[পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পীদের একজন নাগিব মাহফুজ। তার জন্ম ১১ ডিসেম্বর ১৯১১, মিশরের কায়রো মহানগরীর প্রাচীন এলাকা গামালিয়্যায়, একটি ধার্মিক পরিবারে। অংক ও বিজ্ঞান নিয়ে লেখাপড়া শুরু হলেও তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন (১৯৩৪) দর্শন নিয়ে। লেখাপড়া শেষ করে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে অবসর নেওয়ার আগে পর্যন্ত বহু গুরুত্বপূর্ণ উচ্চতর পদ অলঙ্কৃত করেন। ১৯৫৪ সালে ৪৩ বছর বয়সে বিয়ে করেন। সারা জীবনে তিনি বিদেশ ভ্রমণ করেছেন মাত্র তিন বার, তা-ও চিকিৎসার জন্য।
তার লেখালেখির শুরু প্রাথমিক শিক্ষালাভ কালে। প্রথম বই ‘খুফুজ উইজডম’ একটি উপন্যাস, বের হয় ১৯৩৯ সালে। তার উপন্যাসের সংখ্যা ৩৪ এবং ছোটগল্পের বই ১৫টি। এ ছাড়া রয়েছে একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ, আর অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ। তিনি ২৫টি চিত্রনাট্যও লিখেছেন। তার উপন্যাস এবং গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে ৩০টিরও অধিক। ১৯৭১ সাল থেকে মৃত্যুর কিছুদিন আগ পর্যন্ত নিয়মিত সাপ্তাহিক কলাম লিখেছেন, যা একই সঙ্গে আররিতে আল-আহরাম-এ এবং ইংরেজিতে আল-আহরাম উইকলিতে প্রকাশিত হয়েছে। এসব কলাম নিয়ে একটি বই বের হয় ২০০১ সালে। দেশে-বিদেশে সমান জনপ্রিয় ও সম্মানের অধিকারী তিনি। তার অসামান্য সাহিত্যকৃতির জন্য তাকে দু-দুবার ইজিপ্সিয়ান স্টেট প্রাইজ দেওয়া হয়। ১৯৮৮ সালে তাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ২০০৬ সালের ৩০ আগস্ট কায়রোতে এই মহান সাহিত্যিকের মৃত্যু হয়।
১৯৯২ সালে দ্য প্যারিস রিভিউতে তার একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। এটি গ্রহণ করেন শার্লোট আল-শাবরাভি। এই সাক্ষাৎকারে তিনি তার সাহিত্যকৃতি, জীবন ও জগতভাবনা নিয়ে কথা বলেন।—অনুবাদক]
প্রশ্ন : আপনার লেখালেখির শুরু কখন?
মাহফুজ : ১৯২৯ সালে। আমার সবগুলো গল্প প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। মাজাল্লার সম্পাদক সালামা মুসা বলতেন, তোমার মধ্যে প্রতিশ্রুতি আছে, কিন্তু এখনও মানোত্তীর্ণ হতে পারোনি। ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরের কথা আমার মনে পড়ে, কারণ সেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু, হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করলেন। আমার গল্প ‘আবাছ আল-আকদার’ ছাপা হলো, সেটা মাজাল্লা প্রকাশকদের পক্ষ থেকে এক ধরনের অপ্রত্যাশিত উপহার। সেটা আমার জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
প্রশ্ন : তারপর আপনার লেখা এবং প্রকাশনা সহজভাবেই চলতে লাগল?
মাহফুজ : না। সেই প্রথম প্রকাশের পর আমার এক বন্ধু, সে-ও লেখক, আমার কাছে এসে বলল, তার ভায়ের একটা প্রিন্টিং প্রেস আছে। সে কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে একটা প্রকাশনা কমিটি গঠন করল, ওরা কিছুটা সফলও হয়েছিল। ১৯৪৩ সাল থেকে আমরা কিছুটা নিয়মিত প্রকাশনা শুরু করলাম। আমরা প্রত্যেক বছর আমার একটা করে গল্প প্রকাশ করতে লাগলাম।
প্রশ্ন : কিন্তু আপনি কখনো জীবিকার জন্যে লেখার ওপর নির্ভর করেননি।
মাহফুজ : না। আমি সব সময় সরকারি চাকরি করেছি। বিপরীতে, আমি সময় ব্যয় করেছি সাহিত্যের পেছনেÑ বই আর কাগজ নিয়ে। লেখালেখি থেকে অর্থ উপার্জন অনেক পরের ঘটনা। আমি আশিটি গল্প প্রকাশ করেছি কোনো বিনিময় ছাড়াই। এমনকি আমার প্রথম দিককার উপন্যাসগুলোও বিনে পয়সায় ছেপেছি, সব ওই কমিটিকে সাহায্য করার জন্যে।
প্রশ্ন : লেখালেখি থেকে অর্থ উপার্জন কবে থেকে শুরু হলো?
মাহফুজ : যখন আমার ছোটগল্পগুলো ইংরেজি, ফরাসি এবং জার্মান ভাষায় অনূদিত হলো। বিশেষভাবে ‘জাবালাভি’ খুই সাফল্য লাভ করল, অন্য যেকোনো গল্পের চেয়ে এতে বেশি অর্থ এলো। আমার প্রথম অনূদিত উপন্যাস ‘মিদাক অ্যালি’। সেটি প্রথম ছেপেছিলেন খাইয়্যাত নামের এক লেবাননী প্রকাশক। আমি বা অনুবাদক কেউই এর থেকে পয়সা পাইনি, প্রকাশক আমাদের ঠকিয়েছিল। ১৯৭০ সালে এটি আবার ছাপল হ্যানিমান। তারপর এটি ফরাসি ভাষায় অনূদিত হলো, তারপর আমার অন্য অনুবাদগুলো ছাপা হতে লাগল।
প্রশ্ন : ১৯৫২ সাল পূর্ববর্তী রাজনৈতিক পরিবেশ আপনার জীবনে কী ভূমিকা রেখেছিল?
মাহফুজ : ১৯১৯ সালের বিপ্লব যখন ঘটে, তখন আমার বয়স সাত। এর দ্বারা আমি খুব প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। আমি যাদের চিনতাম তাদের প্রত্যেকেই ছিল ওয়াফদ পার্টি এবং উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভের পক্ষে। পরে আমি জগলুল পাশা সাদ-এর প্রত্যক্ষ অনুসারী হিসেবে রাজনীতিতে জড়িয়েছিলাম। আমি এখনও মনে করি যে, আমি আমার জীবনে যা কিছু করেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে এই রাজনীতি-সংশ্লিষ্টতা। তবে আমি কখনো রাজনীতির সক্রিয় কর্মী ছিলাম না, বা কোনো রাজনৈতিক দলের বা আনুষ্ঠানিক কমিটির সদস্য ছিলাম না। যদিও আমি ওয়াফদ পার্টির সমর্থক ছিলাম, আমি কখনো দলীয় সদস্য হিসেবে পরিচিত হতে চাইনি। একজন লেখক হিসেবে আমি পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে চেয়েছি যা কখনো কোনো দলীয় সদস্যের থাকতে পারে না।
প্রশ্ন : আর ১৯৫২ সাল?
মাহফুজ : আমি সেই বিপ্লব নিয়ে সুখী ছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেটা গণতন্ত্র আনতে পারেনি।
প্রশ্ন : সেন্সরশিপ নিয়ে কি আপনাকে খুব ভুগতে হয়েছে? সেজন্যে আপনাকে কি আপনার কোনো পাণ্ডুলিপি পুনর্লিখন করতে হয়েছে?
মাহফুজ : সম্প্রতি নয়, তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আল-ক্কাওরা আল-জাদিদা এবং রাদিবাসকে সেন্সর করা হয়েছিল। আমাকে বামপন্থী বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সেন্সরকারীরা রাদিবাসকে উস্কানিকর বলে আখ্যায়িত করেছিল। কারণ এতে জনগণ রাজাকে হত্যা করে, আর আমাদের রাজা তখনও জীবিত। আমি তাদের ব্যাখ্যা করে বোঝালাম যে, এটা নিছকই একটা ঐতিহাসিক গল্প, কিন্তু তারা দাবি করল এটা একটা মিথ্যা ইতিহাস, আলোচ্য রাজাকে লোকেরা হত্যা করেনি, তিনি মারা গিয়েছিলেন ‘রহস্যজনক ঘটনা’য়।
প্রশ্ন : সেন্সরকারীরা দ্য চিলড্রেন অব গ্যাবেলাভির ব্যাপারেও তো আপত্তি তুলেছিল, তাই না?
মাহফুজ : তুলেছিল। এমনকি সেই সময় আমার ওপর সব ধরনের শৈল্পিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল, সাহিত্যিক সেন্সরশিপ কমিটির প্রধান আমাকে বলেছিলেন, কায়রোর প্রধান ইসলামি সংস্থা আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বিরোধে না জড়ানোর স্বার্থে আমি যেন মিশরে বই প্রকাশ না করি। বইটা বৈরুতে প্রকাশ পেলেও মিশরে প্রকাশের অনুমতি পায়নি। সেটা ১৯৫৯ সাল, নাসেরের সময়। এই বইটা এখনও এখানে কেনা যায় না, চোরাই পথে আসে।
প্রশ্ন : চিলড্রেন অব গ্যাবেলাভি নিয়ে আপনার ইচ্ছা কী ছিল? আপনি কি এটাকে উস্কানিকর করে তুলতে চেয়েছিলেন?
মাহফুজ : আমি এই বইটাতে দেখাতে চেয়েছি- সমাজে বিজ্ঞানের একটা স্থান আছে, ঠিক একটা নতুন ধর্মের মতো, বলতে চেয়েছি যে বিজ্ঞান আবশ্যিকভাবে ধর্মীয় মূল্যবোধের বিরোধী নয়। আমি পাঠককে বোঝাতে চেয়েছি, বিজ্ঞানকে প্রত্যাখ্যান করার অর্থ হলো সাধারণ মানুষকে ত্যাগ করা। দুর্ভাগ্যক্রমে এটাকে ভুল বোঝা হয়েছে, এর জন্যে দায়ী ওইসব লোক, যারা জানে না কিভাবে একটা গল্পকে পড়তে হয়। রূপককে আক্ষরিক অর্থে নেওয়া ঠিক নয়। অনেক পাঠকেরই বোধশক্তির যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
প্রশ্ন : সালমান রুশদির ব্যাপারে আপনার চিন্তা-ভাবনা কী? আপনি কি মনে করেন একজন লেখকের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা উচিত?
মাহফুজ : আমি সত্যিকারভাবে যা ভাবি তা হলো, প্রত্যেক সমাজের নিজস্ব ঐতিহ্য, আইন, ধর্মীয় বিশ্বাস আছে, যেগুলোকে তারা সংরক্ষণ করার চেষ্টা করে। কালে-কালে ব্যক্তিবিশেষের পরিবর্তন দাবি করে। আমি বিশ্বাস করি যে, সমাজের অধিকার রয়েছে, তার নিজস্বতাকে রক্ষা করার, ঠিক যেমন একজন ব্যক্তির অধিকার রয়েছে যা সে পছন্দ করে না, তাকে আক্রমণ করার। একজন লেখক যদি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, তার সমাজের আইন বা বিশ্বাসগুলো আর উপযোগী নয়, বরং ক্ষতিকর, তাহলে তার বিরুদ্ধে কথা বলা তার দায়িত্ব। কিন্তু তাকে তার এই স্পষ্টবাদিতার জন্যে মূল্য দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে। যদি সে এই মূল্য দিতে প্রস্তুত না থাকে, তাহলে তার জন্যে চুপ থাকাই বাঞ্ছনীয়। নিজস্ব নীতি ও ধারণা প্রচারের কারণে জেলে যেতে হয়েছে বা পুড়ে মরতে হয়েছে এমন ব্যক্তির সংখ্যা ইতিহাসে প্রচুর। সমাজ সব সময় নিজেকে রক্ষা করেছে। আজকাল সে এটা করে পুলিশ এবং আদালতের সাহায্যে। আমি মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে যেমন সমর্থন করি, তেমনই সমর্থন করি এর মোকাবেলায় সমাজের অধিকারকেও। মতভিন্নতার মূল্য আমাকে দিতেই হবে। এটা প্রাকৃতিক নিয়ম।
প্রশ্ন : আপনি কি ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ পড়েছেন?
মাহফুজ : না। এটা যখন বের হয় তখন আমি আর ভালো পড়তে পারি না, আমার দৃষ্টিশক্তি সম্প্রতি খুবই খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে। তবে আমেরিকান কালচারাল অ্যাটাশে বইটার প্রত্যেকটা চ্যাপ্টার আমাকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছেন। আমি দেখেছি এতে যে, মানহানি করা হয়েছে তা অগ্রহণযোগ্য। রুশদি এমনকি নবীর স্ত্রীদেরও অপমান করেছে! এখন কথা হলো, আমি আইডিয়া নিয়ে বিতর্ক করতে পারি, কিন্তু অপমানগুলোর কী করব? মানহানি আদালতের বিষয়। একই সঙ্গে আমি খোমেনির অবস্থানকেও সমান বিপজ্জনক বলে বিবেচনা করি। রায় দিয়ে দেওয়ার অধিকার তার নেই, এটা ইসলামি পদ্ধতি নয়। ইসলামি নীতি অনুযায়ী, যখন কোনো লোক ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়, তখন তাকে তওবা এবং শাস্তির মধ্যে কোনো একটাকে বেছে নিতে বলা হয়। রুশদিকে সে সুযোগ দেওয়া হয়নি। আমি সব সময় রুশদির লেখার স্বাধীনতাকে সমর্থন করেছি এবং সে আইডিয়ার দিক থেকে কী চেয়েছে, সেটা আমি বলেছি। কিন্তু এমন কোনো কিছুর মানহানি করার অধিকার তার নেই, বিশেষ করে নবী বা সেই রকম কোনো পবিত্র কিছুর। তুমি কি একমত নও?
প্রশ্ন : আমি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে পারছি… কুরআনে কি মানহানি বা ব্লাসফেমি নিয়ে আলোচনা আছে?
মাহফুজ : অবশ্যই। শুধু কুরআন কেন, দুনিয়ার সকল সভ্য জাতিই ধর্ম-নিন্দার বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করেছে।
প্রশ্ন : আপনি কি শিশুকালে ধার্মিক ছিলেন? আপনি কি প্রত্যেক শুক্রবার পিতার সঙ্গে মসজিদে যেতেন?
মাহফুজ : যৌবনকালে আমি বিশেষভাবে ধার্মিক ছিলাম। কিন্তু আমার পিতা জুমআর নামাজে যাওয়ার জন্যে আমার ওপর চাপ দিতেন না, যদিও তিনি প্রত্যেক শুক্রবারই নামাজে যেতেন। পরে আমি প্রবলভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করি যে ধর্মকে উন্মুক্ত রাখা উচিত; বদ্ধ-মানসিকতার ধর্ম হচ্ছে একটা অভিশাপ। ধর্ম নিয়ে অতি বাড়াবাড়ি তাদের ব্যাপার যাদের জীবনের শেষ আশাটুকুও হারিয়ে গেছে। আমি ধর্মকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি, কিন্তু একই সঙ্গে সেটা বেশ বিপজ্জনক হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও আছে। তুমি যদি জনগণকে আলোড়িত করতে চাও তাহলে একটা সংবেদনশীল জিনিস খুঁজবে, আর মিশরে ধর্ম ছাড়া অন্য কিছুতে মানুষ এত আলোড়িত হয় না। কৃষকদের কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে কী? ধর্ম। সে কারণে ধর্মকে খোলা মন নিয়ে ব্যাখ্যা করা উচিত। ধর্মের প্রেম এবং মানবিকতার বিষয়গুলোকে উচ্চকিত করা উচিত। ধর্ম প্রগতি ও সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত, কেবল আবেগ নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজকাল ধর্মের পশ্চাদপদ ব্যাখ্যা করা হয় এবং সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়।
প্রশ্ন : ওইসব মেয়ে সম্পর্কে আপনি কী বলবেন যারা তাদের মস্তক, এমনকি মুখ এবং হাতও ঢেকে রাখে? এটা কি ধর্মকে সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর উদাহরণ?
মাহফুজ : মস্তক ঢাকা একটা স্টাইল ও ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। এটা এখন আর সে কথা বোঝায় না অধিকাংশ লোকজন যা মনে করে। তবে আমি ধর্মীয় উন্মাদনাকে ভয় করি। এটা একটা অনিষ্টকর প্রবণতা, মানবিকতার বিরোধী।
প্রশ্ন : আপনি কি ইদানীং নামাজ পড়েন?
মাহফুজ : কখনো কখনো পড়ি। বয়সের কারণে পেরে উঠছি না। তেমার এবং আমার মধ্যে, আমি ধর্মকে একটা আবশ্যকীয় মানবীয় আচরণ বলে গণ্য করি। এখনো, সব সময় নামাজ পড়া, রোজা রাখা, আর জায়নামাজে মাথা ছোঁয়ানোর চাইতে আরেকজন মানুষের কল্যাণ করা সুস্পষ্টরূপেই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। খোদা ধর্মকে ব্যায়ামের উপকরণ বানাতে চাননি।
প্রশ্ন : এখন, আপনি ডিনার পার্টি ও সংবর্ধনা সভায় যেতে চান না। কেন?
মাহফুজ : আমি কখনো এসব অনুষ্ঠানে যাই না। এমনকি আমার বন্ধুদের বাড়িতেও বেড়াতে যাই না। আমি তাদের সঙ্গে দেখা করি ক্যাসিনো কাসর আল-নীল অথবা কোনো কফি হাউসে।
প্রশ্ন : সেই কারণেই কি আপনি নোবেল প্রাইজ নিতে সুইডেনে যাননি? এত-এত দেখা-সাক্ষাৎ, ডিনার, পার্টি… সে কারণে?
মাহফুজ : না, ঠিক তা নয়। যৌবনকালে আমি ভ্রমণ খুব পছন্দ করতাম, কিন্তু এখন আর সে ইচ্ছা হয় না। এমনকি দুই সপ্তাহের ভ্রমণও আমার লাইফ স্টাইলকে বিঘ্নিত করে।
প্রশ্ন : আপনাকে নিশ্চয়ই বহুবার জিজ্ঞেস করা হয়েছে নোবেল প্রাপ্তিতে আপনার প্রতিক্রিয়া কী? আপনি কি আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন যে পুরস্কার পাচ্ছেন?
মাহফুজ : মোটেই না। আমার স্ত্রী মনে করতেন, আমি এটা পাওয়ার যোগ্য, কিন্তু আমি সব সময় সন্দেহ করতাম যে নোবেল একটা পাশ্চাত্যীয় পুরস্কার; আমি মনে করতাম তারা কখনোই প্রাচ্যের কাউকে এটা দিতে চায় না। একটা গুঞ্জন ছিল যে আরব জগতের দুজন লেখক তালিকায় আছেনÑ ইউসুফ ইদরিস এবং অ্যাডোনিস।
প্রশ্ন : আপনি কি জানতেন যে, আপনার নাম বিবেচনা করা হচ্ছে?
মাহফুজ : না। সেদিন সকালে আমি আল-আহরাম-এ ছিলাম। আমি যদি আর আধ ঘণ্টা দেরি করতাম, তাহলে তৎক্ষণাৎ জেনে যেতাম। কিন্তু আমি বাড়ি গিয়ে লাঞ্চ করছিলাম। খবরটা আল-আহরাম-এ এসেছিল টেলিপ্রিন্টারে, তখন তারা আমার বাড়িতে টেলিফোন করে। আমার স্ত্রী আমাকে জাগিয়ে তুলে জানায় খবরটা, আমার মনে হয় সে আমার সঙ্গে কৌতুক করছে, আমি আবার ঘুমাতে যাচ্ছিলাম। তখন সে বলল যে, আল-আহরাম থেকে টেলিফোন এসেছে। আমি ফোন ধরতেই শুনলাম একজন বলছে, অভিনন্দন, জনাব! লোকটা মি. বাশা। উনি আমার সঙ্গে মাঝে-মধ্যে হাসি-তামাশা করে থাকেন, তাই তার কথায় আমি গুরুত্ব দিলাম না। আমি পাজামা পরিহিত অবস্থায়ই লিভিংরুমে গিয়ে বসলাম। তখন ডোরবেলটা বেজে উঠল। কেউ একজন ভেতরে ঢুকল, আমার মনে হলো সে সাংবাদিক, কিন্তু না, দেখলাম তিনি সুইডিশ অ্যাম্বাসাডর! সুতরাং আমি দুঃখ প্রকাশ করে পোশাক পরিবর্তন করতে চাইলাম… এভাবেই ব্যাপারটা ঘটেছিল।
প্রশ্ন : আবার আপনার লেখার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আপনি কি নিয়মিত শিডিউল মেনে লেখেন?
মাহফুজ : আমি সব সময় বাধ্য হই সেটা করতে। আটটা থেকে দুটো পর্যন্ত আমি কাজে থাকি। চারটা থেকে সাতটা পর্যন্ত লিখি। তারপর সাতটা থেকে দশটা পর্যন্ত পড়ি। শুক্রবার ব্যতীত এটা আমার নিয়মিত রুটিন। যা-ইচ্ছা-তাই করার সময় পাই না আমি। তবে আমি তিন বছর আগে লেখালেখি বন্ধ করে দিয়েছি।
প্রশ্ন : আপনি আপনার গল্পের চরিত্র এবং আইডিয়াগুলোকে কিভাবে নিয়ে আসেন?
মাহফুজ : আমাকে এভাবে বলতে দাওÑ তুমি যখন তোমার বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাও তখন কী নিয়ে কথা বলো? সেইসব জিনিস সেই দিন, সেই সপ্তাহে, আপনার ওপর একটা দাগ ফেলে যায়… আমি গল্প লিখি এই একই পদ্ধতিতে। ঘটনা ঘটে বাড়িতে, স্কুলে, রাস্তায়, এগুলো হচ্ছে গল্পের ভিত্তি। কিছু কিছু অভিজ্ঞতা এমন গভীর দাগ কেটে যায় যে, সেগুলো নিয়ে কাবে কথা বলার চেয়ে আমি উপন্যাসের মধ্যে নিয়ে কাজ করি। ধরো, উদাহরণস্বরূপ, একজন অপরাধী সম্প্রতি তিনজন লোককে খুন করেছে। এই মূল গল্প থেকে শুরু করে এটাকে কিভাবে লিখব, তার কয়েকটা উপায় নির্ধারণ করি। উদাহরণস্বরূপ, আমি পছন্দ করব গল্পটা কার পরিপ্রেক্ষিত থেকে লিখবÑ স্বামী, স্ত্রী, চাকর, নাকি খুনির? পছন্দের এই হের-ফেরের কারণে একেকটা গল্প আলাদা হয়ে যায়।
প্রশ্ন : যখন আপনি লিখতে শুরু করেন, তখন শব্দগুলোকে কি আপনাআপনি চলে আসতে দেন, নাকি প্রথমে নোট তৈরি করেন? আপনি মনের মধ্যে নির্দিষ্ট থিম ঠিক করে নিয়ে লিখতে বসেন?
মাহফুজ : আমার ছোটগল্পগুলো আসে সরাসরি হৃদয় থেকে। অন্য রচনার ক্ষেত্রে আমি প্রথমে গবেষণা করি। ‘দ্য কায়রো ট্রিলজি’ শুরু করার আগে, উদাহরণস্বরূপ, আমি বিস্তারিত গবেষণা করেছিলাম। প্রত্যেকটা চরিত্র সম্পর্কে আমি আলাদা ফাইল তৈরি করেছিলাম। সেটা যদি না করতাম, তাহলে খেই হারিয়ে ফেলতাম, অনেক কিছু ভুলে যেতাম। কখনো কখনো থিম আসে আপনাআপনি, গল্পের ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়ে, আর কখনো কখনো শুরু করার আগে থেকেই মনের মধ্যে থিম ঠিক করা থাকে। আমার যদি আগে থেকেই জানা থাকে যে আমি এমন একজন মানুষের ছবি আঁকতে চাই যে সকল বিপদাপদ অতিক্রম করে বিজয়ী হতে চায়, তাহলে আমি সেই রকম ক্ষমতাসম্পন্ন নায়ক তৈরি করি। তবে আমি একটা চরিত্রের আচরণের দীর্ঘ বর্ণনা দেওয়ার মাধ্যমেও গল্প লিখি, সেক্ষেত্রে থিম আপনাআপনি বেরিয়ে আসে।
প্রশ্ন : একটা গল্পকে চূড়ান্ত করার আগে আপনি কী রকম সংশোধন ও পুনর্লিখন করেন?
মাহফুজ : আমি ঘন ঘন সংশোধন করি, অনেক কেটে ফেলি, গোটা পৃষ্ঠা জুড়ে লিখি, এমনকি পেছনেও। প্রায়ই আমার সংশোধনী হয় মোটা দাগের। সংশোধনীর পর আমি গল্পটা পুনরায় লিখি এবং তারপর প্রকাশকের কাছে পাঠাই। তখন আমি পুরনো সব কাগজ-পত্র ছিঁড়ে ফেলে দেই।
প্রশ্ন : আপনি আপনার নোটগুলো কখনোই সংরক্ষণ করেন না? অনেক লেখক তাদের লেখার প্রত্যেকটা শব্দ সংরক্ষণ করেন! আপনি কি মনে করেন না একজন লেখকের সংশোধনী পর্যবেক্ষণ করার মধ্য দিয়ে তার লেখার পদ্ধতি পাঠ করা আগ্রহের ব্যাপার?
মাহফুজ : হতে পারে, তবে ব্যাপারটা স্রেফ এই যে, নোট সংরক্ষণ করা আমার সংস্কৃতির অংশ নয়। আমি কখনো শুনিনি যে, কোনো লেখক তার লেখার প্রাথমিক খসড়া সংরক্ষণ করেন। আমাকে সংশোধনীগুলো বাতিল করতে হয়, তা না হলে আমার বাড়ি অপ্রয়োজনীয় কাগজে ভেসে যাবে! তাছাড়া, আমার হাতের লেখা ভয়ানক রকম খারাপ!
প্রশ্ন : ছোটগল্প এবং উপন্যাস কোনোটাই আররি সাহিত্যিক উত্তরাধিকারের অংশ নয়। তা সত্ত্বেও এ দুটি প্রকরণ নিয়ে আপনার যে সাফল্য, তাকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করেন?
মাহফুজ : আমরা আরব লেখকরা ছোটগল্প এবং উপন্যাসের ধারণা পশ্চিম থেকে ধার করেছি, কিন্তু এতদিনে সেটা আমাদের নিজেদের সাহিত্যে আত্মীকৃত হয়ে গেছে। চল্লিশ এবং পঞ্চাশের দশকে অনেক অনুবাদ হয়েছে; আমরা স্রেফ গল্প লেখার পদ্ধতি এবং স্টাইলটা গ্রহণ করেছি। কিন্তু ভুলবে না যে আমাদের উত্তরাধিকারের ভাঁড়ারে রয়েছে আইয়াম আল-আরাব, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ‘আন্তার’ এবং ‘কায়েস ও লাইলা’, আর অবশ্যই দ্য থাউজ্যান্ড অ্যান্ড ওয়ান নাইটস।
প্রশ্ন : আপনি কি আপনার কোনো চরিত্রকে পরিচয় করিয়ে দেবেন?
মাহফুজ : ট্রিলজির কামাল হচ্ছে আমার নিজের প্রজন্মের প্রতিনিধি—আমাদের আইডিয়া, আমাদের পছন্দ, আমাদের সিদ্ধান্তহীনতা ও মানসিক সংকটÑ এই অর্থে তার চরিত্রটি আত্মজীবনীমূলক। কিন্তু একই সঙ্গে সে সর্বজনীনও বটে। আমি আব্দুল গাওয়াদ-এর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা অনুভব করি, এই পিতা লোকটি সকল দিক থেকে জীবনমুখী, তিনি তার বন্ধুদের ভালোবাসেন এবং কৌতুক করেও কাউকে কখনো আঘাত দেন না। এই দুইজন মিলে আমার ব্যক্তিত্বের উভয় অর্ধেকাংশকে উপস্থাপন করে। আব্দুল গাওয়াদ খুব সামাজিক, শিল্প এবং সঙ্গীতের সমঝদার; অন্যদিকে কামাল আত্মমুখী ও লাজুক, আন্তরিক ও আদর্শবাদী।
প্রশ্ন : আসুন আমরা আপনার রচনার নির্দিষ্ট উদাহরণ নিয়ে কথা বলিÑ ‘দ্য থিফ অ্যান্ড দ্য ডগস’। এটা কিভাবে শুরু হয়েছিল?
মাহফুজ : এই গল্পটার অনুপ্রেরণা একজন চোর, যে কিছুদিনের জন্য কায়রোকে সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল। তার নাম মাহমুদ সুলাইমান। জেল থেকে বেরিয়ে সে তার স্ত্রী এবং আইনজীবীকে খুন করার চেষ্টা করে। তারা অক্ষতভাবে পালিয়ে যায়, কিন্তু ঘটনার ফেরে সে নিজেই নিহত হয়।
প্রশ্ন : উপন্যাসে যেমনটি হয়েছে, বাস্তবেও কি তার স্ত্রী তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল?
মাহফুজ : না। আমি এই চরিত্রকে সামনে রেখে কাহিনীটা বানিয়েছি। সে সময় আমি একটা অবিরাম এবং অদ্ভুত অনুভূতিতে ভুগছিলাম যে, আমাকে তাড়া করা হচ্ছে, এবং এই বিশ্বাস জন্মেছিল যে, সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমাদের জীবন অর্থহীন হয়ে পড়েছে। তাই আমি যখন এই চোরের কাহিনী লিখলাম, তখন আমি এর সঙ্গে আমার গল্পও জুড়ে দিলাম। একটা সরল অপরাধ-কাহিনী কালের দার্শনিক অনুধ্যান হয়ে উঠল! প্রধান চরিত্র সাইয়িদ মাহরানকে আমি আমার সকল সন্দেহ ও জটিলতার অংশ করেছি। আমি তাকে শেখ, পতিতা, অর্থ ও খ্যাতির জন্যে বিশ্বাসঘাতকতাকারী আদর্শবাদীর মধ্যে উত্তর খোঁজার অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে চালিত করেছি। লেখক, তুমি বুঝতে পারছ, নিছক একজন সাংবাদিক নন। তিনি গল্পকে তার নিজের সন্দেহ, প্রশ্ন এবং মূল্যবোধের সঙ্গে অন্তর্বয়ন করেন। এটাই শিল্প।
প্রশ্ন : গল্পটায় ধর্মের ভূমিকা কী? শেখ যেমন পরামর্শ দিচ্ছেন, খোদায় বিশ্বাস স্থাপনই কি সত্যিকার সুখ লাভের উপায়? অপরাধী যার সন্ধান করছে সুফিবাদ-এর মধ্যেই কি তার উত্তর নিহিত?
মাহফুজ : শেখ জীবনকে প্রত্যাখ্যান করছেন, আমরা জানি। অন্যদিকে অপরাধী চাচ্ছে তার তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধান। তারা পৃথক দুই জগতের বাসিন্দা। আমি সুফিবাদকে ভালোবাসি, ঠিক ততটাই ভালোবাসি সুন্দর কবিতা, কিন্তু এটা কাঙ্ক্ষিত উত্তর নয়। সুফিবাদ হচ্ছে মরুভূমির মরীচিকার মতো। এটা তোমাকে বলছেÑ আসো, বসো, আরাম করো এবং ক্ষণিকের জন্যে উপভোগ করো। জীবনকে প্রত্যাখ্যানকারী যে কোনো পথকে আমি প্রত্যাখ্যান করি, কিন্তু আমি সুফিবাদকে পছন্দ না করে পারি না, কারণ এর কথা শুনতে এত মধুর লাগে… যুদ্ধের মধ্যে এটা আপনাকে স্বস্তি দেয়…।
প্রশ্ন : কাহিনীর নারী চরিত্র নূর, তার ব্যাপারটা কী? ‘আর দ্য বিগিনিং অ্যান্ড দ্য অ্যান্ড’-এর নাফিসা এবং মিরামার-এর জোহরার মতো মেয়েরা? এই চরিত্রগুলো, যদিও তারা ‘পতিত’, সুস্পষ্টরূপেই সহৃদয়, এবং ভবিষ্যতের একমাত্র আশাকে মূর্তকারী।
মাহফুজ : এটা ঠিক, যদিও আমি চেয়েছিলাম নাফিসা একটা আদর্শ মিশরীয় পরিবারে অসম্মানজনক আচরণের পরিণতি কী সেটাও তুলে ধরুক।
প্রশ্ন : এই ধরনের শাস্তিকে কি আপনি উপেক্ষা করেন?
মাহফুজ : আমি, অধিকাংশ মিশরীয়র মতো, অনুভব করি যে এই মাত্রার শাস্তি একটু বেশি কঠোর। অন্যদিকে একজন মিশরীয় লোক যদি নাফিসার ভাই যা করেছে সেভাবে সাড়া না দেয় তাহলে, সে এই সমাজে বাস করতে পারবে না। সে চাক বা না চাক, সে পতিতা মেয়েটিকে হত্যা করতে বাধ্য। এই ঐতিহ্যের পরিবর্তন আসতে লম্বা সময় লাগবে, যদিও সম্প্রতি, বিশেষত শহর এলাকায়, এর শক্তি অনেকখানি হ্রাস পেয়েছে।
প্রশ্ন : ট্রিলজির আব্দুল গাওয়াদ সমকালের আদর্শ মিশরীয় পুরুষের প্রতিরূপ। এখনও কি তার মতো মানুষই অধিক?
মাহফুজ : ওহ, হ্যাঁ। বিশেষ করে গ্রাম এলাকায়… যদিও আজকের আব্দুল গাওয়াদ সম্ভবত অপেক্ষাকৃত কম চরমপন্থী। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই কি তার ছায়া নেই?
প্রশ্ন : প্রত্যেক মিশরীয় লোক, না কি প্রত্যেক লোকের কথা বলছেন?
মাহফুজ : আমি অন্য দেশের কথা বলতে পারি না, তবে এটা মিশরীয়দের ক্ষেত্রে খুবই সত্য।
প্রশ্ন : যদিও অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে, সেটা বলবেন না?
মাহফুজ : পরিবর্তন শুরু হয়েছে। সংসারে নারীর অবস্থান অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে, প্রধানত শিক্ষার কারণে, যদিও অন্যান্য কারণও রয়েছে।
প্রশ্ন : সংসারে কার প্রাধান্য থাকা উচিত বলে আপনি মনে করেন? কার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকা উচিত?
মাহফুজ : বিয়ে হচ্ছে সমান অংশীদারিত্বের একটা কোম্পানির মতো। কোনো একজন শাসন করবে না। যদি মতান্তর হয় তাহলে দুজনের মধ্যে যে অধিকতর বুদ্ধিমান সে প্রাধান্য বিস্তার করবে। তবে প্রত্যেকটা পরিবার আলাদা। ক্ষমতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অর্থের ওপর নির্ভরশীল; যে সবচেয়ে বেশি অর্থ উপার্জন করে সেই বেশি ক্ষমতাবান হয়। কোনো ধরা-বাঁধা নিয়ম নেই।
প্রশ্ন : মিশরের মতো অতি রক্ষণশীল, ঐতিহ্যবাহী সমাজে পুরুষের ওপর নারী কি প্রায়ই ক্ষমতাশীল হয় না?
মাহফুজ : অবশ্যই। সাম্প্রতিক ইতিহাস তারই প্রমাণ দেয়। গণনাযোগ্য রাজনৈতিক বা সামরিক ক্ষমতার অধিকারী পুরুষরা শক্ত নারীদের কব্জায় পড়ে, তারাই তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব বিস্তার করে। এই নারীরা পর্দা ও বোরখার পেছন থেকে শাসন করে।
প্রশ্ন : আপনার নায়িকাদের অধিকাংশই কেন নীচু শ্রেণীর নারী? আপনি কি তাদের দিয়ে কোনো বড় কিছুকে প্রতিবিম্বিত করতে চান? যেমন মিশর, উদাহরণ হিসেবে?
মাহফুজ : না। নীচু শ্রেণীর নারীদের সম্পর্কে লিখে আমি স্রেফ এটাই দেখাতে চাই যে, এইসব উপন্যাস যে-কালের পটভূমিতে লেখা সে সময় নারীদের কোনো অধিকার ছিল না। একজন মহিলা যদি ভালো স্বামী খুঁজতে না পারে বা খারাপ স্বামীকে ত্যাগ করতে না পারে, তাহলে তার কোনো ভবিষ্যত থাকে না। কখনো কখনো তার একমাত্র গন্তব্য হচ্ছে, দুর্ভাগ্যক্রমে, অবৈধ পন্থা। এই নিকট অতীতেও, নারীরা প্রচুর অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল… এমনকি বিয়েতে পছন্দের স্বাধীনতা, তালাক, এবং শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার থেকেও। এখন মেয়েরা শিক্ষা লাভ করছে, অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে, কারণ যে মেয়ে শিক্ষা লাভ করছে সে একটা অস্ত্র পাচ্ছে। কোনো কোনো সমালোচক মিদাক অ্যালির হামিদাকে মিশরের প্রতিরূপ বলে গণ্য করেছেন, কিন্তু আমার সে রকম কোনো ইচ্ছা ছিল না।
প্রশ্ন : সেইসব সমালোচক সম্পর্কে আপনার ধারণা কী, যারা আপনার কাজকে প্রতীকের ভাষায় ব্যাখ্যা করে?
মাহফুজ : আমি যখন প্রথম শুনি যে হামিদা মিশরকে প্রতীকায়িত করেছে, আমি অবাক হয়েছিলাম, কিছুটা আঘাতও পেয়েছিলাম। আমার সন্দেহ হয়েছিল যে সমালোচকরা অযথাই প্রত্যেক জিনিসকে, প্রত্যেক মানুষকে, প্রতীকে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তারপর আমি হামিদার আচরণ এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটের মধ্যে সাদৃশ্য লক্ষ্য করতে লাগলাম। এর মধ্যে আমি প্রবন্ধটা পড়ে ফেললাম, আমার উপলব্ধি হলো যে সমালোচক ঠিকই বলেছেন, আমি যখন হামিদা সম্পর্কে লিখছি তখন অবচেতনভাবে মিশরের কথাও লিখছি। আমার মনে হয় এই ধরনের প্রতীকী সমান্তরালতা সর্বদাই সম্ভবত আসে অবচেতনা থেকে। যদিও পাঠক একটা লেখার মধ্যে যা দেখে হতে পারে আমি সেই বিশেষ অর্থ বোঝাতে চাইনি, তা সে অর্থ যতই না গল্পের বৈধ অংশ হোক। একজন লেখক যেমন সচেতনভাবে লেখেন তেমনই অবচেতনভাবেও লেখেন।
প্রশ্ন : কোন বিষয় আপনার হৃদয়ের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ? কোন বিষয় নিয়ে লিখতে আপনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন?
মাহফুজ : স্বাধীনতা। উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা, রাজার অবিসংবাদী শাসন থেকে মুক্তি, এবং সমাজ ও পরিবারের প্রেক্ষাপটে মৌলিক মানবিক স্বাধীনতা। এই ধরনের স্বাধীনতা একটা আরেকটার অনুবর্তী হয়। ট্রিলজিটায়, উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিপ্লব রাজনৈতিক স্বাধীনতা আনার পর আব্দুল গাওয়াদের পরিবার তার থেকে আরও স্বাধীনতা দাবি করল।
প্রশ্ন : আপনি কি মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যত সম্পর্কে আশাবাদী, বিশেষ করে উপসাগরীয় যুদ্ধ এবং অব্যাহত সহিংসতার পেক্ষাপটে?
মাহফুজ : আমার এই বয়সে নৈরাশ্যবাদী হওয়া চলে না। যৌবনে এ কথা ঘোষণা করা যায় যে মানুষের সামনে কোনো আশা নেই, কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে মানুষ পৃথিবীকে ঘৃণা না করার জন্য জনগণকে সাহস জোগাতে শেখে।
প্রশ্ন : কিন্তু নায়ক সম্পর্কে আপনার ধারণা কী? আপনার গল্পে, প্রকৃতপক্ষে সমকালীন কোনো মিশরীয় লেখকের গল্পেই, নায়কের অস্তিত্ব দেখা যায় না। কেন?
মাহফুজ : এটা সত্যি যে আমার অধিকাংশ গল্পে নায়ক নেই—কেবল চরিত্র রয়েছে। কেন? কারণ আমি আমাদের সমাজকে সমালোচকের দৃষ্টিতে দেখি এবং যেসব লোককে দেখি তাদের মধ্যে অসাধারণ কিছু লক্ষ করি না। আমার আগের প্রজন্ম ১৯১৯ সালের অভ্যুত্থান দ্বারা প্রভাবিত ছিল, তারা নায়কোচিত আচরণ প্রত্যক্ষ করেছে—অস্বাভাবিক বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম কর্মী, সেই রকম নায়ক। অন্য লেখকরা—তওফিক আল-হাকিম, মুহাম্মাদ হুসাইন হায়কল, ইবরাহীম আবদ আল-ক্কাদির আল-মাজিনি—নায়কোচিত লেখা লিখেছেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে, আমাদের প্রজন্ম খুব উদাসীন এবং নায়ক একটা দুর্লভ জিনিস; এই কালে ফ্যান্টাসি না হলে কোনো উপন্যাসে তুমি নায়ক সৃষ্টি করতে পারো না।
প্রশ্ন : নায়ককে আপনি কীভাবে চিত্রায়িত করবেন?
মাহফুজ : প্রাচীন আরবি সাহিত্যে অনেক নায়ক আছে, তারা সবাই অশ্বারোহী, উপাধিধারী সম্ভ্রান্ত যোদ্ধা। কিন্তু বর্তমানে, আমার দৃষ্টিতে, একজন নায়ক হবে সে যে একটি বিশেষ নীতিমালার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ এবং বাধার মুখেও তার ওপর অটল রয়েছে। সে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে, সুবিধাবাদী নয়, এবং তার একটা শক্তিশালী নৈতিক ভিত্তি আছে।
প্রশ্ন : আপনি কি নিজেকে একজন নায়ক বিবেচনা করেন?
মাহফুজ : আমাকে?
প্রশ্ন : আপনি কি আপনার সন্তান এবং জনগণের জন্য সেই রকম একজন মডেল নন যিনি বিরোধিতার মুখেও নিজ নীতিমালার ওপর অটল থেকেছেন?
মাহফুজ : হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। তবে আমি নিজেকে নায়ক বলে মনে করি না।
প্রশ্ন : তাহলে আপনি নিজেকে কিভাবে চিত্রিত করবেন?
মাহফুজ : আমি এমন একজন মানুষ যে সাহিত্য ভালোবাসে। যে কাজে বিশ্বাসী এবং কাজের ব্যাপারে আন্তরিক। এমন একজন মানুষ যে কাজকে অর্থ এবং খ্যাতির চেয়েও বেশি ভালোবাসে। অবশ্য অর্থ এবং খ্যাতি যদি আসে, স্বাগত! কিন্তু সেটা কখনোই আমার লক্ষ্য হয়নি। কেন? কারণ আমি যে কোনো কিছুর চাইতে লেখাকে বেশি ভালোবাসি। এটা খারাপ শোনাতে পারে, কিন্তু আমি অনুভব করি যে, সাহিত্য ছাড়া আমার জীবনের কোনো অর্থ থাকবে না। আমার ভালো বন্ধু, ভ্রমণ, বিলাসিতা, সবই থাকতে পারে, কিন্তু সাহিত্য ছাড়া আমার জীবন করুণ হয়ে উঠবে। এটা আশ্চর্য জিনিস, কিন্তু বাস্তবে তা নয়, কারণ বেশির ভাগ লেখকই একই রকম। তার মানে এই নয় যে লেখা ছাড়া আমি জীবনে আর কিছু করিনি। আমি বিবাহিত, আমার ছেলেমেয়ে আছে। ১৯৩৫ সাল থেকে আমার চোখের সংবেদনশীলতার সমস্যা, যার কারণে গ্রীষ্মকালে আমার লেখা এবং পড়া নিষেধ, সুতরাং এটা আমার জীবনকে সুষমতা দান করেছে- খোদা প্রদত্ত সুষমতা। প্রত্যেক বছর তিনটি মাস আমাকে অবশ্যই জীবনযাপন করতে হবে এমন একজন মানুষ হিসেবে যে লেখক নয়। সেই তিন মাস আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করি এবং ভোর পর্যন্ত বাইরে থাকি। তাহলে আমি তো বেঁচে আছি, না কি?