(পর্ব-৪০)
সারা সপ্তাহের কাজের দিনগুলো একটি চাকার মতো করেই ঠিক একই রকমভাবে আবর্তিত হতে থাকে। প্রতিটি দিনই যেন ঠিক আগের দিনটিরই হুবহু প্রতিচ্ছবি। গত দিনটির মতোই স্থির ও এতটাই অনিবার্য যে, তাদের মনে হয় তারা যেন গতকালের একটি রাফ খসড়ার আসল রূপ। তবে যাই হোক না কেন, শনিবারগুলো কিন্তু অন্যসব কাজের দিনগুলোর নির্ধারিত ছাঁচ ভেঙে ফেলে দিয়ে নতুন একটি রূপে আসার মতো সাহস সবসময়ই দেখায়।
এই দিনটিতে কৃষকরা তাদের বউ-বাচ্চা দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে শহর চষে বেড়ায়। তাদের মাড় দিয়ে ইস্তিরি করা শক্ত খাকি প্যান্ট এবং সার্টগুলো দেখলেই বোঝা যায় যে, এসবের আড়ালে তাদের স্ত্রী আর মেয়েদের কতটা নিবিড় যত্ন এবং পরিশ্রম লুকিয়ে রয়েছে। তারা প্রায়ই আমাদের স্টোরে এসে খাওয়ার পরের বিল পরিশোধ করা খুচরা পয়সাগুলো নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতো। তারা দিনের পর দিন এই খুচরা পয়সাগুলো জমিয়ে রাখতো যেন, যখন তাদের ছোট-ছোট ছেলে-মেয়েরা শহরে আসার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে দিন গুনতে থাকবে। ওই সময় যেন তারা এই খুচরোগুলো শহরে আসার আগে তাদের বাচ্চাদের হাতে সেসব তুলে দিতে পারে। অথচ তাদের শিশু-কিশোর বয়সী বাচ্চাগুলো তাদের বাবাদের এসব আচরণের জন্য খোলাখুলিভাবেই যারপরনাই বিরক্তি প্রকাশ করতো। এসব দেখে ওই সময় আংকেল উইলি বাচ্চাগুলোকে দোকানের ভেতরে ডেকে নিয়ে গিয়ে ওদের হাতে পরিবহণের সময় ভেঙে যাওয়া মিষ্টি বাদামের প্যাটিসগুলো ধরিয়ে দিতো। বাচ্চাগুলো মুখ থেকে ক্যান্ডিগুলো বের করে প্যাটিস খাওয়ার জন্য আবারও স্টোরের বাইরে চলে যেতো। রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পথে ছড়িয়ে থাকা ধুলোর পাউডারে ফুটবলের মতো করে লাথি মারতে থাকতো। একইসঙ্গে সময় মতো শহরে পৌঁছাতে পারবে কি না, সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে পায়চারী করতে থাকতো।
বেইলি চায়নাবেরি গাছের পাশে বসে বসে ওর বয়সী অন্য ছেলেদের সঙ্গে মাম্বেলদিপেগ (বাচ্চাদের এক ধরনের খেলা) খেলতো। আর মোমা এবং আংকেল উইলি তখন বর্তমান সময়ের সারাদেশের কৃষকদের হালহকিলত সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করতেন। আমি ওই সময় নিজেকে স্টোরের ভেতরে এসে পড়া আলোর রোশনির মধ্যে বন্দি হয়ে থাকা ধুলোকণার মতো মনে করতাম। যেমন করে আলোর রোশনির মধ্যে ধূলিকণাগুলো বাতাসের ঝাঁপটায় একবার ভেতরের দিকে ঢুকে যায় আবারও বাইরের দিকে সরে আসে। কিন্তু সেগুলো কখনোই আর মায়াময় অন্ধকারের ভেতর নিজেকে মুক্ত করে ছেড়ে দিতে পারে না। ঠিক ওই রকম।
গরমকালের সকালগুলো তাড়াহুড়ো করে কুয়োর ঠাণ্ডা জলে নিজেকে পরিষ্কার করার মাধ্যমে শুরু হতো। রান্নাঘরের দরজার পাশের নিচের জায়গাটিতেই সাবানের কেসটা রাখা থাকতো। এটাকে পোকামাকড়ের ঘরবাড়ি ডাকা হতো (বেইলি ওই সময় পোকামাকড়দের পালতো)। গ্রীষ্মের দিনগুলোতে, ভোরের প্রার্থনার পর টাটকা দুধের সঙ্গে শুকনো সিরিয়াল মিশিয়ে আমরা নাস্তা সারতাম। আর এরপরেই শুরু হতো শনিবারসহ অন্য কর্মদিবসের প্রাত্যহিক কর্মসূচি। মেঝে ঘষামাজা করা, বাড়ির সামনের পেছনের উঠোনগুলো ঝাড়ু দেওয়া, রবিবারের জন্য আমাদের জুতোগুলোকে চকচকে করে পালিশ করা ইত্যাদি কাজ করতে হতো। আর আমাদের কাজ দেখে (আংকেল উইলিও বিস্কুট খেতে খেতে খুশিতে জ্বলজ্বল করতেন) এবং একইসঙ্গে তিনি বিস্কুট খেতে খেতে স্টোরে সদাইপাতি কিনতে আসা, শনিবারে অর্থাৎ সপ্তাহান্তে তাড়াহুড়ো করে কাজ শেষ করা একের পর এক ঘরমুখী ক্রেতাদের অবিশ্রামভাবে সামাল দিয়ে যেতেন।
অতীতের সেই সব অবিস্মরণীয় বছরের কথা যখন আমি মনে মনে ভাবি। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে খেয়াল করি যে ওই সময় সপ্তাহের অন্যান্য দিনের তুলনায় শনিবারগুলোই ছিল আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয়। আমি জেনেছিলাম যে, এভাবেই একের পর এক অন্তহীন কাজের ভেতর থেকেও কী যে এক অপরিসীম আনন্দের নির্যাস পাওয়া যায়! আর শিশুরা যেহেতু কোনো কিছুর বিকল্প খুঁজে বের করতে পারে না। ফলে তাদের সহ্য করার ক্ষমতাও হয় একেবারে অসীম।
সেইন্ট লুইস থেকে ফিরে আসার পর থেকেই মোমা আমাদের বাড়ির এসব কাজের জন্য সাপ্তাহিক হিসেবে কিছু বেতন দিতেন। শুধু দোকানের ক্যাশ বক্স থেকে টাকাগুলো নেওয়া ছাড়া; ব্যবসা থেকে অর্জিত টাকার শতকরা দশ ভাগ টাকা চার্চে দান করা ছাড়া মোমা যেহেতু টাকাপয়সা নিয়ে খুব কমই লেনদেন করতেন। আমার মনে হয় আমাদের সপ্তাহ শেষে এই যে দশ সেন্ট করে হাতখরচ দেওয়া হয়, সেটা তিনি করতেন। কারণ তিনি বোঝাতে চাইতেন যে, আমাদের জীবনটা আর আগের মতো নেই। সবকিছুর ভেতরেই একটা বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। আর এই যে মাঝখানে কয়েক বছর মোমার কাছ থেকে চলে এসে আমরা সেইন্ট লুইসে ছিলাম। পরবর্তী সময়ে আবার এই স্ট্যাম্পসে ফিরে এলাম। এসবই হয়তো তার কাছে একটি পরিবর্তিত রূপ বলেই মনে হতো। আমাদের সঙ্গে তিনি আগন্তুকের মতোই ব্যবহার করতেন।
সপ্তাহ শেষে পাওয়া সেই দশ সেন্ট আমি প্রায় সবসময়ই বেইলিকেই দিয়ে দিতাম। বেইলি প্রতি শনিবারেই সিনামা দেখতে যেতো। সিনেমা দেখে আসার পথে ও আমার জন্য স্ট্রিট অ্যান্ড স্মিথ কাউ বয়ের বইগুলো কিনে নিয়ে আসতো।
একমাত্র কাছের মানুষ। ও যদি মরে যায় তাহলে যত সর্বনাশ হবে সেটা আমার হবে। অন্য কারও কিছুই হবে না। আমার যা কিছু আছে প্রকৃতপক্ষে আমার অস্তিত্ব ওর ওপরেই নির্ভর করছে।
এক শনিবার রাতে বেইলি রিএলটো (থিয়েটার) দেখে অনেক রাত করে বাড়িতে ফিরল। ওই সময় মোমা শনিবার রাতের স্নান করার জন্য জল গরম করছিলেন। সেদিন সন্ধ্যার সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো শেষ হয়ে গিয়েছিল। গোধূলি বেলার মায়াবি আলোতে আংকেল উইলি সামনের বারান্দায় বসে বসে গুনগুন করে একটি গান গাইছিলেন। হাতে তৈরি করা একটি সিগারেটে সুখ টান দিচ্ছিলেন। ওই সময় দেখতে দেখতে চারদিকে ঘন সন্ধ্যা নেমে এলো। মায়েরা তাদের মাঠে দল বেঁধে খেলারত বাচ্চাদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। বাচ্চাদের স্টোরের কাছে হুড়োহুড়ি করে খেলার শব্দ এবং হা হা করে হাসাহাসির শব্দ, আমাকে কেউ ধরতে পারেনি বলতে বলেতে ঝাপাঝাপি করার শব্দগুলোও ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগলো।
আংকেল উইলি বললেন, লাইটটা জ্বালিয়ে দিলে খুব ভালো হতো, বোন!
শনিবারগুলোতে আমরা স্টোরে ইলেকট্রিক লাইট জ্বালাতাম। যেন শেষমুহূর্তে রোববারের জন্য কেনাকাটা করার ক্রেতারা টিলার ওপর দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার সময় দেখতে পায় যে স্টোরটি তখনো খোলা আছে। মোমা সেই শনিবার রাতে আমাকে লাইট জ্বালাতে বলেননি। কারণ তিনি আসলে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে, এত রাত হয়ে গেছে অথচ বেইলি এই রহস্যময় সীমাহীন অন্ধকারের মধ্যে তখনো বাড়ির বাইরে রয়ে গেছে।
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মোমা রান্নাঘরের চারপাশে অস্থির হয়ে পায়চারী করতে লাগলো। তার নিঃসঙ্গ চোখে-মুখে আতঙ্কের সমুহ চিহ্ন ফুটে উঠলো। দক্ষিণের এই কালো নারীরা যারা তাদের সন্তানদের, নাতি-নাতনিদের এবং ভাইপো-ভাইজিদের কোলেপিঠে করে মানুষ করে গড়ে তুলতেন, তারা তাদের মায়ার বাঁধনে এদের সবাইকে হৃদয়ের পরতে পরতে সূক্ষ্ম জালের সঙ্গে বেঁধে রাখতেন। তাই প্রাত্যহিক নিয়মের কোনো ব্যত্যয় তাদের জন্য অসহনীয় যন্ত্রণার কারণ হয়ে দেখা দিতো। আর এই কারণেই বর্তমান জেনারেশন আসার আগপর্যন্ত দক্ষিণের কালো মানুষদের আমেরিকার প্রাচীন স্থাপত্যের সংরক্ষক হিসেবে ডাকা হতো।
আত্মগ্লানিতে ভোগা বেশিরভাব মানুষদের মতো আমার কখনোই আত্মীয়-স্বজনের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বা ভোগান্তির কথা শুনে তাদের প্রতি করুণা জাগ্রত হতো না। এটা তো সত্যি যে যদি আসলেই বেইলির কোনো খারাপ কিছু হয়ে যায় তাহলেও মোমা বা আংকেল উইলির তেমন কিছুই এসে যাবে না। কারণ আংকেল উইলির পাশে সবসময়ই মোমা আছেন আর মোমার আছে স্টোর। তার ওপর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে আমরা দুজন মোমার নিজের ছেলেমেয়ে নই। আমরা তার নাতি-নাতনি। কিন্তু বেইলি হচ্ছে আমার আপন। একমাত্র কাছের মানুষ। ও যদি মরে যায় তাহলে যত সর্বনাশ হবে সেটা আমার হবে। অন্য কারও কিছুই হবে না। আমার যা কিছু আছে প্রকৃতপক্ষে আমার অস্তিত্ব ওর ওপরেই নির্ভর করছে।
রান্নাঘরের চুলার ওপর ফুটতে থাকা গোসলের জল শুকিয়ে যেতে লাগলো। এদিকে দুশ্চিন্তায় উদ্ভ্রান্ত হয়ে মোমা কোনো কারণ ছাড়াই বারবার খাবার টেবিলটিকে ঝেড়ে ঝেড়ে পরিষ্কার করতে লাগলো।
চলবে…
আরও পড়ুন: আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-৩৯ ॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু