॥ পর্ব: ৩॥
হারুকি মুরাকামি (১২ জানুয়ারি ১৯৪৯) বর্তমান সময়ে জাপানের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। কথাসাহিত্যে অবদানের জন্য জাপান ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমালোচকদের প্রশংসা ও অনেক পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি। এইসব পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি অ্যাওয়ার্ড (২০০৬), ফ্রাংক ও’কনার আন্তর্জাতিক ছোটগল্প পুরস্কার। এছাড়া তাঁর সমস্ত সাহিত্যকর্মের জন্য ফ্রান্ৎস কাফকা পুরস্কার (২০০৬) ও জেরুজালেম পুরস্কার (২০০৯) পেয়েছেন। তাঁর মৌলিক রচনার মধ্যে ‘এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ’ (১৯৮২), ‘নরওয়েজিয়ান উড’ (১৯৮৭), ‘দ্য উইন্ড-আপ বার্ড ক্রনিকল’ (১৯৯৪-১৯৯৫), ‘কাফকা অন দ্য শোর’ (২০০২) এবং ‘ওয়ানকিউএইটফোর’ (২০০৯-২০১০) অন্যতম।
হারুকি মুরাকামি উত্তর আধুনিক সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রভাবশালী লেখক। তিনি গত এক দশকে কয়েকবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য শর্ট লিস্টেড হয়েছেন কিন্তু রহস্যময় কারণে তিনি এখনো নোবেল পুরস্কার থেকে বঞ্চিত। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন আমেরিকান উপন্যাসিক জন রে, চিন্তাসূত্রের জন্য দ্য প্যারিস রিভিউ থেকে অনুবাদ করেছেন মোস্তাফিজ ফরায়েজী। আজ প্রকাশিত হলো এর তৃতীয় পর্ব।
জন রে: আপনার নায়করা মাঝে মাঝে পৃথিবী সম্পর্কে আপনার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির কথা বর্ণনা করে। বিষয়টা অনেকটা স্বপ্নের ভেতর স্বপ্নদ্রষ্টার আবির্ভাবের মতো।
মুরাকামি: দয়া করে এভাবে ভাবুন, আমার একটি যমজ ভাই আছে। আমার বয়স যখন দুই বছর, আমাদের ভেতর অন্যজন অপহৃত হলো। তাকে অনেক দূরবর্তী একটা জায়গায় নেওয়া হলো, তখন থেকে আমরা একজন আরেকজনকে দেখিনি। আমি আমার নায়ককে এ রকমই মনে করি। আমারই একটা অংশ কিন্তু আমি নই। আমরা একে অন্যের সঙ্গে অনেক দিন দেখা করিনি। এটা আমারই একটা রূপ। ডিএনএ অনুসারে আমরা একই, কিন্তু আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা ভিন্ন। প্রতিবার যখন আমি একটা বই লেখি, আমার পায়ে ভিন্ন জুতো পরি। কেননা মাঝে মাঝে আমি নিজেকে ধারণ করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। এই পন্থায় আমি সেখান থেকে পালাতে পারি। এটা এক ধরনের কল্পনা। আপনার যদি কল্পনার জগত না থাকে, তাহলে আপনি একটা বই লিখবেন কিভাবে?
জন রে: হার্ড-বয়েল্ড ওয়ান্ডারল্যান্ড নিয়ে আরেকটা প্রশ্ন। এটার নির্দিষ্ট একটা ভারসাম্য আছে, একটা নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে এবং রহস্য সমাধানের একটা মেজাজ আছে। যেটা আপনার পরের দিকে লেখা বইগুলো থেকে আলাদা। যেমন দ্য উইন্ড-আপ বার্ড ক্রনিকল। উপন্যাসটির গঠন ও আপনার চিন্তা-চেতনা কি কিছু জায়গায় পরিবর্তিত হয়েছিল?
মুরাকামি: হ্যাঁ। আমার প্রথম দুটো বই জাপানের বাইরে প্রকাশিত হয়নি, আমি সেগুলোকে বাইরে প্রকাশিত হতে দেইনি। বই দুটো অপরিপক্ক, আমি মনে করি ওগুলো খুব ছোট বই, ওগুলো দুর্বল প্রকৃতির বই।
জন রে: সেগুলোর ত্রুটি কী ছিল?
মুরাকামি: আমি আমার প্রথম দুটি গ্রন্থে গতানুগতিক জাপানি উপন্যাস বিনির্মাণ করার চেষ্টা করেছিলাম। বিনির্মাণ বলতে, আমি ভেতরের সবকিছু ফেলে দিয়েছিলাম, শুধু কাঠামোটা রেখেছিলাম। এরপর আমাকে সেই কাঠামো নতুন ও তরতাজা কোনো কিছু দিয়ে পূরণ করতে হত। কিভাবে এটা করতে হয়, সেটা আমি আবিষ্কার করেছিলাম, আমি সফলভাবে এটা করতে পেরেছিলাম আমার তৃতীয় বইয়ে, ১৯৮২ সালে এ ওয়াইল্ড শিপ চেজে। প্রথম দুটো বই আমাকে শিখতে সাহায্য করছিল। আমি মনে করি, আমার নিজস্ব রচনাশৈলী এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ দিয়েই শুরু হয়েছিল। তারপর থেকে আমার বইগুলো আরও বড় হতে থাকলো, সেগুলোর গঠন আরও জটিল হতে থাকল। আমি প্রতিবার যখন নতুন বই লিখি, আগের কাঠামোটা ভেঙে ফেলি, নতুন কাঠামো তৈরি করার জন্য। এছাড়া আমি সবসময় একটা নতুন বিষয়বস্তু অথবা একটা নতুন সীমাবদ্ধতা অথবা একটা নতুন কাল্পনিক বস্তু নতুন বইয়ে নিয়ে আসি। আমি উপন্যাসের কাঠামোর ব্যাপারে খুব সচেতন। আমি যদি সেই কাঠামো পরিবর্তন করি, তাহলে আমাকে আমার গদ্যের ধরনটাও পাল্টে ফেলতে হবে, চরিত্রগুলোও পাল্টে ফেলতে হবে। আবার আমি যদি একই কাজ বার বার করি, ক্লান্ত হয়ে যাব, বিরক্ত হয়ে পড়ব।
জন রে: আপনার লেখার কিছু উপাদান পরিবর্তিত হয়েছে, বাকিগুলো অপরিবর্তিত আছে। আপনার উপন্যাস সবসময় উত্তম পুরুষে রচিত। প্রত্যেকটির ভেতর একজন পুরুষ একজন নারীর সঙ্গে বিভিন্নরকম যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে থাকে, পুরুষটি নারীটির চেয়ে একদম বিপরীতধর্মী হয়, পুরুষটি তার ভয় ও উদ্ভট খেয়ালকে প্রকাশ করে।
মুরাকামি: আমার উপন্যাস ও গল্পগুলোতে নারীরা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর মাধ্যমটির কাজ হলো তার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কিছু ঘটে যাওয়া। এটা এক ধরনের প্রক্রিয়া। নায়ক সবসময় এই মাধ্যম দিয়ে প্রভাবিত হয় এবং সে যা কল্পনা করে, তা আসলে সেই নারীটিই তাকে দেখায়।
জন রে: এই মাধ্যম বা যোগসূত্র কি ভিক্টোরিয়ান ধারার? না কি সাইকিক ধারার?
মুরাকামি: আমি মনে করি, লিঙ্গের উপস্থাপন হচ্ছে… এক ধরনের গভীর প্রতিশ্রুতি। যদি লিঙ্গের উপস্থাপন ভালো হয়, তুমি আহত অবস্থা থেকে আরোগ্যলাভ করবে, তোমার চিন্তাশক্তি চাঙ্গা হয়ে উঠবে। এটা তোমার ভালো জায়গায় উত্তরণের একটা পথ। এই অর্থে, আমার গল্পে নারীরা মাধ্যম স্বরূপ, আগামীর পৃথিবীর অগ্রদূত। এ কারণেই তারা সবসময় নায়কের কাছে আসে, নায়ক কখনো তাদের কাছে যায় না।
জন রে: আপনার উপন্যাসে দুটি আলাদা ধরনের নারী চরিত্র দেখা যায়। একধরনের সঙ্গে নায়কের গভীর সম্পর্ক থাকে—মাঝে মাঝে নারীটি হারিয়ে যায়। নারীটি নায়ককে তার কল্পনায় খুঁজে ফেরে, আরেক ধরনের নারী যে পরে আসে এবং নায়ককে তার অনুসন্ধানে সাহায্য করে অথবা এর বিপরীত ঘটে। দ্বিতীয় ধরনের নারীরা উন্মুক্ত মনের, খামখেয়ালি ও যৌনতার দিক দিয়ে বেশ খোলামেলা। নায়ক তার সঙ্গে খুব উষ্ণ সম্পর্ক রাখে। প্রথম ধরনের হারিয়ে ফেলা নারীর চেয়েও রসালো সম্পর্ক রাখে। এই শৈল্পিক উপস্থাপনার অর্থ কী?
মুরাকামি: আমার নায়ক প্রায় সবসময় আধ্যাত্মিক পৃথিবী ও বাস্তব পৃথিবীর মাঝে ধরা পড়ে। আধ্যাত্মিক পৃথিবীতে নারী অথবা পুরুষরা শান্ত, বুদ্ধিমান ও বিনয়ী। জ্ঞানী। আর বাস্তব পৃথিবীতে, তুমি যে রকম বললে, নারীরা চটপটে, মিলনাত্মক ও পার্থিব। তাদের ভেতর রসবোধ আছে। নায়কের মন দুই দিকে বিভক্ত হয়ে যায় এবং সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না কোনটাকে গ্রহণ করবে। আমি মনে করি, আমার কাজের এটি একটি মূল বিষয়। এটি হার্ড-বয়েল্ড ওয়ান্ডারল্যান্ডে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান, সেখানে নায়কের মন-দেহ একরকম বিভক্ত হয়ে যায়। নরওয়েজিয়ান উডে দুই জন মেয়ে ছিল, নায়ক প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি তাদের ভেতর কাকে বেছে নেবে।
জন রে: আমার রসবোধ সবসময় নারীদের প্রতি ঝুঁকে থাকে। পাঠকদের কোনো প্রেমের সম্পর্কের কথা বলতে চাইলে রসবোধের ব্যবহার একটি প্রাথমিক পদ্ধতি, এটা বাদে অনেক ব্যাখ্যা দিয়েও প্রেমের সম্পর্কের কথা পাঠকদের খুশি করতে পারে না। নরওয়েজিয়ান উডে আমি মিদোরির জন্য সবসময় আকর্ষিত ছিলাম।
মুরাকামি: আমার মনে হয়, প্রতিটি পাঠকই একই কথা বলবে। বেশিরভাগই মিদোরিকে বেছে নেবে। আর নায়কও শেষপর্যন্ত তাকে বেছে নেয়। কিন্তু তার একটা অংশ অন্য জায়গায় ছিল, সেটা সে নিজেও অস্বীকার করতে পারবে না। এটা তারই একটা অংশ, একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সব মানুষের তার হৃদয়ের প্রতি একটা দুর্বলতা আছে। ওই ফাঁকা জায়গাটাও তাদের অংশ। আমাদের মনের প্রকৃতিস্থ অংশ আছে এবং একটি বিকৃত অংশ আছে। আমরা ওই দুই অংশের ভেতর মধ্যস্থতা করি। আমি যখন লেখালিখি করি, আমি আমার বিকৃত মস্তিষ্কের অংশটা ভালোমতো দেখতে পারি। বিকৃত শব্দটা ঠিক নয়। সঠিক শব্দটি হবে অসাধারণ কিংবা অবাস্তব। আমাকে অবশ্যই বাস্তব পৃথিবীতে ফিরে যেতে হবে এবং প্রকৃতিস্থ অংশটাকে তুলে নিতে হবে। কিন্তু আমার ভেতর যদি অপ্রকৃতিস্থ দুর্বল অংশটি না থাকে, আমি এখানে থাকব না। অন্য ভাষায় বলতে গেলে, নায়ক দুটি নারী দ্বারা নির্মিত, তাদের যেকোনো একজন ছাড়া সে চলতে পারবে না। এই অর্থে, নরওয়েজিয়ান উড একটি স্পষ্ট উদাহরণ।
জন রে: এ কথার আলোকে বলা যেতে পারে, নরওয়েজিয়ান উডে রেইকো চরিত্রটি চমৎকার। আমি তাকে কোথায় রাখব জানি না, কিন্তু আমার মনে হয় সে দুটি পৃথিবীতেই ছিল।
মুরাকামি: তার মন অর্ধেক প্রকৃতিস্থ ও অর্ধেক অপ্রকৃতিস্থ ছিল। এটি একটা গ্রিক মুখোশ, তুমি যদি একদিক থেকে দেখো, সে একটা দুঃখী চরিত্র; অন্যদিক থেকে যদি দেখো, সে একটা রসাত্মক চরিত্র। এই বিষয়টা বিবেচনা করলে, সে একটা রূপক চরিত্র। আমি এই চরিত্রকে খুব পছন্দ করি। আমি যখন রেইকো-স্যান চরিত্রটি লিখেছিলাম, আমি খুব তৃপ্ত হয়েছিলাম।
জন রে: আপনি কী আপনার সরস চরিত্রগুলোর বিষয়ে বেশি মমতাময়ী ছিলেন? নাউকসের চেয়ে কি মিদোরিস এবং কাসাহারাসের প্রতি বেশি অনুরক্ত ছিলেন?
মুরাকামি: আমি রসবোধক সংলাপ লিখতে পছন্দ করি, এটা মজার ব্যাপার। কিন্তু আমার চরিত্রগুলো যদি কৌতুকপ্রবণ হয়, তবে সেটা বিরক্তিকর ব্যাপার হবে। ওই সব সরস চরিত্রগুলো আমার মনকে স্থিতিশীলতা দেয়, রসবোধ একটা স্থায়ী বিষয়। আপনাকে রসবোধ আনতে হলে শান্ত থাকতে হবে। আপনি যদি উত্তেজিত হয়ে পড়েন আপনি অশান্ত হয়ে পড়তে পারেন, এটাই উত্তেজনার একটা সমস্যা। আপনি যখন রসাত্মক হবেন, আপনি শান্ত থাকবেন। কিন্তু আপনি হাসতে হাসতে যুদ্ধ করতে পারবেন না।
চলবে…