অনুবাদ: ফারহানা রহমান
পর্ব-৩১
স্ট্যাম্পসের দর্শনীয় স্থানগুলোতে আসলে দেখার মতো কিছুই ছিল না। খরা, বন্যা, গুম, খুন-হত্যা—এসব ছিল এখানকার নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়।
বেইলি স্ট্যাম্পসে এসে তার সাধাসিধে জীবনটাকে আরেকটু বৈচিত্র্যপূর্ণ করার জন্যই নানা ধরনের লোকগীতি ও দেশাত্মবোধক গান বাজাতে লাগলো। আমাদের স্ট্যাম্পসে ফিরে আসার পর থেকেই ও প্রত্যেকটি বিষয় নিয়েই নানাভাবে বিদ্রূপ করতে লাগলো। কথা বলার সময় সে এমনভাবে শব্দ উচ্চারণ করতো, যেন সে মুখের ভেতর পাথর আর জিভের নিচে নস্যি ভরে রেখেছে। মনে হতো প্রতিটি শব্দকে মুখের ভেতর নিয়ে গড়গড়া করছে। বাক্যগুলোকে টেনে টেনে দ্বৈত উচ্চারণে জিভের ভেতরের অন্ধকারের পিচ্ছিল পথ দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে বের করে আনছে। আমাদের স্টোরের ক্রেতারা প্রকৃতপক্ষেই স্বজন ছিল। তারা খুব সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল। সাধাসিধে মানুষগুলো আসলেই কোনো প্যাঁচ বুঝতো না। ফলে বেইলির নানা কটূক্তি আর বিদ্রূপেও ওঁরা কিছুই মনে করতো না। সত্যি কথা বলতে কী, ওঁরা আসলে বুঝতোই না যে, বেইলি আসলে যে ওদের নিয়ে বিদ্রূপ করছে। ওঁরা ভাবতো বড় শহরে থেকে বেইলি বোধহয় এভাবেই স্টাইল করে কথা বলা শিখে ফেলেছে।
তারা বলতো, বেইলি জুনিয়রের কথাবার্তা একেবারেই বড় বেইলির মতো হয়েছে, তাই না? ও আসলে ওর বাবার মতই দারুণ বাকপটু হয়েছে। ওর কথা বলার স্টাইল সত্যি দারুণ! তারা বলতো, বাচ্চাগুলোকে বলতে শুনি যে সেখানকার লোকজন নাকি তুলা তোলে না। তাহলে ওরা কিসের ওপর নির্ভর করে জীবনধারণ করে? তুলো না তুললে ওঁদের খাবার জোটে কিভাবে?
বেইলি ওঁদের বলেছে যে উত্তরের তুলোর গাছগুলো এতই বড় যে যদি সাধারণ জনগণ তুলা তুলতে চেষ্টাও করে তাহলেও ওঁদের মই দিয়ে উঠে তারপর তুলা সংগ্রহ করতে হবে। আর তাই তো তুল চাষিরা হাত দিয়ে নয় বরং মেশিনের মাধ্যমেই উত্তরের শহরগুলোতে তুলা সংগ্রহ করে থাকে।
একমাত্র আমিই কিছুক্ষণের জন্য হলেও বেইলির দয়াদাক্ষিণ্য পেয়ে থাকি। এই যে ও আমার সঙ্গে যতদূর সম্ভব ভদ্র ব্যবহার করে, আমাকে মায়া করে এর কারণ কিন্তু এই নয় যে, ও আমাকে করুণা করছে। বরং ও ভাবে যে, আমরা দুজনেই আসলে কোনো এক বিশেষ কারণে পরিস্থিতির শিকার হয়েছি। দুজনেরই ভিন্ন ভিন্ন কষ্টের কারণ আছে। আমরা কেউ আসলে ভালো নেই। আমি সত্যি সত্যি কিন্তু ওর এই হতাশাগুলো বুঝতে পারি। আর ঠিক সেভাবেই বেইলিও বুঝতে পারে আমার সবকিছু থেকে নিজেকে গুঁটিয়ে নেওয়ার এই বিষয়টাকে। জীবন সম্পর্কে আমার অনাগ্রহের পেছনের কারণগুলো ও ঠিক ঠিক বুঝতে পারে।
আমি আমার সারাজীবনে কখনোই আসলে জানতে পারিনি যে আংকেল উইলিকে কেউ কখনো আমার সেইন্ট লুইসের সেই দুর্ঘটনার কথাটা বলে দিয়েছিল কি না? কিন্তু প্রায়ই আমি দেখতাম যে, তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে তার বড় বড় চোখ দিয়ে আমার দিকে দূর থেকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। যখনই বুঝতে পারতেন যে, আমিও ব্যাপারটা খেয়াল করেছি, সঙ্গেসঙ্গেই তিনি আমাকে কোনো না কোনো কাজের অজুহাত দেখিয়ে তার সামনে থেকে সরিয়ে দিতেন। আর এসব ঘটনা ঘটলেই আমি একিসাথে খুব স্বস্তিও পেতাম আবার ভীষণ লজ্জায় লাল হয়ে উঠতাম। আমি কখনোই চাই না যে আংকেল উইলির মতো একজন পঙ্গু অসহায় লোকও আমাকে সহানুভূতি দেখাক (যেভাবে একজন অন্ধ অনেকগুলো অন্ধকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যায়, আমি তেমন জীবন চাই না।) আর আমি এটাও চাই না যে আংকেল উইলি যাকে আমি আমার মতো করেই আমি ভীষণ ভালোবাসি সেও আমার সব কাহিনি শুনে আমাকে পাপিষ্ঠ আর নিকৃষ্ট একজন মানুষ মনে করুক। আর যদি এমনও হয় যে সত্যি সত্যি তিনি আমাকে ঘৃণ্য মনে করেন তাহলেও অন্তত আমার কাছে যেন সেটা অজানাই রয়ে যায় সেটাই আমি চাই। আমি আসলে আর কোনো কিছুই জানতে চাই না। এ পৃথিবীর কোনো ব্যাপারেই আমার আর কোনো আগ্রহ নেই।
স্ট্যাম্পসের সেই সময়টিতে খুব মৃদুভাবে আমার কাছে শব্দগুলো ভেসে আসতো। আমার মনে হোতো যে মানুষগুলো তাদের মুখের মধ্যে রুমাল চাপা দিয়ে বা তাদের হাত মুখে চেপে ধরে ফিসফিস করে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে। যাবতীয় রঙগুলোকেও মিথ্যেই মনে হতো আমার কাছে। বরং এটা বলাই হয়তো বেশি যুক্তিসঙ্গত হবে যে, প্যাস্টেল রঙের আলোছায়াময় যে বর্ণচ্ছটা আমার চোখের পর্দার ওপর ভেসে উঠতো তার সবকিছুকেই আমার মনে হতো যে এগুলো আসলে মিথ্যের রাজত্বই কায়েম করে চলেছে। এগুলো শুধু যে শুধু কতগুলো বহুবর্ণময় রঙের উদ্ভাসই দেখায় না, বরং তা একাধারে ঝাপসা আর বিবর্ণতার সঙ্গেও আমাদের গভীরভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়। আর তাই আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারি যে আমাদের এই জীবনকে ঘিরে রয়েছে বিষণ্ণ মিথ্যের নানা রঙ আর বিচিত্র সব ভণ্ডামি।
দিনের পড় দিন মানুষের নামগুলো আমার কাছ থেকে বিস্মৃত হতে লাগলো। আমি পালিয়ে বাঁচতে চাইলাম ওদের কাছ থেকে। আমার দিনদিন নিজেকে পাগল মনে হতে থাকে। নিজের মানসিক সুস্থতা নিয়ে আমি ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি। যত যাইহোক না কেন আমরা তো প্রকৃতপক্ষেই প্রায় এক বছরের মতোই স্ট্যাম্পসের বাইরেই ছিলাম। যেসব ক্রেতাদের হিসাবনিকাশের যাবতীয় তথ্য আমি আনুষ্ঠানিকভাবে সবসময় মনে রাখতাম, সেসবই তো আমি এখন ভুলে গেছি। তারা সবাই এখন আমার কাছে অপরিচিত হয়ে উঠেছে। যেমন আমিও তাদের কাছে হয়ে গেছি বড় শহরের কোনো অভিজাত মেয়ে।
শুধু মোমা ও আংকেল উইলি ছাড়া স্ট্যাম্পসের প্রত্যেকেই আসলে আমার কথা বন্ধ করে দেওয়ার এই নীরবতাকে স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিলো। তারা মনে করতে লাগলো যে উত্তরের চাকচিক্যময় জীবন থেকে আমার অনিচ্ছায় জোর করে দক্ষিণে ফিরিয়ে আনার কারণেই আমি আসলে বিষণ্ণতায় ভুগে ভুগে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি। আর তাই সময়সুযোগ মত ওঁরা আমাকে বড় শহরে অবস্থানরত আমার আনন্দদায়ক জীবনযাপন নিয়ে নানাভাবে খোঁচাতে লাগলো। ইঙ্গতিপূর্ণ কথাবার্তা বলতে লাগলো। এছাড়া, তো অবশ্য ওঁরা সবাই মনে মনে বিশ্বাস করতো যে আমি আসলেই খুব নরম মনের কল্পনাপ্রবণ একটি ছোট্ট মেয়ে। তবে সমস্যা হচ্ছে দক্ষিণের নিগ্রোরা নরম মনের মানুষ বলতে আসলে দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী কোনো সংবেদনশীল বা স্পর্শকাতর মানুষ বলেই মনে করতো। ফলে আমি যেভাবে ওঁদের সম্পর্কে ভেবেছিলাম যে ওঁরা আমাকে খুব আন্তরিকভাবেই গ্রহণ করবে আর ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেখা গেলো যে ওঁরা আসলে আমাকে ঠিক ততটা ক্ষমার চোখে দেখল না এবং সেই গভীর আন্তরিকতা যা আমি প্রত্যাশা করেছিলাম ওঁদের কাছ থেকে সে প্রত্যাসাও কিন্তু অপূর্ণই রয়ে গেলো।
চলবে…
আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-৩০॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু