ্রন্থ, ‘দ্য স্যান্ড চাইল্ড’ ও ‘রেসিজম এক্সপ্লেইনড টু মাই ডটার’। বই দুটি ৩০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ ফরাসি সাহিত্য পুরস্কার গ্র্যান্ড প্রিক্স লিটারারি প্রাইজ, জার্মানির অন্যতম সাহিত্য পুরস্কার এরিক মারিয়া রেমার্ক লিটারারি প্রাইজ ও আইরিশ সাহিত্য পুরস্কার ডাবলিন ইন্টারন্যাশনাল লিটারারি অ্যাওয়ার্ড। বার্লিন লিটারারি ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠানে জার্মান শিল্প-সাহিত্যবিষয়ক ম্যাগাজিন ‘দার স্পিগেল’-এর পক্ষে জার্মান লেখক ও সাংবাদিক জেস স্মি তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেন। সাক্ষাৎরটি জার্মান থেকে সরাসরি ভাষান্তর করা হয়েছে। ভূমিকা ও ভাষান্তর: শাহনেওয়াজ বিপ্লব]
জেস স্মি: ‘আরববসন্ত’—এই শব্দবন্ধটি আপনি পছন্দ করেন?
তাহার বেন জিলন: আসলেই টার্মটি আমার খুব পছন্দ। বলা যায়, আরবদের জন্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের একটি চমৎকার উপহার ‘আরববসন্ত’ শব্দবন্ধটি। যদি বলা হতো আরববিদ্রোহ, তাহলে হয়তো সেটা যথাযথ হতো না। কারণ, বিদ্রোহে জড়িয়ে থাকে কোনো গোষ্ঠী বা দল কিন্তু বসন্তে জড়িয়ে আছে সবাই। আরববসন্ত—জনগণেরই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
জেস স্মি: ‘আরববসন্ত’ আরবি সাহিত্যকে কতটা প্রভাবিত করেছে?
তাহার বেন জিলন: আরবি সাহিত্যকে আরববসন্ত কতটা প্রভাবিত করেছে—তা আগামী দিনের আরবি সাহিত্যই বলে দেবে। তবে আরববসন্তের যে সুফলটি আরব লেখকেরা এখন ভোগ করছেন, সেটি হচ্ছে—আরবের লেখকেরা এখন স্বাধীনভাবে, স্বৈরশাসকদের পরোয়া না করেই লিখতে পারছেন।
জেস স্মি: স্বৈরশাসকদের সময়ে আরবের লেখকদের অবস্থা কী রকম ছিল?
তাহার বেন জিলন: স্বৈরশাসকদের সময়ে তো লেখকদের ওপর প্রচুর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। সরকারের চাপিয়ে দেওয়া নানারকম বিধিনিষেধ তো ছিলই, এ ছাড়া লেখকেরা নিজে থেকেও ভয়ের ভেতর থাকতেন—লেখার মাশুল কতটা গুনতে হবে, সেই ভয়ে। এমনকি যাঁরা নির্বাসনে ছিলেন, তাঁরাও ভয়ে অনেক কথা লিখতেন না—পরিবারের কথা ভেবে।
জেস স্মি: তো, আরববসন্তের পর আরব লেখকেরা কি নিজেদের দেশে ফিরেছেন?
তাহার বেন জিলন: অনেক আরব লেখকই দেশে ফিরে গেছেন। যেমন মিসর, লিবিয়া বা ইরাক—যেসব দেশে মোটামুটি শান্তি ফিরে এসেছে।
জেস স্মি: লেখকেরা ছাড়া সাধারণ আরবদের ভাবনাটা এখন কী রকম?
তাহার বেন জিলন: আরব দেশগুলো সুদীর্ঘ সময় ধরে স্বৈরশাসকের হাতে শাসিত হয়েছে। আরববসন্তের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসকদের বিদায়ের পর ধীরে ধীরে সব ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আসছে। কিন্তু জনগণ চায়, এ পরিবর্তনের গতি আরও দ্রুত হোক। তা না হওয়ায় তরুণ প্রজন্ম বেশ হতাশ।
জেস স্মি: তরুণদের এত হতাশার কারণ কী?
তাহার বেন জিলন: আসলে একটি দেশে পরিবর্তন আনতে গেলে কখনো কখনো এক প্রজন্ম পর্যন্ত সময় লেগে যায়। কিন্তু আরববসন্তে যেসব তরুণেরা পথে নেমেছেন, জীবন বাজি রেখেছেন; তাঁরা পরিবর্তনের জন্য এক প্রজন্ম পর্যন্ত অপেক্ষা করতে কোনোভাবেই রাজি নন। সে জন্য বহু আরব তরুণ হতাশ হয়ে এখন ইউরোপে অভিবাসিত হচ্ছেন।
জেস স্মি: তরুণদের বাইরে আরবের সাধারণ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা এখন ঠিক কী রকম?
তাহার বেন জিলন: আরবের অনেক দেশেই এখনো প্রচুর প্রশাসনিক দুর্নীতি আছে। স্বৈরশাসকের বদলে সাধারণ মানুষের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বটে; কিন্তু প্রশাসনিক দুর্নীতির চিত্রটি ঠিক একই রকম সব জায়গায়। রাতারাতি এই পরিবর্তনও খুব কঠিন।
জেস স্মি: ২০১১ সালে প্রকাশিত আপনার ‘আরববসন্ত’ বইয়ে আরব স্বৈরশাসকদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার জন্য আপনি ইউরোপীয় রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আপনার এ ক্ষোভের কারণ কী?
তাহার বেন জিলন: ইউরোপিয়ান রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে এ ক্ষোভের যুক্তিসঙ্গত কারণ তো অবশ্যই আছে। ইউরোপিয়ান রাজনীতিকরা আরবের সাধারণ মানুষের স্বার্থকে কখনো প্রাধান্য দেননি; বরং অর্থনীতি আর তেলবাণিজ্যকেই সবসময় প্রাধান্য দিয়েছেন।
জেস স্মি: এখন ইউরোপীয় রাজনীতিবিদ বা সরকারগুলো আরব লেখকদের কিভাবে সহায়তা করতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
তাহার বেন জিলন: এখন ইউরোপীয় সরকারগুলোর সহায়তাই বরং বেশি দরকার আরব লেখকদের জন্য। ইউরোপের সব ভাষাতেই আরবি লেখকদের লেখা আরও বেশি করে অনূদিত হওয়া দরকার। এর ফলে ইউরোপিয়ান লেখকদের সঙ্গে আরব লেখকদের একটা সম্পৃক্তি গড়ে উঠবে। আর এই সম্পৃক্তি বাড়ানোর জন্য ইউরোপিয়ান লেখকদের অনুষ্ঠানে আরব লেখকদের আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে।
জেস স্মি: তরুণ আরবি লেখকদের উদ্দেশে আপনার কী উপদেশ?
তাহার বেন জিলন: পড়তে হবে এবং পড়তেই হবে। ব্যাপক পড়াশোনাই একজন লেখকের সফল হওয়ার পথে প্রধান সহায়ক। কিন্তু কম্পিউটারের কারণে আরবের তরুণ লেখকদের ক্ষেত্রে পড়াশোনায় ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে। আরব সাহিত্য বা সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে হলে তাদের অন্য দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে হবে।