পর্ব-২৯
আমার নানি ব্যাক্সটার আমাদের ডেকে বললেন, তোমরা দুজন আমাদের বড়দের কোনো কথা শুনোনি তো, তাই না? আমি কিন্তু কখনোই চাই না যে, তোমরা ওই বদমায়েশ লোকটাকে নিয়ে আর একটা কথাও বলো। আর আমার এই বাসায় ওই শয়তানের নাম কেউ উচ্চারণ করুক সেটা আমি চাই না। বুঝতে পেরেছ, সোনারা? নানি ভীষণ গম্ভীর হয়ে কথাগুলো বললেন। এরপর তিনি আমার জন্য আপেল স্ট্রুডেল বানানোর জন্যে রান্নাঘরের দিকে হেঁটে গেলেন।
এতসব অপ্রত্যাশিত আকস্মিক ঘটনা-দুর্ঘটনায় আমি তো মুষড়ে পড়লাম। এমনকি বেইলিও এগুলো দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো। একটি ছোট্ট বিড়ালের বাচ্চা যেমন করে একটি বিশালাকার ভয়ানক হিংস্র নেকড়কে দেখে দারুণ এক বিস্মিত নিয়ে হা হয়ে তাকিয়ে থাকে, বেইলিও ঠিক তেমনিই একজন জলজ্যান্ত মানুষের হঠাৎ করেই লাশ হয়ে যাওয়ার খবরে স্তম্ভিত হয়ে চুপচাপ একা একা দূরে গিয়ে বসে রইলো। ও তো সবকিছু জানে না। তাই হয়তো আমার মতো করে দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে পারেনি। কিন্তু সবকিছু বুঝতে পেরে আমি যতটা ভয় পেয়েছি, বেইলিও ঠিক ততটাই কিন্তু ভয় পেয়েছে।
সেই মুহূর্তেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম যে, যদিও বা বেইলি আসলে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে কিন্তু আমার এই ভয়াবহ বিপদের দিনে ও আসলে আমাকে কোনোই সাহায্য করতে পারবে না। আর আমি তো আমার আত্মাটাকে শয়তানের কাছে বেচেই দিয়েছি। আমার আর কোনো নিস্তার নেই। আর তাই এই পরিস্থিতিতে আমার পক্ষে যা করা সম্ভব ছিল, তাই করলাম। শুধু বেইলি ছাড়া এই পৃথিবীর সবার সঙ্গে আমি চিরদিনের মতো কথা বলা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সহজাতভাবেই আমি একটা ব্যাপার বুঝে গিয়েছিলাম, আমি আর বেইলি দুজন-দুজনকে এতই ভালোবাসি যে, অন্তত ওকে কষ্ট দেওয়া আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। কিন্তু আমি এটাও বুঝেছি যে, আমি যদি অন্য কোনো মানুষের সঙ্গে আবারও স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা চালিয়ে যাই, তাহলে তারাও হয়তো একের পর একে সবাই মরে যাবে। শুধু আমার নিঃশ্বাসের সঙ্গে যেসব কথাবার্তা আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, সেগুলো দিয়েই তাদের জীবন বিষিয়ে উঠতে পারে। আর খোলবিহীন মোটা কালো শামুকগুলো যেমন করে মোচড় খাওয়ার ভান করতে থাকে, সেভাবেই আমার কথার বিষে বিষাক্ত হয়ে মানুষগুলো তড়পাতে তড়পাতে রাস্তার মধ্যে মরে পড়ে থাকবে। আর তাই আমাকে চিরদিনের জন্য কথা বলা বন্ধ করে দিতে হবে।
তারা ভীষণভাবে আমার ওপর বিরক্ত হতে লাগলো। আমার এই নীরবতা তাদের কাছে অসহ্য হয়ে উঠলো। ওরা আমাকে নির্লজ্জ-বেহায়া বলে গালাগালি করা শুরু করলো। আমার এই নীরবতাকে ওঁদের কাছে জঘন্য মনে হতে লাগলো।
আমি বুঝতে পারলাম, আমার নিজের ভেতরের গভীর নীরবতার মধ্যে ডুবে যেতে হলে আমাকে শব্দের প্রতি জোঁকের মতো সংবেদনশীল হতে হবে। কোনো শব্দ উচ্চারণ না করেই তাই আমি আমার চারপাশের প্রতিটি শব্দ গভীর মনোযোগে শুনতে শুরু করলাম। আমি সম্ভবত এটাই ভেবেছিলাম, প্রতিটি শব্দ শোনার পর সেই শব্দের গভীরতা আমি অনুধাবন করে তাকে নিজের ভেতর স্থির হয়ে সমাধিত হতে দেবো। আমার মনে হয়েছিল আমার কানের ভেতর দিয়ে সমস্ত শব্দ প্রবেশ করে সেগুলো মনের গভীরে যেয়ে বরফের মতো জমে থাকবে। আর আমার চারপাশের পৃথিবীটা শান্ত হয়ে আমাকে ঘিরে থাকবে। বাসার ভেতর যে রুমটিতে সবাই বসে হাসাহাসি করছিল, আমি সেখানে গিয়ে বসলাম। মনে হলো তাদের উচ্চারিত সব শব্দ তীব্রভাবে সেখানকার দেয়ালের ওপর একের পর এক পাথরের মতো আছড়ে পড়ছে। আর আমি সেই ভয়াবহ শব্দের দাঙ্গার ঠিক মাঝখানে গিয়ে একটি বস্তুর মতো চুপচাপ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলাম। আর আমি অনুভব করলাম যে মাত্র এক-দুই মিনিটের মধ্যেই কোনো একটি গোপন পথ দিয়ে গভীর এক নীরবতা সেই রুমটিকে ঘিরে ফেললো। আমি যেহেতু সেখানকার প্রতিটি শব্দ গিলে ফেলছিলাম, তাই শব্দগুলো ধীরে ধীরে শূন্যে মিলিয়ে গিয়ে ঘরটিকে একেবারে নিস্তব্ধ করে দিলো।
ধর্ষণের আঘাত মেনে নিতে না পেরে অথবা হাসপাতালের অসুস্থতার দিনগুলোর ভয়াবহতা মেনে নিতে না পেরেই হয়তো আমি স্তব্ধ হয়ে গেছি। এটাই সবাই ভাবতে লাগলো। এসব কারণেই মূলত আমার আচরণ বদলে গেছে মনে করে বাসার সবাই প্রথম সপ্তাহে আমাকে কিছুই বললো না। বরং সবাই ভীষণ আন্তরিকতার সঙ্গে আমাকে খেয়াল রাখতে শুরু করলো। তবে ধর্ষণজনিত কোনো আলোচনা বা হাসপাতাল নিয়ে কোনো প্রকার কথাবার্তা নানির বাসায় আর কখনোই হয়নি। ওই সময়টিতে আমি আর বেইলি আবারও আমার নানি ব্যাক্সটারের বাসায় থাকা শুরু করেছিলাম। ওরা সবাই চাইতো যে বেইলি যেন আমার পাশাপাশি সবসময় থাকে। কারণ ওরা বুঝতে পেরেছিল যে, আমি শুধু বেইলির সঙ্গেই কথা বলতে পারি। আর অন্য কারও সঙ্গে হয়তো কথা বলবো না।
সেসময়টিতে হাসপাতাল থেকে নার্স এসে আমার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিতো। দেখাশোনা করতো। শেষপর্যন্ত সেই দিনটি এলো, যেদিন নার্সটি শেষবারের মতো আমাকে দেখতে এলো। ডাক্তারও বাসার সবাইকে ডেকে জানিয়ে দিলো, আমার কোনো বিপদ নেই। আমি একেবারেই সুস্থ হয়ে গেছি। এর মানে হলো আমি এখন থেকে সেই আগের মতো আবারও রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে হেঁটে বেড়াতে পারবো। হ্যান্ডবলসহ নানা ধরনের খেলাধুলা করতে পারবো। যা আমি সুস্থ অবস্থায় করতাম। তবে অসুস্থ হওয়ার পর থেকে সমস্ত খেলাধুলা এমনকি ঘর থেকে বের হওয়া পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সুস্থ হওয়ার পরেও আমি আর কখনোই সেই আগের মতো প্রাণোচ্ছল ছোট্ট মেয়েটি হতে পারলাম না। সময়, পরিস্থিতি, জীবন; সবই আমাকে বদলে যেতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু আমার পরিবারের কেউ আমার এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারলো না। তারা চাইতো আমি আবারও আগের সেই প্রাণচঞ্চল লক্ষ্মী বাচ্চাটা হয়ে বাঁচি। কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয়। তারা ভীষণভাবে আমার ওপর বিরক্ত হতে লাগলো। আমার এই নীরবতা তাদের কাছে অসহ্য হয়ে উঠলো। ওরা আমাকে নির্লজ্জ-বেহায়া বলে গালাগালি করা শুরু করলো। আমার এই নীরবতাকে ওঁদের কাছে জঘন্য মনে হতে লাগলো।
বেশ কিছুদিনের জন্য বাসার সবাই আমি কথা বলি না আর চুপ করে থাকি বলে আমাকে উন্নাসিক বলতে শুরু করলো। আমাকে কথা বলানোর জন্য নানা ধরনের শাস্তি দিতে থাকলো। এরপর দেখা গেলো, হৈচৈ করেও কোনো কাজ হচ্ছে না। তাই ওরা নানাসময় আমাকে নিয়ে নানাভাবে সমস্যায় পড়ছে ভেবে দু/চার ঘা চড়থাপ্পড়ও দিতে লাগলো। অবশেষে নিরুপায় হয়ে ওরা আমাকে আর বেইলিকে আবারও স্ট্যাম্পসে রেখে আসার সিদ্ধান্ত নিলো।
আসলে তখন জীবনের এমন এক ক্রান্তিকালে এসে পৌঁছেছিলাম যে, গন্তব্যের কথা ভাবার মতো কোনো অবকাশ আমার ছিল না। আমার কপাল আমাকে দোজখের আগুনের মধ্যে নিয়ে ফেলুক কিংবা কোনো নোংরা দুর্গন্ধময় টয়লেটের মধ্যে নিয়ে ফেলুক, তাতে আমার এখন আর কিছুই এসে যায় না।
আমি ও বেইলি স্ট্যাম্পসে ফিরে যাওয়ার জন্য ট্রেনে উঠে বসলাম। এই প্রথমবারের মতো বেইলি স্ট্যাম্পসে ফিরতে চাইলো না। আমি ওকে নানাভাবে সান্ত্বনা দিতে থাকলাম। স্ট্যাম্পসে থাকার সুবিধার কথা বলে বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকলাম। কিন্তু বেইলি অঝরে কেঁদেই চললো। ও ট্রেনের দুই বগীর মাঝখানের করিডোরে দাঁড়িয়ে তার প্রিয়তম মায়ের দিকে তাকিয়ে হাউমাউ করে চিৎকার করে কান্নাকাটি করতে থাকলো। আর ট্রেনটি যখন স্টেশন ছেড়ে রওনা হলো, বেইলি তার ছোট্ট শরীরটাকে যতদূর সম্ভব দরজা দিয়ে বের করে দূর থেকে তার প্রিয় মা’কে সম্পূর্ণভাবে মুছে যাওয়ার আগ পর্যন্ত দেখতেই লাগলো।
আমি আমার জীবনে আর কখনোই জানতে পারিনি, ঠিক কী কারণে আমাদের স্ট্যাম্পসে পাঠিয়ে দেওয়া হলো? আমার মানসিক সুস্থতা ফিরে আসবে ভেবে আমার মা’ই কি আমাদের স্ট্যাম্পের নির্জন পরিবেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? না কি আমার নানির বাসার সবার কাছে আমি একজন অসহ্য মানুষ হয়ে উঠেছিলাম আর তাই ওরা আমাকে ওখান থেকে বের করে দিলো? সঠিক কারণটা কখনোই আর জানা সম্ভব হয়নি। তবে এটাও তো সত্যি যে, একটি সারাক্ষণ বিষণ্ণ হয়ে থাকা শিশুর কাছে থাকার যন্ত্রণার চেয়ে এই পৃথিবীতে আর কোনো জঘন্য ব্যাপার হতে পারে না। তাই ওদের পক্ষে আমাকে সহজভাবে মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল।
এই যে আমি এতদিন পর আমার শৈশবের প্রিয়তম জায়গাটির কাছে আবারও ফিরে যাচ্ছি, সেটা কিন্তু আমার কাছে এততুকুও আর গুরুত্ব পেলো না। আমি খুবই চিন্তায় পড়লাম বেইলির দুঃখিত চেহারা দেখে। আসলে তখন জীবনের এমন এক ক্রান্তিকালে এসে পৌঁছেছিলাম যে, গন্তব্যের কথা ভাবার মতো কোনো অবকাশ আমার ছিল না। আমার কপাল আমাকে দোজখের আগুনের মধ্যে নিয়ে ফেলুক কিংবা কোনো নোংরা দুর্গন্ধময় টয়লেটের মধ্যে নিয়ে ফেলুক, তাতে আমার এখন আর কিছুই এসে যায় না।
চলবে…