উইলিয়াম ফকনার ১৮৯৭ সালে মিসিসিপির নিউ আলবেনিতে জন্মগ্রহণ করেন। মারি কাথবার্ট ফকনার ও মড বাটলার ফকনারের চার ছেলের মধ্যে সবার বড় উইলিয়াম ফকনার। তার বয়স যখন পাঁচ, তখন পরিবার স্থানান্তরিত হয়ে ৩৫ কিলোমিটার দূরে মিসিসিপির অক্সফোর্ড শহরে চলে যায়। এই শহরেই ফকনার তার জীবনের অধিকাংশ সময় কাটান। শেরউড অ্যান্ডারসনের কাছ থেকে উৎসাহিত হয়ে তিনি ১৯২৬ সালে রচনা করেন প্রথম উপন্যাস ‘সোলজার’স পে। ১৯৩১ সালে প্রকাশিত তার স্যাংকচুয়ারি বইটি সর্বপ্রথম পাঠক জনপ্রিয়তা পায়। এর আগে তিনি মসকুইটোস, সারটোরিস, দ্য সাউন্ড অ্যান্ড দ্য ফিউরি, অ্যাজ আই লে ডাইং লিখলেও এতে তার সংসার চলতো না।
উইলিয়াম ফকনার মোট ১৯টি উপন্যাস ও বহু ছোট গল্প লিখেছেন। বেশ কিছু কাব্যগ্রন্থও তার আছে। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হলো—দ্য সাউন্ড অ্যান্ড দ্য ফিউরি (১৯২৯), অ্যাজ আই লে ডাইং (১৯৩০), লাইট ইন অগাস্ট (১৯৩২), আবসালোম, আবসালোম (১৯৩৬), দ্য আনভ্যাংকুইশ্ড (১৯৩৮), দ্য হ্যামলেট (১৯৪০), অ্যা ফ্যাবল (১৯৫৪) ইত্যাদি। ১৯৪৯ সালে বিশ্বখ্যাত কথাসাহিত্যিক উইলিয়াম ফকনার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।
সাক্ষাৎকারটি ১৯৫৬ সালে নিউইয়র্ক শহরে নেওয়া হয়। দ্য প্যারিস রিভিউতে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন আমেরিকান লেখিকা ও সম্পাদিকা জিন স্টাইন। সাক্ষাৎকারটি চিন্তাসূত্রের জন্য অনুবাদ করেছেন তরুণ অনুবাদক মোস্তাফিজ ফরায়েজী। আজ প্রকাশিত হলো এর প্রথম পর্ব।
পর্ব-এক
জিন স্টাইন: মিস্টার ফকনার, আপনি একটু আগে বলছিলেন আপনি সাক্ষাৎকার দেওয়া একটুও পছন্দ করেন না। কিন্তু কেন?
উইলিয়াম ফকনার: আমি সাক্ষাৎকার পছন্দ করি না, কেননা আমি ব্যক্তিগত প্রশ্নে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাই। প্রশ্ন যদি আমার সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে হয়ে থাকে, আমি সেগুলোর উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু তারা যখন আমার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে প্রশ্ন করে, আমি তার উত্তর দিতেও পারি আবার নাও দিতে পারি। আমি যদি ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর দেইও, তাহলেও ওই একই প্রশ্নের উত্তর আগামীকাল পাল্টে যেতে পারে।
স্টাইন: লেখক হিসেবে আপনি নিজেকে কেমন মনে করেন?
ফকনার: যদি আমার কোনো অস্তিত্ব না থাকতো, তবে আমার, হোমিংওয়ের, দস্তভয়স্কির পরিবর্তে অন্য কেউ লিখতেন। শেক্সপিয়রের নাটক কে লিখেছেন, এটা নিয়ে মতবিরোধ আছে, কমপক্ষে তিনজন লেখক শেক্সপিয়রের নাটক লেখার দাবি রাখেন। কে হ্যামলেট এবং অ্যা মিডসামার নাইট’স ড্রিম লিখলেন, এটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। তবে অবশ্যই কেউ না কেউ লিখেছেন। এখানে লেখকের কোনো গুরুত্ব নেই। তার সৃষ্টিই শুধু গুরুত্বপূর্ণ। শেক্সপিয়র, বালজাক, হোমার—এঁরা সবাই প্রায় একই বিষয়ে লিখেছেন। তারা যদি এক-দুই হাজার বছর বেঁচে থাকতেন, তাহলে প্রকাশকদের অন্য লেখকের প্রয়োজনই হতো না।
স্টাইন: যদিও আপনাকে বলার মতো কোনো বিষয় নয়, তবু প্রশ্নটা করছি, একজন লেখকের ব্যক্তিসত্তা কি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়?
ফকনার: তার নিজের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে পাঠকেরা লেখকের ব্যক্তিসত্তার চেয়ে সাহিত্যকর্ম নিয়েই সবসময় ব্যস্ত থাকে।
স্টাইন: আপনার সমসাময়িক লেখকেরা?
ফকনার: আমরা সবাই আমাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ। তাই আমি আমাদের চমকপ্রদ ব্যর্থতাকে অসম্ভব সাধন হিসেবে নির্ণয় করি। আমি যদি আমার লেখাগুলো পুনরায় লিখতে পারতাম, আমার বিশ্বাস আরও ভালো কিছু উপহার দিতে পারতাম। একজন লেখকের এ রকম মনের অবস্থাই হচ্ছে তার ভালো অবস্থা। এই কারণেই লেখক কাজ করতে থাকেন, পুনরায় চেষ্টা করতে থাকেন। সে প্রতিবার মনে করে সে এবার তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে, তবে নিশ্চিতভাবে সে সেটা পারে না। যে কারণে এই অবস্থাটা একজন লেখক কিংবা শিল্পীর জন্য সবচেয়ে ভালো। একবার যদি সে এটা করে ফেলে, একবার যদি তার কল্পিত চিত্রের সঙ্গে তার লেখা পরিপূর্ণভাবে মিলে যায়, তার স্বপ্নের আর কিছুও অবশিষ্ট থাকবে না; তার স্বপ্নের গলা কাটা যাবে। আমার সম্পর্কে বলতে গেলে, আমি একজন ব্যর্থ কবি। সম্ভবত প্রতিটি উপন্যাসিক প্রথমে কবিতা লেখা শুরু করে, একসময় সে বুঝতে পারে তার দ্বারা কবিতা লেখা সম্ভব নয়, তখন সে ছোট গল্প লেখা শুরু করে, কবিতার পর ছোট গল্পের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। ছোট গল্প লিখতে ব্যর্থ হওয়ার পরই একজন লেখক উপন্যাস লেখার সিদ্ধান্ত নেয়।
স্টাইন: একজন ভালো ঔপন্যাসিক হওয়ার জন্য কোনো সম্ভাব্য সূত্র আছে?
ফকনার: নিরানব্বই ভাগ মেধা। নিরানব্বই ভাগ নিয়মানুবর্তিতা। নিরানব্বই ভাগ কার্যক্ষমতা। লেখক যা লিখবে সেটা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলে চলবে না। একটা লেখা সর্বোত্তম হওয়া কখনো সম্ভব নয়। সব সময় এমন কিছু স্বপ্ন দেখতে হবে যার উচ্চতা স্পর্শ করা তোমার জন্য দুঃসাধ্য। সমসাময়িক কিংবা পূর্বসূরিদের চেয়ে ভালো হবার অযথা চেষ্টা থেকে বিরত থাকা উচিত। নিজের চেয়েও ভালো হওয়ার চেষ্টা করাই মুখ্য কাজ। একজন লেখক বা শিল্পী দৈত্যদের দ্বারা চালিত একটি জীব। সে নিজেও জানে না দৈত্যরা কেন তাকে বাছাই করল, কেন করল সে শুধু সেটা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। একজন লেখক সম্পূর্ণ অনৈতিক গোছের। সে তার কাজ সম্পাদন করার জন্য যে কারো কাছ থেকে চুরি, ডাকাতি, ধার, ভিক্ষা সবই করবে।
স্টাইন: আপনি কি বলতে চাচ্ছেন লেখককে সম্পূর্ণ নিষ্ঠুর প্রকৃতির হতে হয়?
