অনুবাদ: ফারহানা রহমান
(পর্ব-৩৪)
একটি পাথুরে রাস্তা ধরেই মিসেস ফ্লাওয়ারসের বাড়িতে যেতে হতো। তবে সেই পাথুরে রাস্তার পাশ দিয়েই একটি ছোট মেঠোপথও ছিল। আর সে পথেই লোকজন মূলত সবসময় আসাযাওয়া করতো। মিসেস ফ্লাওয়ারস হাত দুলিয়ে দুলিয়ে পাথুরে পথ ধরেই হেঁটে যাচ্ছিলেন। আর আমি হাঁটছিলাম মেঠোপথ ধরে তার পেছন পেছন।
তিনি আমার দিকে মাথা না ঘুরিয়েই সোজা হেঁটে যেতে যেতেই বললেন, মার্গারেট, আমি শুনেছি, তুমি নাকি স্কুলে খুব ভালো রেজাল্ট করছ। বাহ! এটা খুব ভালো কথা কিন্তু সবই নাকি লেখার খাতাতেই। এর মানে হচ্ছে তুমি লিখিত পরীক্ষায় খুব ভালো করছ। তোমার টিচাররা কিন্তু আমাকে বলেছেন, তুমি তাদের সাথে কোনো কথাই নাকি একেবারে বলো না। সেটা কি ঠিক হচ্ছে বলো? একটি ত্রিভূজাকার খামারকে বাম পাশে রেখে এসে আমরা একটি বেশ বড় রাস্তায় ওপর এসে উঠলাম। এটি একটি প্রশস্ত রাস্তা। ফলে আমরা চাইলেই দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে পারি। কিন্তু আমি তা না করে, কোনো কথা না বলেই মিসেস ফ্লাওয়ারসের সঙ্গে সম্মানজনক দূরত্ব রেখে পেছন পেছন হাঁটতে লাগলাম। এমনকি ক্লাসে কারও সঙ্গে কথাবার্তা না বলার ব্যাপারে তিনি আমাকে যে প্রশ্ন করেছিলেন, তারও কোনো উত্তর দিলাম না।
মিসেস ফ্লাওয়ারস আমাকে ডেকে বললেন, আমার কাছে আসো মার্গারেট! আমার সাথে সাথে হাঁটো। আমি চাইলেও তো মিসেস ফ্লাওয়ারসকে নিষেধ করতে পারতাম না। ফলে আমি তার সঙ্গে সঙ্গেই হাঁটতে লাগলাম। আমি তাকে এতই শ্রদ্ধা করতাম এবং ভালোবাসতাম যে, তিনি যখন আমাকে মার্গারেট বলে ডাকতেন, তখন আমার মনটা প্রশান্তিতে ভরে যেতো।
আরও স্পষ্ট করে যদি বলি, তিনি প্রত্যেকটি শব্দ এতই শুদ্ধ করে উচ্চারণ করতেন যে, আমি একেবারে নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি, যে-কোনো একজন বিদেশিই যিনি একটুও ইংরেজি বোঝেন না, তিনিও তার এই স্পষ্ট উচ্চারণের কারণে প্রতিটি শব্দের মানে বুঝতে পারবেন।
এই বিশাল বাড়িটার বাইরে নিশ্চয়ই রান্নাবান্না খাওয়াদাওয়া বা অন্যান্য কাজ করার জন্য কোনো একটি ছোটখাটো বাড়িও থাকবে। কিন্তু আমি আগে কখনো সেটা খেয়াল করিনি কেন, ভেবে অবাক হচ্ছিলাম।
আমার দিকে তাকিয়ে মিসেস ফ্লাওয়ারস বললেন, এখন শোনো, কারও পক্ষেই তো আসলে তুমি যদি না চাও তাহলে তোমাকে দিয়ে কথা বলানো সম্ভব নয়, তাই না? আর আসলেই সেটা অসম্ভব। তবে এটাও তো ঠিক যে, আমাদের মনে রাখতে হবে, ভাষা আসলে মানুষের জন্য একটি আশীর্বাদ। মানুষ মানুষের সঙ্গে ভাষা ব্যবহার করেই তো প্রকৃতপক্ষে যোগাযোগ স্থাপন করে। মানুষের জন্য এটাই সবচেয়ে সহজ যোগাযোগের মাধ্যম। এই যে আমরা নিজেদের মধ্যে এত সুন্দর করে কথা বলতে পারি, এটাও কিন্তু একটা বিশেষ কারণ যে, আমরা অন্যান্য আর সব ইতর প্রাণী থেকে আলাদা অবস্থানে আছি। মিসেস ফ্লাওয়ারসের এসব কথাবার্তা শুনে আমি যেন একেবারে নতুন একটা জগতে প্রবেশ করলাম। আমি তো আগে কখনো ঠিক এভাবে ভাবিনি। বা ভাবার অবকাশ পাইনি। তবে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, তার কথাগুলো নিয়ে আমি সময় করে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করবো।
আমার পাশে হাঁটতে হাঁটতে মিসেস ফ্লাওয়ারস আরও বললেন যে, তোমার দাদি কিন্তু আমাকে একটা দারুণ খবর জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তুমি নাকি একটু সুযোগ পেলেই বই নিয়ে পড়তে বসে যাও। তুমি অনেক পড়ো তাই না? এটা খুব ভালো একটা অভ্যেস। তবে একটা ব্যাপার কিন্তু অবশ্যই মনে রাখতে হবে, কাগজে লেখা শব্দগুলো কিন্তু শুধুই শব্দ নয়। একটি শব্দের মধ্যে প্রবেশ করলে আমরা এর ভেতরের অনেক গভীর কোনো অর্থ খুঁজে পাই। এক-একটি শব্দের মধ্যে আমরা দেখতে পাই একেক ধরনের ছবির প্রকাশ। আর এভাবেই একটি শব্দকে যে আমরা কাগজের ভেতর থেকে চোখ দিয়ে শুধুই পড়ি তাই কিন্তু নয়, বরং এসব শব্ধ থেকে আমাদের মনের মধ্যে নানা রঙের ছায়া দোল দেয় এবং বিচিত্র সব ছবি ভেসে ওঠে।
মানুষের কণ্ঠস্বর থেকে যেসব শব্দ বেরিয়ে আসে আর সেগুলো মধ্যে যা যা ছবি ফুটে ওঠে, সেই বিষয়টা নিয়েই আমি ভাবতে লাগলাম। ব্যাপারটি আমার কাছে দারুণ কাব্যিক ও আনন্দের মনে হলো।
মিসেস ফ্লাওয়ারস বললেন, তিনি আমাকে আজকে এমন কিছু বই উপহার হিসেবে দেবেন, যেগুলোকে আমাকে বারবার পড়তে হবে। আমি যেন সেসব বই শুধু চোখ দিয়েই না পড়ে যাই। বরং আমি যেন সেসব বই নানাভাবে উচ্চারণ করেই পড়ি। আর কখনো আস্তে আস্তে থেমে থেমে কখনো মৃদুস্বরে আবার কখনো যেন খুব জোরে জোরে উচ্চারণ করেই পড়ি। আর একটি সম্পূর্ণ বাক্যকে যেন নানা ভঙ্গিমায় উচ্চারণ করে পড়ি। তিনি আরও বললেন, কিন্তু শোনো বাচ্চাটা, বইটি যদি কোনোভাবে টুঁটাফাটা হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু আমি খুব রেগে যাবো। আর তখন কিন্তু তোমার কোনো অজুহাতই শুনবো না। বলে দিচ্ছি।
মিসেস ফ্লাওয়ারসের বইটি আমার কাছ থেকে ছিঁড়ে গিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে এমন চিন্তা করেই আমি মনে মনে ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম। মনে হলো এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুও আসলে খুব কমই হয়ে যায় আমার জন্য। মিসেস ফ্লাওয়ারসের বাসার ভেতরের মৌ মৌ সুগন্ধ এককথায় আমাকে পাগল করে দিয়েছিল। আমি বিস্মিত ও হতবিহবল হয়ে গিয়েছিলাম। যেকোনো কারণেই হোক না কেন, আমার আসলে আগে কখনোই মিসেস ফ্লাওয়ারসের সঙ্গে বসে কোনো কিছু খাওয়ার বা তাকে অন্যদের সঙ্গে বসে কিছু খেতে দেখার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। এই বিশাল বাড়িটার বাইরে নিশ্চয়ই রান্নাবান্না খাওয়াদাওয়া বা অন্যান্য কাজ করার জন্য কোনো একটি ছোটখাটো বাড়িও থাকবে। কিন্তু আমি আগে কখনো সেটা খেয়াল করিনি কেন, ভেবে অবাক হচ্ছিলাম।
মনকি অনেকদিন হলো তিনি বিস্কুট পর্যন্ত নিজ হাতে আর বানান না। তবু আমি নিশ্চিত ছিলাম যে অন্যান্য আর সবকিছুর মতোই তার তৈরি এই বিস্কুটগুলোও ভীষণ দারুণ মজার। খেতেও দারুণ হবে।
ওঁর বাড়ির মূল দরজাটা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ভ্যানিলার মিষ্টি গন্ধ এসে একেবারে আমাদের নাকেমুখে আছড়ে পড়লো। আর আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় একেবারে সজাগ হয়ে উঠলো। মিসেস ফ্লাওয়ারস আমার কাছে এসে বললেন, জানো, আমি না আজকে সকালেই চায়ের সঙ্গে খাওয়ার জন্য এই বিস্কুটগুলো তৈরি করেছি। আচ্ছা বলো তো ছোট্ট বাচ্চাটা, তুমি কি বুঝতে পেড়েছিলে যে আমি আসলে শুধু তোমার সঙ্গে এই চা-বিস্কুট আর ল্যামোনেড খেতে খেতে গল্পগুজব করার জন্যই এতসব প্ল্যান করেছিলাম? তাড়াতাড়ি আমার কাছে আসো, চলো আমরা চা-বিস্কুট খাওয়া শুরু করি। আর শোনো, ওই বক্সের মধ্যে কিন্তু ল্যামোনেড আছে। ওখান থেকে নিয়ে ল্যামোনেড খাবে বুঝলে?
তার আচরণে একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম, তিনি গ্রীষ্মকালের সাধারণ দিনগুলোতেও সবসময় বরফ দিয়ে পানি খান অথবা আইসক্রিম খান। অথচ আমাদের এই স্ট্যাম্পসের বেশিরভাগ পরিবারই পুরো গ্রীষ্মকালের মধ্যে হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি শনিবারেই শুধু বরফ সংগ্রহ করতে পারে। আর তারা তাদের সেই বরফগুলো আইসক্রিমের জন্য তৈরি কাঠের রেফ্রিজারেটরে সংগ্রহ করে রেখে যে কয়দিন সম্ভব খায়।
মিসেস ফ্লাওয়ারস আমার হাত থেকে ব্যাগগুলো নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। এই সুযোগে আমি ওঁর বাড়িটার ভেতরটা মনোযোগ দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। বাড়িটা ছিল আমার সমস্ত অতি উদ্ভট ও বিচিত্র কল্পনারও অনেক উর্ধ্বে। আমি হতবিহবল হয়ে চারপাশটা দেখতে লাগলাম। দেয়াল থেকে ধূসর সব বিশাল বিশাল ছবি যেন আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দাঁত বের করে ভেংচি দিচ্ছে। অথবা বলা যেতে পারে আমার দিকে তাকিয়ে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। একেবারে নতুন তৈরি করা সাদা ফকফকা পর্দাগুলো যেন বাইরের বাতাসের বিপক্ষে নিজেকের রক্ষা করার জন্যই একেবারে ঘরের ভেতরে ঠেলে ঢোকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বাড়িটির ভেতর-বাহির সবকিছুকেই আমি এমনভাবে গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম যেন পরবর্তী সময়ে বেইলির সঙ্গে আমার এখানে দেখা সবকিছু নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা চালিয়ে যেতে পারি। আর এই বাড়িটিকে নিয়ে পরবর্তী সময়ে আমরা দুজন যেন অনেক মজার মজার গালগল্প তৈরি করতে পারি।
আমি যখন চোখ বড় বড় করে বাড়িটিকে পর্যবেক্ষণ করছিলাম, ঠিক সেসময়ই মিসেস ফ্লাওয়ারস টি-টাওয়েল দিয়ে ঢাকা একটি বড় প্লেট হাতে নিয়ে রুমে ঢুকলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মার্গারেট ওই টেবিলটার পাশের চেয়ারটাতে বসো প্লিজ। যদিও বা তিনি বারবারই বলছিলেন যে ব্যস্ততার জন্য ইদানীং তিনি আর কোনো বেকিং করে রান্না করেন না। এমনকি অনেকদিন হলো তিনি বিস্কুট পর্যন্ত নিজ হাতে আর বানান না। তবু আমি নিশ্চিত ছিলাম যে অন্যান্য আর সবকিছুর মতোই তার তৈরি এই বিস্কুটগুলোও ভীষণ দারুণ মজার। খেতেও দারুণ হবে।
চলবে…
আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-৩৩॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু