অনুবাদ: ফারহান রহমান
পর্ব-২৬
স্যুপ তৈরি করে মা আমার বিছানায় এসে বসলেন। পানির মতো পাতলা স্যুপ খাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল গলার ভেতর দিয়ে কেউ একটি বড় হাড্ডি ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমার পেটের ওপরটা, পেটের ভেতরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও পিঠ-নিতম্ব সব কিছুই শক্ত ঠাণ্ডা লোহার স্ত্রির (আয়রন) মতো হয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল আমার মাথাটা অন্য কোথায় হারিয়ে গেছে। আর কাঁধের ওপর যেখানে মাথাটা থাকে, ওখানে শুধু বোঁ-বোঁ বাতাস বয়ে যাচ্ছিল।
এদিকে বেইলি ঘুমে ঢলে পড়ার আগ পর্যন্ত আমাকে রোভার বয়েজ শোনাতে লাগলো।
সারারাত জেগে জেগে সেদিন রাতে মা ও মিস্টার ফ্রিম্যানের ঝগড়া শুনলাম। যদিও বা তারা দুজন কী নিয়ে এত ঝগড়াঝাঁটি করছিলেন, তা স্পষ্ট শুনতে পাইনি। কিন্তু আমি মনে মনে মায়ের জন্য প্রার্থনা করছিলাম। আমি কিছুতেই চাইছিলাম না যে, মা মিস্টার ফ্রিম্যানকে খুব বেশি রাগিয়ে দিক। কারণ আমি ভয় পাচ্ছিলাম যে, তাহলে হয়তো লোকটা আমার মতো করে মাকেও এভাবেই ভয়ানক ব্যথা দেবে। আমি জানতাম যে, লোকটা কতটা ভয়ানক। আর এই শীতল মুখ আর শূন্য চোখসম্পন্ন লোকটা পারে না, দুনিয়াতে এমন কোনো খারাপ কাজ নেই। তাদের তুমুল ঝগড়াঝাঁটি চরমে গিয়ে পৌঁছালো। আর মায়ের হাইহিলের খটখট শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যেতে লাগলো। মনে হচ্ছিল ওদের সামনে গিয়ে আমার দাঁড়ানোটা খুবই দরকার। ভাবলাম প্রথমে টয়লেটে যাই তারপর ওখান থেকে আসার পথে ওদের রুমে যাবো। আমাকে দেখলে হয়তো ওদের ঝগড়াঝাঁটি কিছুটা থামবে। বিছানা থেকে টয়লেটে যাওয়ার উদ্দেশ্যে উঠে বসার চেষ্টা করতেই বুঝলাম পা-গুলো পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে। পায়ের পাতা ও গোড়ালি নাড়াতে পারছিলাম কিন্তু হাঁটুগুলো কাঠের মতো শক্ত হয়ে বিছানার সঙ্গে মিশে থাকলো।
মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালবেলা ঘুম ভেঙেই মাকে বিছানার পাশে বসে থাকতে দেখলাম। ‘এখন ক্যামন আছ সোনা? শরীর ক্যামন লাগছে?’
‘আমি ভালো আছি, আম্মু।’ সবসময় এই প্রশ্নের উত্তরে যা বলি এবারও তাই বললাম। তারপর জানতে চাইলাম, ‘বেইলি কোথায় মা?’
মা বললেন, বেইলি ঘুমাচ্ছে। তখনো ঘুম থেকে ওঠেনি কিন্তু তিনি সারারাত জেগেছিলেন। তিনি আমার রুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তাই আমাকে দেখে গেলেন। আমি জানতে চাইলাম মিস্টার ফ্রিম্যান কোথায়? আমার এখনো মনে আছে মিস্টার ফ্রিম্যানের নাম শুনে মা কী ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন। মা বললেন, ‘শয়তানটা চলে গেছে। সকালেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। দাঁড়াও আগে তোমার ক্রিমের ৩+ স্যুপটা নিয়ে আসি, তারপর দেখছি তোমার শরীরে জ্বর আছে কি না?’
আমি কি এখন তাকে আমার কষ্টের কথাটি বলতে পারবো? এমনই অসহ্য সেই কষ্ট আমাকে দেওয়া হয়েছে, যা আমার পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব ছিল। লোকটা যা কিছু আমার সঙ্গে করেছে আর যে অসম্ভব কষ্ট আমাকে সহ্য করতে বাধ্য করা হয়েছে, যা আমার কখনো প্রাপ্য ছিল না। আর আমার ঈশ্বর যদি মনে করে থাকে যে, আমার জন্য এই কষ্টকর অভিজ্ঞতা বরাদ্দ করে থাকে, তাহলে বলতে হবে, এটা সত্যি খুব খারাপ একটা ব্যাপার হয়েছে। আচ্ছা মিস্টার ফ্রিম্যান যদি চলেই গিয়ে থাকে, তাহলে কি বেইলির বিপদ কেটে গেছে? এখন তো লোকটা তাহলে আর বেইলিকে খুন করতে পারবে না। আর সত্যি যদি তাই হয়ে থাকে আর আমি আমার সব গোপন কথা বেইলিকে বলে দেই তাহলে কি বেইলি আমাকে আগের মতোই ভালবাসবে? হায় আল্লাহ! আমি কী করবো এখন?
আমার মুখে মিস্টার ফ্রিম্যানের কথা শুনে বেইলি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। আমিও একইভাবে ওর সঙ্গে কাঁদলাম। আর আজকে এই সময়ে এসে প্রায় পনেরো বছর পর আমরা দুই ভাইবোন আবারও একসঙ্গে হাউমাউ করে একইভাবেই সেদিনের মতো করেই কাঁদছি।
আমার শরীরে জ্বর আছে কি না, দেখার পর মা কিছুক্ষণ রেস্ট নেওয়ার জন্য বিছানায় গেলেন। আর আমাকে বলে গেলেন, আমার যদি শরীর খারাপ লাগে তাহলে যেন তাকে ডেকে তুলি। মা তার রুমে যাওয়ার আগে বেইলিকে বলে গেলেন, সে যেন আমাকে সারাক্ষণ নজরে রাখে আর আমার মুখে আর হাতে কোনো ফুস্করি উঠছে কি না, সেটা যেন খেয়াল করে। মা বললেন, যদি আমার শরীরে কোনো ছোট ছোট গোঁটা ওঠে তাহলে মা এসে ওখানে ক্যালামাইন লোশন দিয়ে দেবেন।
বহুদূর দেশ থেকে আসা ল্যান্ডফোনের কলে কথা বলতে গেলে যেমন কিছু কথা হারিয়ে যায় আর কিছু কথা ভেঙে ভেঙে আবছা শোনা যায়, ঠিক সেভাবেই আমার জীবনে এমন একটি রোববার এলো। যে রোববারের কথা আমি কিছু কিছু আবছাভাবে মনে করতে পারি। তবে সেদিনের বেশিরভাগ স্মৃতিই আমি মনে করতে পারি না। আমি মরা মানুষের মতো বিছানায় লেপটে ছিলাম আর বেইলি আমার মাথার কাছে বসে বসে আমাকে ক্যাটজেঞ্জামার কিডস পড়ে শোনাচ্ছিল। আর মা তার ঘুমের ঘোর কেটে যেতেই বারবার করে এসে আমার মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছিলেন। কোনো কিছু খাওয়ার মতো অবস্থায় আমি ছিলাম না ফলে মা যখনই আমার মুখে স্যুপটা দিচ্ছিলেন, সেগুলো স্বভাবতই আমার থুঁতনি গড়িয়ে বুকের ওপর এসে পড়ছিল। আর কিছুটা গেলার চেষ্টা করতেই আমার দম আঁটকে যাচ্ছিল। এর পরপরই একজন ডাক্তার এসে আমার শরীরের তাপমাত্রা মাপলেন এবং আমার হৃদস্পন্দন মাপার জন্য কব্জি ধরে বসে থাকলেন।
‘বেইলিইইই’ আমার ইচ্ছে হচ্ছিল, চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ওকে বলি, প্লিজ ভাইয়া আমাকে নিয়ে এখনই হ্যাঁ একদম এখনই নিয়ে চল এখান থেকে। চল আমরা পালিয়ে যাই অন্য কোথাও, দূরে অনেক দূরে কোথাও। হতে পারে সেটা ক্যালিফোর্নিয়া অথবা ফ্রান্স অথবা শিকাগো। আমি এটা অন্তত বুঝে গিয়েছিলাম যে, আমি মারা যাচ্ছি। আসলে আমি প্রতিক্ষা করছি মৃত্যুর। কারণ এভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু এটাও খুব সত্যি যে আমি কখনোই মিস্টার ফ্রিম্যানের আশেপাশে মারা যেতে চাই না। লোকটা এতই বদমায়েশ যে, সে না চাইলে হয়তো আমি মরতেও পারবো না। আমাকে আরও কষ্ট দেওয়ার জন্য, আমার সঙ্গে আরও শয়তানি করার জন্য হয়তো বা সে আমাকে মরতেও দেবে না।
মা বললেন, আমাকে স্নান করাতে হবে এবং আমার জামাকাপড় বদলে দিতে হবে। কারণ আমি অনেক ঘেমে গেছি। কিন্তু ঠিক যখনই তারা আমাকে বিছানা থেকে নামানোর চেষ্টা করলো আমি ব্যথায় কুঁকড়ে গেলাম এবং চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম। আমি ব্যথায় এতই ছটফট করছিলাম যে, বেইলিও আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখতে পারছিল না। তবে মা যখন পাঁজাকোলা করে আমাকে তুলে নিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন, মনে হলো তীব্র ব্যথাটা একটু কমেছে। মা আমাকে কোলে তুলে নিতেই বেইলি আমার বিছানার চাদর বদলে দিয়ে শুরু করলো। আর তখনই সেই ভয়াবহ সত্যিটা ওদের চোখের সামনে উন্মোচিত হয়ে গেলো।
বিছানার পুরনো চাদর বদলে নতুন চাদর বিছিয়ে ম্যাট্রেসের ভেতর গুঁজে দেওয়ার সময় আমার সেই লুকিয়ে রাখা রক্তাক্ত পেন্টিটা বের হয়ে এসে ঠিক আমার মায়ের পায়ের ওপর পড়লো।
হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর, কে আমার এই হাল করলো সেটা জানার জন্য বেইলি ভীষণ পীড়াপীড়ি করতে লাগলো। বেইলি আমাকে নানাভাবে বোঝাতে লাগলো যে, যদি আমি লোকটার নাম ওদের কাছে না বলি, তাহলে সে আরও অনেক ছোট্ট মেয়ের সঙ্গেও একই কাজ করবে এবং তাদেরও এভাবেই ভয়াবহ কষ্টের মধ্যে ফেলবে। যখন আমি বেইলিকে বুঝিয়ে বললাম যে, আমি যদি ওর কাছে দুষ্টু লোকটার নাম বলে দেই, তাহলে লোকটা বেইলিকে মেরে ফেলবে। কিন্তু বেইলি এসব কথায় পাত্তা না দিয়ে ভীষণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললো, ‘লোকটা আমার কিছুই করতে পারবে না। আমি তাকে কোনো সুযোগই দেবো না। এসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।’ বেইলি কখনোই মিথ্যে কথা বলে না। ফলে স্বভাবতই আমি আশ্বস্ত হলাম এবং মিস্টার ফ্রিম্যানের সব কার্যকলাপের কথা বেইলিকে বলে দিলাম।
আমার মুখে মিস্টার ফ্রিম্যানের কথা শুনে বেইলি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। আমিও একইভাবে ওর সঙ্গে কাঁদলাম। আর আজকে এই সময়ে এসে প্রায় পনেরো বছর পর আমরা দুই ভাইবোন আবারও একসঙ্গে হাউমাউ করে একইভাবেই সেদিনের মতো করেই কাঁদছি।
চলছে…
আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-২৫॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু