(পর্ব-৩৬)
অনুবাদ: ফারহানা রহমান
শিশুদের যুক্তি কখনো কোনো প্রমাণের ধার ধারে না (ওরা সবকিছুকেই অবধারিত মনে করে)। মিসেস ফ্লাওয়ার কেন আমার দিকে সবার চেয়ে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন অথবা মোমাই তাকে অনুরোধ করেছেন কি না আমার দিকে বিশেষভাবে খেয়াল করতে, এসব ব্যাপার জানার বিষয়ে কখনোই আগ্রহ বোধ করিনি। আমার সব আগ্রহের জায়গাজুড়ে ছিল তার আন্তরিক ব্যাবহার। তিনি যে আমাকে এভাবে আদর করে চা-বিস্কিট বানিয়ে খাইয়েছেন এবং তার প্রিয় বইটি থেকে আমাকে আবৃত্তি করে শুনিয়েছেন, সেটি থেকেই প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, তিনি আমাকে কতটা ভালোবাসেন।
মোমা ও বেইলি স্টোরের ভেতরে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখে বেইলি জানতে বললো, তিনি তোমাকে কী দিলো? বেইলি আমার হাতে ধরা বইগুলো খেয়াল করলো। কিন্তু বইয়ের নিচেই যে আমি কাগজের ঠোঙায় করে ওর জন্য মজাদার বিস্কুট নিয়ে এসেছি, সেটা সে বুঝাতে পারলো না।
মোমার ভারী পদশব্দ আমার বেডরুমের দিকে আসতে শুনলাম। তিনি আবারও আমার কাছে জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার বলছ না কেন যে, তখন তুমি কী বললে? রেগে ফুলে গম্ভীরভাবে তিনি শোয়ার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলেন।
মোমা আমাকে দেখে বললেন, ছোট্ট লক্ষ্মী আপুটা আমার! আমি জানি যে তুমি মিসের ফ্লাওয়ারের সঙ্গে একজন সম্ভ্রান্ত শিশুর মতোই আচরণ করেছ। আর আমি মনেপ্রাণে প্রার্থনা করি যেন এখানকার অধিবাসীরা তোমাদের দুজনকে মন থেকে ভালোবাসে। আমি তাতেই শান্তি পাই। ঈশ্বর জানেন আমি আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব আমার সাধ্য মতোই চেষ্টা করেছি। কিন্তু এসব ভয়াবহ দিনগুলো যে কিভাবে কাটছে…এসব বলতে বলতে মোমা বিষণ্ন হয়ে খেই হারিয়ে ফেলে বলেন, যাও সোনামণি তুমি তোমার পোশাক বদলে আসো।
শোয়ার ঘরে গিয়ে দারুণ মজাদার এসব বিস্কুটগুলো দেখে বেইলি যে কী ভীষণ খুশি হবে সে কথা ভাবতে ভাবতেই বলি, সে যাই হোক, বেইলি, মিসেস ফ্লাওয়ারস কিন্তু তোমার জন্য মজাদার চায়ের বিস্কুট পাঠিয়েছেন, বুঝলে? মোমা হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন, কী বললে? কী বললে তুমি বোন? আবার বলো তো? কী বললে তুমি? রাগে দুঃখে তার গলার স্বর কর্কশ হয়ে উঠলো! রাগের চটে তিনি থরথর করে কাঁপতে লাগলেন।
বেইলি ভয় পেয়ে বলে উঠলো, ও বলেছে যে মিসেস ফ্লাওয়ারস আমার জন্য কিছু পাঠিয়েছে, মানে…
-আমি কিন্তু তোমার সাথে কথা বলছি না জুনিয়র, তোমার কাছে কিছুই জানতে চাইনি।
মোমার ভারী পদশব্দ আমার বেডরুমের দিকে আসতে শুনলাম। তিনি আবারও আমার কাছে জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার বলছ না কেন যে, তখন তুমি কী বললে? রেগে ফুলে গম্ভীরভাবে তিনি শোয়ার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলেন।
-মোমা। খুব শান্ত নরম স্বরে বেইলি বলে উঠলো, মোমা! ও আসলে বলতে চেয়েছিল…।
-তুমি একদম মুখ বন্ধ করে চুপ করে বসে থাকো জুনিয়র, আমি শুধু তোমার বোনের সঙ্গেই এখন কথা বলতে চাই!
আর মানুষ অশান্তিতে পাগল হয়ে যাবে। হে আমার দয়ালু ঈশ্বর আপনি আমাদের ক্ষমা করে দিন। হে পিতা আমি আপনার কাছে হাঁটু গেঁড়ে ভিক্ষা চাচ্ছি। এই শিশুটিকে এবারের মতো ক্ষমা করে দিন। দয়া করুন আমাদের ওপর।
আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না যে আমি আসলে কোন মহাভারত একবারে অশুদ্ধ করে ফেললাম? তবে এভাবে গনগনে আগুনের ওপর দড়ি দিয়ে ঝুলে ঝুলে রোস্ট হওয়ার চেয়ে বরং একেবারে পুড়ে মরাই ভালো। আমি আবারও বলে উঠলাম যে, আমি তখন বেইলিকে বলেছিলাম যে, যাই হোক না কেন, মিসেস ফ্লাওয়ারস তোমার জন্য কিছু বিস্কুট পাঠিয়েছেন।
-হ্যাঁ ঠিক! আমি তাহলে সঠিক শুনেছিলাম! আচ্ছা ঠিক আছে এখন যাও তোমার জামাকাপড় বদলে নাও আগে। আমি যাচ্ছি বেতটা নিয়ে আসতে।
প্রথমে আমি ভেবেছিলাম যে মোমা আসলে আমাদের সঙ্গে দুষ্টুমি করছেন। আমি ভেবেছিলাম তিনি শেষপর্যন্ত দারুণ মজা করে বলে উঠবেন, তুমি কি নিশ্চিত? তুমি কি সত্যিই বলতে চাও যে মিসেস ফ্লাওয়ার আসলে আমার জন্য কিছুই পাঠাননি? কিন্তু দেখা গেলো এক মিনিটের মধ্যেই মোমা একটি দড়ির মতো চিকনপিচ গাছের কঞ্চি নিয়ে আমাদের ঘরের ভেতর ঢুকলেন। এভাবে আলগা করে ভেঙে আনাতে পিচ গাছের ডালটি থেকে বাজে একটা গন্ধ ভেসে আসছিল। আমার কাছে এসে তিনি বললেন, হাঁটু গেঁড়ে বসো, আর বেইলি জুনিয়র তুমিও আসো আর ওর পাশে হাঁটু গেঁড়ে ওর মতো করেই বসো।
আমরা তিনজনই একইভাবে হাঁটু গেঁড়ে বসলাম, এরপর তিনি বলতে লাগলেন, হে দয়ালু পিতা! আপনি তো আপনার এই বান্দার দুর্বিষহ এই জীবনের দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে সব কিছুই জানেন। শুধু আপনি সহায় ছিলেন বলেই আমি এই দু’দুটি নাবালক বাচ্চাকে লালনপালন করার মতো সাহস দেখিয়েছিলাম। কতবার! কতবার যে মনে হয়েছে, আমি আর পারছি না। কিন্তু আপনি আমাকে ভরসা দিয়েছেন, আমাকে পথ দেখিয়েছেন, আপনার দয়ার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন আমাকে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু হায় আমার দয়ালু ঈশ্বর! দেখুন আপনার এই দুঃখী বান্দার আজ কী পরিণতি হলো! আপনি জানেন হে ঈশ্বর! আমি সর্বতভাবে চেষ্টা করেছি আমার নাতি-নাতনিকে আমার মতো করে আদর্শবান করে গড়ে তুলতে। তাদেরও উচিত আমার আদর্শ মেনে চলা। কিন্তু হে ঈশ্বর আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন যে, শয়তান এসে পদে পদে আমাকে বাধাগ্রস্ত করছে। আমি কোনোদিন কল্পনাও করতে পারিনি যে, আমার ঘরেই কেউ একজন কখনো আপনাকে উদ্দেশ করে অভিশাপ দেবে। এই ঘরের ছাদের নিচ থেকেই কারও মুখ থেকে অভিশাপের বাণী উচ্চারিত হবে, তা কখনো তা ভাবতে পারিনি। হে পিতা, আমি তো সারাজীবন আপনার ইবাদত বন্দেগিতেই কাটিয়ে দিয়েছি। আর এই শিশু বাচ্চাটির মুখ দিয়েই কি না শেষপর্যন্ত এমন অভিসম্পাত বের হয়ে এলো, ভাবতেই পারছি না। কিন্তু আমার স্মরণে আছে যে, আপনি বলেছিলেন, পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার শেষ দিনগুলোতে ভাই ভাইয়ের বিপক্ষে চলে যাবে, সন্তান তার পিতামাতার বিরুদ্ধে কাজ করবে। মানুষ হতবুদ্ধি হয়ে দুর্বিষহ রাগেক্ষোভে দাত কিড়মিড় করবে আর চারদিক থেকে ভয়াবহ চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে আকাশবাতাস ফুঁড়ে যাবে। আর মানুষ অশান্তিতে পাগল হয়ে যাবে। হে আমার দয়ালু ঈশ্বর আপনি আমাদের ক্ষমা করে দিন। হে পিতা আমি আপনার কাছে হাঁটু গেঁড়ে ভিক্ষা চাচ্ছি। এই শিশুটিকে এবারের মতো ক্ষমা করে দিন। দয়া করুন আমাদের ওপর।
কিন্তু সেসব কথাবার্তা শুনলে ঈশ্বর খুবই নাখোশ হন। ফলে আমরা সেই পাপের কাজ কোনোভাবেই করতে পারি না। আর আমাদের উচিত সবসময়ই সাবধানে কথাবার্তা বলা।
এরপর আমি আর সহ্য করতে না পেরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম। মোমার গলার স্বর একেবারে চিৎকারের পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। আমি এটা অন্তত বুঝতে পারলাম, আমি যে অপরাধটা করেছি, তা একেবারে ক্ষমার অযোগ্য। ঈশ্বরের সঙ্গে আমার অপরাধ নিয়ে সমঝোতা করতে গিয়ে তিনি এতটাই ক্ষুব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যে, কোনোদিকেই কিছু খেয়াল না করেই এমনকি স্টোর ফেলে রেখে বাইরে চলে গেলেন। এরপর যখন তার সব অভাব অভিযোগ করা শেষ হলো, তখন দেখা গেলো যে আমরা তিন জনই গলা ছেড়ে হাউমাউ করে কেঁদে চলেছি। তিনি এক হাত ধরে টেনে নিয়ে আমার পিঠে বেশ কয়েকটি বেতের বাড়ি দিলেন। কিন্তু আমার এই পাপের ফলে এবং তার অভাবনীয় আবেগের বহিঃপ্রকাশে তিনি এতটাই আঘাত পেলেন যে, এরপর একেবারেই বিধ্বস্ত ও হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেন।
মোমা তখন আর কোনো কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না। তিনি একেবারে স্তব্ধ হয়ে রইলেন। সন্ধ্যার পর আমি খেয়াল করলাম আমি যে বেইলিকে বলেছিলাম, ‘যাই হোক না কেন’ আর এই বাক্যাংশটি ব্যবহার করেই আমি মহাপাপ করে ফেলেছি। মোমা ব্যাপারটার ব্যাখ্যা দিলেন যে, জেসাস হচ্ছেন আমাদের একমাত্র উপায়! তিনি আমাদের পিতা! আমাদের কাছে সর্বত সত্যি ও আলোময়! ফলে যেই এভাবে বলবে যে, ‘যেই উপায়েই হোক না কেন’ অর্থাৎ তিনি বলতে চান যিশুর কসম বা ঈশ্বরের কসম! কিন্তু কোনো কারণেই এই বাড়িতে এভাবে প্রভূর নামে বৃথা কসম কাটা যাবে না। এটা হচ্ছে মহাপাপ!
বেইলি যখন মোমাকে বোঝাতে চেষ্টা করলো যে সাদা মানুষরা কোনো একটি বিষয় নিয়ে আরও বেশি আলোচনা করার সময় এভাবে ‘যাই হোক না কেন’ বাক্যাংশটি বলে থাকে, তখন মোমা আমাদের রীতিমতো সাবধান করে দিলেন, সাদা মানুষদের কথাবার্তা হচ্ছে বর্বরদের মতো। ওরা মুখে যা আসে তাই বলে ফেলে। কিন্তু সেসব কথাবার্তা শুনলে ঈশ্বর খুবই নাখোশ হন। ফলে আমরা সেই পাপের কাজ কোনোভাবেই করতে পারি না। আর আমাদের উচিত সবসময়ই সাবধানে কথাবার্তা বলা।
চলবে…
আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-৩৫ ॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু