অনুবাদ: ফারহানা রহমান
[পর্ব-৩]
স্কুপটাকে বাদ দিয়ে আধা পাউন্ড ময়দা মেপে সেগুলোকে ধুলোহীন পাতলা কাগজের ব্যাগে জমা করাটা ছিল আমার জন্য এক কথায় রোমাঞ্চকর অভিযান। আট আউন্স বা এক পাউন্ড করার জন্য হাতলওয়ালা রুপালি রঙের চামচে কতটুকু ময়দা, মণ্ড অথবা এরকম যেকোনো ধরনের খাবার, চিনি বা ভুট্টা নিয়ে ভরে স্কেলে কতটুকু চাপ দিতে হয়, তা বোঝার মতো চোখ বা আন্দাজ আমার তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমি যখন একেবারে সঠিকভাবে মাপা শিখে গেলাম, তখন আমাদের সমঝদার ক্রেতারা নানাভাবে আমার প্রশাংসা করে বলতে লাগলো। বলতে লাগলো, ‘সিস্টার হেন্ডারসনের নাতি-নাতনিরা কিন্তু সত্যি খুব স্মার্ট!’ দোকানটির পক্ষ হয়ে আমি চুপ করে থাকলেই তীক্ষ্ণ চোখের মহিলাটি বলতো, ‘একটু বেশি করে ময়দা দাও না বাছা! তুমি কি আমার কাছ থেকে লাভ করার চেষ্টা চালাচ্ছ?’
তখন আমি নিজেকে নীরবে অবিরাম শাস্তি দিয়ে যেতাম। প্রতিটি ভুল ফয়সালার জন্য! এই শাস্তি রূপোয় মোড়ানো চুমুর জন্য ছিল না, এটি ছিল মিষ্টি ফোঁটা ফোঁটা চকলেটের জন্য, যা ছিল বেইলির পরই আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় বস্তু। আরও হতে পারে কৌটার আনারসগুলো। আনারসের প্রতি এই অতি মোহ আমাকে পাগলপ্রায় করে ফেলেছিল। আমি সেই দিনগুলোর স্বপ্ন দেখতাম, যখন বড় হয়ে একটি সম্পূর্ণ আনারসের কৌটার কার্টন আমার একার জন্য কেনার মতো সামর্থ্য হবে।
যদিও বিদেশি ক্যানের ভেতর সিরাপে ভেজানো সোনার আংটিগুলো সারাবছর ধরে আমাদের শ্যালভস ভরা থাকতো, তবু ওগুলো আমরা শুধু ক্রিসমাসের সময়টিতেই খেতে পারতাম। মোমা প্রায় সময়ই এই জুস দিয়ে ব্ল্যাক ফ্রুট কেক তৈরি করতেন। তারপর তিনি ফ্রাইপ্যানের ভেতরের কেকের মধ্যে অনেক করে আনারসের টুকরোগুলো ছড়িয়ে দিতেন। বেইলি ও আমি দুজনেই মাত্র একটি স্লাইস করেই সেই কেক পেতাম। আমি আমার টুকরোটা হাতের মুঠোর মধ্যে রেখে অন্তত চার ঘণ্টা ধরে ঘুরে বেড়াতাম। আমার আঙুলের ভেতর শুধু ফলের সুগন্ধ ছাড়া আর কোনোকিছুই অবশিষ্ট থাকতো না। আমার এটা ভাবতে দারুণ লাগতো, আনারসের জন্য আমার এই আকাঙ্ক্ষা এতই পবিত্র যে, কখনোই এর একটি কৌটা চুরি করে বাগানে গিয়ে একা একা খেতে পারবো না। তবে, এই ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম, আমাকে যে মিষ্টি ঘ্রাণ উদ্ভিন্ন করছে, তা অবশ্যই যাচাই করে দেখতে হবে। আবার এদিকে এতটাও স্নায়ুর জোর ছিল না যে, তা পরীক্ষা করে দেখবো।
