অনুবাদ: ফারহানা রহমান
পর্ব-৪৩
এভাবেই আরও একটি দিন শেষ হয়ে যেতো। আলোছায়া-ঘেরা ভোরের আঁধারে তুলোর ট্রাক এসে তার মোটা পেট থেকে তুলো তোলার শ্রমিকদের কর্মস্থলে উগড়ে বের করে দিতো। আর ওই সময় সব শ্রমিক নেমে গেলে খালি ট্রাকটি দৈত্যের বায়ু ত্যাগ করার মতো বিকট গর্জন করে উঠোন ছেড়ে রাস্তার দিকে রওনা হয়ে যেতো। কয়েক মুহূর্তের জন্য শ্রমিকরা সেখানে হতবিহবল হয়ে এমনভাবে টক্কর দিতো, যেন তারা অপ্রত্যাশিতভাবে কোনো একটি অচেনা জায়গায় চলে এসেছে। তারা তখন হতবুদ্ধি হয়ে বোকার মতো আচরণ করতো।
স্টোরের ভেতর সেসব পুরুষদের চেহারাগুলো দেখা ছিল ভয়াবহ যন্ত্রণার একটি কাজ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমার এ ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিল না। তখন তারা তাদের পরিশ্রান্ত চেহারাগুলো ঢাকার জন্য মুখে এমনভাবে নকল হাসি ফুটিয়ে তুলত যেন তাদের কিছুই হয়নি, যেন তারা একদম ঠিক আছে, একটুও পরিশ্রান্ত নয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তাদের মনের চাহিদা মেটাতে তাদের দেহগুলো ওই সময় একেবারেই অস্বীকৃতি জানাতো। এমনকি যখন তারা জোর করে হাসতে চেষ্টা করতো, তখনো তাদের কাঁধগুলো ক্লান্তির ভারে নুইয়ে পড়তো। আর যখন তারা উচ্ছ্বাস প্রকাশের জন্য হাত দুটোকে গর্ব করে প্যান্টের পেছনের পকেটের কাছে রাখতো, তখন তাদের হাতের তালুগুলো কোমর থেকে এমনভাবে খোসে পড়তো, যেন সেখানে মোম গলিয়ে পিচ্ছিল করে রাখা হয়েছে।
‘শুভ সন্ধ্যা! সিস্টার হ্যান্ডারসন! দ্যাখো না সেখানেই ফিরে এসেছি যেখান থেকে শুরু করেছিলাম।’
মোমা এমনকি সামান্য সাফল্যও নিজের কাছে না রেখে তাদের অভিনন্দন জানিয়ে বলতেন, ‘অবশ্যই স্টুয়ার্ড ভাই! একদম ঠিক বলেছ জনাব! ঈশ্বরের কাছে হাজার শুকরিয়া যে যেখান থেকে শুরু করেছিলে সেখানেই আবার ফিরে আসতে পেরেছ তোমরা!’
এসময় আমি আর বেইলি মোমাকে হাতের কাজে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করতাম অথচ আংকেল উইলি উঠোনে বসে বসে তাদের সঙ্গে গালগল্প করতেন। তারা সারাদিন ধরে কে কী কাজ করেছে, সেগুলো সম্পর্কে জানতে চাইতেন।
এসব অতি সাধারণ জনগণ যাদের প্রতিদিনের অতীত ইতিহাস এমনকি ভবিষ্যৎ পর্যন্ত অবলুপ্তির পথেহুমকির মুখে পর্যবসিত হয়েছিল তারা মনে করতো যে শুধু ঐশ্বরিক শক্তির বলেই তারা এখনো বেঁচে আছে। তাদের এই সংকীর্ণ জীবনবোধ দেখে আমি আশ্চর্য হতাম। তারা ভাবতো তাদের এই দুর্বিষহ দারিদ্র্য নিয়ে বেঁচে থাকাও আসলে ঈশ্বরের ইচ্ছের ওপরই নির্ভর করছে। কিন্তু যেহেতু মানুষের জীবনযাত্রার মান এবং শৈলী তার প্রতিনিয়ত বস্তুগত উন্নতির মাপকাঠিতে বিচার হওয়ার মাধ্যমে সে ক্রমাগত সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। ফলে ঈশ্বরও মানুষের এই সমৃদ্ধির গতির ওপর নির্ভর করেই একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ উপায়ে প্রত্যেকের প্রতি তার নির্দিষ্ট দায়িত্ব বণ্টন করে থাকেন।
‘আর এটাই মূল কারণ যে সেই সকল প্রশংসার যোগ্য। হ্যাঁ আপনি ঠিক বলেছেন ম্যাম! সবকিছুই ঈশ্বরের দয়ার উপর নির্ভর করছে।’ দেখে মনে হচ্ছে যে তাদের অভারল(কাঁধের সঙ্গে বেল্ট দিয়ে ঝোলানো লম্বা প্যান্ট। -অনুবাদক) এবং শার্টগুলো যেন কেউ কোনো একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে ছিঁড়ে ফালিফালি করে দিয়েছে। আর তাদের দেখলে এটা অন্তত বোঝা যায় যে গত কয়েক ঘণ্টা ধরে তুলোর আভা ও ধুলো পড়ে পড়েই তাদের মাথার চুলগুলো পুরোপুরি ধূসর হয়ে গেছে।
পুরুষের ফেলে দেওয়া জুতোগুলো পরে কাজ করতে করতে নারীদের পাগুলো ফুলে একেবারে ঢোল হয়ে যেতো। কাজ শেষে ফিরে এসে, সারাদিন ধরে তুলো তোলার ফলে ধুলো ময়লায় মাখামাখি হওয়া তাদের দেহটিকে তারা কূপের জল দিয়ে ধুয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করার চেষ্টা করতো।
তাদের এভাবে সারাদিন ধরে বলদের মতো কাজ করাকে ভীষণভাবে ঘৃণা করতাম। আমার আরও বেশি লজ্জা লাগলো এটা দেখে যে, তারা কাজের ব্যাপারে এমন একটা আলগা ভান করতো, যে কাজটা আসলে এতটা খারাপ নয়; যা বাইরে থেকে দেখে মনে হয়। আংশিক কাঁচ দিয়ে ঘেরা ক্যান্ডি কাউন্টারের কাছে গিয়ে তারা যখন একেবারেই ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে ঝুঁকে পড়তো, তাদের দেখে আমার খুবই বলতে ইচ্ছে হোতো যে, দয়া করে তোমরা একটু মানুষের মতো সোজা হয়ে দাঁড়াও, ‘দয়া করে ভেবে দ্যাখো আসলে একজন মানুষের অঙ্গভঙ্গি ঠিকক্যামন হওয়া দরকার!’
কিন্তু আমি যদি এ ধরনের একটি শব্দও উচ্চারণ করতাম অর্থাৎ আমি যদি আমার মুখ খুলতাম তাহলে মোমা হয়তো পিটিয়েই আমার পিঠের চামড়া উঠিয়ে ফেলতেন। এসব তুলো শ্রমিকের দেহের ভারে যে ক্যান্ডি কাউন্টারের কাঠের মেঝেতে চিড় ধরে গিয়েছিল, সেটা পর্যন্ত মোমা দেখেও না দেখার ভান করতেন। তিনি হেসে হেসে তাদের সঙ্গে আন্তরিক কথাবার্তা চালিয়ে যেতেন। তাদের নির্দেশ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সবাইপাতি সরবরাহ করতেন। মোমা জিজ্ঞেস করতেন, ‘বাসায় গিয়ে এখন নিশ্চয়ই তুমি তোমার রাতের খাবার রান্না করবে তাই না? সিস্টার উইলিয়াম?’ এসময় আমি আর বেইলি মোমাকে হাতের কাজে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করতাম অথচ আংকেল উইলি উঠোনে বসে বসে তাদের সঙ্গে গালগল্প করতেন। তারা সারাদিন ধরে কে কী কাজ করেছে, সেগুলো সম্পর্কে জানতে চাইতেন।
সিস্টার উইলি মোমাকে উত্তর দিতেন, ‘না, না ম্যাম! ঈশ্বরের অনেক দয়া যে কালকের অবশিষ্ট অনেক খাবারই আজকের জন্য রয়ে গেছে। নতুন করে রান্নার দরকার নেই। আমরা বাড়িতে গিয়ে সমস্ত নোংরা জামাকাপড় পরিষ্কার করবো। কারণ আমাদের আজকে চার্চে গিয়ে পুনরুজ্জীবন সভায় যোগ দিতে হবে।’
মোমার প্রতি নানা মানুষের সম্ভাষণ ভেসে আস্তে লাগলো, ‘শুভ সন্ধ্যা! সিস্টার! ক্যামন আছ তোমরা?’
এই ভয়াবহ ক্লান্ত দেহমন নিয়ে তাহলে এখন এদের চার্চে যেতে হবে? সারাদিনের অমানুষিক পরিশ্রমে পরিশ্রান্ত দেহকে পালকের বিছানায় একটু বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ না দিয়েই তাহলে এরা এখন চার্চে যাবে সভা করতে? এসব দেখে আমি একটি ব্যাপারই উপলব্ধি করতে পারলাম যে, আমাদের এই কালো মানুষগুলো আসলে ম্যাজাকিস্ট (এমন ব্যক্তি যারা অন্যের দ্বারা অত্যাচারিত ও অপমানিত হওয়ার মাধ্যমে সুখ বা আনন্দ বোধ করে। -অনুবাদক) হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে? আর এই যে দারিদ্র্য-নিষ্পেষিত জীবন, যা ওরা নিজের ভাগ্য হিসেবে মেনে নিয়েছে। সেটা প্রকৃত অর্থেই এদের ভাগ্যের সঙ্গে এতটুকু সম্পর্কিত নয়। বরং এই কালো মানুষগুলো এই তুচ্ছাতিতুচ্ছ জীবনকেই ভালোবাসে। ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে আসলে এভাবেই তারা তাদের জীবন কাটাতে চায়।
মোমা তখন বলতেন, ‘আমি বুঝতে পারছি সিস্টার উইলিয়াম যে তুমি আসলে কী বলতে চাইছ। তুমি তোমার শরীরের ক্ষুধার মতো আত্মার ক্ষুধাও মেটাতে চাও। ঈশ্বরের আজ্ঞা হলে আমিও আমার বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে চার্চে আসছি। জানো তো পবিত্র বইয়ে লেখা আছে যে, আমাদের পিতা যেভাবে চলেছেন, আমরা যেন বাচ্চাদেরও সেভাবেই জীবনে চলতে শিক্ষা দেই। আর তাতেই পিতা (যিশু) সবসময় তাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকবেন।’
‘আর সেটাই পবিত্রগ্রন্থে উল্লেখ করা রয়েছে। একেবারেই সেটাই।’
রেল লাইনের কাছে মাঠের মধ্যে একটি সমতল জায়গায় কাপড় দিয়ে তাঁবু তৈরি করা হয়েছিল। নরম মসৃণ ঘাস ও তুলোর বল দিয়ে মাটির ওপরটা কারপেটিং করা হয়েছিল। কলাপসিবল চেয়ারের পাগুলো নরম মেঝের ভেতর ডুবে ছিল। তাঁবুগুলোর ঠিক মাঝখান বরাবর কাঠের ক্রুশটি সটান দাঁড়িয়ে ছিল। তাঁবুতে প্রবেশের পথে যেখানে যাজকের মঞ্চটি অবস্থিত, তার ঠিক পেছনের একটি খাম্বার সঙ্গে বৈদ্যুতিক বাতিটি ঝুলে ছিল। অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাইরের খুঁটির সঙ্গে ঝুলে থাকা বাতিগুলো অবিরামভাবে আলো দিয়ে চলেছিল।
গভীর অন্ধকারের ভেতর দুলতে থাকা বৈদ্যুতিক বাতিগুলোকে দূর থেকে কী ভীষণ নিঃসঙ্গ ও উদ্দেশ্যহীন যে দেখাচ্ছিল! মনে হচ্ছিল, ওরা যেন একেবারে অনর্থকভাবেই শুধু তাদের আলো বিলিয়ে চলেছে। সেই ঝাপসা উজ্জ্বল আলোয় ত্রিমাত্রিক হয়ে আছে, তাঁবুটি এই তুলোক্ষেতের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, সেটা এতই অচেনা আর অপ্রত্যাশিত একটি জিনিস যে, এটি হয়তো আমার চোখের সামনেই হঠাৎ করে উড়ে দূরে কোথায় হারিয়ে যাবে।
বলা নেই, কওয়া নেই, আকস্মিকভাবে অজস্র মানুষ সেই উজ্জ্বল আলোর অস্থায়ী চার্চের দিকে ধেয়ে আসতে লাগলো। বড়দের গুরুগম্ভীর গমগমে আওয়াজে চারপাশটা ছেয়ে গেলো। মোমার প্রতি নানা মানুষের সম্ভাষণ ভেসে আস্তে লাগলো, ‘শুভ সন্ধ্যা! সিস্টার! ক্যামন আছ তোমরা?’
মোমা উত্তর দিলেন, ‘সবই ঈশ্বরের দয়া! ভালোভাবে বেঁচেবর্তে থাকার অবিরাম চেষ্টা করে চলেছি মাত্র।’
ওই সময় ঈশ্বরের আত্মার সঙ্গে বিলীন হয়ে যাওয়ার জন্য তারা মনেপ্রাণে নিজেদের সমর্পিত করে চলেছিল। মানুষের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ নিয়ে আলোচনা করে সময় নষ্ট করার মতো একটুও সময় কারও হাতে ছিল না।
চলবে…
আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-৪২॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু