[১৯৩০ সালের ১ জানুয়ারি সিরিয়ার লাটাকিয়ার আল কোয়াসাবিন নামক গ্রামের একটি কৃষক পরিবারে আরবের কবি, অনুবাদক,সম্পাদক ও তাত্ত্বিক কবি অ্যাডোনিস জন্ম হয়। তার প্রকৃত নাম আলী আহমেদ সৈয়দ ইসবার। সতের বছর বয়সে তিনি নাম পরিবর্তন করে গ্রিক দেবতার নাম অনুসারে নিজের নাম রাখেন অ্যাডোনিস।
১৪ বছর বয়সে তিনি সিরিয়ার রাষ্ট্রপতিকে একটি কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন। এর ফলে তিনি একটি ফরাসি স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। পরবর্তী সময়ে দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সেখান থেকে দর্শনে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে তার ভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য তাকে ১৯৫৫ সালে একবছর কারাগারে বন্দি জীবন কাটাতে হয়। সেখান থেকে ছাড়া পেতে তিনি বৈরুতে চলে যান। সেখানে তিনি প্রবাসী লেখক ও শিল্পীদের একটি সমৃদ্ধ সম্প্রদায় খুঁজে পান। এবং শির এবং মাওয়াকিফ নামে দুটি প্রগতিশীল সাহিত্য পত্রিকার প্রতিষ্ঠা ও সম্পাদনা করেন।
পরবর্তী সময়ে তিনি সেন্ট জোসেফ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। ১৯৬০ সাল নাগাদ তিনি সুফি ভাবধারার সঙ্গে স্যুরিয়েলিজম মিশিয়ে একটি নতুন কবিতাধারা গড়ে তোলেন। আরবি কবিতার আধুনিক আন্দোলনের তিনি একজন পথিকৃৎ। আদুনিস আরবি কবিতার আনুষ্ঠানিক কাঠামোর ঐতিহ্য ভেঙে দিয়ে মুক্ত শ্লোক ও গদ্য কবিতার কাঠামোয় নিয়ে আসেন।
আদুনিস অসংখ্য কবিতার সংকলনের লেখক। প্রায় ১৭ টি ভাষায় তার কবিতার অনূদিত হয়েছে। তিনিই প্রথম আন্তর্জাতিক নাজিম হিকমত কবিতা পুরস্কার, নরওয়েজিয়ান একাডেমি ফর লিটারেচার অ্যান্ড ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশনস বিজারসন পুরস্কার, ব্রাসেলস আন্তর্জাতিক কবিতার সর্বোচ্চ পুরস্কার এবং সিরিয়া-লেবানন সেরা কবি পুরস্কার জিতেছেন। তিনি সার্বনে দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয় এবং লেবানিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। বর্তমানে তিনি সপরিবারে প্যারিসে বসবাস করছেন। —অনুবাদক]
আমাদের মধ্যে কোনো কথা নেই
আমাদের চোখের পাতা থেকে কি বালিগুলো একেবারে ধুয়েমুছে যাবে?
খরস্রোত কি তবে ধুয়ে দিতে পারে সব শস্যের দানা?
ও ভঙ্গুর! ও হে পোড়া বীজেরা!
আমাদের ভেতর আর কোনো কথা নেই।
নেই কোনো প্রতিধ্বনি অবশিষ্ট।
আর চেয়ে দ্যাখো, রাস্তার সামনেই
সেতুগুলো সব কেমন ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে।
আলাপের শুরু
অতীতে যে শিশুটি আমি ছিলাম,
সে একবার আমার কাছে এসেছিল
কী অদ্ভুত একটি মুখ!
কিন্তু সে কিছুই বলেনি
নৈঃশব্দ্যের ভেতর আমরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হেঁটেছি
আমাদের দুজনের চলার পথে একটি অপরূপ নদী বয়ে গেছে ।
শিষ্টাচারগুলো আমাদের কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল
স্মৃতিগুলো পাল তুলে এখন বাতাসে উড়ছে
আর তারপর,
যেখানে পৃথিবী একটি অরণ্য রচনা করেছিল
সেখানে কখন যেন আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম
আর ঋতুর বদলে তা জলে ভরে গেলো।
একসময় যে শিশু ছিল, সে এবার সামনে এলো—
জানি না,
কী যে আমাদের কাছে নিয়ে এলো
কী বা বলার বাকি আছে আর আমাদের?
নিঃসঙ্গ ভূমি
আমার বসতি এইসব পলাতক শব্দের ভেতর
আমি বেঁচে আছি,আমার মুখের একান্ত সঙ্গী হয়ে
আর শোনো, আমার মুখমণ্ডলই হচ্ছে আমার দিশারি
আর তোমার নামের মধ্যেই রয়েছে আমার দেশ,
যে, দীর্ঘ, মন্ত্রমুগ্ধ এবং নিঃসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আর তোমার নামের মধ্যেই আমার মৃত্যু নিহিত আছে হে বন্ধু আমার।
নতুন নুহ
কাদা ও বৃষ্টিতে আমরা জাহাজে ভ্রমণ করে বেড়াই
আমাদের ওহিরা ঈশ্বরের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ
আমরা বেঁচে আছি–অথচ আমাদের সমস্ত মানবতা মরে যায়
আমরা তরঙ্গের ওপর ভ্রমণ করি, আর সেখানেই আটকে গেছি;
আকাশ ভরা লাশের দড়িতে আমাদের জীবন ঝুলছে
তবে স্বর্গ আর আমাদের মধ্যে প্রার্থনার মধ্যে
একটি মাত্র বাইরের জানালা খোলা আছে
‘বলুন,তবে কেন প্রভু, আপনি শুধু আমাদেরই রক্ষা করলেন?
বাকি আর সব মানুষ ও জীবজন্তুর ভেতর থেকে?
আর এখনই বা আমাদের তবে কোথায় ছুড়ে ফেলছেন?
আপনার অন্য ভূমিতে , নাকি আমাদের প্রথম জন্মভুমিতে?
মৃত্যুর উড়ন্ত পাতাদের আঁধারে, নাকি জীবনের বাতাসে?
আমাদের মধ্যে, আমাদের ধমনীর ভেতর
শুধু সূর্যের প্রতি ভয় প্রবাহিত হয়।
আমরা আলোর প্রতি নিরাশ
আমরা হতাশ, প্রভু, আগামীর প্রতি
আবার নতুন করে জীবন শুরুর প্রতিও।
আমরা যদি সৃষ্টির সেই চারাগাছ না হতাম
যদি না হতাম কেউ পৃথিবীর অথবা এই প্রজন্মের?
অথবা আমরা যদি শুধু সাধারণ কাদামাটি
বা জ্বলন্ত অঙ্গার হতাম
বা এদের মাঝামাঝি কিছু একটা
তাহলেই আর আমাদের এভাবে দেখতে হতো না
এই পৃথিবীকে, এর প্রভুকে
আর এর জাহান্নামকে,নতুন করে আবারও ।
নতুন নুহ-২
যদি সময় আবারও নতুন করে শুরু হয়
আর জল জীবনের সম্মুখে নিমজ্জিত হয়
এবং পৃথিবীটি প্রকম্পিত হয়ে ওঠে, আর সেই ঈশ্বর
আমার দিকে ছুটে এসে অনুনয়-বিনয় করে, ‘নুহ, জীবিতদের রক্ষা করুন!’
তাঁর অনুরোধের সাথে আমি আর নিজেকে জড়াবো না
আমার জাহাজে করে আমি ভ্রমণ করে যাবো, অপসারণ করবো
মৃতদের চোখ থেকে কাদা ও নুড়ি।
আমি মহাপ্লাবনের কাছে তাদের অস্তিত্বের গভীরতা খুলে দেবো
আর তাদের শিরায় শিরায় ফিসফিস করে বলবো
যে আমরা আসলে মরুভূমি থেকে ফিরে এসেছি;
আমরা আসলে গুহা থেকে নির্গত হয়েছি
আর আমরাই বছরের পর বছর ধরে আকাশকে পরিবর্তিত করেছি।
আরও বলবো, যে আমরা আমাদের ভেতরের ভয়কে হার মানিয়ে যাত্রা করি—
আর আমরা সেই কথিত ঈশ্বরের কথা মানি না।
মৃত্যুর সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে
আমাদের তটরেখাগুলো সুপরিচিত, আর ওগুলো হচ্ছে আনন্দদায়ক হতাশা;
লোহিত জলের তুষার-শীতল সমুদ্র যা দিয়ে আমরা হেঁটে পার হই
এর একেবারে শেষ পর্যন্ত অবারিত।
আর আমরা সেই ঈশ্বরের প্রতি অমনোযোগী এবং তার কথার প্রতিও
আর আমরাই একজন নতুন ঈশ্বরের জন্য প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রতীক্ষায় আছি।
ক্ষত-১
বাতাসের পরশে ঘুমন্ত পাতাগুলো
ক্ষতবিক্ষত তরণী
তারা একে অন্যের ওপর
ক্ষতের মহিমা হয়ে যুগের গ্লানি নিয়ে ধসে পড়ে।
