অনুবাদ: ফারহানা রহমান
(পর্ব-২৮)
‘মার্গারেট উত্তর দাও! ঠিক করে বোলো মিস্টার ফ্রিম্যান কি তোমার গায়ে হাতাহাতি করতো? তুমি যাকে রেপ করা বলছ, সেই দিনের কথা বলছি। সেদিন, যেদিন অভিযুক্ত লোকটি তোমাকে রেপ করলো, সেদিনের আগেও কি সে তোমার শরীরের গোপন স্থানে হাতিয়েছে?
আদালতের প্রত্যেকেই জানতো যে উত্তরটা না’ই হবে। কিন্তু সবাই যা জানতো, সেটা সেটাই কি ঠিক? মিস্টার ফ্রিম্যান আর আমি যে কথাগুলো জানতাম, সেটা আর কেউই জানতো না। আমি অসহায়ের মতো মিস্টার ফ্রিম্যানের গম্ভীর চেহারার দিয়ে তাকিয়ে থাকলাম। আশা করছিলাম মিস্টার ফ্রিম্যান যেন আমাকে ইঙ্গিতে বোঝান যে, আমি যেন সবকিছু অস্বীকার করি। কিন্তু হায়! নিশ্চয়ই তিনি সেটা কখনোই চাইবেন না। কিন্তু আমি স্পষ্টতই ‘না’ বললাম।
এই ভয়াবহ মিথ্যেটা আমার গলার কাছে দলার মতো আটকে রইলো। আর আমি যেন দম বন্ধ হয়ে মরে যাচ্ছিলাম। আহ! লোকটা আমাকে দিয়ে কী জঘন্যভাবেই না মিথ্যে কথাটা বলালো। আমি লোকটাকে ঘৃণা করি, ভীষণভাবে ঘৃণা করি! ওহ কী নোংরা, কী কুৎসিত! কী জঘন্য-ঘৃণ্য ব্যাপার ঘটলো আমার সঙ্গে! আমি অঝোরে কাঁদতে লাগলাম। কিন্তু চোখের জল আমার মনকে কিছুতেই শান্ত করতে পারলো না। আগেও বহুবার ভীষণ কষ্ট পেলে আমি কেঁদে কেঁদে নিজেকে শান্ত করেছি, কিন্তু এখন আর কোনো কিছুতেই কোনো কাজ হলো না। আমি হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে উন্মাদের মতো চিৎকার করতে লাগলাম, ‘আপনি একটা নোংরা বদমায়েশ বুড়ো ভাম! আপনি জঘন্য! আপনি নোংরা! আপনি নোংরা! আমি ঘৃণা করি আপনাকে।’
বলো তো তুমি কেমন আছ? সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো না? শোনো টম তুমি কি একটু ল্যামোনেড খাবে? নাকি ঠাণ্ডা বেয়ার দেবো? কী খাবে বলো তো?’
আমাদের উকিল দৌড়ে এসে আমাকে স্ট্যান্ড থেকে কোলে তুলে নিয়ে গিয়ে আমার মায়ের কোলে তুলে দিয়ে এলো। আমি কাঁদতে কাঁদতে মায়ের বুকের ভেতর মুখ লুকালাম। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আসল সত্যিটা হচ্ছে, আমি সেই মিথ্যে কথাটার মাধ্যমেই আমার অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছে গিয়েছিলাম। ওই সময় আর আন্য কোনো কিছুরই কোনো মূল্য আমার কাছে ছিল না।
মিস্টার ফ্রিম্যানকে একবছর, একদিন জেল দেওয়া হলো। কিন্তু তিনি জেল খাঁটার কোনো সুযোগ পেলেন না। সেদিন বিকেলেই তার উকিল বা অন্য কেউ একজন তাকে জেল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এলো।
বসার ঘরটিতে খুব ভারী পর্দা ব্যাবহার করা হতো, যেন রুমটি সবসময় শীতল থাকে। ওখানে বসে বসে দুপুরে আমরা দুজন অন্যান্য দিনের মতোই মনোপলি খেলছিলাম। কিন্তু সেদিন আমি খুব খারাপ খেলছিলাম। আমি ভয়ে কুঁকড়ে যেতে লাগলাম এটা ভেবে যে, আমি আসলে বেইলির কাছে কিভাবে এসব কথা শেয়ার করবো? আমি ওকে কী করে বলবো, আমি আসলে মিথ্যে কথা বলেছিলাম। আর এসব কথা শুনলে বেইলি আমার সঙ্গে আসলে ঠিক কী রকম আচরণ করবে? ও কি আমাকে ওর বোন বলে আর স্বীকার করবে? মনে মনে এসব কথা ভাবছি, এমন সময় হঠাৎ শুনতে পেলাম কলিংবেল বেজে উঠেছে। নানি রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিলেন। তাই বেইলি দরজাটা খুললো। একজন খুব লম্বা পুলিশ বাসায় এসে মিসেস ব্যাক্সচারকে খুঁজছিল। ওহ আল্লাহ! ওরা কি তাহলে বুঝে ফেলেছে যে, আমি মিথ্যে কথা বলেছি। নিশ্চয়ই পুলিশটা আমাকে জেলে ভরবে। কারণ আমি তো বাইবেলের ওপর হাত রেখে শপথ করেছিলাম, যা বলবো সত্য বলবো। কিন্তু আমি তো আসলে সব সত্যি বলে দেইনি। হে খোদা আমাকে এবারের মতো ক্ষমা করে দাও। আমাকে সাহায্য করো আল্লাহ!
পুলিশের যে লোকটা আমাদের বসার ঘরে দাঁড়িয়ে ছিল, সে আকাশের চেয়েও লম্বা। আমি আল্লাহর কথা ভাবলে ঠিক যে রকম সুন্দর ও আলোকিত ফর্সা একজনের কথা মনে মনে ভাবতাম, তারচেয়েও অনেক বেশি ফর্সা ছিল লোকটি। শুধু লোকটির মুখ ভরে অজস্র বিশাল দাঁড়ি ছিল না, এই যা পার্থক্য।
‘মিসেস ব্যাক্সটার, আমার মনে হয় আপনি ইতোমধ্যেই জেনে গেছেন, কসাইখানার পেছনে মিস্টার ফ্রিম্যানের লাশ পাওয়া গেছে।’ যেন চার্চের ভেতর সংগঠিত খুব পবিত্র কোনো অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা হচ্ছে ঠিক এমনভাবেই নরম আর সংবেদনশীল উচ্চারণে নানি বললেন, ‘আহারে, ব্যাচারার জন্য খুব মায়া হচ্ছে!’
বাসনকোসন মোছার জন্য ব্যবহৃত তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে আমার নানু আরও নরম সুরে জানতে চাইলো, ‘আচ্ছা কেউ কি জানে, কাজটা আসলে কারা করেছে।’
পুলিশটি উত্তর দিলো যে, লাশটা দেখে মনে হলো কেউ হয়তো খুন করে এখানে ফেলে দিয়ে গেছে। লোকজন বলাবলি করছে, মিস্টার ফ্রিম্যানকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আমি খেয়াল করলাম, কথাটা শুনে নানির গালটা একটু যেন গোলাপি হয়ে উঠলো। নানি পুলিশের লোকটাকে বললো, ‘টম, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আমাকে খবরটি দেওয়ার জন্য, আহারে ব্যাচারা মিস্টার ফ্রিম্যান! সত্যি খুব কষ্ট হচ্ছে। অবশ্য এটাই ঠিক যে, সবই ওর কপালের লিখন। ওর কপালে আসলে এভাবেই মৃত্যু লেখা ছিল। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। ব্যাটাটা একটা পাগলা কুত্তা হয়ে গিয়েছিল। আচ্ছা বাদ দাও এসব ফালতু ব্যাপার। বলো তো তুমি কেমন আছ? সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো না? শোনো টম তুমি কি একটু ল্যামোনেড খাবে? নাকি ঠাণ্ডা বেয়ার দেবো? কী খাবে বলো তো?’
আমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওঁদের কথা শুনছিলাম। পুলিশের লোকটাকে দেখতে যদিওবা খুব ভদ্র আর গোব্যাচারা টাইপের মনে হচ্ছিল, কিন্তু আমি তো খুব ভালো করেই জানি, ইনি হচ্ছেন আমার বাম কাঁধের ওপর বসে থাকা কাতিবীন ফেরেস্তা, যে কি না আমার সব পাপের হিসাব লিখে চলেছেন। আর এসব ভাবতে ভাবতে আমি ভীষণ ভীত বোধ করতে থাকি।
আমার মুখ থেকে তো শয়তানের নির্ধারিত শব্দই বের হবে, আর সেই বাণে বিদ্ধ হয়ে খুন হবে অজস্র ভালো মানুষ। তাই আমি চিরদিনের জন্যই চুপ হয়ে গেলাম।
পুলিশের লোকটা হঠাৎ বলে ওঠেন, ‘অনেক ধন্যবাদ মিসেস ব্যাক্সটার! না না এখন আমি কিছুই খাবো না। আমি ডিউটিতে আছি। আমাকে এখনই ফিরতে হবে। অনেক কাজ বাকি।’
নানি গদগদ হয়ে খুব মায়াবি গলায় বললেন, ‘আচ্ছা সোনা! এখন তাহলে এসো। আর শোনো তোমার মা’কে বলো যে, আমি বিয়ারটা শেষ করে আসছি। আমার জন্য যেন কয়েকটা গরম গরম ক্রোসা রেখে দেয়। দুজনে মিলে গল্প করতে করতে দুধ-চা দিয়ে ক্রোসাগুলো মজা করে খাবো।’
আর এরপরেই সেই ভয়ঙ্কর পুলিশটা বিদায় হলো। আমি এই প্রথম বুঝতে পারলাম, মিথ্যে বলা কত বড় পাপ। আমার একটা জঘন্য মিথ্যে কথার জন্যই শেষপর্যন্ত তাহলে মিস্টার ফ্রিম্যানকে মরতে হলো। হায় আল্লাহ! আমি এটা কী করলাম? তাহলে এতদিন যে শুনতাম, ঈশ্বর এই দুনিয়ার সবকিছুই ভারসাম্য রক্ষা করে করেছেন! তাহলে কি এসবই মিথ্যে? কী হচ্ছে তাহলে এসব? আমার একটা মিথ্যে সাক্ষ্য, একটা মাত্র মিথ্যের জন্যই যদি মিস্টার ফ্রিম্যানকে মরতে হয়, তাহলে এটা কি ধরনের ভারসাম্য হলো? একটা মিথ্যে কথার দাম কি তাহলে একটা জীবনের সমান? তাহলে কি মানুষের জীবনের মূল্য এতই কম? হায়! আমি কী করলাম তাহলে?
আমার এই অসহায় অবস্থার একমাত্র সমাধান ছিল বেইলির কাছে। ওই শুধু আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতো। কিন্তু আমার ওকে কোনো কথা জিজ্ঞেস করার মতো সাহস আর হলো না। নিশ্চয়ই আমি চিরকালের জন্যই আমার বেহেস্তে যাওয়ার পথ বন্ধ করে দিলাম। আমার নরকে যাওয়া তাহলে নিশ্চিত হয়ে গেলো। এ জীবনের মতো বেহেস্তে যাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে আমি একটা পুতুলের মতো জড়বস্তুতে পরিণত হলাম। আমি নিজের ওপর থেকে সমস্ত ভরসা হারিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত একজন নির্বোধে পরিণত হলাম। বহুবছর আগে ক্রিসমাসে আমার মায়ের দেওয়া উপহার একটি পুতুলকে যেভাবে আমি ছিন্নভিন্ন করে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম, মনে হলো আমাকেও ঠিক সেভাবেই কেউ ছিন্নভিন্ন করে কেটে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। আমি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে পড়লাম।
যিশু যেভাবে শয়তানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, মনে হলো তিনি আমার দিক থেকেও ঠিক একই ভাবেই মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এমন একটা অনুভূতি হলো যে, আমার ভেতরে সেই শয়তানটি আশ্রয় নিয়েছে, যার দিক থেকে যিশুখ্রিষ্ট মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। শয়তানটি আমার দেহের প্রতিটি রক্তকণিকায় তার উপস্থিতি জানান দিতে লাগলো। আমি বুঝতে পারলাম আমার শরীরের ভেতর সে বয়ে যাচ্ছে, আর চেষ্টা করছে, আমাকে দিয়ে খারাপ কথা আর মিথ্যে কথা বলাতে। আর আমি জানি যে এখন আমি কোনো কথা বললেই তা হবে শয়তানের কথা। ওর কথাই ও আমার জিভ দিয়ে ও বলাবে। তাই আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমি স্থবিরের মতো চুপ হয়ে রইলাম। আমি আমার দাঁতের ওপর দাঁত শক্ত করে চেপে ধরে রাখলাম, যেন একটি শব্দও আর বের হতে না পারে। আমি জানি আমি যদি মুখ খুলি তাহলে শব্দের বন্যা বয়ে যাবে। তাতে অজস্র নির্দোষ, নিরপরাধী মানুষও সেই শব্দের বন্যায় ভেসে যাবে। আমার মুখ থেকে তো শয়তানের নির্ধারিত শব্দই বের হবে, আর সেই বাণে বিদ্ধ হয়ে খুন হবে অজস্র ভালো মানুষ। তাই আমি চিরদিনের জন্যই চুপ হয়ে গেলাম।
চলবে….
আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-২৭॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু