অনুবাদ: ফারহানা রহমান
(দ্বিতীয় পর্ব)
বেইলির যখন ছয় বছর বয়স, আমি ওর চেয়ে বছরখানেক ছোট, ওইসময় আমরা এমন গতিতে সময়কে নিয়ে তোলপাড় করতাম, যা পরে সান ফ্রান্সিসকোতে চাইনিজ বাচ্চাদের অ্যাবাকাস নিয়ে করতে দেখেছি। আমাদের ধূসর গ্রীষ্মের মোটা পেটঅলা চুলোটা শীতকালে গোলাপের মতো লাল হয়ে ফুটে উঠতো। বোকার মতো নানা ধরনের ভুল করলেই এটি একটি গুরুতর শাস্তির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতো।
আংকেল উইলি কালো দৈত্য জেডের মতো বসে থাকতো (তিনি একজন শিশুর মতোই অচল ছিলেন)। আমাদের কথাবার্তা শুনে লাফায়েট কান্ট্রি ট্রেনিং স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে নালিস জানাতেন। তার মুখের বাম দিকটা এমনভাবে ঝুলে থাকতো, যেন তার নিচের দাঁতগুলোর সঙ্গে কেউ কপিকল ঝুলিয়ে দিয়েছে। তার বাম হাতটা ছিল বেইলির হাতের চেয়ে সামান্য একটু বড়। তবে, দ্বিতীয় ভুলটা হচ্ছে অথবা বলা যায় খটকাটা ছিল তার ডানহাতটা অত্যাধিক বড়, যা আমাদের কারও কারও কলারকে পেছন দিয়েও আঁকড়ে ধরতো। মুহূর্তের মধ্যে দোষী ব্যক্তিকে নিস্তেজ লাল হিটারের দিকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিতো, যা শয়তানের দাঁত ব্যথার মতো আমাদের গ্রাস করে নিতো। আমরা কখনো ঠিক সেখানে পুড়ে যেতাম না। একবার আমি পুড়ে যেতে পারতাম, যখন এতই আতঙ্কিত হয়েছিলাম যে, সমস্ত হুমকি থেকে বাঁচার জন্য চুলোর ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম। অন্যসব বাচ্চার মতো আমিও ভাবতাম, যদি একবার আমি সমস্ত ভয়ঙ্কর ঘটনার মুখোমুখি হতে পারি এবং পুরো ব্যাপারটা জিতে যাই, তাহলে সারাজীবনের জন্য এটার বিরুদ্ধে শক্তি সঞ্চয় করতে পারবো। কিন্তু এক্ষেত্রে আমার সব ত্যাগ ও চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে পড়লো। আংকেল উইলি আমার ড্রেসটি এমন শক্ত করে ধরে রাখলেন যে, আমি শুধু গরম লোহার পরিষ্কার শুষ্ক ঘ্রাণটি পাওয়ার মতো কাছাকাছি যেতে পেরেছিলাম। কিছু না বুঝেই আমরা সময়মতো চলার বা নিয়মানুবর্তিতার মহান রীতিনীতি রপ্ত করে ফেললাম। কেবল এই কারণেই যে, আমাদের কাছে যথেষ্ট ধারণক্ষমতা ছিল। এছাড়া অন্য কোনো উপায়ও ছিল না।
পঙ্গুত্বের অসহনীয় যাতনা বাচ্চাদের কাছে এতটাই অযৌক্তিক মনে হতো যে, তারা এটি দেখে বিভ্রান্ত হতো। তারা সম্প্রতি নিজস্ব স্বভাব হারিয়েছিল। আংকেল উইলির অন্য রসিকতাগুলোকে মিস করছিল। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেয়ে আংকেলের পঙ্গুত্ব নিয়ে সমালোচনা শুরু করলো তারা। মোমা কোনো রকম আবেগ দেখানো ছাড়াই কিভাবে একজন মহিলা যিনি তাকে চিনতেন, তিনি তিন বছর বয়সী আংকেল উইলিকে ফেলে গিয়েছিলেন, সেই সময় সম্পর্কিত ঘটনাবলী শেষ না করেই অবিরাম বলে যেতেন। সেই বেবি সিটার সম্পর্কে তার মনে কোনো বিদ্বেষ ছিল না, এমনকি যে এই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছিল, সেই ঈশ্বরের প্রতিও নয়। আংকেল উইলি যে আর সবার মতো করে বেড়ে ওঠেননি, সেটাই মোমা বারবার করে বলে বলে তাদের মনে করিয়ে দিতেন, যারা ঘটনাটি সম্পর্কে জানতো। আমাদের সমাজে যেসব কালো মানুষের দুটি করে হাত-পা ও শক্তি-সামর্থ্য সবই আছে, তারাও কেবল জীবনধারণের জন্য সামান্য উপকরণটুকুই পেতো, সেখানে ঝকমকে মাড় দেওয়া শার্ট, চকচকে জুতো পরা ও তাকভরা খাবারসহ আংকেল উইলি বেকার ও কম বেতনের মানুষদের কাছে গাত্রদাহের কারণ। একইসঙ্গে অদম্য কৌতুকের পাত্রও ছিলেন। তার ভাগ্যই শুধু তাকে পঙ্গু করেনি বরং তার চলার পথকে দ্বিগুণ বাধাগ্রস্ত করেছিল। তিনি আবার অহঙ্কারী এবং সংবেদনশীলও। ফলে তিনি এমনভাব দেখাতে পারতেন না যে, পঙ্গু নন। আবার মানুষের কাছে তার পঙ্গুত্বের অসহায়ত্বকেও লুকিয়ে রাখতে পারতেন না।
এত বছরের চেষ্টায় আমি একবার একবারই তাকে না দেখে থাকতে চেষ্টা করেছিলাম। দেখলাম—তিনি নিজের ও অন্যদের সঙ্গে এমন ভাব করছেন, যেন তিনি পঙ্গু নন। স্কুল থেকে ফেরার পথে আমাদের সামনের উঠোনে একদিন দেখলাম একটি গাঢ় রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। দৌড়ে গিয়ে দেখলাম, একজন অচেনা পুরুষ এবং নারী (আংকেল উইলি পরে বলেছিল যে তারা লিটিল রক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন) স্টোরের ঠাণ্ডার মধ্যে বসে ড. পেপার পান করছেন। আমার এমন মনে হতে লাগলো যে, চারপাশে কিছু একটা ভুল হতে চলেছে। যেমন অ্যালার্ম ক্লক সেট না করলে এটি একসময় বন্ধ হয়ে যায়, সে রকম। আমি জানতাম এটি অযাচিত নয়। সবসময় হয় না কিন্তু মাঝেমধ্যে এমন হয় যে, যাত্রীরা মূল রাস্তা থেকে শুধু টোব্যাকো আর ঠাণ্ডা পানীয় কেনার জন্য স্যাম্পের নিগ্রো স্টোরেই আসে। আমি যখন আংকেল উইলির দিকে তাকালাম, তখন মনের কুঠুরিতে ঠিক কী চলছে, তা টের পেতাম। তিনি কাউন্টারের পেছনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। নিজের জন্য বানানো তাকে ঝুঁকে বা বিশ্রামরত অবস্থায় ছিলেন না। সোজা হয়ে ছিলেন। তার চোখে আমার জন্য হুমকি ও আবেদনের মিশ্রণের প্রশ্রয় ছিল। আগন্তুকদের নিয়মমাফিক অভিবাদন জানালাম। আমার চোখ তার হাঁটার ছড়িটিকে অনুসরণ করছিল। এটাকে কোথাও দেখা যায়নি। তিনি বললেন, অহ…এ…এ…এটি…ওহ এটি হচ্ছে আমার ভাগ্নি। সে…ওহ…এইমাত্র স্কুল থেকে এসেছে। এরপর সেই দম্পতিকে বললেন, ‘আপনারা জানেন যে, কেমন…ওহ…বাচ্চারা কেমন হয়…এখন—এখনকার বাচ্চারা…তারা সারাদিন স্কুলে খেলাধুলো করে এবং বাসায় ফেরার জন্য পাগল হয়ে থাকে যেন আরও একটু বেশি করে খেলতে পারে।’ সেই মানুষগুলো খুব বন্ধুত্বপূর্ণভাবে হাসলো। তিনি যোগ করলেন, ‘আচ্ছা বাইরে গিয়ে তাহলে খেলো, লক্ষ্মীটি।’ আরাকান্সাসের মৃদু স্বরে মহিলাটি হাসলেন। বললেন, ‘বেশ! মিস্টার জনসন তুমি জানো যে, তুমিও একসময় এরকম একজন শিশুই ছিলে। তোমার নিজের কি কোনো বাচ্চাকাচ্চা আছে?’ অধৈর্য নিয়ে উইলি আংকেল আমার দিকে তাকালেন, কিন্তু যখন তিনি তার উঁচু জুতোর ফিতে বাঁধার জন্যই শুধু ৩০ মিনিট সময় নিচ্ছিলেন, তখন আমি তার দিকে তাকাইনি পর্যন্ত। তিনি আমাকে বললেন, ‘আমার…আমার মনে হয়, তোমাকে যেতে বলেছিলাম। যাও বাইরে গিয়ে খেলো।’
শেক্সপিয়ারের শাদা চামড়া প্রসঙ্গে নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিতাম যে, তার মৃত্যুর এত বছর পর তার শ্বেতাঙ্গ রূপ এখন আর কারও জন্য কোনো ব্যাপারই হতে পারে না।
আমি যাওয়ার আগে তাকে দেখলাম চিলেকোঠায় মোমের আলোর পাশের তাকে আংকেল উইলি পেছন ফিরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, প্রিন্স এলবারট ও স্পার্ক প্লাগ তামাক চিবোচ্ছেন। আংকেল বললেন, ‘না। কোনো বাচ্চাকাচ্চা বা স্ত্রী কিছুই নেই।’ তিনি একটু হাসার চেষ্টা করলেন, ‘আমার বুড়ো মাকে আর ভাইয়ের দুই বাচ্চাকে দেখাশোনা করতে হয়।’
নিজেকে অন্যের কাছে গ্রহণযোগ্য ও সুন্দর করে তোলার জন্য যে, তিনি আমাদের ব্যবহার করতেন, তার জন্য আমি কিছু মনে করতাম না। প্রকৃতপক্ষে তিনি যদি চাইতেন, তাহলে আমি তার মেয়ে হিসেবে অভিনয় করতেও রাজি ছিলাম। শুধু এই কারণেই নয় যে, আমি নিজের বাবার প্রতি কোনো আনুগত্য বোধ করতাম না। বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমি যদি আংকেল উইলির সন্তান হতাম, তাহলে বরং আরও অনেক বেশি ভালোবাসা পেতাম!
সেই দম্পতিটি বাসার পেছন দিক থেকে কিছুক্ষণ পর চলে গেলো। আমি খেয়াল করলাম, লাল গাড়িটাকে দেখে মুরগিগুলো খুব ভয় পেয়ে গেলো, বাতাসে প্রচুর ধুলো উড়িয়ে গাড়িটি ম্যাগ্নোলিয়ার দিকে চলে গেলো।
আংকেল উইলি তাক ও কাউন্টারের মধ্যের লম্বা ছায়াঘেরা করিডোরে হাত রেখে রেখে এমনভাবে নিচে নেমে গেলেন, যেমন করে একজন মানুষ তার স্বপ্নগুলো থেকে বিতাড়িত হয়ে বেড়িয়ে যায়। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম, তিনি একদিকে হেলে পড়ছেন আর অন্য সবকিছুকে আঘাত করতে করতে চলেছেন—যতক্ষণ না তিনি কয়লার তেলের ট্যাংকের কাছে না পৌঁছুলেন। তিনি তার হাত অন্ধকারের অবকাশে লুকিয়ে রেখেছিলেন এবং তার মুঠির মধ্যে বেতটি শক্ত করে আঁকড়ে রেখেছিলেন। তিনি শুধু কাঠকে অবলম্বন করেই নিজের ওজনকে সেটির ওপর ছেড়ে দিলেন। ভাবছিলেন নিজেকে সেখান থেকে টেনে বের করতে পেরেছেন।
আমি কখনোই জানতে পারবো না যে, সেই দম্পতি কেন তার কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যারা মিস্টার জন্সনের পিছনে ফেলে আসা লিটিল রকের জীবন সম্পর্কে একটি সম্পূর্ণ ছবি নিতে চাইছিলেন।
এই পঙ্গুত্বের জীবন নিশ্চয়ই তার কাছে ভীষণ ক্লান্তিকর হয়ে পড়েছিল। যেমন করে বন্দিরা কারাগারের অনুশাসনে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। দোষীরা ক্লান্ত হয় দোষারোপ শুনতে শুনতে। উঁচু হিলের জুতো ও বেত অস্বস্তিকর পেশীগুলো ও ভারী জিহ্বা নিয়ে অপমানে বা ঘৃণায় তার চেহারায় যে কষ্টের প্রতিফলন হয়েছিল, তা তাকে একেবারে ভেঙেচুরে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল। একটি মাত্র বিকেলের জন্য, একটি বিকেলের মাত্র একটু সময়ের জন্য তিনি আর কোনো কিছুরই অংশই হয়ে রইলেন না।
আমি সবকিছু অনুধাবন করতে পারলাম আর জীবনের এই সময়টিতে এসে তার সবচেয়ে কাছের হতে চাইলাম, যা আগে কখনোই করিনি। স্যাম্পের এই সময়টিতেই শেক্সপিয়ারের সঙ্গে পরিচিত হলাম। তার প্রেমে পড়ে গেলাম। সাদা মানুষদের মধ্যে শেক্সপিয়ারই হলো আমার প্রথম প্রেম। যদিও আমি কিপ্লিং, পো, বাটলার, থ্যাচেরি, হেনরিও খুব পছন্দ করতাম। অল্পবয়সের আবেগ-অনুরাগ জমিয়ে রেখেছিলাম পল লরেন্স ডানবার, লাংস্টন হিউজ, জেমস ওয়েল্ডন জন্সন ও ডব্লিউ. ই. বি দ্যু বোইসের, ‘লিটানি এট আটলান্টা’র জন্য। শেক্সপিয়ারের শাদা চামড়া প্রসঙ্গে নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিতাম যে, তার মৃত্যুর এত বছর পর তার শ্বেতাঙ্গ রূপ এখন আর কারও জন্য কোনো ব্যাপারই হতে পারে না।
বেইলি ও আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, ‘মার্চেন্ট অব ভ্যানিস’ থেকে কিছু দৃশ্য মুখস্ত করে ফেলবো। কিন্তু বুঝতে পারলাম যে, মোমা আমাদের এই লেখক সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন। তখন বলে দিতে হবে যে, শেক্সপিয়ার একজন শ্বেতাঙ্গ ছিলেন আর তিনি মরে গেছেন কি যাননি তাতে কিছু এসে যায় না। কারণ কোনো সাদা মানুষকে তার পক্ষে কখনোই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আর তাই আমরা শেক্সপিয়ারের বদলে জেমস ওয়েলডন জনসনের ‘দ্য ক্রিয়েশন’কেই বেছে নিয়েছিলাম।
চলবে…
আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায় ॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু