(ধীরুবেন পটেল গুজরাটি লেখিকা। তাঁর জন্ম অবিভক্ত ভারতের বরোদা স্টেটের ভোদোদারায় ১৯২৬ সালের ২৫ মে। তিনি ঔপন্যাসিক, প্লে-রাইটার, অনুবাদক হিসেবে বিশেষভাবে খ্যাতিমান। তাঁর লেখা গল্প, উপন্যাসের মধ্যে আন্ধালী গলি, শিমালানান ফুল, ওয়ানসনো অঙ্কুর, জাভাল, অতীতরাগ, অনুসন্ধান ও আগন্তুক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ২০০১ সালে আগন্তুক উপন্যাসের জন্য ভারতীয় সাহিত্য অ্যাকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি প্লে-রাইটার হিসেবেও খ্যাতির স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর লেখা প্লে ভবানী ভবানী চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। ইংরেজি ভাষায় লেখা তাঁর জাভাল গল্পকে বঙ্গানুবাদ করা হলো। এ গল্পে লেখিকা কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের চিত্র তুলে ধরেছেন। জাভাল নামের এক গৃহবধূকে ডাইনি নাম দিয়ে তাকে চরম নির্যাতনের কাহিনী এ গল্পে বিধৃত হয়েছে। এ গল্পে কাহিনীর মতো কুসংস্কার আজকের তথাকথিত সভ্যসমাজেও বর্তমান থাকার বাস্তব ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়।)
দুপুরবেলা হলেও সূর্যটাকে জাভালের ঘর থেকে দেখা যাচ্ছিল না। ভাঙাচোরা বাড়িটার ভেতরের কুঠুরি ঠাণ্ডা ও অন্ধকার জাকিয়ে বসেছে। পুরনো একটা বাড়ি। সূর্যের আলো না পড়ায় বাড়ির ভেতরটা অন্ধকারে ঢাকা।
কুঠুরিতে কোনো কিছু দেখা কষ্টকর। তবু তার চোখদুটোতে অন্ধকার সহ্য হয়ে গেছে , ফিতের তৈরি একটা খাটিয়া। সেটা একটা দেয়ালের সাথে লাগানো। তারপাশে একটা পাত্রের ভেতর থেকে কয়েকটা ছেঁড়া কাপড়চোপড় যেন উঁকি দিচ্ছে। কুঠরির পেছনে একটা সরু জায়গা। সেখান থেকে শষ্য মাড়াইয়ের শব্দ ভেসে আসছে। মাঝে মাঝে শব্দের ছন্দ থেমে যাচ্ছে। সে সময় দুর্বল শরীরের কোনো লোকের কাশির শব্দ শোনা গেল।
কিছু সময় পরে সে চুলা জ্বালায়। ঘরটা ধোঁয়ায় ভরে গেলে অন্ধকার আরও ঘনীভূত হয়। একজন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে বলল, আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, বাঈ, তুমি কোথায়?
জাভাল চুলায় আগুন জ্বালানোর জন্য চোঙ্গায় ফুঁ দিয়ে বাতাস করার চেষ্টা করছিল। ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে চোঙ্গাটা হাতে করে বাইরে বেরিয়ে এসে সে বিরক্তির সঙ্গে জিজ্ঞেস করে, কে, কে আবার এলো?
সে মানকিকে দেখে বলল, মানকি? এসো এসো বাছা। মাটির মোড়াটার ওপর বসো।
জাভাল তার খালি হাতটা দিয়ে তার চোখদুটো ডেকে আন্দাজে আন্দাজে পা ফেলে এগিয়ে মাটির মোড়াটা দেখালো।
তুমিও বসো , বাঈ । মন দিয়ে আমার কথা শোনো।
রুটি শেকে আসি। আমার খুব খিদে পেয়েছে।
আমি দেরি করতে পারছি না। তুমি রুটি বানিয়ে খাওয়া পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করতে পারছি না।
কেন?
ভগবান মুখীর ছেলে খুবই অসুস্থ। সে দু-একদিনের বেশি বাঁচবে না।
জাভাল উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলো। তার সারা মুখটা বিষাদে ভরে গেল। তার সাদা চুলগুলো জট পাকিয়ে আছে। তার নাকটা বেশ লম্বা, চোখ দুটোতে কান্নার আভাস। তার অপ্রত্যাশিত হাসির শব্দ খি খি খি হি হি…খল খল…খল খল হি হি…
মানকি তার মায়ের মুখে বিরক্তির আভাস লক্ষ করে বলল, তুমি হাসছ কেন, বাঈ? আমি কী বলছি শুনতে পেলে? ভগবান মুখীর ছেলে মৃত্যুর মুখোমুখি।
সে কি মরবে? তুমি কি জানো মানকি, ভগবান মুখী লোকটা বড়ই উদ্ধত—সে আমাকে মারধর করেছিল। কারণ, তার ঝোপের ভেতর থেকে আমি একজোড়া লাউ তুলেছিলাম। সে আমাকে মাটিতে ফেলে ভুট্টো গাছ দিয়ে আমাকে বেদম মার মেরেছিল। যখন তার ছেলের শরীরটাকে মরার চাঙে তোলা হবে, তখন আমার প্রাণটা নেচে উঠবে।
বাঈ, কেউ হয়তো শুনে ফেলবে!
ও গ্রামের কে এখান থেকে আমার এ কথা শুনবে? গ্রামবাসীরা আমার কত যে উপকারে আসে! আমি না খেয়ে মরে গেলেও তারা আমাকে এক চিমটে ময়দা দেয় না। গ্রামবাসীরা গোল্লাই যাক! কেন তারা মুখীর ছেলের সাথে সাথে মরছে না?
মানকির মুখটা ভয় ও ক্রোধে ভরে ওঠে। সে বাইশ বছর বয়সী মেয়ে হলেও তার শরীরে লাবণ্য আছে, একজন বয়সন্ধিক্ষণের মেয়ের মতোই টসটসে তার মুখটা। তাকে দেখে মনে হয় না সে তিন সন্তানের মা। সে তার সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তাড়াতাড়িই ওখান থেকে চলে যাওয়ার কথা ভাবল।
বাঈ, বাঈ! সে রাগে ফিসফিস করে বলল। সে তার মাকে সব সময়ই বাঈ বলে ডাকে। এখন মায়ের সাথে তার ভাল ভাবে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। একা একা থাকায় তোমার মনটা বিগড়ে গেছে। তুমি জানো না কী বলতে হয়, আর কী বলতে হয় না। কেন তুমি এ সব বোঝ না? যদি মুখীর ছেলে মারা যায় তবে তুমি গ্রামে বসবাস করে দেখো! গ্রামবাসীরা তোমাকে কি গ্রামে থাকতে দেবে?
জাভাল এবারই প্রথম ভয় পেল। প্রত্যেক মানুষই বেঁচে থাকতে চায়। তাই তারও বেঁচে থাকার ইচ্ছা। যদিও সে ছেঁড়া কাপড় পরে তিন দিন পর পর মাত্র আধখানা রুটি খেয়ে ভাঙা ঘরে বাস করে তবুও সে বাঁচতে চায়! একা একা নিদারুণ অভাবের মধ্যে বাস করে তার মেজাজটা তিরিক্ষে হয়ে পড়েছে। সে গ্রমবাসীর প্রতি প্রতিশোধ নিতে চায়। সে চায় তাদের যা আছে তা কেড়ে নিতে। সে পেট পুরে খেয়ে গ্রামের পুকুরে গোসল করতে চায়। এগুলো তার জন্য নিষিদ্ধ। সে গ্রামে বসবাসকারী তার ছয় ছেলের বাড়িতে যেতে চায়। সে তাদের কাছ থেকে একটা শাড়ি কিংবা একটা লেপ পেতে চায়—কিন্তু সে তাদের কাছ থেকে কিছুই পাবে না।
জাভাল এক সময় সব কিছু বুঝতে পারল। মানকি তার সবচেয়ে ছোট মেয়ে। অন্ধকার হলে সে তার মায়ের জন্য খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসে। সে জাভাল কে ভয় পায় না। জাভালের আর সব সন্তানরা কাপুরুষ! তারা নামে মাত্রই তার সন্তান। তারা তাদের মায়ের কথা মনে রাখে না। এমনকি তারা তাদের বাবার প্রতিও নির্ভরশীল নয় কারণ গ্রামবাসীদের তাড়নায় একদিন তার বাবা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়? মানকি সে সময় খুবই ছোট। ঘটনাটা ঘটার দিন গ্রামবাসীদের কথার জবাব সে দিয়েছিল। সে বাবার হাত ধরে তার পাশে বসে ছিল । কিন্তু তার বাবা কোনো কথা বলেনি। সে বুঝেছিল, বাবাও কাপুরুষ। তার ছেলেরাও বাবার মতোই কাপুরুষ।
মানকি! আমি মরতে চাই না! তার মা জাভাল বিলাপ করতে থাকে।
এ কারণেই আমি তোমাকে সাবধান করতে এসেছি, তুমি বুঝছো না রামুদিয়ার বাবা আমাকে মেরেই ফেলবে যদি সে জানতে পারে যে আমি এখানে এসেছি?
আমি কিন্তু মুখীর ছেলেকে কিছু করিনি। আমি শপথ করে বলতে পারি। আমি তোমার কাছে শপথ করে বলছি, আমাকে গালিগালাজ করো না।
লোকজনেরা কি তোমার কথা বিশ্বাস করবে?
লোকজন জাহান্নামে যাক। তারা সন্তানহীন হয়ে মরুক, মারা যাক না খেয়ে , তিষ্ঠার পানি পেয়ে মরুক।
বাঈ! বাঈ!
মেয়ে , আমাকে বলতে দাও! আমি কখনোই তাদের অমঙ্গল কামনা করতাম না যদি তারা আমার সারাজীবন ধরে আমাকে অত্যাচার না করত। পশুর মতো তারা আমাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, মানকি! তারা ভোগান্তির শিকার হবে। জাভালের ক্রোধ এক সময় দুঃখে পরিণত হয়। সে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
মানকি সামনে এগিয়ে গিয়ে তার মুখটা ঢাকল। তার কানাকাটি শুনে মানকি বড়ই দুঃখ পেল। সে আতঙ্কিত কণ্ঠে মাকে বলল, বাঈ! শান্ত হও, তা নাহলে সময় হওয়ার আগেই আমরা মারা যাব।
ওহ, মানকি! আমি একটাও খারাপ কাজ করিনি। জাভাল কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল।
তুমি কিন্তু পালিয়েও বাঁচবে না যদি ভগবান মুখীর ছেলে ভালো না হয়।
জাভাল প্রথমবার উপলব্ধি করল তার জীবনে বিপদ ঘনিয়ে আসছে। সে বিড়বিড় করে বলল, আমার ভাইবোনেরা আর আত্মীয়স্বজনরা আমার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে পারে, কিন্তু আমার নিজের ছেলেরা কিভাবে আমাকে না দেখে থাকতে পারে! আমাকে বল, কেউ কি আমার কাছে জানতে চেয়েছিল সেদিন কী ঘটেছিল?
বাঈ, তোমার ওই সব কথা ভাববার সময় আমার এখন নেই। তোমাকে অবশ্যই আমার মামার গ্রামে চলে যাওয়া উচিত।
আমি একা সেখানে কিভাবে যাব?
ছেঁড়া কাপড়গুলোকে একটা পোটলা করে সূর্যাস্ত যাওয়ার পর পরই বাড়ি থেকে বের হবে। সোজা পথে সারারাত ধরে হাঁটলে সকালের মধ্যে তুমি তোমার ভাইয়ের বাড়ি পৌঁছাতে পারবে।
এ বাড়ির কী হবে?
বাঈ, এই তিনটা দেওয়ালের কথা তুমি ভুলে যাও। যদি তুমি মূল্যবান কিছু জমিয়ে রাখো। তবে লুকিয়ে নিয়ে হাঁটতে শুরু করো। অন্ধকারের মধ্যে কেউই তোমাকে দেখতে পাবে না। এমনকি কেউ যদি তোমাকে দেখে ফেলে, তাহলেও তোমাকে ঘাটাতে কেউ সাহস করবে না। এখান থেকে পালাও, যে পর্যন্ত ওই ছেলেটা বেঁচে থাকে।
জাভাল সব বুঝতে পারল, মানকি ঠিকই বলছে, কিন্তু বেশ কয়েক বছর ভাইয়ের সাথে তার যোগাযোগ নেই। সে তার পরিবারের লোকজনদেরও চেনে না। শুধু কয়েকটা ছেঁড়া কাপড়চোপড় সাথে আনা একজন আগন্তুককে তার ভাইপোরা কেন জায়গা দেবে? যদি তার চোখের সামনে তাদের বাড়ির দরজা বন্ধ করে দেয়, তবে সে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। তখন তার অবস্থা কী হবে?
বাছা, তার পরিবর্তে আজ রাতে আমি কেন সুখলার বাড়িতে যাব না? আমি এক কোণে শুয়ে থাকব। কেউই জানতে পারবে না।
মাঙ্গি ভাবী কী তোমাকে তার বাড়িতে থাকতে দেবে? তাড়াতাড়ি করো, বাঈ, তোমার জামাই যেকোনো সময় মাঠে এসে পড়তে পারে। সে আসার আগেই আমাকে বাড়ি ফিরে যেতে হবে। আমি কি তোমার পোটলা বাঁধতে আর রুটি বানিয়ে দিতে সাহায্য করব? তুমি রুটিগুলো সাথে নিয়ে যেও।
একটার বেশি রুটি বানানোর মতো ময়দা নেই, মানকি। চুলা আমি ছাড়া অন্য কেউ ধরাতে পারে না। মেয়ে , পাত্রের মধ্যে যে যে কাপড় দেখতে পাও সেগুলো বের করে এনে একটা বান্ডিল কর। হয়তো ওখানে দুখানা বাসনও আছে।
আমি সব কিছু করে দিচ্ছি, তুমি বের হওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি করো।
তারা দুজন ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বাইরের বারান্দার একটা কাঠের পাত্রের মধ্যে একটা কেরোসিনের ল্যাম্প ঝুলছে। মানকি সেটা ওখান থেকে পেড়ে আনল। সে তার মধ্যে হাতের তালুর আবছা , লালচে দুটো ছাপ দেখতে পেল। এগুলো কার হাতের ছাপ! মায়ের না মাঙ্গি ভাবীর? মানকি ভাবল।
জাভাল হাতের ছাপ দেখে বলল, ওগুলো আমার সেই বয়সের হাতের ছাপ, যে বয়সে আমি এ গ্রামে কনে হয়ে আসি। গ্রামের একজন বলেছিল আমি যখন কনে হয়ে গ্রামে আসি তখন আমাকে দেখতে ছিল রানীর মতো, আমার সাত ছেলে আর এক মেয়ে হলো। গ্রামে একটা জমিও ছিল। প্রথম দিকে আমি ঈশ্বরের আর্শীবাদ প্রাপ্ত ছিলাম।
তারপর কেন সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল ? মানকির জানতে ইচ্ছা হলো। সে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, বাঈ, তুমি কেন গ্রামবাসীদের হামলার শিকার হলে?
ঈশ্বরই জানেন! তোমার দাদী একরাতে আমাকে বাইরে পাঠায়। কানিয়া সে সময় খুবই ছোট। একরাতে সে হঠাৎ করে কান্নাকাটি করতে আরম্ভ করে। তাকে সামলানো দায় হয়ে পড়ল। তোমার দাদী আমাকে কয়েকটা আকদা গাছের পাতা আনতে বলল। সে ওই পাতাগুলো গরম করে কানিয়ার পেটে শেক দেবে। আমি সে সময় জ্ঞানশূন্য প্রায়! আমি দ্রুতপায়ে ওই গাছের পাতা আনতে বের হলাম। আমি ওই গাছের পাতা লেকের ধারে খুঁজতে থাকলাম। কিন্তু আমি তা চিনতে পরছিলাম না। পাতা খুঁজতে খুঁজতে প্রায় সকাল হয়ে গেল। গ্রামের দুটো লোক সাত সকালে বেড়াতে বেড়িয়েছিল। তারা আমাকে ভোরবেলা পাতা তুলতে দেখতে পেল। ওটাই ছিল কাল! সেদিন থেকে সবাই বলতে শুরু করল, জাভাল কালো জাদু করে। তার শয়তানি চোখ আছে। তার চোখের দৃষ্টির সামনে থেকে ছেলেমেয়েদের লুকিয়ে রাখ। প্রথমে এ কথা দু-একজনে বলত, শেষে গ্রামের প্রত্যেকেই বলতে লাগল, জাভাল একজন ডাইনি! জাভাল একজন ডাইনি!
তাড়াতাড়ি কর, বাঈ! তাড়াতাড়ি করো।
দুই.
জাভাল কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে জীবনযাপন করতে পারল না। প্রত্যেকেই আমাকে থামিয়ে আমার সাথে কথা বলতে লাগল। আমি বাইরে বের হলেই লোকেরা তাদের সন্তানদের লুকিয়ে রাখতে লাগল। আমাকে দেখলে তারা গাভী ও মহিষের দুধ দোহানো বন্ধ করে দিত। রেগে গিয়ে আমি তাদেরকে অভিশাপ দিতে শুরু করলাম। আমি সত্যি কথাটা বললেও তারা উল্টো অর্থ করতে থাকল। আমি উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করলাম। আমার মধ্যে ডাইনি ভর করার গল্প চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। মাত্র ছেলেমেয়েরাই নয় তাদের পিতামাতারাও আমাকে দেখে ভয় পেতে লাগল। জীবনের প্রতি আমি আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে লাগলাম, মানকি!
মানকি তার মাকে শান্তনা দিতে চাইল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে সান্ত্বনা জানাতে পারল না। সে শুধু তার মাকে বলল, এই বোকামি থেকে তুমি কী লাভ করতে পারলে, বাঈ?
আমি সমাজচ্যুত হলাম, মানকি, আমি একা ছিলাম, আমার কিছুই করার ছিল না। বেশ, এসো আমরা যাই। মা ও মেয়ে বের হবার আগে গ্রামের দিক থেকে উচ্চকণ্ঠে চিৎকার শোনা গেল। শব্দ শুনে তারা সেদিকে কান পাতল। জাভালের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বছরের পর বছর একাকিত্ব আর ক্ষুধার জ্বালায় তার মধ্যে পাগলামি দেখা দিল। তবুও তার মেয়ে তার কাছে আসায় জাভালের মনের মধ্যে বাঁচার আকাঙ্ক্ষ ঝলক দিয়ে উঠেছিল। গ্রাম থেকে চিৎকার ওঠায় তার সে আশায় জলাঞ্জলি হলো। আতঙ্কে তার চোখদুটো বিস্ফারিত হলো। সে আর্তনাদ করে মেয়েকে জিজ্ঞেস করল, এখন আমরা কী করব?
কোনো কিছুই করার নেই, বাঈ, এখন আর কোনো কিছুই করার নেই। মানকি কষ্টের সাথে কথাটা বলল। সেও ভয় পেয়ে গেল এই ভেবে যদি লোকজন এসে জানতে পারে সে এ বাড়িতে এসেছে তার মায়ের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন করতে। তবে তারা তাকেও ডাইনি বলে ঘোষণা করলে তার সর্বনাশ অনিবার্য! সে এখনো তরুণী, তার তিনটা সন্তান ও স্বামী আছে।
এসো আমরা দৌড়াই।
গ্রামবাসীরা এতক্ষণে বের হয়ে পড়েছে। তারা সবাই আমাদের দেখে ফেলবে।
আমাদের এখন কী করা উচিত? মানকি তার পাগলামির জন্য অনুতপ্ত। তার প্রথম প্রতিক্রিয়া গ্রামবাসী এসে পড়ার আগেই মাকে ভাগ্যের হাতে রেখে ওখান থেকে কেটে পড়া। মায়ের সবচেয়ে ছোট সন্তান হিসাবে মায়ের প্রতি একটা বন্ধন মানকির মনের ভেতরে জেগে উঠল।
হঠাৎ করে মানকি মায়ের প্রতি মমত্ববোধ প্রকাশ করে বলল, বাঈ, তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ো।
কিন্তু গ্রামবাসীরা…
আমি তাদের মোকাবিলা করব। তুমি মোটেই নড়বে না। বাঈ! তুমি একটুও শব্দ করবে না। আমি না ডাকা পর্যন্ত বাইরে আসবে না। তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে যাও।
সে জাভালকে সাহায্য করার জন্য তার হাত দুটো উন্মুখ হয়ে উঠল। সে স্পষ্টভাবে বুঝতে পারল জনতা নিকটবর্তী হচ্ছে। মানকি বলল, তাড়াতাড়ি করো! মানকি কথাটা বলে মাকে ছাইয়ের গাদির ভেতরে ঠেলে দিল। জাভাল এতই দুর্বল যে সে নিজের ভার নিজে রক্ষা করতে না পেরে ছাইয়ের গাদার ভেতরে মুখ থুবড়ে পড়ল। সে ছাইয়ের গাদার সাথে মিশে গেল।
জনতা এসে পড়ার সময় মানকি তার নিজের বুদ্ধিকে শানিয়ে নিল। লোকগুলো উত্তেজিত হয়ে তাদের লাঠিসোটা তোলার আগে মানকি বলল, ভগবান ভাইয়ের পুত্রকে বাঁচানোর জন্য একটা বাজুবন্দ ভিক্ষা করতে আমি বাঈয়ের কাছে এসেছিলাম। কিন্তু বাঈ বনের মধ্যে ঘুরতে গেছে। তাই এখানে তাকে পাইনি।
জাভাল বালকটিকে হত্যা করেছে। ভগবান ভাইয়ের বউ গত পূর্ণিমা থেকে তাকে দুধ পান করাতে পারেনি। ডাইনি প্রতিশোধ নিয়েছে। মানকি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি না। কেন তুমি তার বাড়িতে এসেছ?
আমি ভাবলাম, সবাই তার কাছে আসতে ভয় পাবে। কিন্তু সে তো আমার মা! কেন আমি বালকটিকে বাঁচানোর জন্য তার কাছে আসব না? কিন্তু সে তো বাড়িতে নেই।
সে কোথায় গেছে? সে গ্রামে কিংবা মাঠে গেছে। মেয়ে, আমাদের জানাও! তুমি কি তাকে কোথায়ও লুকিয়ে রেখেছ?
কোথায় আমি তাকে লুকিযে রাখব? ঘরটা তো হাট করে খোলা। আপনারা কি তা দেখছেন না? মানকি এক পাশে সরে গিয়ে বলল।
একদল লোক নেকড়ে বাঘের মতো ঘরের চারদিকে ঘোরাফেরা করে ডাইনিটাকে অভিশাপ দিতে লাগল। একজনের মনে পড়ল জাভাল একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি কেমন আছ? তারপরই সে রোগাক্রান্ত হয়ে ছয় মাস বিছানায় শয্যাশায়ী ছিল। কয়েকজন বলল, জাভাল তার গাভীর দুধ বন্ধ করে দিয়েছিল। জাভাল একজন কনের গহনার প্রশংসা করেছিল। আর তারপরই তার সেই গয়নাগুলো হারিয়ে যায়। তার সম্বন্ধে অনেক অনেক গল্প বাতাসে ছড়ানো। কেউ কেউ আবার জাভালের তুকতাকে রুটি পুড়ে যাওয়ার গল্পও ফাঁদল।
খুবই সাহসের সাথে একজন লোক রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এসে ঘোষণা করল, এই রুটিটা এখনো গরম আছে। মানকি একজন মিথ্যুক। জাভাল অবশ্যই বাড়িতে আছে । এস আমরা খুঁজে বের করে পাপীটাকে হত্যা করি। তার ছেলে কোথায়? সুখলা! কেন তোমরা তাকে সেরে রেখেছ? কাপুরুষ! তোমরা জানো না কি একজন ডাইনি অবশ্যই সব সময়ই একজন ডাইনি? তোমাদের বোন কিংবা ভাই যাই হোক না কেন তাকে হত্যা করা হবে। তোমরা কি গ্রামটাকে বাঁচাতে চাও নাকি ডাইনিকে বাঁচাতে চাও ?
সুখলা সামনে এসে তার মাথা নত করে বলল, আপনারাই ঠিক কথা বলছেন, প্রথমে তাকে অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে।
মানকি তার চোখ বন্ধ করল। সুখলা তার ভাই। এদের মধ্যে অন্য ভাইয়েরাও আছে। তাদের মধ্যে একজন বাবাও থাকতে পারে, যে গ্রাম থেকে পালিয়ে গিয়েছিল জাভালের ভয়ে এই ভেবে যে, তার স্ত্রী সত্যি সত্যি একজন ডাইনি। ঈশ্বর জানেন সে বর্তমানে কোথায় আছে, নাকি মারা গেছে। তার ভাইয়েরা সবাই বেঁচে ছিল । আর ভালোই ছিল, কিন্তু জাভালে একা। সবাই একা। জাভালেকে যদি তারা খুঁজে বের করে তবে মানকির অবস্থা শোচনীয় হবে। এ কথা ভেবে সে ভীত হলো। মানকি তার সন্তানদের জন্য বাঁচতে চায়। সে তার মায়ের জন্য ওই সব লোকেদের হাতে মার খেয়ে মরতে চায় না। জাভালে এখন সম্পূর্ণ একা। সে একজন দুর্বল মহিলা। যার জীবন একাকিত্বে ভরা।
হঠাৎ করে একজন চিৎকার করে বলল, এই কুঠুরী! এসো আমরা কুঠুরী ভেঙে ফেলি। এসো আমরা দেখি ভেতরে কী আছে?
লোকজন তাদের হাতের লাঠি চালাতে শুরু করল। ছাইয়ের গাদির ওপর লাঠির পর লাঠির আঘাত চলতে থাকল যে পর্যন্ত না ওটা ভেঙে ছড়িয়ে না পড়ে। জাভালের চামড়ায় আবৃত কঙ্কাল সার ক্ষতবিক্ষত দেহ গড়িয়ে পড়ল জনতার লোকজনদের পায়ের কাছে। কয়েকজন লোক তাদের লাঠি উচিয়ে ধরলে কে যেন সাবধান করে দিয়ে বলল, সাবধান, ওর গা থেকে রক্তপাত করো না। একজন ডাইনির রক্ত খুবই মারাত্মক। তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারাই ভালো হবে।
তারা মনস্থির করার আগে ভাঙা ছাইয়ের গাদা থেকে বড় একটা গোখরা সাপ বের হয়ে এসে ফনা তুলল। ভয় আর আতঙ্কে জনতা দ্রুত ওখান থেকে কেটে পড়ার চেষ্টা করল।
একজন মহিলাকে হত্যা করার পাপ থেকে গোখরা সাপটি গ্রামবাসীদের বাঁচিয়ে দিল । সাপটি জাভালের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বাড়িটির আর এক জায়গায় আস্থানার খোঁজে প্রস্থান করল। মানকি এতক্ষণ একটা দেওয়ালের সাথে লেপ্টে দাঁড়িয়েছিল। সে তার নিজের মিনমিনে কণ্ঠস্বর শুনল, ওহ বাঈ, আমি তোমাকে খুন করছিলাম। আমিই! সাপটা ঘরের ভেতরে আর লোকগুলো তখন বাইরে, তখন তারা ওখান থেকে কেটে পড়ার তালে ছিল। শেষবারের মতো মানকি তার মায়ের পা দুটো স্পর্শ করার সাহস করল না।
সবার নজর এড়িয়ে সাবধানে মানকি কেটে পড়ার জন্য জনতার মধ্যে হারিয়ে গেল।