অনুবাদ: ফারহানা রহমান
[পর্ব-১৯]
আমাদের মা যেহেতু নেচে নেচে ঘুরে ঘুরে হ্যাভি ব্লুস’য়ের গান গেয়ে যাচ্ছিলেন। ফলে সিরিয়ার সেই দুই ভাই ভীষণ উদগ্রীব হয়ে মায়ের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। অথচ আমি আর বেইলি ঠিকই বুঝতে পারছিলাম, ওঁর গানের মানে। সিরিয়ার ভাইয়েরা অন্যান্য কাস্টমারের সঙ্গে কথা বলার সময়েও মায়ের দিকে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে ছিলেন। আমি খুব ভালো করেই জানি যে, ওঁরা দুজনই আমার মায়ের পাগল করা সৌন্দর্য দেখে একেবারে সম্মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন। আমার মা যে কী না, কথা বললে তার পুরো দেহে, তার চোখমুখ ঠিকরে সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। কথা বলার সময় তার উচ্ছলতা পৃথিবীর যে কাউকে ছাড়িয়ে যায়।
আমরা একসময় লুইসের সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে শিখে গেলাম। সম্ভবত এই সময়টিতেই অ্যামেরিকার কালো নৃত্যশিল্পীরা সবচেয়ে বেশি জন্মেছিলেন। এই নাচটিতে একটু পর পর থেমে যাওয়া, লাফ দেওয়া ও বিশ্রাম নেওয়া ক্রমানুসারে চলতে থাকে। আর অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শোনা, অনুভব করা আর সমন্বয় করাও খুব জরুরি একটি ব্যাপার। আমাদের মায়ের একজন বন্ধুর সামনে আনা হলো। আমাদের কতটুকু শিল্পদক্ষতা আছে, তা দেখানোর জন্য আমাদের একটি বিশাল বড় হলঘরে নিয়ে আসা হলো। বেইলি তাড়াতাড়ি নাচতে শিখে গেলো। সে একজন ভালো নৃত্যশিল্পী হয়ে উঠেছিল। ওই সবসময়ই খুব ভালো নাচতো। আমিও একসময় খুব ভালো নাচতে শিখে গেলাম। জেতার সংকল্প নিয়েই আমি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচতে লাগলাম। যা আমি একইরকম সংকল্প নিয়েই সময়ের সঙ্গেও তাল মিলিয়েই চলতাম।
এখানে আংকেল উইলি অথবা সিজলিং বানানোর জন্য বেলিড চুলা ছিল না। তবে এখানে যা ছিল, তা হচ্ছে প্রিয় মা এবং তার হাস্যরসাত্মক বন্ধুবান্ধবরা, যারা একইভাবে আমাদের উদ্যমী হয়ে কাজ করতে সাহায্য করতেন। ওঁরা আমাদের সারাক্ষণ প্রশংসা করতেন। আরও বেশি বেশি করে সফট ড্রিংক্স আর সেদ্ধ চিংড়ি খেতে দিতেন। তবে, বহুবছর পরেই আমি শুধু নাচতে পারার প্রকৃত আনন্দ ও স্বাধীনতার স্বাদ বুঝতে পেরেছিলাম।
আমার তিন মামা টুটি, টম ও ইরা। সেন্ট লুইসের যুবক হিসেবে সবাই ওঁদের চিনতো। তারা সবাই শহরে চাকরি করতেন। আর নিগ্রো সমাজে আমাদের কেন এত মূল্যায়ন করা হতো, তার প্রকৃত কারণ এতদিন পর এখন ঠিকমতো বুঝতে পারি। কর্মজীবন ও পারিবারিক জীবন ওঁদের সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। আর ওঁদের ক্রমাগত সংকীর্ণতা ও নিচুতাই ওঁদের সবার কাছে এত বিখ্যাত করেছিল। আমাদের নানা মাঝেমাঝে দুঃখ করে বলতেন, ‘ওহ জেসাস! তোমরা যদি চুরির দায়ে বা এ রকম কোনো বোকামির জন্য জেলে যেতে, তাহলে আমি তোমাদের ওখানেই পচে মরতে দিতাম! কিন্তু তোমরা যদি মারামারি করার জন্য অ্যারেস্ট হও, তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই এই বাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে তোমাদের ঘর থেকে বের করে দেবো। আর বাড়িকে চিরদিনের জন্য তালাবদ্ধ করে গুদাম বানিয়ে চলে যাবো।’
ছেলেমেয়েরা তাকে নানারকম কৌতুক শোনাতেন, তার সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে আড্ডা মারতেন, হাসিঠাট্টা করতেন এবং জীবনের শেষের দিনগুলোয়ো যথাসাধ্য ওঁকে ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে রেখেছিলেন।
বাইরে গিয়ে গুণ্ডামি করার জন্য এমন দারুণ উৎসাহ পেয়ে আমার মামারা একেবারে বর্তে যেতেন। তারা একেকজন একেকটি আগুনের গোলা হয়ে ফুটতে ফুটতে ঘর থেকে বের হতেন। এসব কারণেই যে আমার মামারা সব একেকজন একেকটি ভয়ঙ্কর দানবে পরিণত হয়েছিলেন, তাতে আর অবাক হওয়ার মত কী আছে? আমাদের সবচেয়ে ছোট মামা বিলি তখন পর্যন্ত এসব শয়তানি কাণ্ডকারখানার মধ্যে যোগ দেওয়ার মতো যথেষ্ট বড় হয়ে ওঠেননি। অথচ এই কিংবদন্তী পরিবারটির সবচেয়ে জ্বলজ্বলে তারায় পরিণত হয়েছিলেন তিনি।
রীতিমতো দৈত্যপ্রায় একটি লোক ছিল প্যাট প্যাটারসন। সমাজে যার বদনামের কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না। সেই কিনা একদিন আমার মাকে ভীষণ গালিগালাজ করা শুরু করলো। কারণ, মা সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত একা একা বাড়ির বাইরে ছিলেন। আর এটাই ছিল তার জীবনের ভয়ানক এক ভুল। মা ওই লোকটির ব্যাপারে তার ভাইদের কাছে নাশিল করলেন। আমাদের মামারা তাদের অনুগত খুনিদের মধ্যে থেকে একজনকে আদেশ করলেন, পেটারসনকে খুঁজে বের করে আটকে রাখতে। আর লোকটির অবস্থান সম্পর্কে মামাদের ফোন করে জানাতে।
সারা দুপুর তারা লিভিংরুমে বসে বসে ফোনের অপেক্ষায় রইলো। তারা লোকটিকে নিয়ে ঠিক কী কী করবে, সেই ফন্দি ফাঁদতে ফাঁদতে ঘরটিকে সিগারেটের ধোঁয়ায় প্রায় অন্ধকার করে ফেললো। একটু পর পর নানা এসে মামাদের চা-কফি দিয়ে দিয়ে অনুনয়-বিনয় করতে লাগলেন, ‘বাবারা! ওর জানটা নিস না, দয়া করে ওকে একদম মেরে ফেলিস না।’ এরপর নানা কফির কাপ হাতে নিয়ে নানির কাছে চলে গেলেন।
খবর পাওয়ামাত্র মামারা বিদ্যুৎগতিতে পানশালায় গিয়ে হাজির হলেন। ওখানে ছোট একটি টেবিলে চুপচাপ বসে বসে প্যাটারসন মদ খাচ্ছিল। টমি মামা পানশালার মূল দরজাটা আটকে দাঁড়িয়ে থাকলেন। টুটি মামা টয়লেটের দরজা আটকে রেখে তার সামনে পাহারায় দাঁড়িয়ে থাকলেন। বড় মামা ঈরা যাকে সবাই দেবদূতের মতো শ্রদ্ধা করতো আর যাকে সবাই আদর্শ হিসেবে নিয়েছিল, তিনি একেবারে প্যাটারসনের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালেন। আর নিশ্চিতভাবেই সবার কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল।
মাকে কাছে ডেকে ঈরা মামা বললেন, ‘এসো বিবি, এদিকে এসো। দেখো তোমার সামনে কাছে হাজির করেছি। এই যে এটা নিগার প্যাটারসন। দ্যাখো একে আর এর পাছায় কষে একটা লাথি মারো।’
আমার মা পুলিশের ব্যবহার করা মোটা শক্ত বিলিস্টিক দিয়ে লোকটার মাথা এমনভাবে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিলেন যে, ওই মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়লো। আর এই ঘটনার জন্য কখনো কোনো পুলিশ ইনভেস্টিগেশন হয়নি। এমনকী কোনো সামাজিকভাবে নিন্দা বা তিরস্কারও কেউ করেনি।
যত যাইহোক না কেন, নানার হিংস্রতা ও ভয়াবহ মেজাজের কথা যেমন সবাই জানতো, ঠিক একইভাবে আমার প্রায় সাদা বর্ণের নানির সঙ্গে যে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের হোমরাচোমরাদের দারুণ খাতির ছিল, তাও এলাকার সবাই জানতো।
আমার এটা স্বীকার করতে কোনো লজ্জা নেই যে, আমার মামাদের ওইসব গুণ্ডামি দেখে আমি সত্যি খুব রোমাঞ্চিত বোধ করতাম। ওঁরা নিঃসঙ্কোচে একইরকম উল্লাস নিয়ে সাদা আর কালোদের বেদম ধোলাই দিতেন। আর আমার মামাদের নিজেদের মধ্যে এতোই গভীর বোঝাপড়া আর বন্ধুত্ব ছিল যে, তাদের কখনো অন্য কোনো বন্ধুর দরকার পড়তো না। আর তারা কখনো বাইরের কারও সঙ্গে বন্ধুত্বও করতেন না। আমার মা ছিলেন তাদের সব ভাইবোনের মধ্যে একমাত্র ভীষণ উষ্ণ, মিশুক আর বন্ধুবৎসল। তিনি ছিলেন বহির্মুখী একজন মানুষ। আমাদের লুইসে বসবাসরত অবস্থাতেই আমাদের নানা অসুস্থ্য হয়ে বিছানা ধরলেন। আর ওঁর ছেলেমেয়েরা রুটিন করে তাদের অবসর সময় তার যত্নআদ্যি করতে লাগলেন। ছেলেমেয়েরা তাকে নানারকম কৌতুক শোনাতেন, তার সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে আড্ডা মারতেন, হাসিঠাট্টা করতেন এবং জীবনের শেষের দিনগুলোয়ো যথাসাধ্য ওঁকে ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে রেখেছিলেন।
চলবে…
আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-১৮॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু