অনুবাদ: ফারহানা রহমান
[পর্ব-২১]
সেন্ট লুইসকে আমি কখনোই নিজের স্থান বলে মনে করতে পারিনি। মনে মনে সবসময় ভাবতাম যেকোনোএকটি বিশেষ কারণেই আসলে আমি এখন বিদেশে আছি। হঠাৎ করে ভোঁস করে ওঠা টয়লেটের ফ্ল্যাশের শব্দের সঙ্গে আমি কোনোদিন অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারিনি। আর প্যাকেটে ভরা খাবার-দাবারের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার কথা তো ভাবাই যায় না। যখন-তখন বিনা নোটিশে বেজে ওঠা কলিংবেলের আওয়াজ অথবা চরম বিরক্তিকর গাড়ি, ট্রেন বা বাসের ভয়াবহ ক্যাওয়াজের শব্দ যা দেয়াল ছাপিয়ে অথবা দরজার নিচের ফাঁকফোকর দিয়ে ভেসে এসে কানে ঝালাপালা করে দিতো সেসব উদ্ভট শব্দের সঙ্গে সত্যি বলতে কী আমি এ জীবনে কখনোই নিজেকে ঠিক মানিয়ে নিতে পারিনি। মনে মনে আমি সবসময়ই ভাবতাম যে আমি আসলে কয়েক সপ্তাহের জন্যই শুধু সেন্ট লুইসে বেড়াতে এসেছি মাত্র। আবার যেকোনো দিন মোমার কাছে স্ট্যাম্পসেই ফিয়ে যাবো। যত দ্রুত সম্ভব আমি বুঝে গেলাম যে এটা আমার নিজের বাড়ি নয়। আর তারপর থেকেই রবিন হুডের ঘন জঙ্গলে আর অ্যালি উপসের বিশাল বিশাল গুহার ভেতর যেখানে সব বাস্তবতাই আসলে অবাস্তব কল্পকাহিনীতে ঠাঁসা আর যা প্রতিদিনই আমার সামনে নতুন রূপে আবির্ভূত হতো সেখানেই নিজেকে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করলাম। আর স্ট্যাম্পেও আমি ঠিক একইরকম আবর্তনের মধ্যেই নিজেকে ঢুকিয়ে রাখতাম। আমি জেখানেই যখন থাকতাম সবসময়ই এভাবেই ভাবতাম যে আমি এখানে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য আসিনি।
আমাদের সব প্রয়োজনই মেটাতে সক্ষম ছিলেন আমাদের মা। এমনকি এর মানে যদি অন্য কাউকে দিয়েও কাজগুলো উদ্ধার করাকেও বোঝানো হয়ে থাকে তবে তাই। যদিও তিনি একজন প্রফেশনাল নার্স ছিলেন কিন্তু আমরা যখন তার সঙ্গে থাকতাম তখন তিনি কখনোই তার পেশা সংক্রান্ত বা অন্যকে সেবা দেওয়ার কোনো কাজ করতেন না। এদিকে মিস্টার ফ্রিম্যান তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রই শুধু কিনতেন। কিন্তু আমাদের মা জুয়াঘরে তাস কেটে কেটে পোকার গেমস খেলে অনেক বাড়তি টাকাপয়সা উপার্জন করতেন। আর সেটা দিয়েই আমাদের সব প্রয়োজন মিটতো। ঘড়ির কাটা ধরে ধরে আটটা থেকে পাঁচটার যে চাকরির জগৎ তার প্রতি আমার মা’র কখনোই কোনো আগ্রহ বা আকর্ষণ ছিল না। আমার মা ছিলেন একজন ভীষণ গ্ল্যামারাস নারী যাকে নার্সের ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় দেখার জন্য আমাকে পরবর্তী সময়ে কুঁড়ি বছর ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
মিস্টার ফ্রিম্যান সাউথারন প্যাসেফিক ইয়ার্ডসে ফোরম্যান হিসেবে চাকরি করতেন। মা রাতে বাড়ির বাইরে বের হলে মিস্টার ফ্রিম্যান মাঝেমাঝে অনেক রাত করে ঘরে ফিরতেন। মা চুলার আঁচ কমিয়ে দিয়ে তার ওপর খুব যত্ন করে খাবার ঢেকে রেখে দিতেন। মিস্টার ফ্রিম্যান চুলো নিভিয়ে দিয়ে সেখান থেকে খাবার নিয়ে খেতেন। মা এমনভাবে সবার জন্য খাবার রেডি করে রাখতেন যেন আমরা ওঁকে এই ব্যাপারটি নিয়ে কখনো বিরক্ত না করি। রান্নাঘরে বসে মিস্টার ফ্রিম্যান চুপচাপ রাতের খাবার খেয়ে নিতেন। এদিকে সে সময়টিতে আমি আর বেইলি লোভাতুর হয়ে আলাদা আলাদাভাবে আমাদের স্ট্রিট অ্যান্ড স্মিথপাল্প ম্যাগাজিনটা পড়তাম। আর এখন যখন আমরা পত্রিকার পেছনে পয়সাই খরচ করছি তখন তো জাঁকজমকপূর্ণ ছবিওয়ালা ইলাস্ট্রেটেড পেপারব্যাকের ম্যাগাজিনই কিনবো, তাই না? আর আমাদের মা যখন বাইরে থাকতেন আমরা চেষ্টা করতাম বাড়ির ভেতর একটি সম্মানজনক পরিস্থিতি ধরে রাখার। ফলে আমরা আমাদের হোমওয়ার্ক শেষ করে রাখতাম। সেইসঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে সব হাঁড়িপাতিলগুলোকেও ধুয়েমুছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে উঠিয়ে রেখেই কেবল আমরা ম্যাগাজিন নিয়ে বসতাম। অথবা লোন রেঞ্জার, ক্রাইম বাস্টার বা দ্য শ্যাডোর গানগুলো বাজিয়ে দিতাম তখন।
মিস্টার ফ্রিম্যান বড়সড় একটি বাদামি ভল্লুকের মতোই খুব সম্ভ্রমের সঙ্গে চলাফেরা করতেন। আমাদের সঙ্গে একেবারেই কম কথা বলতেন। তিনি শুধু মা’র জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকতেন। আক্ষরিকভাবেই তিনি তার সমস্ত সত্তা ত্যাগ করে এই অপেক্ষার পেছনে নিজেকে একেবারে সঁপে দিতেন। তিনি কখনোই বসে বসে কোনো পেপার পত্রিকা পড়তেন না অথবা পা নাচিয়ে নাচিয়ে মগ্ন হয়ে রেডিওতে গানবাজনা বা অন্যকিছু শুনতেন না। তিনি যা করতেন তা হচ্ছে এক অপরিসীম অনন্ত অপেক্ষা আর সত্যি সত্যিই সেটাই শুধু তিনি করতেন যার নাম প্রতীক্ষা!
যাইহোক না কেন আমি তো খুব ভালো করেই জানি শুধু এদের মৃত্যুর মাধ্যমেই আসলে এতসব মজার মজার খাবারগুলো পেট ভরে খাওয়া সম্ভব।
কখনো যদি আমাদের ঘুমিয়ে পড়ার আগে মা বাড়িতে ফিরতেন তাহলে আমরা দেখতাম যে জীবন্মৃত মিস্টার ফ্রিম্যানের দেহে প্রাণ ফিরে এসেছে। কারণ আর বাকী সময়গুলোতে তিনি একেবারেই একজন মরা মানুষের মতোই বিষণ্ন হয়ে পড়ে থাকতেন। মাকে দেখেই তিনি হাসতে হাসতে তার বিশাল চেয়ার থেকে এমনভাবে উঠে আসতেন যেন এইমাত্র তিনি ঘুম ভেঙে জেগে উঠলেন। এই ঘটনাগুলো ঘটার কয়েক সেকেন্ড আগের দৃশ্যগুলোর কথা আমি এখনো মনে করতে পারি। আমার মনে আছে যে আমাদের দরজার কাছে এসে হঠাৎ করেই যেন একটি গাড়ি এসে থামতো, তারপর ইটের দেয়াল ভেদ করে মা’র হাইহিল পরা পায়ের ঠকাঠক শব্দগুলো ক্রমশ আমাদের কানের কাছে ভেসে আসতো। আর অবশেষে তার দরজা খোলার চাবিটি আমাদের দরজার ওপর ঝনঝন করে বেজে উঠতো আর সঙ্গেসঙ্গেই মোচর দিয়ে দরজাটিও খুলে যেতো। এবং একইসঙ্গে মিস্টার ফ্রিম্যান তার স্বভাবসুলভ প্রশ্নটিও মার উদ্দেশে ছুড়ে দিতেন, ‘হেই বেইবি তোমার দিনটি ক্যামন কাটলো সোনা?’
আর মা বাসায় ঢুকেই লাফ দিয়ে মিস্টার ফ্রিম্যানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন আর তাকে জড়িয়ে ধরে তার ঠোঁটগুলোকে নিজের ঠোঁটের ভেতর ঢুকিয়ে চুমু খেতে শুরু করতেন। অথচ তখনো কিন্তু মিস্টার ফ্রিম্যানের ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নটি বাতাসে ভেসে বেড়াতো। এর পরপরই মা ঘুরে দাঁড়িয়ে আমাকে আর বেইলিকে জড়িয়ে ধড়ে লিপস্টিকসহই চুমু খেতে শুরু করতেন আর জানতে চাইতেন, ‘তোমরা কি তোমাদের হোমওয়ার্ক এখনো শেষ করনি সোনারা?’ আমরা যখন বলতাম যে শেষ হয়েছে তার উত্তরে তিনি বলনে, ‘খুব ভালো করেছো লক্ষ্মী বাচ্চারা আমার। আচ্ছা এখন যাও তোমাদের রাতের প্রার্থনা শেষ করে ঘুমিয়ে পড়গিয়ে।’ আর কখনো যদি আমাদের হোমওয়ার্ক কিছুটা বাকি রয়ে যেতো অথবা মা এসে দেখতো যে আমরা তখনো বসে বসে পড়ছি তখন তিনি বলতেন, ‘আচ্ছা তাহলে এখন তোমরা তোমাদের রুমে গিয়ে আগে হোমওয়ার্ক শেষ করো তারপর কিন্তু রাতের প্রার্থনা শেষ করবে এবং তারপর ঘুমাতে যাবে, ঠিক আছে?’
এমন কখনো হোতো না যে মিস্টার ফ্রিম্যান মুচকি মুচকি করে হাসতে হাসতে হা হা করে হেসে উঠলেন। বরং তিনি সবসময় একইরকম গভীরতা নিয়েই ভাবেই মুচকি মুচকি করে হাসতেন। মাঝে মাঝে এমন হোতো যে মা হঠাৎ করেই মিস্টার ফ্রিম্যানের কোলের ওপর গিয়ে বসতেন এবং তাকে ভীষণ আদর করতেন। আর তখন মিস্টার ফ্রিম্যানের চেহারাটা একেবারে দেখার মতো হোতো। তিনি তখন এতোই তরুণ হয়ে উঠতেন যেন তিনি চিরকাল এমনই থাকতে চান আর চান যে মা ও যেন সবসময় তার কোলের ওপরেই এভাবে বসে থাকে।
আমাদের রুম থেকেই আমরা শুনতে পেতাম যে তারা দুজন রেডিও ছেড়ে দিয়ে গান শুনছে এবং মদের গ্লাস দুটোকে টোস্ট করছে। আমার মনে হয় মা আসলে তার সঙ্গে রাত্রিটা দারুণভাবে উদযাপন করার জন্যই ওঁকে নেচে নেচে দেখাতেন। তিনি একাই নাচতেন কারণ মিস্টার ফ্রিম্যান নাচতে পারতেন না। তিনি শুধু বসে বসে মার ডান্স দেখতেন। ঘুমিয়ে পড়ার আগপর্যন্ত প্রায়ই আমি শুনতে পেতাম যে আমার মা নিজের দুপায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মিলিয়ে একাই নেচে চলেছেন।
আমি মিস্টার ফ্রিম্যানের জন্য মনে মনে খুব কষ্ট পেতাম। আমি তার জন্য এতটাই কষ্ট পেতাম যে ঠিক একইভাবেই কষ্ট পেতাম আরকান্সাসের পেছনের উঠোনে সদ্য জন্ম নেওয়া অসহায় শুয়োর ছানাগুলোর জন্যেও। শীতের শুরুতেই যেন আমরা পর্যাপ্ত খাবার মজুদ করে রাখতে পারি সে-কারণেই সারাবছর ধরে আমরা শুয়োরগুলোকে বেশি বেশি খাইয়ে খাইয়ে থকথকে চর্বিযুক্ত মোটাতাজা করে তুলতাম। যদিওবা আমি সেই ছোট্ট টুসটুসে হেলেদুলে চলা শুয়োর ছানাগুলোর অসহায়ত্বের জন্য খুবই কষ্ট পেতাম। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, আমি তো এটাও জানি যে এদের কাছ থেকে পাওয়া একেবারে টাটকা সসেজ আর ওদের মাথা দিয়ে বানানো গরম গরম মজাদার চিজস খেতে আমি কতই না ভালোবাসি। যাইহোক না কেন আমি তো খুব ভালো করেই জানি শুধু এদের মৃত্যুর মাধ্যমেই আসলে এতসব মজার মজার খাবারগুলো পেট ভরে খাওয়া সম্ভব।
চলবে…
আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-২০॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু