অনুবাদ: ফারহানা রহমান
[পর্ব-২৩]
এটা সত্যি যে বিছানাটা একেবারে ভেজা ছিল। কিন্তু আমি খুব ভালো করেই জানি যে এটা আমি করিনি। আমার দিক থেকে কোনো রকম দুর্ঘটনা ঘটেনি। আমার মনে হয় মিস্টার ফ্রিম্যান যখন আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল, হয়তো বা তখনই তিনি এই অঘটনটা ঘটিয়েছেন। কিন্তু দেখা গেলো যে তিনি একগ্লাস পানি এনে সেটা ভেজা জায়গার ওপর ঢেলে দিলেন, যা দেখতে অনেকটা আমার হিস্যুর মতোই লাগছিল। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে বেশ কিছুদিন ধরে ভয়ানক সব স্বপ্ন দেখে দেখে আমি এভাবেই বিছানায় হিস্যু করে দিচ্ছিলাম, যা দেখতে অনেকটা এরকমই লাগতো। বিছানায় পানি ঢালতে ঢালতে মিস্টার ফ্রিম্যান আমাকে খুব কর্কশ স্বরে বলতে লাগলেন, ‘এই পিচ্চি উঠে আয় তাড়াতাড়ি। তুই তো দেখি মুতে বিছানা ভাসিয়ে দিয়েছিস।’
এই দক্ষিণ দিকের কড়াকড়ি শাসনে মানুষ হওয়ায় আমি অন্তত এতটুকু জানতাম যে, কখন আসলে বড়দের মুখের ওপর কথা বলা যায় এবং কখন কোন পরিস্থিতিতে একেবারে চুপ করে থাকতে হয়। কিন্তু আমি সত্যি সত্যি শুধু এতটুকুই জানতে চেয়েছিলাম যে, তিনি কেন এমন করে মিথ্যে কথা বললেন যে আমি বিছানায় হিস্যু করেছি? তিনি তো নিজেই যা বলছেন সেটা বিশ্বাস করেন না এবং খুব ভালো করেই জানেন যে, আমি হিস্যু করিনি। তাহলে শুধু শুধু কেন এই মিথ্যে কথা বলছেন? আর তিনি যদি সত্যিই ভেবে থাকেন আর বিশ্বাস করেন যে, আমি একটা দুষ্টু বাচ্চা, তাহলে কি তিনি আমাকে আর কখনো ওভাবে বুকে জড়িয়ে ধরবেন না? অথবা তিনি যে আমার সত্যিকার বাবা সেটা অস্বীকার করবেন? আমি কি সত্যিই তাহলে তাকে লজ্জায় ফেললাম। আমার ওপর কি তিনি খুব বেশি বিরক্ত হলেন?
‘রিটি! তুমি তো বেইলিকে খুব ভালোবাসো তাই না?’ তিনি বিছানার কোণায় বসতেই আমি লাফ দিয়ে তার কাছে চলে আসলাম। আর বললাম, ‘হ্যাঁ খুবই ভালোবাসি আমি বেইলিকে।’
মিস্টার ফ্রিম্যান বিছানায় বসে নিচের দিকে ঝুঁকে মোজা পরছিলেন। তার পিঠটা এতই চওড়া আর মমতায় ভরা ছিল যে, আমার শুধু ওখানে মাঠা ঠেকিয়ে বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে হচ্ছিল।
‘শোনো রিটি! তোমাকে খুব সহজ করে একটা কথা বুঝিয়ে বলছি। কান পেতে শোনো। একটা কথা মনে রেখো যে, তুমি যদি কখনো কারও কাছে আমরা আজকে যা করেছি, সে সম্পর্কে মুখ খোলো, তাহলে কিন্তু আমি তোমার প্রিয় ভাই বেইলিকে মেরে ফেলবো। বুঝলা? ওকে না তুমি খুব ভালোবাসো? ওকে বাঁচাতে চাইলে সবসময় মুখ বন্ধ রাখবে।’
আমরা? আমরা আবার কী করলাম? নিশ্চয়ই তিনি এটাই বোঝাতে চাচ্ছেন না যে, আমিই আসলে বিছানায় হিস্যু করেছি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারলাম না। আর সবকিছু মিলিয়ে আমি এতই ভয় পেয়েছিলাম যে, তাকে কিছু জিগ্যেস করার মতো সাহস সত্যি হচ্ছিল না। তবে মনে হচ্ছে তিনি যে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন, সেই ব্যাপারটাই বোঝানোর চেষ্টা করছেন। ব্যাপারটা নিয়ে যে বেইলির সঙ্গে আলোচনা করবো, তারও তো কোনো উপায় নেই। তাহলে তো ওকে সব কিছুই খুলে বলতে হয়। কিন্তু সেটা তো করা যাবে না। লোকটা যে হুমকি দিলো, বেইলিকে মেরে ফেলবে, সেটা ভেবেই তো আমি রীতিমতো স্তম্ভিত আর হতবুদ্ধি হয়ে যাচ্ছি। তিনি রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো মা’কে সব খুলে বলি। আমি যে বিছানায় হিস্যু করিনি আর মিস্টার ফ্রিম্যান যে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন, এতসব ঘটনা ঘটিয়েছেন, সেগুলো মাকে খুলে বলতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু তিনি তো বেইলিকে খুন করার হুমকি দিয়েছেন। ফলে আমি সবকিছু চেপে গেলাম।
হায় আল্লাহ! আবার সেই পুরাতন ফাঁপরে পড়লাম! এই যন্ত্রণার মধ্যেই সারাজীবন আমাকে বাঁচতে হলো। সারাজীবন ধরে দেখলাম যে, আমার সামনে সবসময় জাঁদরেল আর্মিদের মতো একদল বয়স্ক মানুষ ঘুরে বেড়ায় এবং তারা আসলে আমার কাছ থকে কী চায়, আর তাদের তাদের উদ্দেশ্য, ভাবভঙ্গি বা মতিগতির আসলে কিছুই আমি কখনোই বুঝে উঠতে পারিনি। আর তারাও কখনো আমাকে বোঝার চেষ্টা করেনি। একই ঘটনা ঘটলো মিস্টার ফ্রিম্যানকে নিয়েও। তাকে অপছন্দ করার মতো কোনো কারণ এখন পর্যন্ত ঘটেনি, আর তিনিও যে আমাকে অপছন্দ করবেন, তেমন কিছুও তো আমি করিনি। প্রকৃতপক্ষে আমরা কেউ কাউকে আসলে ঠিকমতো বুঝতেই পারিনি।
এরপর, দিনের পর দিন তিনি আমার সঙ্গে আক্ষরিক অর্থেই কিছুই করলেন না। শুধু অপরিচিত মানুষের মতো দূর থেকে বিষণ্ণভাবে আমার দিকে না তাকিয়েই হ্যালো বলে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগলেন। এভাবেই কয়েক সপ্তাহ কেটে গেলো এবং এটাই আমার জীবনের একমাত্র গোপনীয় ঘটনা, যা আমি বেইলির কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিলাম। আর প্রায়ই আমি ভাবতাম যে, বেইলি হয়তো আমার চেহারা দেখেই সবকিছু বুঝে ফেলবে আর আমাকে চাপাচাপি করবে আসল ঘটনা খুলে বলার জন্য। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে বেইলি কোনো কিছুই খেয়াল করলো না পর্যন্ত।
তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘নড়ো না, প্লিজ নড়ো না! চুপ করে বসে থাকো, এভাবে মোচড়ামুচড়ি করো না প্লিজ।’ তিনি এসব কথা বলতে বলতেই আমাকে কোলের ওপর নিয়ে ভীষণভাবে ঝাঁকাতে লাগলেন।
এদিকে মিস্টার ফ্রিম্যানের জন্য আমার ভীষণ কষ্ট হতে লাগলো। আমি খুব নিঃসঙ্গ বোধ করতে লাগলাম। আর তার বিশাল বাহুর ভেতর যে নিরাপত্তা খুঁজে পেতাম তা হারিয়ে ফেলেছি বলে বিষণ্ণ বোধ করতে লাগলাম। এতদিন পর্যন্ত আমার জীবনে শুধু বেইলি ছিল। আর তার সঙ্গে ছিল খাবারদাবার, মোমা আর তার স্টোর, অনেক অনেক গল্পের বইয়ের সম্ভার এবং আংকেল উইলি। কিন্তু কেউ কখনো কোনোদিন এর আগপর্যন্ত আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেনি। মানুষের স্পর্শ কেমন হয়, সেটা আমি আগে জানতাম না। এই প্রথমবারের মতো আমি কোনো একজন মানুষের স্পর্শ পেলাম। আর সেটা আমি ভীষণভাবে মিস করতে লাগলাম।
প্রতিদিন উঠোন থেকে বাড়ির ভেতরে ঢোকার পথে আমি বসে বসে মিস্টার ফ্রিম্যানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি যখন বাসায় ঢুকতেন, তখন কখনোই আমার দিকে তাকাতেন না পর্যন্ত। আর আমি নাছোড়বান্দার মতো গভীর অনুরাগ নিয়ে প্রতিদিন তাকে শুভ সকাল, শুভ সন্ধ্যা বলতেই থাকলাম!
এভাবে চলতে চলতেই হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় আমি খুব অস্থির হয়ে পড়লাম। সেদিন সারাদিন মনখারাপ করে ছিলাম। কোনোকিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। মিস্টার ফ্রিম্যান তার রুমে বসে আছে দেখতে পেয়ে দৌড়ে গিয়ে তার কোলের ওপর বসে পড়লাম। তিনি তখনো বসে বসে শুধুই আমার মা’র জন্যই অপেক্ষা করে ছিলেন। আর বেইলি সেসময় শ্যাডো অ্যালবামের গানগুলো শুনছিল। ও আর আমাকে একটুও মিস করতো না। আমি আছি কি না, ও সেটা খেয়াল পর্যন্ত করতো না। আমি কোলে বসার পরেও মিস্টার ফ্রিম্যান একেবারে অনড় হয়েই বসে রইলেন। এমনকি আমাকে একটু জড়িয়ে পর্যন্ত ধরলেন না। কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারলাম যে আমার ঊরুর নিচে একটি নরম মাংসপিণ্ড আস্তে আস্তে শক্ত হয়ে উঠছে আর নড়াচড়া করছে। হঠাৎ করেই জিনিসটা একেবারে শক্ত হয়ে উঠলো আর সেইসঙ্গে তিনিও আমাকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে কাছে টেনে নিলেন এবং বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরলেন। এরপর তিনি গভীরভাবে শ্বাস নিতে নিতে কয়লার ধুলো আর গ্রিসের ঘ্রাণ নিতে লাগলেন। আর আমার এতই কাছে চলে এলেন যেম আমি তার বুকের ভেতর মুখ গুজে তার বুকের হৃদস্পন্দনের শব্দ শুনতে লাগলাম। আমি বুঝতে পারলাম যে, তার এই হৃদস্পন্দন আসলে আমার জন্যেই হচ্ছে। তার বুকের ভেতর এই ধুকপুকানি যা শুধু আমার জন্যই হচ্ছে আর আমিই একমাত্র শুনতে পাচ্ছি। তার হৃদয়ের এই ধুকধুক শব্দ এসে আমার কানের ওপর আর মুখের ওপর এসে বাড়ি খাচ্ছে। আমি সব শুনতে পাচ্ছি কারণ আমি মুখ গুঁজে রয়েছি তার শার্টের মধ্যে তার বুকের ভেতর। তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘নড়ো না, প্লিজ নড়ো না! চুপ করে বসে থাকো, এভাবে মোচড়ামুচড়ি করো না প্লিজ।’ তিনি এসব কথা বলতে বলতেই আমাকে কোলের ওপর নিয়ে ভীষণভাবে ঝাঁকাতে লাগলেন। এরপর কোনো কথাবার্তা না বলে হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়ালেন আর আমি সঙ্গে সঙ্গে কোল থেকে পিছলিয়ে মেঝের ওপর এসে ধুপ করে পড়ে গেলাম। আর তখন তিনি বাথরুমের দিকে দৌড়ে চলে গেলেন।
চলবে…