তাহলে নিগ্রোদের প্রতি তার আরও কত কিছুই না করার সামর্থ্য ছিল। কিন্তু তিনি কিছু না বলেই চলে গেলেন।
তেরো বছর বয়সে চিরদিনের জন্য আরাকান্সাস ছেড়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত স্টোরটি ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় স্থান। নিঃসঙ্গ ও রিক্ত ভোরগুলোতে স্টোরটিকে নবজাতকের চোখে দেখা অব্যক্ত বর্তমান মনে হতো। সামনের দরজাটা খোলার সময় মনে হতো, কোনো অপ্রত্যাশিত উপহারের ফিতা খুলছি। নরম-মোলায়েম আলো স্বচ্ছন্দে নিজেই (আমরা উত্তরমুখী ছিলাম) ম্যাকারাল, স্যালমন, টোব্যাকো ও সুতোর বান্ডিলের তাকগুলোর ওপর ছড়িয়ে পড়তো। চর্বির বিস্তীর্ণ থালার মতো এটি সমানভাবে ছড়িয়ে পড়তো। গরমকালের দুপুরগুলোয় এই গলিত চর্বি নরম হয়ে ঘন স্যুপের মতো হয়ে ছড়িয়ে যেতো। বিকেলে যখনই আমি স্টোরে হাঁটতে যেতাম, তখনই এর ক্লান্তি অনুভব করতে পারতাম। আমি শুধু একাই এটির অর্ধেক হয়ে যাওয়া দিনের ধীর নাড়ির স্পন্দন শুনতে পেতাম। কিন্ত আবার শোয়ার আগের সময় অনেক মানুষ যখন আসা-যাওয়া করতো,, তাদের বিল কত হয়েছে, তা নিয়ে তর্কাতর্কি করতো বা তাদের প্রতিবেশীদের নিয়ে হাসাহাসি করতো অথবা কেবল সিস্টার এন্ডারসনকে ‘হাই’ জানাতেই হয়তো বা আসতো, তখন সকালের সেই জাদুর প্রতিশ্রুতি স্টোরটিতে ফিরে আসতো। আর পরিবারটির পরাস্ত জীবনের ওপর নিজেই ছড়িয়ে পড়তো।
মোমা ক্রিসপি ক্রাকারসের বাক্সগুলো খুলতেন এবং আমরা সবাই স্টোরের পিছনের মাংসের ব্লকের কাছে গোল হয়ে বসতাম। আমি পেঁয়াজগুলোকে টুকরো টুকরো করতাম আর বেইলি সার্ডিন মাছের দুটো বা তিনটে কৌটা খুলতো। সেগুলোর তেল থেকে মাছগুলোকে আলগা করে পাশে রেখে দিতো। সেটাই হতো রাতের খাবার। সন্ধ্যায় যখন আমরা একাই শুধু থাকতাম, তখন আংকেল উইলি কখনো আমাদের তার দুঃখ-পরিতাপের কোনো ইঙ্গিত দিতেন না। এতে মনে হতো, দিনের শেষের শান্তির আশ্বাসের যে চুক্তি ঈশ্বর শিশুদের, নিগ্রোদের ও বিকলাঙ্গদের সঙ্গে করেছিলেন, তার প্রভাব হয়তো তখনো বর্তমান ছিল।
মুরগির মধ্যে কয়েক স্কুপ ভুট্টা ছেড়ে দেওয়া এবং উদ্ধৃত খাবারের সঙ্গে শুকনো টক মিশ্রণ করা এবং শূকরের জন্য তৈলাক্ত পানি দেওয়া এসবই ছিল আমাদের প্রত্যেক সন্ধ্যার কার্যক্রম। বেইলি ও আমি গোধূলির পথ অনুসরণ করে শূকরের খামারের কাছে যেতাম। ড়ার প্রথম মইয়ের ধাপের কাছে গিয়ে আমরা কৃতজ্ঞ শূকরদের সঙ্গে ফালতু আজেবাজে সব গল্প বানিয়ে বানিয়ে বলতাম। তারা তাদের কোমল গোলাপি নাকটি নিচু করে ঘষাঘষি করতো এবং খুব খুশি হয়ে নাকের গভীরে ঘোঁত ঘোঁত শব্দ করতো। আমরা ঘোঁত ঘোঁতের উত্তরে সবসময় তাদের ভেংচি দিতাম। খুব খুশি আর কৃতজ্ঞও হতাম। কারণ আমাদের সবচেয়ে নোংরা কাজটি শেষ করে ফেলতে পারতাম। জুতো, মোজা, পা ও হাত থেকে অশুভ নোংরা গন্ধটি ধুয়ে ফেলতাম।
শূকর চরানোর শেষের দিনগুলোতে, সামনের উঠোনে আমি একটি ঘোড়ার শব্দ শুনলাম (এটিকে সত্যি সত্যি ড্রাইভওয়ে বলে ডাকা উচিত, এছাড়া এটির মধ্যে ড্রাইভ করার মতো কিছুই ছিল না) এবং দৌড়ে বাইরে গেলাম দেখার জন্য যে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কে ঘোড়ায় চড়ে এসেছে, যখন মিস্টার স্টুয়ার্ড যিনি চুপচাপ তিক্তবিরক্ত একজন মানুষ যিনি নিজেই একটি ঘোড়ার মালিক, তারও তো আজকের সকাল পর্যন্ত উষ্ণ-আগুনে বিশ্রাম নেওয়ার কথা ছিল, তাকেও সেই আওয়াজটি সারা মাঠ ঘুরিয়ে ডেকে আনলো।
দুই পা দুই দিকে যথেষ্ট ছড়িয়ে দিয়ে লম্পটদের মতো করে শেরিফ তার ঘোড়ার ওপর বসে থাকতো। এমনকি বোবা প্রাণীদের প্রতি তার যে ভীষণ ঔদাসীন্য ছিল, সেটাও ছিল তার কর্তৃত্ব ও ক্ষমতারই বহিঃপ্রকাশ। তাহলে নিগ্রোদের প্রতি তার আরও কত কিছুই না করার সামর্থ্য ছিল। কিন্তু তিনি কিছু না বলেই চলে গেলেন।
টাগাদাগ টাগাদাগ করে ঘোড়া চালিয়ে শেরিফ মদির বাতাসে হারিয়ে গেলেন। স্টোরের পাশ থেকে আমি আর বেইলি শুনতে পেলাম যে তিনি মোমাকে বলছেন, ‘অ্যানি, উইলিকে আজকে রাতে একটু কম ঘুমাতে বোলো। কোনো একটি পাগলা নিগারলোক আজকে একজন সাদা নারীর সঙ্গে কোনো খুব বড় গড়বড় করেছে। কিছুক্ষণ পর কয়েকটি ছেলে এখানে আসতে যাচ্ছে। এমনকি এতগুলো বছরের ধীর বিস্মৃতির পরেও আমার সেই দিনের অনুভূতির কথা মনে পড়ে যায়, যেদিন ভয়ে আমার মুখের ভেতরটা উত্তপ্ত হয়ে শুকনো বাতাসে ভরে গিয়েছিল। সেটা আমার দেহকে পলকা বাতাসের মতো করে তুলেছিল।’
উষ্ণ ভোরের জন্য শিশির ফোঁটার মতো সেখানেই অপেক্ষা করে চলেছে।
‘ওই ছেলেগুলো?’ সিমেন্টের মুখওয়ালা ও চোখের ভেতর এতই ঘৃণা যে তোমার পোশাক পর্যন্ত পুড়িয়ে ফেলে যদি তারা কখনো শনিবারে তোমাকে শহরের প্রধান সড়কে আড্ডা দিতে দেখে। ছেলেগুলো? তাদের দেখে মনে হয় তাদের জীবনে কখনোই নতুন যৌবন আসেনি। ছেলেগুলো? না, বরং ওদের পুরুষ বলাই ভালো! যারা সৌন্দর্য আর জ্ঞান নয় বরং কবরের ধুলো ও বয়সের ভারে আবৃত হয়ে আছে। এটি হচ্ছে নিদারুণ ঘৃণার কদর্যতা ও পচনের চাষাবাদ।
এমন যদি হয় যে, শেষ বিচারের দিন সেইন্ট পিটার আমাকে তলব করেন এবং শেরিফের দয়াশীলতার কথা জানতে চেয়ে আমাকে সাক্ষী দিতে বলেন, তার পক্ষে কোন সাক্ষ্য দিতে আমি অক্ষম হবো? তার অত্যধিক আত্মবিশ্বাস, যা আমার আংকেল ও বাকি সব কালো মানুষকে, যারা ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে আসার পায়ের জিঞ্জির শব্দ শুনতে পেয়ে নিজেদের মুরগিদের পালিয়ে যাওয়ার মতো আওয়াজ করে বাড়ির নিচে গিয়ে লুকাতো, সেই শব্দ ছিল অত্যন্ত অপমানজনক। মোমার ধন্যবাদের অপেক্ষা না করেই শেরিফ উঠোন ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো। তারা অবশ্যই সেটাই করেছে, যা তাদের করা উচিত ছিল। তিনি একজন ভদ্র পারিষদ ছিলেন। দেশের আইন অনুযায়ী উপযুক্ত ক্রীতদাসদের উদ্ধার করছেন। এরপর তাদের ক্ষমা করে দিচ্ছেন।
তাৎক্ষণিকভাবেই, তখনো প্রচণ্ডভাবে ঘোড়ার খুরের শব্দ মাটিতে গর্জিত হচ্ছিল, মোমা কয়লার তেলের ল্যাম্পটি ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলেন। আংকেল উইলির সঙ্গে তিনি নীরবে শান্ত-স্থির হয়ে শক্ত কিছু কথা বললেন। আমাকে আর বেইলিকে স্টোরে ডেকে পাঠালেন।
আমাদের বাক্স থেকে আলু ও পেঁয়াজ খালি করতে বলা হলো। এরপর আলাদা করে রাখার বাক্সের ভেতরের দেয়ালটিকে সরিয়ে ফেলতে বলা হলো। আংকেল উইলি ধীরে ধীরে ভীষণ ক্লান্ত ও ভীত হয়ে আমাকে তার রাবারের হাঁটার ছড়িটি দিলেন। বড় খালি বাক্সটির ভেতরে মাথানিচু করে ঢুকে গেলেন। তিনি সেখানে শুয়ে পড়ার আগেই এটি তাকে চিরদিনের জন্যই নিয়ে চলে গেলো এবং তারপর আমরা স্তরের পর স্তর আলু ও পেঁয়াজ দিয়ে ক্যাসরোলের (রান্নার পাত্রবিশেষ) মতো তাকে ঢেকে দিলাম। তারপর স্টোরের অন্ধকারে দাদি নতজানু হয়ে প্রার্থনা করতে বসলেন।
এটি সত্যি—ভীষণ সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল যে, সেদিন সন্ধ্যায় ছেলেগুলো আমদের উঠোনে ঢুকে পড়েনি। মোমাকে বাধ্য করেনি স্টোরটা খুলে দিতে। আর তাহলেই তারা নিশ্চিতভাবে আংকেল উইলিকে খুঁজে পেতো। তাকে কোনো বিচার ছাড়াই খুন করতো। সারারাত তিনি বিলাপ করে করে গুঙিয়ে কাঁদলেন। যেন সত্যি সত্যি তিনি কোনো জঘন্য অপরাধ করে ফেলেছেন। সবজির কম্বল থেকে তার সেই গম্ভীর আওয়াজ ধাক্কা খেয়ে বেরিয়ে এসেছিল। আমি কল্পনার চোখে স্পষ্ট দেখলাম, তার চোয়ালটি আরও ডানে ঝুলে পড়েছে। উষ্ণ ভোরের জন্য শিশির ফোঁটার মতো সেখানেই অপেক্ষা করে চলেছে।
চলবে…
আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-২॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু