॥কিস্তি-১॥
গত কয়েক মাস ধরে ট্রাম্প প্রশাসনের বিশৃঙ্খল নীতি বিশ্বব্যাপী এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নিউইয়র্ক টাইমস-এর পক্ষ থেকে নোয়াম চমস্কির সাক্ষাৎকার নেন সাংবাদিক জর্জ ইয়ান্সি। দীর্ঘ একমাস ই-মেইল চালাচালির পর জর্জ ইয়ান্সিকে সময় দিতে রাজি হন চমস্কি। সাক্ষাৎকারটির বেশিরভাগই ই-মেইলে নেওয়া হয়। চিন্তাসূত্রের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন রবি আচার্য্য। আজ প্রকাশিত হলো প্রথম কিস্তি:
জর্জ ইয়ান্সি: আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের স্বর্ণযুগ পার হওয়ার পর ট্রাম্প প্রশাসনের স্বৈরশাসন দেখছি। এ থেকে জনগণের মুক্তির জন্য একজন দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবীর কোন ভূমিকা কার্যকর হতে পারে?
নোয়াম চমস্কি: মনে রাখতে হবে—মশা মারতে আমাদের পারতপক্ষে পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করা উচিত না। আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের স্বর্ণযুগের পর এ ধরনের ঘটনা অর্থহীন। আর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ভয়ঙ্কর হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে স্টিফেন কোলবার্টের বর্তমান বক্তব্য এ ব্যাপারে যথাযথ। যখন নর্থ ক্যারোলিনা রাজ্যের সাংসদ বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য (আগামীতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে পারে) লুকাতে চাইলেন, তখন রাজ্য ও স্থানীয় সরকারি সংস্থাকে নীতিগত পরিকল্পনা প্রণয়নে বাধা দিয়ে কোলবার্ট বলেন, এটা খুবই অসাধারণ মেধাবী সমাধান! বিজ্ঞান যদি এমন কোনো ফল দেয়, যা তোমার পছন্দ নয়, তবে সংসদে একটা আইন পাস করে বলো, যে এটা অবৈধ। তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ট্রাম্প প্রশাসন বিশ্ববাসীর স্বাভাবিক জীবনের জন্য হুমকি, সেই সত্য নানাভাবেই ঢাকতে চাইছে। তারা নিয়মনীতি অবৈধ ঘোষণা করছে। এমনকি গবেষণা, জলবায়ু ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের ব্যাপারে আলোচনা বন্ধ করে যতটা সম্ভব, ততটা তাড়াতাড়ি ছুটছে শুধু সাময়িক লাভ ও ক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য।
জর্জ ইয়ান্সি: এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমার মনে হচ্ছে, ট্রাম্পের নীতি হচ্ছে আত্মঘাতী।
নোয়াম চমস্কি: হ্যাঁ অবশ্যই। ট্রাম্পের রাজনৈতিক আদর্শ ও নীতি নৈতিকতাকে হাস্যকর বলা যথেষ্ট নয়। ও সব লোকের চিন্তা ও বিশ্বাসকে পর্যবেক্ষণ করা জরুরি, যারা সত্যিকার অর্থে আস্ত প্রতারক, প্রাকৃতিক চাহিদা বোঝে না ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অবহেলা করতে চায় অন্য কোনো কারণে। যদি আমরা দর্শন বলতে বুঝি—কার্যকারণ ও চিন্তানির্ভর গবেষণা, তবে আমরা এ সময়ের সমাধান বের করতে পারি। শুধু বিরোধী মতের সঙ্গে বিরোধিতায় জড়ানোর প্রয়োজন নেই। তার চেয়ে সেই ঝুঁকি ও সমস্যার বিশ্লেষণ করে এর বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। এর মাধ্যমেই আমরা সমস্যার সমাধান করতে পারব।
জর্জ ইয়ান্সি: আমি যখন পিটাসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকে দর্শনের ছাত্র ছিলাম, তখন আমাকে বিশ্লেষণের নিয়ম শেখানো হয়েছিল। আমার তখন মনে হয়েছিল—কোনো ধারণাকে বিশ্লেষণ করা ছাড়া দর্শনশাস্ত্রের কোনো কাজ নেই। যদিও আমি মার্ক্সিয়ান দর্শন এখনো বিশ্বাস করি—দর্শন পৃথিবীকে পরিবর্তন করে দিতে পারে। আচ্ছা দর্শনের কোনো চিন্তাধারা কি পৃথিবী পরিবর্তনে সক্ষম বলে মনে করেন আপনি?
নোয়াম চমস্কি: বর্তমানে যে দুটি ভয়াবহ ইস্যু আমাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হতে পারে, সেগুলো হলো জলবায়ূ পরিবর্তন ও পারমাণবিক যুদ্ধ। আমি নিশ্চিত নই—মার্ক্স কী বোঝাতে চেয়েছেন তার এই উক্তি দ্বারা—‘একজন দার্শনিক এখন পর্যন্ত শুধু বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। অথচ উচিত ছিল পৃথিবী পরিবর্তন করা।’ এর অর্থ কি দর্শন পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে পারে? অথবা দার্শনিকদের সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত পৃথিবী পরিবর্তনের ব্যাপারে? যদি তার উদ্দেশ্য প্রথমটি হয়, তবে তিনি বুঝিয়েছেন—দর্শন ব্যাপক অর্থে বোঝায় সামাজিক শৃঙ্খলা ও বিশ্বাসকে বিশ্লেষণ করে জানা এবং কেন এটি পরিবর্তন হওয়া উচিত, কিভাবে তা পরিবর্তন হয় তা জানা? এ ব্যাপক অর্থে দর্শন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে পৃথিবী পরিবর্তনে। আর একজন দার্শনিক গতানুগতিক বিশ্লেষণ ক্ষমতা ব্যবহার করে এ চেষ্টা করেন তার দার্শনিক জীবন ও দৈনন্দিন কাজকর্মের মধ্য দিয়ে। উদাহরণ-স্বরূপ আমরা ব্রাট্রান্ড রাসেল-এর দার্শনিক জীবন ও কর্মজীবনকে বলতে পারি।
জর্জ ইয়ান্সি: হ্যাঁ, রাসেল সত্যিকার অর্থে একজন দার্শনিক ও জনমুখী বুদ্ধিজীবী ছিলেন। এ ক্ষেত্রে আপনি নিজেকে কিভাবে উপস্থাপন করেন?
নোয়াম চমস্কি: সততার সঙ্গেই বলছি—আমি কখনোই এ ব্যাপারে চিন্তা করিনি। আমি যুক্ত হয়েছি এমন ধরনের কার্যক্রমে, যা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং মনে হয়েছে। আর আমার কাজের কিছু অংশ হয়তো রাসেলের মতো হয়েছে, যেটুকু আমি বুঝি।
জর্জ ইয়ান্সি: এমনও সময় ছিল, যখন মানবতার সামান্যতম ভোগান্তি সহ্য করা ছিল অসহনীয়। একজন প্রকৃত মানুষ হিসেবে আপনি সবসময় পৃথিবীর মানুষের ভোগান্তি নিয়ে কথা বলেন। আপনি কিভাবে এসব প্রত্যক্ষ করছেন। আর এখন কিভাবে এ দৃঢ় প্রত্যয় রাখছেন যে, আপনিও এ ভূমিকা অব্যাহত রাখবেন।
নোয়াম চমস্কি: এ ভূমিকা অব্যাহত রাখতে অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতাকে প্রত্যক্ষ করাই আপনাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এর চেয়ে বেশি আর কি আপনাকে উৎসাহ দিতে পারে? কিভাবে দরিদ্র মানুষ এমন খারাপ অবস্থায় বসবাস করছে, যা আমরা সইতে পারতাম না? তারা কিভাবে সম্পূর্ণরূপে, সাহসিকতা ও বিরত্বের সঙ্গে তাদের সংগ্রাম ও সুবিচারের জন্য আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে!
জর্জ ইয়ান্সি: আপনাকে যদি ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য জরুরি ২/৩টি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তালিকাভুক্ত করতে হয়, তাহলো আপনি কোনগুলোকে গুরুত্ব দেবেন? এ মুহূর্তে আমরা চরম অসহায় ও হতাশা অনুভব করছি বলেই এমন প্রশ্ন?
নোয়াম চমস্কি: আমি মনে করি না—অবস্থা এতটা খারাপ হয়েছে। আপনি ২০১৬ সালের আমেরিকার নির্বাচনে বার্নি স্যান্ডোরের নির্বাচনি প্রচারণার সফলতা দেখুন। এটা খুবই স্বাভাবিক ছিল—একজন বিলিয়নর আমেরিকান মিডিয়ার প্রচারণা ও টাকার মাধ্যমে সহজেই প্রতিক্রিয়াশীল রিপাবলিকান দলের মনোয়ন পাবেন। কিন্তু স্যান্ডারের নির্বাচনি প্রচারণা নাটকীয়ভাবে আমেরিকান রাজনীতির একশ বছরের ইতিহাস ভেঙে দিয়েছে। বড় ধরনের রাজনৈতিক গবেষণা, বিশেষত থমাস ফার্গুসানের কাজ আমাদের বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয়েছে যে, নির্বাচন কিভাবে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে আয়োজন করা হয় বিজয়ী নির্ধারণ করার জন্য। যেমন নির্বাচনি প্রচারণা আপনাকে সহজেই বুঝতে সহায়তা করবে নির্বাচনে কে জয়ী হবে। আর কে না জানে যেকোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিজয় বা অংশগ্রহণের প্রথম শর্ত। হলো কর্পোরেট শক্তি, বেসরকারি সম্পদের সমর্থন ও বহির্বিশ্বের চাপ।
স্যান্ডারের নির্বাচনি প্রচারণা দেখিয়েছে—কিছুটা জনমুখী আন্দোলন করে দলের মনোনয়ন পাওয়া যেতে পারে। এমনকি নির্বাচনে জয়ীও হওয়া যায় ব্যবসায়ীদের অর্থসহায়তা ও মিডিয়া প্রচারণার সমর্থন না পেয়েও। নির্বাচনে স্যান্ডার জয়ী হবেন, এমনটা মনে করার যথেষ্ট কারণও ছিল। তা হলে বিষয়টি ওবামা ও ক্লিনটন পার্টির ব্যবস্থাপকদের জন্য মাথাব্যথার কারণ হতো। যাই হোক, স্যান্ডার কিন্তু এখন পর্যন্ত দেশের প্রান্তিকগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশের কাছে সর্বাধিক জনপ্রিয়। তার সমর্থকরা প্রথমেই তাকে মনোনয়ন প্রত্যাশী করার মাধ্যমে ইলেক্টরাল পলিটিক্স এ প্রবেশ করাতে চাচ্ছিল। আর তখন বারাক ওবামার নেতৃত্বাধীন ডেমোক্রেটিক পার্টি স্থানীয় ও রাজ্যের নির্বাচনে ভেঙে পড়ছিল। কিন্তু ওবামার দলকে পুনর্গঠন ও সক্রিয় শক্তির অধিকারী দল হিসেবে তখনো গড়া যেত। এজন্য তাকে জনমুখী নতুন আইন চুক্তি করতে হতো, জনকল্যাণমুখী হতে হতো। শ্রমিক শ্রেণীর হয়ে কথা বলতে হতো। আর এভাবেই ক্লিনটনের নতুন ডেমোক্রেট দল পুনর্গঠন সম্ভব ছিল। তখন এ ডেমোক্রেট দল আংশিক হোক বা বেশি হোক, মডারেট রিপাবলিকান দলের আদর্শের মতো আদর্শ ধারণ করত। কারণ নতুন বাজার অর্থনীতির উদ্ভব হওয়ার পর জনমুখী রাজনীতি থেকে এ দুই দলই সরে এসেছে। পুরো পৃথিবীর মানুষ থেকে রিপাবলিকান রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। যেন তারা দায়িত্ব নিয়েছে, একাগ্রচিত্তে মানুষের শালীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার ধ্বংস করার জন্য।
এ ধরনের জনবিরোধী কার্যক্রম বন্ধ করা মানুসের ক্ষমতার বাইরে নয়। এ লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজন এখনই সরাসরি সম্মিলিত আন্দোলন। এ অবৈধ সংসদীয় ও নির্বাহী কার্যক্রম রিপাবলিকানদের বন্ধ করতে যে অসভ্যরা নাটের গুরু হিসেবে ভূমিকা রাখছে, তাদের চরিত্র প্রকাশ্যে উন্মোচন করা দরকার। পৃথিবীতে বিচ্ছিন্ন একটি ক্ষুদ্র আমেরিকা তৈরির ট্রাম্প প্রকল্প মোকাবিলা করার অনেক উপায় আছে। পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন আমেরিকার তৈরির মাধ্যমে রিপাবলিকানরা নিজেদের প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক শক্তি ব্যবহার করেছে।
জর্জ ইয়ান্সি: সবচেয়ে ভয়াভহ কোন বিষয়ের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমরা?
নোয়াম চমস্কি: আমরা সবচেয়ে বেশি জলবায়ু পরিবর্তন ও পারমাণবিক যুদ্ধের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে রিপাবলিক নেতারা পুরো পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তারা যেন উঠেপড়ে লেগেছে পৃথিবীতে বাসযোগ্য পরিবেশ ধ্বংস করার জন্য। আমরা শুধু এ ব্যাপারে কথাই শুনছি। কিন্তু কোনো পরিকল্পনার বাস্তবায়ন দেখছি না। আমরা বিভিন্ন ধরনের প্রতিবাদী কর্মসূচির মাধ্যমে ট্রাম্পের জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প রুখে দিতে করতে পারি।
অন্যদিকে পারমাণবিক যুদ্ধের ব্যাপারে সিরিয়া ও রাশিয়ার সীমান্তে বড় ধরনের সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে, যা যুদ্ধের ও অচিন্তনীয় ঘটনার অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে। এরপর পারমাণবিক প্রকল্প আধুনিকায়নের কার্যক্রম আরও বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে। সম্প্রতি জেনেছি—আমেরিকার পারমাণবিক প্রকল্প আধুনিকায়নের কার্যক্রম ভীতি সৃষ্টি করার সরু সূতা বপন করা শুরু করেছে, যেন পৃথিবীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ভে। আর এ বিষয়টি Bulletin of the Atomic Scientists-শীর্ষক প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে আলোচক বলেছেন—আমেরিকার পারমাণবিক প্রকল্প আধুনিকায়নের কার্যক্রম ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের হত্যা করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে প্রায় তিনগুণেরও বেশি। আশা করা যায়, এতে যদি কোনোভাবে পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হয়, তবে আমেরিকার এমন সক্ষমতা আছে যে, খুব সহজেই শত্রুপক্ষের অস্ত্রসম্ভার ধ্বংস করে যুদ্ধ জয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়। এর গুরুত্ব খুবই পরিষ্কার। এতে বোঝা যায়—ক্রাইসিসের সময় যখন দেখা যাবে, সবার হাতেই পারমাণবিক বোমা আছে, রাশিয়ান আর্মির নিয়ন্ত্রকরা যখন যুদ্ধের পরিসমাপ্তি টানতে গিয়েও টানতে পারবে না, ঠিক তখনই আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ রক্ষার একমাত্র উপায় হতে পারে, এই ব্যালাস্টিক আক্রমণ। এর মধ্য দিয়ে পৃথিবী ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে পৌঁছবে।
চলবে…