আমাদের চোখের পাপড়িগুলো থেকে গাছগুলো বেড়ে উঠছে
হ্রদের জলের বেদনার মর্মে মর্মে।
সেতুগুলোতে যখন জখমের চিহ্ন ফুটে ওঠে
সেখানে কবর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হয়
আর আমাদের প্রেম ও মৃত্যুর সমুদ্র তীরের মাঝে
সহনশীলতা থাকে সীমা-পরিসীমাহীনভাবে।
দ্যাখো, ক্ষত তো কেবল একটি চিহ্ন মাত্রই
আর এই ক্ষত একটি উত্তরণও বটে।
ক্ষত-২
দেই আমি জখমের স্বর—
ঘণ্টা ধ্বনি দিয়ে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া ভাষাটিকে
আর দুরাগত পাথরটিকেও।
শুকনো পৃথিবীর ধুলোয় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতে যেতে
ফেরি করা সেই সময়ের আছড়ে পড়ে রুক্ষ-প্রান্তরে
জ্বালাই আমি দাউদাউ দহনের আগুন।
আর ইতিহাস যখন পুড়তে থাকে আমার পোশাকের ভেতর
যখন আমার বইগুলোর পাতায় পাতায় নীল নখর গজায়
দিনের পর দিন আমি শুধু কাঁদি
‘কে তুমি? কে তোমাকে ছুড়ে দিয়েছে
আমার এই সরলা দেশটিতে?’
আমার বইয়ের ভেতর ও চির-নবীন ভূমিতে
ধুলোয় তৈরি একজোড়া চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি,
শুনতে পাই— কেউ একজন বলছে
‘আমিই সেই ক্ষত যে জন্মেছি
আর বেড়ে চলেছি তোমার ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গেই।’
ক্ষত-৩
তোমাকে মেঘ বলে ডাকি আমি
বিচ্ছেদ বেদনায় আহত হে আমার ঘুঘু!
আর আমি তোমার নাম রেখেছি বই ও কলম
দ্যাখো, এখানেই শুরু হোলো তবে কথোপকথন
আমার ও প্রাচীন জিভের মাঝে
টোমস দ্বীপে।
আর প্রাচীন পতনের দ্বীপপুঞ্জের ভেতর
বাতাস ও খেজুর গাছগুলোকেই আমি
শব্দ শেখাই,
ও হে, আমার বিচ্ছেদী ঘুঘুর জখম তুমি।
ক্ষত -৪
যদি আমার কাছে থাকতো
স্বপ্ন ও আয়নার একটি বন্দর, একটি জাহাজ
যদি থাকতো একটি শহরের অবশিষ্টাংশ!
অথবা শিশুদের কলকাকলিতে মুখর একটি দেশ, যা কাঁদছে,
জখমের সম্মানে আমি লিখে রাখতাম সবকিছুই।
বর্শার মতো এমন একটি গান
যা গাছ, পাথর এবং আকাশকে ভেদ করে যায়
যা জলের মতোই মোলায়েম আর তখন
শুরু হয় লাগামহীন, বিজয়কেতন।
ক্ষত-৫
বৃষ্টি নামুক আমাদের মরুভূমিতে
স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষায় শোভিত হে পৃথিবী।
ঢেলে দাও আর তবে এবার আমাদের তুমুল নাচাও!
আমরা তো একেকটি ক্ষতের থাবা
ডালপালা ছেঁড়া সেইসব গাছ যা ক্ষতের নৈঃশব্দ্য ভালোবাসে
যে চোখের পাতার দিকে আর নরম হাতগুলোর
দিকে অপলক তাকিয়ে জেগে শুয়ে আছে ।
স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষায় অলঙ্কৃত এই দুনিয়া
আর ক্ষতের ছোবলের মতোই এই পৃথিবী
আমার কপালে এসে আছড়ে পড়ে;
কাছে এসো না, ক্ষতরা নিকটেই রয়েছে
আমাকে প্রলুব্ধ করো না–ক্ষত আরও অনেক বেশি সুন্দর।
যে ইন্দ্রজালের অন্তিম রাজত্বে
তোমার চোখগুলো নিক্ষিপ্ত হয়েছিল
ক্ষত তার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে,
সংকুল পথ পেরিয়ে গেছে আর
একটি পালও কিন্তু পেছনে ফেলে যায়নি;
এমনকি একটি দ্বীপকেও পেছনে ছেঁড়ে যায়নি ,
পরিত্রাণের পথে প্রলোভিত হওয়ার জন্য।