অনুবাদ: ফারহানা রহমান
[পর্ব-৪]
[ড. মায়া অ্যাঞ্জেল্যু—আমেরিকান কবি। তার জন্ম ১৯২৮ সালের ৪ এপ্রিল। মিসোরি রাজ্যের সেন্ট লুইস শহরে। ছিলেন একাধারে, কণ্ঠশিল্পী, অভিনেত্রী, নাট্যকার, শিক্ষক ও একজন জীবনীকার। তার পুরো নাম মার্গারেট অ্যানি জনসন।
১৯৯৩ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি তার নিজের লেখা কবিতা ‘পালস অব মর্নিং’ আবৃত্তি করেন। এজন্য পরে গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডও পান। ইতোপূর্বে ১৯৬১ সালে একমাত্র কবি রবার্ট ফ্রস্টই প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘দ্য গিফট আউটরাইট’ কবিতাটি আবৃত্তি করার সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন।
১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা নিজের অভিষেক অনুষ্ঠানে মায়া এঞ্জেলোর কবিতা পাঠ করে তাকে সম্মান দেখান। কর্মজীবনে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। সমগ্র পৃথিবীর ৭০টিরও বেশি ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি সম্মাননা পান। প্রায় ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট বা ডক্টর উপাধি পান।
১৯৬৯ সালে তার প্রথম আত্মজীবনী ‘আই নো হোয়াই দ্য কেজড বার্ড সিংস’ বইটি প্রকাশিত হলে বিশ্বব্যাপী তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। বইটি পরবর্তী দুবছর ধরে নিউ ইয়র্ক টাইমস এর বেস্ট সেলার তালিকায় সর্বোচ্চ স্থান দখল করে ছিল। ২০১৪ সালের ২৮ মে সকালে অ্যাঞ্জেল্যু চিরনিদ্রায় চলে যান। চিন্তাসূত্রের জন্য এই মহান লেখকের আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড ‘আই নো হোয়াই দ্য কেজড বার্ড সিংস’-এর বাংলা অনুবাদ করেছেন কথাশিল্পী-কবি-অনুবাদক ফারহানা রহমান। নাম দিয়েছেন, ‘আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়’। আজ প্রকাশিত হলো চতুর্থ পর্ব]
দক্ষিণের কোনো একটি শহরের সঙ্গে অন্য শহরের পার্থক্য কী? উত্তরের শহর থেকে হেমলেট বা সিটি হাই রাইজের সঙ্গে অন্য শহরগুলোর পার্থক্য কী? উত্তর নিশ্চয়ই অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে। ছেলেবেলার উত্তরহীন প্রশ্নগুলো অবশেষে শহরে ফিরে যায়। উত্তরও খুঁজে পায়। বীরপুরুষ বা জুজুর ভয় দেখানো মানুষগুলো, মূল্যবোধ ও অপছন্দের বিষয়গুলো প্রথমেই বাধা পায় নতুন শহরে এসে। গোড়ার দিকের পরিবেশের সঙ্গে তা মিশে যায়। পরবর্তী বছরগুলোয় তারা তাদের চেহারা, স্থান, এমনকী তাদের রঙও বদলে ফেলে। তারা তাদের কর্মকৌশল, তীব্রতা ও জীবনের লক্ষ্যগুলোও পরিবর্তন করে ফেলে। আবার সেসব মুখোশের খোলসের নিচেই তারা তাদের শৈশবের কোমল মুখটি কানটুপির নিচে ঢেকে রাখে চিরজীবন ধরে।
মিস্টার ম্যাকএলরয় ছিলেন ভীষণ লম্বা চওড়া একজন মানুষ। যদিও বছরের পর বছর তার কাঁধ থেকে মাংসপেশী ক্ষয়ে যাচ্ছিল। আমি যখন তাকে চিনতাম, তখন তার সেই প্রশস্ত পেশী আর নেই, হাত বা পায়ে নয় বরং বিশাল বপু নিয়ে তিনি স্টোরের ঠিক পাশের বিরাট র্যাম্বলিং হাউজটিতে থাকতেন।
স্কুলে তিনিই একমাত্র নিগ্রো ছিলেন, যাকে আমি চিনতাম। যিনি ম্যাচিং করে জ্যাকেট ও প্যান্ট পরতেন। একসময় জানতে পারলাম—পুরুষদের জন্য এ ধরনের পোশাক কিনতে পাওয়া যায়। যাকে স্যুট বলে। আমি আগে মনে করতাম, ফর্সা লোকদেরই শুধু এই পোশাক মানায়। কারণ স্যুট পরলে পুরুষদের কম ম্যানলি, কম ভয়ঙ্কর ও কিছুটা মেয়েলি মনে হয়।
বড়রা যখন আমার শরীরের আকৃতি নিয়ে নানা উল্টোপাল্টা মন্তব্য করতো, তখন বেইলি তার রুম থেকে আমার দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে থাকতো।
মিস্টার ম্যাকএলরয় কখনো জোরে হাসতেন না। এমনকী খুব কমই তিনি মৃদু হাসতেন। তার একমাত্র ভালো গুণ ছিল, তিনি আংকেল উইলির সঙ্গে মাঝে-মাঝে কথা বলতেন। কখনোই চার্চে যেতেন না। আমার আর বেইলির চোখে তিনি অত্যন্ত সাহসী একজন ব্যক্তি ছিলেন। এভাবে জীবন কাটাতে পারা সত্যি কতই না মহৎ ব্যাপার! ধর্মকে মোটেই গুরুত্ব না দিয়েই জীবনযাপন করা; তাও আবার মোমার মতো একজন অতি ধার্মিক মানুষের পাশের বাসায় থেকে।
তিনি যেকোনো সময় যেকোনো কিছুই ঘটিয়ে ফেলতে পারেন বলেই আমি ওই সময় বিশ্বাস করতাম। তার প্রতি কোনোরকম ক্লান্তি বা বিরক্তি বোধ করতাম না। আর তার কাছ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন বা আলাদাও ভাবতাম না। যদিও বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে এখন তাকে খুবই সাধারণ ও নীরস একজন মানুষ বলেই মনে হয়। যিনি স্যাম্প মহানগরের আশেপাশের শহরগুলোতে (গ্রামগুলোতে) সাধারণ জনগণের কাছে নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ ও টনিক বিক্রি করতেন মাত্র।
মিস্টার ম্যাকএলরয় আর দাদির মধ্যে বিশেষ কোনো বোঝাপড়া ছিল বলে মনে হতো। আমি নিশ্চিত যে, এটা ছিল। কারণ খেয়াল করতাম, আমরা তার বাড়ির গণ্ডির ভেতর বা উঠোনে গেলেও তিনি কখনোই কিছু বলতেন না। গ্রীষ্মের দীর্ঘ রৌদ্রকরোজ্জ্বল বিকেলগুলোতে আমি প্রায়ই আর উঠোনের চায়নাবেরি গাছের ছায়ায় বসে থাকতাম। চায়নাবেরি ফল থেকে আসা তীব্রগন্ধে চারপাশ ম-ম করতো। এ সময় বেরির রস খাওয়া মাছিদের ভনভন শব্দে আমার ঘুম চলে আসতো। তখন তিনি খয়েরি থ্রিপিস পরে বারান্দার দোলনায় বসে দোল খেতেন। সেই সময় তার খড়ের তৈরি টুপিটি পোকামাকড়ের ভারে ও ঘূর্ণিতে মাঝেমাঝে ঢুলতে থাকতো।
মিস্টার ম্যাকএলরয়ের কাছ থেকে সারাদিনের জন্য মাত্র একবারই সম্ভাষণ আশা করা যেতো—‘সুপ্রভাত বাচ্চারা’ বা ‘শুভ বিকেল শিশুরা’। এছাড়া সারাদিনে তিনি একটি শব্দও করতেন না। বাসার সামনের রাস্তায় বা কুয়ার পাশে অথবা ছোঁয়াছুঁয়ি খেলার সময় তার বাড়ির পেছনে কখনো সঙ্গে দেখা হলেও তিনি কখনো কোনো কথা বলতেন না।
আমার ছেলেবেলার জীবনে তিনি একজন রহস্যময় ব্যক্তিই হয়ে রইলেন। প্রকাণ্ড বড় বড় জানালাবিশিষ্ট বিশাল বারান্দা দিয়ে বাড়ির চারপাশটা ঘেরা ছিল। আর প্রচুর জমিসহ একটি বাড়ির মালিক ছিলেন তিনি। ছিলেন স্বাধীন কালো মানুষ! তিনি ছিলেন স্যাম্পের ওই সময়ের একজন ব্যতিক্রমধর্মী মানুষ।
আমার পৃথিবীতে বেইলিই ছিল শ্রেষ্ঠ মানুষ। আর এটাই সত্যি যে—সে ছিল আমার ভাই। আমার একমাত্র ভাই সে। আমার আর কোনো ভাইবোন ছিল না—যার সঙ্গে বেইলিকে শেয়ার করে নেওয়া যেতো। এটা সত্যি সত্যি আমার জন্য ভীষণ সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল—আমি শুধু বেইলির কারণেই খ্রিস্টধর্ম পালন করতে পেরেছি। আমি গডের কাছে এজন্য খুবই কৃতজ্ঞ। যেখানে আমি ছিলাম বেশ বড়সড়ো আর বিশাল হাতওয়ালা একজন মানুষ। যে প্রতিটি কাছে বিপত্তি ঘটাতো বা বাধাপ্রাপ্ত হতো। সেখানে বেইলি ছিল ছোটখাটো, কমনীয় ও মসৃণ একজন বালক। আমার বিশ্রী গায়ের রঙের জন্য আমি যখন আমার খেলার সাথীদের কাছ থেকে আজেবাজে মন্তব্য শুনতাম, তখন বেইলি তার মখমল কালো ত্বকের জন্য সবার প্রশংসা পেতো। তার মাথাজুড়ে কালো কোঁকড়ানো তুলতুলে চুলগুলো ছড়িয়ে পড়ে থাকতো। আর আমার মাথায় থাকতো স্পাতের উলের মতো মোটা মোটা কালো চুল। কিন্তু এত অসামঞ্জস্যের পরও বেইলি আমাকে খুব ভালোবাসতো।
বড়রা যখন আমার শরীরের আকৃতি নিয়ে নানা উল্টোপাল্টা মন্তব্য করতো, তখন বেইলি তার রুম থেকে আমার দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে থাকতো। আর আমি জানতাম এর প্রতিশোধ নেওয়া ওর জন্য শুধু একটু সময়ের ব্যাপার। আমার পৃথিবীতে জন্মানো নিয়ে বয়স্ক মহিলারা যেভাবে বিস্ময় প্রকাশ করতো, সে কথাগুলো বেইলি চুপচাপ আগে শুনতো। তারপর শীতল ভৌতিক স্বরে সে বলতো, ‘ওহ! মাইজারিজ কোলম্যান, আপনার ছেলে কেমন আছে? তাকে সেদিন দেখে মনে হচ্ছিলো যে, সে এতই অসুস্থ—যেকোনো সময় মরে পড়ে থাকবে।’
শেষপর্যন্ত আমার হার্টবিট বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে তারপর সে থামতো। পরে আবারও হা হা করে হাসতে হাসতে খেলায় ফিরে আসতো।
মহিলাটি উত্তর দিতো—‘আগাস্ট! এসব কী বলছ? মরে যাবে? কিন্তু কেন? ও তো অসুস্থ না।’ এরপর বেইলি আগের চেয়েও শীতল ভয়ঙ্কর গলায় মাথা উঁচু করে বলে উঠতো—‘আরও জঘন্য কুৎসিত হতে হতে।’ জিভ কেটে, দাঁত কড়মড় করে আমি আমার হাসি আটকাতাম। খুব গম্ভীর মুখে হাসিহাসি ভাবটা লুকিয়ে রাখতাম। পরে বাড়ির পেছনের কালো আখরোট গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে হা হা করে হাসতে হাসতে আমরা দুজন গড়াগড়ি খেতাম।
বেইলি তার দুষ্টুমির জন্যও কম শাস্তি পেতো। কারণ সে ছিল হ্যান্ডারসন-জনসন পরিবারের গর্ব! পরে যখন সে আমাদের একজন পরিচিতের কাছে এসব দুষ্টুমির বর্ণনা করতো, তখন সেসব ঘটনাকে তেল মেরে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে গ্রহণযোগ্য করে বলা হতো। আমি যতটুকু সময়ের কথা ভাবতাম, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় সে এসব করার জন্য পেতো। আমার চেয়ে অনেক আগেই সে অনেক বেশি টুকটাক কাজ করে ফেলতো। এমনকী অনেক বেশি হোমওয়ার্ক ও বেশি বেশি বইও সে পড়ে ফেলতে পারতো। পাহাড়ের পাশের অববাহিকায় যে দলটির সঙ্গে সে খেলাধুলো করতো, তাদের মধ্যে বেইলিই ছিল সবার সেরা। চার্চে গিয়ে শব্দ করে প্রার্থনা করতে পারতো। ফলের কাউন্টারের নিচে বসে থাকা আংকেল উইলির নাকের সামনে থেকেই ব্যারেল থেকে আচার পর্যন্ত চুরি করে ফেলতো।
একদিন দুপুরবেলা খাবারের সময় স্টোরটি কাস্টমারে ভর্তি হয়ে ছিল। ঠিক এমন সময় বেইলি একটি ছাঁকনি ব্যারেলে ঢুকিয়ে দিয়ে দুটো মোটা আঁচারের বোতল তুলে আনলো। যেগুলোকে আমরা খাবার ও ময়দার গুবরে পোকা থেকে বাঁচানোর জন্য ব্যারেলের মধ্যে পানি দিয়ে ভরে সেখানে রেখেছিলাম।
বেইলি আঁচারগুলোকে ছাঁকনির ভেতর ঢুকিয়ে উঠিয়ে নিলো। ব্যারেলের এক পাশে নিয়ে পানি ঝরিয়ে ফেললো। স্কুলের শেষ ঘণ্টাটা বাজতেই সে ছাঁকনি থেকে পানি ঝরে যাওয়া মোটামুটি শুকনো আঁচারটি তুলে নিলো। আর সেটিকে পকেটে পাচার করে দিয়ে ছাঁকনিটাকে কমলার ঝুড়ির পেছনে ছুড়ে মারলো। এরপর আমরা স্টোর থেকে পালিয়ে আসলাম। এটি ছিল গ্রীষ্মের দুপুর তাই বেইলি ছোট একটি শর্টস পরে ছিল। ফলে তার ধূসর রঙের পাগুলো আঁচারের রসে ভিজে একাকার হয়ে গেলো। সে তার পকেট ভরে থাকা লুটের মাল নিয়ে খুশিতে লাফাতে থাকতো। ব্যাপারটা কেমন হলো—এমন দুষ্টুমির হাসিতে তার চোখ চকচক থাকতো। তার গা থেকে সিরকার মতো অথবা টকটক দেবদূতের মতো গন্ধ ভেসে আসতো।
আমাদের সকালের টুকটাক কাজ শেষ হয়ে গেলে মোমা আর আংকেল উইলি স্টোরের দিকে মনোযোগ দিতেন। আমরা ওই সময় অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতাম—যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে চিৎকার চেঁচামিচি শুরু না হতো। লুকোচুরি খেলার সময় তার গলা খুব সহজেই চেনা যেতো। বেইলি গাইতো—‘গতরাতে, পরশুরাতে আমার বাসায় ২৪ জন ডাকাত পড়েছিল। তোমরা যারা সবাই লুকিয়ে আছো, বেরিয়ে এসে আঘাত করো। আমি তোমাদের গুরু। মাথার ওপর বোঁবোঁ করে রোলিং পিন ঘুরাচ্ছি। কারা তোমরা সবাই লুকিয়ে আছ?’ নেতাকে অনুসরণ করতে হলে, স্বভাবতই তাকে সবচেয়ে বেশি সাহসের কাজগুলো করে দেখাতে হবে। এছাড়া, নানা চমক সৃষ্টি করতে জানতে হবে। আর যখন কেউ চাবুকের গোড়ায় বসে ফোঁসফোঁস করে তখন তাকে আগাটাও ঘোরাতে জানতে হয়! বনবন করে ঘোরা, সাঁই করে নিচে নামা। শেষপর্যন্ত আমার হার্টবিট বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে তারপর সে থামতো। পরে আবারও হা হা করে হাসতে হাসতে খেলায় ফিরে আসতো।
ছেলেবেলার ছোট পরিসরে স্যাম্পের কালো মানুষদের এলাকাটাকে মনে হতো সম্পূর্ণ একটি পৃথিবী।
একটি নিঃসঙ্গ শিশুর যা কিছু দরকার হয়। যা কিছু পেলে সে তৃপ্ত হয়। যদি কিছু আশা করার মতো থাকে, সেগুলোকে পূর্ণ করার আশা। একজন দৃঢ় ঈশ্বরের কাছথেকে কঠিন সব জিনিস চেয়ে নেওয়ার মতোই! আমার এই সুন্দর কালো ভাইটিই ছিল আমার পুরো রাজত্ব।
প্রত্যেকটি জিনিসকে পারলে সংগ্রহ করে রাখাই ছিল স্ট্যাম্পসের নিয়ম। প্রথম তুষারপাতের পর যখন পশুগুলোকে হত্যা করা শুরু হতো, প্রতিবেশীরা সবাই একে অন্যকে শূকর জবাই করতে ওই সময় সাহায্য করতো। বড় বড় চোখের শান্তশিষ্ট গরুগুলো, যেগুলো দুধ দেওয়া বন্ধ করে দিতো, সেগুলোকেও জবাই করা হতো।
খ্রিষ্টান মেথোডিস্ট এপিসকোপাল চার্চের মহিলারা মোমাকে শুকরের মাংসের সসেজ বানাতে সাহায্য করতো। নিচে রাখা মাংসগুলোর গভীরে তারা তাদের মোটা মোটা হাতগুলো কনুই পর্যন্ত ডুবিয়ে দিতো। ঋষির ধ্যান ভাঙানোর মতো সুগন্ধী গোলমরিচ ও লবণ দিয়ে তারা সেগুলোকে মাখাতো। যেসব ভদ্র-বাধ্য বাচ্চা মসৃণ কালো কালো সব চুলোর জন্য দূর থেকে কাঠ সংগ্রহ করে নিয়ে আসতো, তাদের প্রথমেই খুব মজাদার ছোট ছোট সব সসেজের স্যাম্পল তৈরি করে দেওয়া হতো। পুরুষরা মাংসের বড় বড় টুকরোগুলোকে ছোট ছোট করে কেটে রান্না করার জন্য বিশাল কয়লার চুল্লির ভেতর ঢুকিয়ে দিতেন। তারা তাদের ভয়ঙ্কর ছুরিগুলো দিয়ে মাংসের গিঁটগুলো কেটে অপ্রয়োজনীয় হাড়গুলো ছাড়িয়ে দিতেন। এরপর মাংসের মধ্যে লবণ মাখাতেন, ছোট ছোট সুক্ষ্ণ নুড়ির মতো দেখতে মোটা বাদামি লবণ। আর মাংসের আবরণের ওপর তখন রক্তের ক্ষুদ্র কণাগুলো চিকচিক করতো।
পরবর্তী তুষারপাতের আগ পর্যন্ত সারাবছরব্যাপী আমরা ধোঁয়ার (কয়লার) চুল্লি ও স্টোরের পাশের ছোট বাগান থেকে খাবার সংগ্রহ করে খেতাম। এমনকী সারি সারি শ্যাল্ভস ভরে রাখা সাজানো টিনজাত খাবারগুলো থেকেও নিয়ে খেতাম। শ্যাল্ভ বা তাকগুলোতে সাজানো বিচিত্র খাবারগুলো দেখে ক্ষুধার্ত বাচ্চাদের মুখে জল চলে আসতো। মাখনের ভাপা বিস্কুটগুলোর মধ্যে সবুজ মটরশুঁটি, লেটুস পাতা, বাঁধা কপি, রসালো লাল টোম্যাটো যা কিছু দেওয়া থাকতো, সেসব সঠিক সময়ের পর পর কামড়ের সঙ্গে সঙ্গে কড়মড় করে দাঁতের নিতে পড়তো। এছাড়া, সসেজ, বিট, স্ট্রবেরি ও আরও যতরকম ফল আরাকান্সাসে পাওয়া যেতো, তার সবই তাকেই স্তরে স্তরে সাজানো থাকতো।
এত ধরনের খাবার থাকার পরও মোমো মনে করতেন শিশু হিসেবে অন্তত বছরে দুবার আমাদের ফ্রেশ খাবার খাওয়া উচিত। শহরে গিয়ে পশুর কাঁচা কলিজা কিনে নিয়ে আসার জন্য ওই সময় আমাদের অর্থাৎ বেইলির কাছে টাকা-পয়সা নিকেল আর ডাইমস (অ্যামেরিকার দশ সেন্টের রুপার কয়েন) দেওয়া হতো। যেহেতু সাদা মানুষদের ফ্রিজ ছিল ফলে তাদের কসাইরা টেক্সারকানার (টেক্সাসের একটি শহর) বাণিজ্যিক কসাইখানা থেকে মাংস নিয়ে আসতো। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়েও ধনী ব্যক্তিদের কাছে সেগুলো বিক্রি করতো। ছেলেবেলার ছোট পরিসরে স্যাম্পের কালো মানুষদের এলাকাটাকে মনে হতো সম্পূর্ণ একটি পৃথিবী। পথে যার সঙ্গেই দেখা হতো তাকে সম্ভাষণ করতে পারলেই আমরা কৃতজ্ঞবোধ করতাম। আর বেইলি রাস্তায় দেখা হয়ে যাওয়া প্রত্যেকটি বন্ধুর সঙ্গে কয়েক মিনিট ধরে খেলতে বাধ্য হতো। পকেটে টাকা নিয়ে শহরের যাওয়ার মজাই ছিল আলাদা। আমাদের হাতেও থাকতো যথেষ্ট সময়। কিন্তু শহরের অন্য অংশে যেখানে সাদা মানুষদের বসবাস ছিল সেখানে পৌঁছালেই সব আনন্দ উবে যেতো। হোয়াইটফক্সভিলের আগের স্টপেজ মিস্টার উইলি উইলিয়ামসের ডু ড্রপ ইন, যখন আমরা ছেড়ে আসতাম, আমাদের একটি পুকুর অতিক্রম করে আসতে হতো। সেই সঙ্গে সমান্তরাল রেলপথের ওপর দিয়ে আমরা নানা দুঃসাহসিক অভিযান চালাতাম। মানুষখাদক প্রাণীদের অঞ্চলের মধ্যে আমরা ছিলাম অস্ত্রহীন অভিযাত্রী।
স্ট্যাম্প শহরের মানুষের মধ্যে এতটাই বৈষম্য (পৃথকীকরণ) ছিল যে বেশিরভাগ কালো শিশু, একেবারেই জানতো না যে সাদা মানুষ দেখতে আসলে ঠিক কেমন? এছাড়া, তারা একেবারে অন্যরকম ছিল। ভীষণ ভীত। এসব ভয়ের মধ্যে ছিল শত্রুতার ভয়। ক্ষমতাশালীদের বিপক্ষে ক্ষমতাহীনদের হেনস্তার ভয়, ধনীদের বিপক্ষে দারিদ্র্যতার ভয়। এছাড়া, ছিল কাজের মালিকদের বিপক্ষে কর্মীদের আর ভদ্রস্থ পোশাকধারীদের বিপক্ষে জরাজীর্ণ পোশাকধারীদের ভয়। আমার মনে পড়ে আমি কখনোই বিশ্বাস করিনি যে, সাদা মানুষ সত্যি সত্যি বাস্তবেও আছে।
তাদের কখনোই মানবজাতি হিসেবে ভাবা হতো না। তারা ছিল সাদা জাতি।
হেঁশেলে কাজ করা বহু নারী আমাদের স্টোরে কেনাবেচা করতেন। তারা যখন তাদের মালিকদের পরিচ্ছন্ন কাপড়গুলো ধোপাখানা থেকে শহরে নিয়ে যেতেন, তখন তারা প্রায়ই আমাদের সামনের বারান্দায় নিজেদের ওই ঝুড়িগুলো রেখে দিতেন। আর সেখান থেকে কোনো একটি শক্ত করে মাড় দেওয়া ঝকঝকে ইস্ত্রি করা কাপড় নিয়ে সবাইকে দেখাতেন যে, তাদের ইস্ত্রি করার হাত কতই না দারুণ! তাদের এইসব কাপড়ের মালিকরা প্রকৃতপক্ষে কতই না ধনী আর ঐশ্বর্যবান!
আমি কিন্তু সেইসব কাপড়ের খোঁজ করতাম যা তারা তখনো দেখা যায়নি। আমার ধারণা ছিল সাদা মানুষরা শুধু আংকেল উইলির মতোই শর্টস পরে, যেন তারা হিস্যু করার সময় সহজেই তাদের ওই বিশেষ জিনিসটা বের করে ফেলতে পারে। আর সাদা নারীদের সম্পর্কে আমি ভাবতাম যে, সবাই যেমন করে বলে আসলে তাদের স্তনগুলো তাদের জামার সঙ্গেই তৈরি করে আঁটকে দেওয়া থাকে সেটা আসলে ঠিক না। কারণ আমি তাদের ব্রাগুলো ঝুড়ির মধ্যেই অনেকবার দেখেছি আর সেগুলোর ভেতর তাদের স্তনগুলো আঁটকে থাকতে দেখিনি। তবে, তারা যে সত্যিকারের মানুষ সেই ব্যাপারে আমি নিজেকে কখনোই বুঝ দিতে পারতাম না। তাদের আমি সবসময়ই কাল্পনিক মানুষই মনে করতাম। মিসেস ল্যাক্রন, মিসেস হ্যানড্রিক্স, মোমা, রিভেরেন্ড স্নিড, লিলি বি, লুইস ও রেক্স তাদেরই সত্যিকারের মানুষ বলে মনে হতো। ওইসব সাদা জাতিগোষ্ঠী কখনোই মানুষ হতে পারে না। কারণ তাদের পাগুলো খুব ছোট ছোট। তাদের গায়ের চামড়া একদম সাদা আর স্বচ্ছ। তারা তাদের পায়ের গোড়ালিতে ভর দিয়ে অন্য মানুষদের মতো করে হাঁটে না বরং তারা হিল পায়ে দিয়ে ঘোড়ার মতো করে হাঁটে।
আমার শহরের দিকটায় যেসব মানুষ থাকে তারাই হচ্ছে আসল মানুষ। যদিও আমি তাদের সবাইকে ঠিক পছন্দ করতাম না। প্রকৃতপক্ষে কাউকেই খুব একটা পছন্দ করতাম না। তবে তারা মানুষ ছিল। কিন্তু ওইসব ফ্যাঁকাসে প্রাণীগুলো যারা শহরের অন্যপ্রান্তে থাকতো, তাদের জীবনযাপন ছিল অস্বাভাবিক। তারা ছিল ভিনগ্রহের প্রাণী। তাদের কখনোই মানবজাতি হিসেবে ভাবা হতো না। তারা ছিল সাদা জাতি।
চলছে…
আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-৩॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু