অনুবাদ: মোস্তাফিজ ফরায়েজী
মিগুয়েল স্ট্রিটের অতিথিপরায়ণ বাড়িগুলোতে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় তিনজন ভিক্ষুক ডাকাডাকি করতো। দশটার সময় একজন ভারতীয় ধূতি আর সাদা জ্যাকেট পরে আসতো, আমরা তার ঝুলিতে একটিন চাল ভরে দিলে সে পিঠে করে তা বয়ে নিয়ে যেতো। দুপুর বারোটায় একজন বৃদ্ধা মহিলা হুঁকো ফুঁকতে ফুঁকতে আসতো, সে এক সেন্ট পেতো। তারপর দুটায় একটা অন্ধ লোক তার পেনি বুঝে নেওয়ার জন্য আসতো। তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসতো এক বালক। শুধু এরাই আসতো তাই নয়, মাঝে মাঝে খচ্চর টাইপের লোকও আসতো। একদিন একটা লোক এসে বললো, সে ক্ষুধার্ত। আমরা তাকে খেতে দিলাম। তারপর সে আমাদের কাছে সিগারেট চাইলো, শুধু তাই নয়, যতক্ষণ না আমরা সিগারেটটা ধরিয়ে দিলাম, ততক্ষণ সে গেলোই না। ওই লোকটি আর কখনো আসেনি।
এরপর একদিন একজন আশ্চর্যজনক লোকের আগমন ঘটলো। সময়টা বিকাল চারটা। আমি সবে স্কুল থেকে ফিরে পোশাক পাল্টেছি, ঠিক সেই সময় লোকটি ডাকাডাকি শুরু করলো। আমি আসতেই লোকটি আমাকে বললো, সনি, আমি কি তোমাদের বাড়ির আঙিনায় আসতে পারি?
লোকটি দেখতে ছোটখাটো, বেশ পরিপাটি, তার পোশাক দেখলেই বিষয়টা বোঝা যায়, তার মাথায় হ্যাট, পরনে সাদা শার্ট আর কালো রঙের ট্রাউজার। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কী চান? সে বললো, আমি তোমাদের মৌমাছি দেখতে চাই।
বলে রাখা ভালো, আমাদের আঙিনায় চারটি গ্রু-গ্রু পাম গাছ আছে, আর গাছগুলো মৌমাছিতে ভরে গেছে।
আমি দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে চিৎকার করে মাকে ডাকতে লাগলাম, মা, বাইরে একজন লোক এসেছে। লোকটি বলছে, সে মৌমাছি দেখতে চায়।
আমার মা বাইরে বের হয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে অশোভনভাবে বললেন, আপনি কী চান?
লোকটা বললো, আমি মৌমাছি দেখতে চাই।
তার ইংরেজি উচ্চারণ খুব ভালো, এটা আমার কাছে স্বাভাবিক ঠেকলো না, এমনকি আমার মায়ের মুখেও একটু চিন্তার ছাপ দেখলাম। মা আমাকে বলল, যতক্ষণ লোকটা মৌমাছি দেখে, তুমি এখানেই থাকো আর লোকটার প্রতি লক্ষ রাখো।
লোকটি বললো, ধন্যবাদ, ম্যাডাম। আপনি আজকে একটা ভালো কাজ করলেন।
সে খুব আস্তে আস্তে এবং সুচারুভাবে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করলো। তার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দই তার মূল্য বোঝাতে লাগলো।
লোকটি আর আমি একঘণ্টা ধরে পাম গাছের কাছে হাঁটু গেড়ে মৌমাছি দেখতে লাগলাম। হঠাৎ লোকটি বললো, আমি মৌমাছি দেখতে ভালোবাসি। সনি, তুমি কি মৌমাছি দেখতে পছন্দ করো?
আমি বললাম, এসব করার সময় আমার নেই।
সে দুঃখ প্রকাশের ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, এটাই আমি করি, আমি শুধু দেখি। আমি দিনের পর দিন পিঁপড়া দেখি। তুমি কি কখনো পিঁপড়া দেখেছ? বিছা, শতপদী, কনগরি দেখেছ কখনো?
আমি মাথা নাড়িয়ে ‘না’ জানিয়েই বললাম, আপনি কী করেন?
সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আমি একজন কবি।
আমি বললাম, ভালো, কবি!
সে বললো, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ।
-আপনার নাম কী?
-বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ।
-বি. কী বিল-এর সংক্ষিপ্ত রূপ?
-ব্লাক। ব্লাক ওয়ার্ডসওয়ার্থ। হোয়াইট ওয়ার্ডসওয়ার্থ ছিল আমার ভাই। আমাদের একই আত্মা। আমি ক্ষুদ্র একটি ফুলকেও সকালের সৌন্দর্য দেখার মতো করে দেখে চিৎকার করে উঠি।
আমি বললাম, তুমি কেন চিৎকার করে ওঠো?
কেন? বালক, তুমি যখন বড় হবে তখন বুঝতে পারবে। তুমিও একজন কবি, তুমি কি সেটা জানো? যখন তুমি একজন কবি, তুমি তখন যেকোনো কিছুর জন্য চিৎকার করতে পারবে।
আমি একথা শুনে হাসতে গিয়েও হাসতে পারলাম না।
সে বললো, তুমি তোমার মাকে পছন্দ করো?
মা যখন আমাকে মারেন না তখন পছন্দ করি তাকে।
সে তার ট্রাউজারের পেছন পকেট থেকে একটা ছাপা কাগজ বের করে বললো, এই কাগজটাতে মা সম্পর্কে সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা লেখা আছে, আমি এটা তোমার কাছে দরকষাকষি করে ‘চার সেন্টে’ বিক্রি করতে চাই।
আমি ভেতরে গিয়ে মাকে বললাম, তুমি চার সেন্ট দিয়ে একটা কবিতা কিনবে?
মা বললেন, লোকটাকে এখনই উঠোন থেকে চলে যেতে বলো।
আমি বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাছে ফিরে গিয়ে বললাম, মা’য়ের কাছে চার সেন্ট নেই।
বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ বললো, এটাই হচ্ছে কবিতার শোকগাথা।
তারপর সে তার কাগজটা পকেটে রাখলো। আমার কথায় সে আহত হলো বলে মনে হলো না। বেশ স্বাভাবিকই লাগছিল তাকে।
আমি বললাম, এদিক-ওদিক ঘুরে এভাবে কবিতা বিক্রি করা মজার ব্যাপার। ক্যালিপসোনিয়ানরা এ রকম করতো। তোমার কবিতা কি কেউ কিনেছে?
সে বললো, এখন পর্যন্ত একটি কপিও কেউ কেনেনি।
-তাহলে কেন তুমি কবিতা নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছো?
সে বললো, এভাবে আমি অনেক কিছু দেখি। আমি সবসময় আশা রাখি, এভাবেই কবিদের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়ে যাবে।
আমি বললাম, তুমি কি সত্যিই মনে করো আমি কবি?
সে বললো, তুমি আমার মতোই ভালো কবি।
তারপর বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ চলে গেলো। আমি মনে মনে প্রার্থনা করলাম, যেন পুনরায় এই আজব লোকটার সঙ্গে আমার দেখা হয়।
সপ্তাখানেক পরে, স্কুল থেকে ফিরে এক বিকেলে দেখি লোকটি মিগুয়েল স্ট্রিটের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমি এগিয়ে গেলাম। সে বললো, তোমার জন্য অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি।
বললাম, তোমার একটি কবিতাও বিক্রি হয়েছে?
সে বলল, আমার বাড়ির আঙিনায় পোর্ট-অব-স্পেনের সবচেয়ে বিখ্যাত আম গাছ আছে। আমগুলো এখন পেকে লাল হয়ে গেছে, খেতে দারুণ মিষ্টি আর রসালো। আমি তোমাকে এটা বলার জন্য এসেছি। তোমাকে আম খাওয়ার দাওয়াত দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
লোকটি বাস করতো আলবার্তো স্ট্রিটের এক রুমের একটা ছোট্ট কুটিরে। কুটিরটা ছিল তার জমির একদম মাঝখানে। বাড়ির আঙিনাটা একদম সবুজ। সেখানেই বড় আমগাছটা। একটা নারিকেল আর বরই গাছও আছে। পুরো জায়গাটা জঙ্গলের মতো, কেননা এটা শহর না। এখানে তুমি এই রাস্তায় বড় বড় দালান দেখতে পারবে না।
লোকটি ঠিকই বলেছিল। আমগুলো মিষ্টি আর রসালো। আমি ছয়টার মতো খেলাম, তাতেই হলুদ আমের রস আমার হাত বেয়ে কনুইতে চলে আসলো, আমের রস আমার মুখ বেয়ে থুঁতনিতে পৌঁছে গেলো। আমার শার্টেও দাগ লেগে হয়ে গেলো।
আম খেয়ে বাড়ি ফিরলে মা আমাকে বললেন, তুই কোথায় ছিলে? তুমি কী মনে করেছ, তুমি খুব বড় হয়ে গেছ? যখন যেখানে ইচ্ছা সেখানে চলে যেতে পারবে? যাও, আমার জন্য একটা বেত কেটে নিয়ে এসো, তারপর মজা দেখাচ্ছি।
মা আমাকে বেদম পেটানো শুরু করলেন। আমিও বাড়ি থেকে দৌড়ে পালাতে পালাতে শপথ করলাম, আর কোনোদিন বাড়ি ফিরে আসব না। পালিয়ে আমি আর কই যাবো? বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থের বাড়িতে গেলাম। আমার নাক দিয়ে তখন রক্ত ঝরছিল। বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ বললো, কান্না থামাও, চলো আমরা একটু হাঁটতে বেরোই।
কান্না থামিয়ে ছোট ছোট শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছিলাম। মানে ফোঁপাচ্ছিলাম। যাই হোক, আমরা হাঁটতে বেরোলাম। আমরা সেন্ট ক্লেয়ার এভিনিউ থেকে সাভানাহ পর্যন্ত হাঁটলাম, আমরা ঘোড়দৌড়ের মাঠেও হাঁটলাম।
বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ বললো, এখন চলো ঘাসের ওপর চিত হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। তারাগুলো কত দূরে সে বিষয়ে আমি তোমাকে ভাবাতে চাই।
সে যেমন বললো, আমি সেরকমই করলাম। সে যেটা বোঝাতে চেষ্টা করলো, আমি সেটাই দেখলাম। আমি কোনোকিছুই অনুভব করলাম না, আবার একইসঙ্গে আমার জীবনের এমন বৃহৎ ও মহান কিছু অনুভব করিনি। আমি আমার সব রাগ, অভিমান, কান্না, দুর্দশা সবকিছুই ভুলে গেলাম।
বললাম, আমি ভালো অনুভব করছি, সে আমাকে তারার নামগুলো বলতে লাগলো। নির্দিষ্টভাবে আমার মনে আছে, অরিয়ন অব হান্টারের কথা, কিন্তু কী কারণে এই নামটি মনে আছে, সেটা আমি জানি না। এমনকি আজও আমি অরিয়ন কোনটা সেটা দেখিয়ে দিতে পারি, বাকিগুলোর নাম আমি ভুলে গেছি। যাই হোক, তারপর একটা আলো আমাদের মুখের ওপর এসে পড়লো। আমরা একটা পুলিশের লোক দেখলাম। আমরা ঘাসের ওপর থেকে উঠে পড়লাম।
পুলিশ বললো, তোমরা এখানে কী করছ?
বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ বললো, আমিও এই প্রশ্নটি গত চল্লিশ বছর ধরে নিজেকে করে চলেছি।
আমি আর মি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ বন্ধু হয়ে গেলাম। সে আমাকে বললো, তুমি আমগাছ, নারিকেল গাছ, বরই গাছ বা আমার সম্পর্কে কাউকে বলবে না। তুমি এটা গোপন করে রাখবে। তুমি যদি কাউকে বলো, আমি কিন্তু জেনে যাবো, কারণ আমি একজন কবি।
আমি তাকে কথা দিলাম। তার ছোট কুটিরটা আমার অনেক পছন্দ হলো। এতে জর্জের সামনের রুমের চেয়ে বেশি আসবাবপত্র আছে এমনটি নয়। কিন্তু এটা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কিন্তু এটা দেখতে নীরব-নিস্তব্ধ।
একদিন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, তুমি তোমার আঙিনায় এসব ঝোপঝাড় রেখেছ কেন? এটা কি তোমার আঙিনা স্যাঁতস্যাঁতে করে ফেলছে না?
সে বললো, শোনো, আমি তোমাকে একটা গল্প বলি। অনেকদিন আগে, একটা ছেলে আর একটা মেয়ের দেখা হলো, তারপর তারা একে অন্যের প্রেমে পড়ে গেলো। তারা একে অন্যকে অনেক ভালোবাসতো। কিছুদিন পর তারা বিয়ে করে ফেললো। তারা দুজনেই কবি। ছেলেটি শব্দমালা ভালোবাসতো। মেয়েটি ঘাস, ফুল, গাছ ভালোবাসতো। তারা একটা ছোট্ট ঘরে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতো। তারপর একদিন, মেয়েটি ছেলেটিকে বললো, আমরা আমাদের পরিবারে আরেকটি কবি পেতে চলেছি। কিন্তু সেই কবিটির আর জন্ম হয়নি, কারণ মেয়েটি মারা গেলো। তরুণ কবিও তার সঙ্গে মারা গেলো, তার অভ্যন্তরে সে মারা গেলো। আর ওই মেয়েটির স্বামীর খুব মন খারাপ হলো, সে বললো, সে বাগানের কোনো কিছুতে আর হাত দেবে না। তাই বাগানটি যেমন আছে তেমনটিই থেকে গেলো। দিনে দিনে সবকিছু বড় হতে লাগলো এবং জঙ্গলের মতো হয়ে গেলো।
আমি বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থের দিকে তাকালাম, সে যখন অতিশয় সুন্দর গল্পটা আমাকে বলছিল তাকে তখন আরও বয়স্ক মনে হচ্ছিল। আমি তার গল্পটা বুঝতে পারলাম।
একদিন আমরা একসঙ্গে দীর্ঘপথ হেঁটে হেঁটে গেলাম। বোটানিক্যাল গার্ডেন ও রক গার্ডেনে গেলাম। সন্ধ্যার কিছু আগে চ্যান্সেলর হিলে উঠলাম। দেখলাম কিভাবে পোর্ট-অব-স্পেনে অন্ধকার নেমে আসে, তারপর দেখলাম কিভাবে শহরে ও পোতাশ্রয়ের জাহাজে বাতি জ্বলে ওঠে।
আমি অবাক হতাম। এইসময়ে এসে সে সবকিছু এমনভাবে করছিল যেন সে জীবনে প্রথমবারের মতো কাজগুলো করছে। সে সবকিছু এমনভাবে করছিলো যেন সে গির্জার কিছু আচার পালন করছে। সে আমাকে বললো, এখন আইসক্রিম হলে কেমন হয়?
আমি যখন ‘হ্যাঁ’ বললাম, সে আরও সিরিয়াস হয়ে বললো, আমরা এখন কোন ক্যাফেতে যাবো?
কথাটা এমনভাবে বললো যেন আইসক্রিম খাওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সে এই বিষয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করে আবারও বললো, আমার মনে হয়, আমি দোকানে যাবো। দোকান থেকে দাম দেখেশুনে আইসক্রিম আনবো।
এভাবেই আমার পৃথিবীটা অতিশয় উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠলো। একদিন আমি যখন তার আঙিনায়, সে আমাকে বললো, আমার একটা গোপনীয় বিষয় আছে, যেটা আমি তোমাকে বলবো।
আমি বললাম, এটা সত্যিই গোপনীয় বিষয় তো?
—এই মুহূর্তে, হ্যাঁ।
আমি তার দিকে তাকালাম, সে আমার দিকে তাকালো। তারপর সে বললো, এটা শুধু আমার আর তোমার ভেতর থাকবে, মনে রেখো কথাটা। কথাটা হচ্ছে–আমি একটা কবিতা লিখছি। আমি হতাশা ভরা কণ্ঠে বললাম, ওহ। সে বললো, কিন্তু এই কবিতাটি একটু অন্যরকম। এটা পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা কবিতা হতে চলেছে।
আমি তার কথা শুনে শিস দিলাম। সে বলতে থাকলো, আমি এই কবিতাটি নিয়ে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছি। যে গতিতে আমি লিখছি এভাবে চললে এখন থেকে বাইশ বছর পর কবিতাটি লেখা শেষ হবে।
—তুমি তাহলে অনেক লেখো, তাই না?
—এখন আর অত লিখি না। আমি প্রতি মাসে মাত্র এক লাইন লিখি। কিন্তু আমি নিশ্চিত করি, লাইনটা যেন ভালো হয়।
—গত মাসের ভালো লাইনটি কী ছিল?
সে আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, অতীত খুব গভীর।
—এটা একটা সুন্দর লাইন।
—আমি আমার পুরো মাসের অভিজ্ঞতা আমার কবিতার এক লাইনে লেখার চেষ্টা করি। তাই, বাইশ বছর ধরে আমি এমন একটা কবিতা লিখব, যেটাতে সব মানবসভ্যতার কথা ধ্বনিত হবে।
শুনে আমি অবাক। আমরা হাঁটতে থাকলাম। ডকসাইটের সমুদ্রের তীর ঘেঁষে একদিন হাঁটতে হাঁটতে আমি বললাম, আমি যদি এই পিনটা পানির মধ্যে ফেলে দেই, তোমার কি মনে হয় এটা ভাসবে?
—দুনিয়াটা বড় আজব। তোমার পিনটা পানিতে ফেলো আর আমাদের দেখতে দাও কী ঘটে।
পিনটি স্বভাবতই ডুবে গেলো। আমি বললাম, এই মাসে কবিতার খবর কী?
কিন্তু সে আমাকে কোনো লাইন বললো না। সে কেবল বললো, ওহ হ্যাঁ, লাইনটা আসছে। লাইনটা আসছে।
আমরা সমুদ্রের তীরে বসে দেখলাম যাত্রীবাহী জাহাজ পোতাশ্রয়ের দিকে আসছে। কিন্তু পৃথিবীর সেরা কবিতাটির লাইন আমার আর শোনা হলো না। আমি বুঝতে পারলাম, সে ধীরে ধীরে আরও বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কিভাবে জীবনযাপন করো?
সে বলল, তুমি বলতে চাচ্ছো, আমি টাকা কোথায় পাই?
আমি মাথা নাড়াতেই সে কুটিলভাবে হেসে উঠলো, তারপর বললো, আমি ক্যালিপসোর সিজনে ক্যালিপসো গাই।
—এটাতেই তোমার বছরের বাকি সময় চলে যায়?
—এটাই যথেষ্ট।
—কিন্তু তুমি যখন পৃথিবীর সেরা কবিতাটি লিখবে, তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মানুষ হয়ে যাবে, তাই না?
সে কোনো উত্তর দিলো না। এরপর একদিন আমি তাকে দেখতে তার ছোট্ট কুটিরে গেলাম, দেখি সে শয্যাগত। তাকে এতটা বয়স্ক আর দুর্বল লাগছিল যে, দেখেই আমার কান্না চলে আসছিল। সে বললো, কবিতাটি ভালো চলছে না। সে আমার দিকে না তাকিয়ে জানালা দিয়ে নারিকেল গাছের দিকে তাকিয়ে এমনভাবে কথা বলতে লাগলো, যেন আমি সেখানে নেই। সে বলল, আমার বয়স যখ বিশ, আমি আমার মাঝে জোর পেতাম। তারপর আমার চোখের সামনে দেখলাম তার মুখাবয়ব আস্তে আস্তে বয়স্ক হয়ে যাচ্ছে, আরও মলিন হয়ে যাচ্ছে।
সে বলতে থাকলো, কিন্তু সেটা অনেক বছর আগের কথা।
তারপর আমি বিষয়টা গভীরভাবে অনুভব করলাম—আমার মা আমাকে থাপ্পড় মারলে যেরকম অনুভব করি, সেরকম। আমি সেটা তার মুখাবয়বে ভেসে উঠতে দেখলাম। সবাইকে দেখানোর জন্যই ভেসে উঠেছে ওটা। কুঁচকানো মুখাবয়বের ওপর যমদূত ভেসে উঠছে।
সে আমার দিকে তাকালো, আমার আমার চোখের জল দেখে উঠে বসে বললো, কাছে এসো।
আমার চোখের ভেতর তাকিয়ে সে বললো, ওহ, তুমিও এটা দেখতে পারছো। আমি সবসময়ই জানতাম তোমার কবির চোখ রয়েছে। সেই মুহূর্তে তাকে দেখে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে হলো না। এতে আমি আরও জোরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম।
সে তার রুগ্ণ বুকে আমাকে টেনে নিয়ে বললো, তুমি কি চাও আমি তোমাকে একটা মজার গল্প বলি? এটা বলার সময় সে আমাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য মুচকি হাসতে লাগলো।
কিন্তু আমি উত্তর করতে পারলাম না। সে বললো, আমি যখন গল্পটা শেষ করব, আমার কাছে ওয়াদা করো, তুমি এখান থেকে চলে যাবে, আর আমাকে দেখতে আসবে না। ওয়াদা করো?
আমি মাথা নাড়ালাম।
সে বললো, ভালো ছেলে। শোনো, আমি তোমাকে একদিন একটা ছেলে কবি আর মেয়ে কবির গল্প বলেছিলাম, সেটা মনে আছে? ওই গল্পটা সত্যি না। গল্পটা আমি বানিয়ে বলেছিলাম। আর ওই যে কবিতা আর পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা কবিতা নিয়ে যেসব কথা বলেছিলাম, সেসবও মিথ্যা। এটাই কি পৃথিবীর সবচেয়ে মজার গল্প নয়?
এরপর তার গলার স্বর ভঙ্গুর হয়ে গেলো। আমি সেখান থেকে বের হয়ে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে আমার বাড়ির দিকে গেলাম– একজন কবির মতো।
একবছর পরে একদিন আমি আবার সেই আলবার্তো স্ট্রিটের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি উৎসুক মনে চোখ মেলে এদিক-ওদিক তাকিয়ে সেই কবির ছোট্ট কুটিরটি খুঁজতে লাগলাম। তবে তার সেই ছোট্ট কুটিরের কোনো চিহ্নই খুঁজে পেলাম না। কুটিরটি উধাও হয়ে গেছে এমনটা নয়। সেটা ভেঙে একটা বড় দোতলা বাড়ি বানানো হয়েছে। সেই আম গাছ, বরই গাছ, নারিকেল গাছ সবই কেটে ফেলা হয়েছে; এখন সব জায়গাতেই শুধু ইট আর কংক্রিট। বাড়িটি দেখলে মনে হবে, বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থের কখনো কোনো অস্তিত্বই ছিল না।