ফকনার: লেখকেরা শুধু নিজের শিল্পকর্মের জন্য দায়বদ্ধ। ভালো লেখক হলে অবশ্যই পুরোপুরি নিষ্ঠুর প্রকৃতির হবে। তার একটা স্বপ্ন আছে, সে সেই স্বপ্ন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সবসময় যন্ত্রণায় ভোগে। একটা গ্রন্থ লিখতে আত্মসম্মান, অহঙ্কার, শালীনতা, নিরাপত্তা, আনন্দ সবকিছুই লাগে। একজন লেখককে যদি তার মায়ের কাছ থেকে কোনোকিছু ডাকাতি করা লাগে, তবু সে ইতস্তত বোধ করবে না; যেমন ‘ওডি অন অ্যা গ্রিসান আর্ন’ যেকোনো পরিমাণ বয়স্ক মহিলাদের সমমূল্যের।
স্টাইন: তাহলে কি নিরাপত্তা, আনন্দ, কদরের অভাব শিল্পীর সৃজনশীলতার ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে? ফকনার: না। এগুলো গুরুত্বপূর্ণ শুধু ব্যক্তিগত শান্তি ও তুষ্টির জন্য। শিল্পকর্মের সঙ্গে ব্যক্তিগত শান্তি ও তুষ্টির কোনো সম্পর্ক নেই।
স্টাইন: তাহলে একজন লেখকের লেখার জন্য সর্বোত্তম পরিবেশ কোনটি?
ফকনার: শিল্পের সঙ্গে পরিবেশেরও কোনো সম্পর্ক নেই। কোথায় বসে বা কী অবস্থায় লেখাটি লেখা হচ্ছে, সেটা বিষয় নয়। তুমি যদি আমার কথা ধরো, আমাকে ব্রোথেলের জমিদার হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। আমার মতে, একজন লেখকের লেখার জন্য ওটাই উপযুক্ত পরিবেশ। এটা লেখককে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দেবে; তাকে ক্ষুধা ও ভয় থেকে মুক্ত রাখবে; তার মাথার ওপর একটা ছাদ থাকবে। জায়গাটি সকালের দিকে প্রশান্তিতে ভরা থাকবে; আসলে সকালই কাজ করার উপযুক্ত সময়।
খারাপ পরিবেশ রক্তচাপ বাড়িয়ে দিতে পারে, ফলে একজন লেখক হতাশ ও ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠতে পারে। এজন্য লেখকের প্রশান্তি প্রয়োজন। আমার প্রশান্তির জন্য শুধু প্রয়োজন কাগজ, তামাক, খাবার আর কিছুটা হুইস্কি।
স্টাইন: আপনি অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করলেন। লেখকের কি এটা প্রয়োজন?
ফকনার: না। লেখকের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রয়োজন নেই। তার শুধু প্রয়োজন একটি পেন্সিল আর কিছু কাগজ। আমি কখনো লেখার জন্য টাকা উপহারকে ভালো চোখে দেখি না। একজন ভালো লেখক কোনো ফাউন্ডেশনে তার লেখা জমা দেয় না। সে সবসময় লেখালিখি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। একজন লেখক যদি ভালো মানের লেখা না লিখতে পারে, তখন সে প্রচার করে বেড়ায় সে লেখার সময় পায়নি কিংবা তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই। ভালো শিল্পকর্ম চোর কিংবা বুটলেগারদের কাছ থেকেও বের হয়ে আসতে পারে। মানুষেরা এটা ভেবে ভীত হয়, তারা কতটা সংগ্রাম ও দারিদ্র্য সহ্য করে টিকে থাকতে পারবে। তারা জীবনের কঠোরতা খুঁজতে যেয়ে ভীত হয়। এসবের কিছুই একজন ভালো লেখককে ধ্বংস করতে পারে না। শুধু একটি জিনিস একজন লেখকের জীবনকে পরিবর্তিত করতে পারে—সেটা হচ্ছে মৃত্যু। একজন ভালো লেখকের সফলতার কিংবা ধনী হওয়ার কথা চিন্তা করার সময় থাকে না। সফলতা স্ত্রী লিঙ্গাত্মক, অনেকটা নারীর মতো; তুমি যদি তার প্রতি নত হও, তবে সে তোমাকে অগ্রাহ্য করবে। তাকে আয়ত্ত করতে হলে তোমাকে তোমার হাতের উল্টো পিঠ দেখাতে হবে। তারপর সে হয়তো তোমার দিকে হামাগুড়ি দিয়ে অগ্রসর হবে।
স্টাইন: সিনেমায় কাজ করার জন্য আপনার লেখালিখির কি ক্ষতি হয়?
ফকনার: একজন যদি ভালো মানের লেখক হয়, তাহলে কোনো কিছুই তার লেখালেখির ক্ষতি করতে পারবে না। একজন যদি উঁচু মানের লেখক না হয় তাহলে কোনোকিছুই তাকে সাহায্য করবে না। সমস্যাটা তার জন্য, যে ভালো মানের লেখক নয়। সে ইতোমধ্যে তার আত্মাটা একটা সুইমিংপুলের জন্য বিক্রি করে দিয়েছে।
স্টাইন: একজন লেখক কি চলচ্চিত্রের জন্য লেখালিখিতে আপস করে?
ফকনার: সবসময়, কারণ একটি চলচ্চিত্র সহযোগিতা দ্বারা সৃষ্ট। যেকোনো সহযোগিতাই আপসের মাধ্যমে হয়, কথাই আছে—দেওয়া ও নেওয়া (to give and to take)। মূলত দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমেই সিনেমার কাজ করতে হয়।
স্টাইন: আপনি কোন অভিনয়শিল্পীর সঙ্গে কাজ করতে সবচেয়ে পছন্দ করেন?
ফকনার: হাফ্রে বোগার্টের সঙ্গে আমি সবচেয়ে ভালোভাবে কাজ করেছি। বোগার্ট আর আমি একসঙ্গে ‘টু হ্যাভ অ্যান্ড হ্যাভ নট’ ও ‘দ্য বিগ শিপ” চলচ্চিত্রে কাজ করেছি।
স্টাইন: আপনি কি আরও চলচ্চিত্রে কাজ করতে চান?
ফকনার: হ্যাঁ, আমি জর্জ অরওয়েলের ‘নাইনটিন এইটটি ফোর’ উপন্যাসটি অবলম্বনে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চাই। আমি কাহিনীর সমাপ্তিতে একটা জিনিস প্রমাণ করতে চাই, যেটা অনেক দিন ধরে আমার মনকে হাতুড়িপেটা করছে, সেটা হলো স্বাধীন থাকার সাধারণ ইচ্ছা থাকার কারণে মানুষটি অবিনশ্বর।
স্টাইন: সিনেমাতে কাজ করার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম ফলাফল আপনি কিভাবে পান?
ফকনার: আমার মতে চলচ্চিত্রের মূল কাজটা অভিনেতারা করেন, চিত্রনাট্যকারেরা শুধু স্ক্রিপ্টটা ছু্ড়ে ফেলে দেন ও ফাইনাল রিহার্সালের সময় দৃশ্যগুলোকে নতুন করে দেখেন। এগুলো ঘটে সিনেমার ক্যামেরা অন করার আগে। আমি যদি চলচ্চিত্রের কাজ না করতাম অথবা আমি যদি চলচ্চিত্রের কাজকে বেশি গুরুত্বসহকারে না নিতাম, তাহলে আমি চলচ্চিত্রের কাজ করতে চেষ্টাই করতাম না। এখন আমি জানি, আমি কখনোই একজন ভালো চিত্রনাট্যকার হতে পারব না। তাই সাহিত্যচর্চার মতো চলচ্চিত্রে আমার আগ্রহ আর কখনোই হবে না।
________________________________________________________________________
আমার যদি পুনর্জন্ম হতো, তাহলে আমি বাজপাখি হতে চাইতাম
__________________________________________________________________
স্টাইন: আপনার হলিউড স্মৃতি সম্পর্কে কিছু যদি বলতেন?
ফকনার: আমি মাত্র এমজিএমের সঙ্গে একটা চুক্তি করে বাড়ির পথ ধরছি। এমন সময় চুক্তিকৃত সিনেমাটির ডিরেক্টর আমাকে বললেন, ‘আপনি যদি এখানে আরেকটি কাজ করতে চান, আমাকে বলবেন। আমি আরেকটি নতুন চুক্তির ব্যাপারে স্টুডিওর সাথে কথা বলব।’ আমি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বাড়িতে এলাম। ছয় মাস পরে আমি আমার ডিরেক্টরকে তারবার্তা পাঠালাম, আমি আরকটি কাজ করতে আগ্রহী। তার কয়েকদিন পরেই আমার হলিউড এজেন্ট মারফত আমার কাজের প্রথম সপ্তাহের চেক পেয়ে গেলাম। আমি অবাক হয়েছিলাম, কেননা আমি মনে করেছিলাম কোনোকিছু হওয়ার আগে আমাকে অফিশিয়াল নোটিশ ও চুক্তিপত্র দেওয়া হবে। আমি ভেবেছিলাম চুক্তিপত্র মনে হয় পরে আসবে। তার পরিবর্তে দ্বিতীয় সপ্তাহে আমার কাছে দ্বিতীয় সপ্তাহের কাজের জন্য চেক এলো। এই চেক আসাটা ১৯৩২-এর নভেম্বর থেকে ১৯৩৩-এর মে পর্যন্ত চলেছিল। তারপর আমি এমজিএম স্টুডিও থেকে একটি টেলিগ্রাম পেলাম। যেখানে লেখা, ‘উইলিয়াম ফকনার, অক্সফোর্ড, আপনার শূন্যতা অনুভব করছি। আপনি কোথায়? এমজিএম স্টুডিও।”
উত্তরে টেলিগ্রাম করে লিখেছিলাম, ‘এমজিএম স্টুডিও, কালভার সিটি, ক্যালিফোর্নিয়া। উইলিয়াম ফকনার।’
টেলিগ্রাম করার সময় অল্পবয়স্ক নারী অপারেটর আমাকে বলেছিল, ‘বার্তাটি কোথায় মিস্টার ফকনার?’ আমি বলেছিলাম, ‘এটাই বার্তা।” সে বলল, ‘আমাদের নীতিমালায় বলছে, একটি বার্তা ছাড়া আমি এটা পাঠাতে পারব না, আপনাকে কিছু একটা লিখতে হবে।” তাই আমি শুভেচ্ছামূলক কিছু একটা লিখে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর আমি স্টুডিও থেকে টেলিফোন কল পেয়েছিলাম। আমাকে বলা হয়েছিল, প্রথম প্লেনটি ধরে নিউ অরলিন্সে যাওয়ার জন্য। ডিরেক্টর ব্রাউনিং-কে রিপোর্টিং করার কথাও আমাকে বলা হয়েছিল। আমি অক্সফোর্ডের ট্রেনে উঠে আট ঘণ্টায় নিউ অরলিন্স যেতে পারতাম কিন্ত আমি স্টুডিওর নির্দেশ মেনে চললাম। আমি মেমফিসে গেলাম। মেমফিস থেকে মাঝে-মধ্যে এরোপ্লেন নিউ অরলিন্সে যেত। তিন দিন পরে একটা গিয়েছিল। আমি ওটাতে করেই নিউ অরলিন্সে পৌঁছাই। এতকিছুর পরেও ঘটনাক্রমে সিনেমাটি থেকে আমাকে ও ব্রাওনিং-কে বিনা কারণে বহিষ্কার করা হয়। এটা একটা মজার স্মৃতি।
স্টাইন: আপনি বললেন, একজন লেখককে চলচ্চিত্রে কাজ করার জন্য তার স্বাভাবিক লেখালেখির সঙ্গে আপস করতে হয়। লেখকের লেখালিখি বিষয়টা কেমন? একজন লেখক কি তার পাঠকদের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ?
ফকনার: একজন লেখকের প্রতিশ্রুতি হচ্ছে কাজটা তার সর্বোত্তম চেষ্টার মাধ্যমে সম্পাদন করা। আমি নিজে সাধারণ মানুষদের সম্পর্কে জানতে খুব আগ্রহী। কে আমার লেখা পড়ছে, সেটা ভাবার আমার সময়ই নেই। জন ডো আমার লেখা সম্পর্কে কিংবা অন্য কারও লেখা সম্পর্কে কী বলল এটাকেও আমি অগ্রাহ্য করি। আমার লেখা একটা আদর্শ মানে পৌঁছেছে। আমি মাঝে মাঝে ‘লা টেনটেসশন ডি সেইন্ট অ্যান্তোনি’ অথবা ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ পড়ি। আমার বেশ ভালো লাগে। আমার যদি পুনর্জন্ম হতো, তাহলে আমি বাজপাখি হতে চাইতাম। কোনোকিছুই তাকে ঘৃণা করে না, তাকে হিংসা করে না, তাকে চায় না কিংবা তার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। তাকে কেউ বিরক্ত করে না কিংবা সে বিপদেও পড়ে না। আবার সে যেকোনো কিছু খেতে পারে।
স্টাইন: আপনার লেখা আদর্শ মানে নিয়ে যাবার জন্য আপনি কি কোনো কৌশল ব্যবহার করেন?
ফকনার: যে লেখক কৌশলের প্রতি আগ্রহী তার মাথার সার্জারি করা উচিত। লেখালিখির কোনো যান্ত্রিক পদ্ধতি নেই, কোনো শর্টকাট নেই। এখনকার তরুণ লেখকেরা বোকার মতো কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করে। লেখককে নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে, মানুষ ভুল থেকেই শেখে। একজন ভালো শিল্পী বিশ্বাস করে, কেউই তাকে উপদেশ দিতে যথেষ্ট নয়। তার বিশেষ ধরনের আত্মগর্ব থাকে। একটা পুরনো লেখকের সে যতই প্রশংসা করুক না কেন, সে চাই তাকে হারিয়ে দিতে, তাকে ছাড়িয়ে যেতে।
স্টাইন: তাহলে কি আপনি কৌশলের ব্যাপারটাকে তিরস্কার করতে চান?
ফকনার: অবশ্যই নয়। মাঝেমাঝে কৌশল কল্পনার ওপর প্রভাব খাটাতে শুরু করে।
স্টাইন: দ্য সাউন্ড অ্যান্ড দ্য ফিউরি সম্পর্কে বলবেন?
ফকনার: দ্য সাউন্ড অ্যান্ড দ্য ফিউরি! আমি এই উপন্যাসটা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে পাঁচ বার লিখেছি। আমি গল্পটা বলার চেষ্টা করেছি মাত্র। আমার যন্ত্রণাদায়ক স্বপ্ন থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছি। উপন্যাসটি দুজন হারিয়ে যাওয়া নারীকেন্দ্রিক, নারী দুজন হচ্ছে ক্যাডি ও তার মেয়ে। ডিলসি আমার অন্যতম প্রিয় একটি চরিত্র। কারণ সে এমন একজন নারী যে একইসঙ্গে সৎ, সাহসী, উদার, উদ্যমী ও ভদ্র। এমনকি সে আমার চেয়েও সাহসী, ভদ্র ও সৎ। তার কোনো তুলনা নেই।
স্টাইন: দ্য সাউন্ড অ্যান্ড দ্য ফিউরি লেখাটা কিভাবে শুরু করেছিলেন?
ফকনার: মূলত চিত্রকল্প দিয়েই এটি শুরু হয়েছিল। যখন চিত্রকল্পটি মাথায় আসে তখন এটা রূপক ছিল না। চিত্রকল্পটি সাদামাঠা ছিল। একটা ছোট্ট মেয়ে তার ঘরের জানালা দিয়ে তার দাদির শেষকৃত্য দেখছে এবং নিচে বসে থাকা তার ভাইকে বলছে, বাইরে কী হচ্ছে তা। একসময় আমি ব্যাখ্যা করলাম তারা কারা। তারা কী করছে কিংবা তাদের প্যান্টে কিভাবে মাটি লেগে গেলো। আমি বুঝতে পারলাম এতকিছু একটা ছোটগল্পে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়, তাই উপন্যাস লেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। তারপর আমি কাদা লেগে থাকা প্যান্টের রূপকতা বুঝলাম। সেই চিত্রকল্পটিকে আমি এবার অন্য একটি চিত্রকল্প দিয়ে প্রতিস্থাপিত করলাম। তখন একটা এতিম মেয়ে নর্দমার নল বেয়ে তার বাড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা করছিল। আমি ইতোমধ্যে বাচ্চা মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে গল্প বলা শুরু করে দিয়েছিলাম, কিন্তু আমি অনুভব করলাম গল্পটি অন্য কাউকে দিয়ে বলালে ভালো হয়। এমন একজন যে তাকে চেনে, কী ঘটেছিল জানে, তবে কেন ঘটেছিল সেটা জানে না এমন কাউকে বেছে নিলাম। আমি আবার গল্পটা বলার চেষ্টা করলাম, এবার অবশ্য অন্য এক ভাই হয়ে উঠলো গল্পকথক। তবু ঠিকমতো হলো না। আমি তৃতীয় বার তৃতীয় ভাইয়ের দৃষ্টিতে গল্পটা বর্ণনা করলাম। তবু হলো না। আমি গল্পটার খণ্ডচিত্রগুলো একত্রিত করলাম, শূন্যস্থানগুলো পূরণ করলাম এবং আমাকে আবার গল্পকথক বানালাম। এখানেই শেষ নয়, বইটি প্রকাশিত হওয়ার পনেরো বছর পরে, অন্য একটা বইয়ে গল্পটা পরিশিষ্ট আকারে বলতে গিয়ে আমি চূড়ান্ত গল্পটি বলেছি। তারপর গল্পটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি, এটা মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশান্তি দেয়। তবু আমি এটাকে একা ছাড়তে পারি না, আমি কখনোই গল্পটা ঠিকভাবে বলতে পারব না। আমি যদি আবারও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে গল্পটা বলার জন্য জোর চেষ্টা চালাই, হয়তো আমি আবারও ব্যর্থ হবো।
স্টাইন: বেনজি আপনার ভেতর কী ধরনের আবেগ জাগ্রত করেছিল?
ফকনার: বেনজির জন্য আমার আবেগ-অনুভূতি বলতে যা অনুভব করেছিলাম তা হলো বিষাদ; মানবজাতির জন্য সমবেদনা। এক হিসেবে তুমি বেনজির জন্য কিছু অনুভব করবে না, কেননা বেনজি নিজেই কোনোকিছু অনুভব করে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনুভব করি সে একটি বিশ্বাসযোগ্য চরিত্র, আমি সেভাবেই তাকে সৃষ্টি করেছি। সে এলিজাবেথিয়ান নাটকের কবরখনকের মতো একটি প্রস্তাবনা। সে তার উদ্দেশ্য পূরণ করে হারিয়ে যায়। বেনজি শুভ ও অশুভ শক্তি প্রয়োগে অক্ষম কেননা শুভ ও অশুভ শক্তি সম্পর্কে তার কোনো জ্ঞানই নেই।
স্টাইন: বেনজি কি ভালোবাসা অনুভব করতে পারে?
ফকনার: বেনজি স্বার্থপর হবার মতো যথেষ্ট বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন নয়। সে একটা পশু। আবেগপ্রবণতা ও ভালোবাসা সে বুঝতে পারলেও তার নামকরণ করতে পারে না।
চলবে…