ভূমিকা: পূর্ব ইউরোপের চারটি ভিন্ন ভিন্ন দেশ তথা লিথুয়েনিয়া, স্লোভেনিয়া, রোমানিয়া ও আলবেনিয়া থেকে চয়ন করা চারটি কবিতা রচিত হয়েছে গ্রীষ্মকালের প্রেক্ষাপটে। শীতপ্রধান ওই দেশগুলোতে তুষারপাত এতই প্রবল যে, কেবল গ্রীষ্মকালে প্রান্তর, উপত্যকা ও বনানী ভরে ওঠে ফুলে-ফলে এবং মানুষও সুযোগ পায় খোলামেলা হাওয়ায় ঘরের বাইরে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘোরাফেরা করতে। গ্রীষ্মের মুক্ত আবহের সঙ্গে পিকনিক, ছুটি কিংবা জুটি বেঁধে প্রেমে পড়াও সমার্থক হয়ে ওঠে।
গিদরে কাঝলুসকাইটা: এই কবির এর জন্ম ১৯৮০ সালে। লিথুয়েনিয়ার ভিলনিউস বিশ্ববিদ্যালয়ে কবি ভাষা ও সাহিত্যে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। চারটি ভিন্ন ভিন্ন কাব্যগ্রন্থের প্রণেতা লিথুয়েনিয়ার কবি গিদরে কাঝলুসকাইটা সম্পাদক হিসাবেও খ্যাতিমান। তিনি সংস্কৃতি বিষয়ক একটি জার্নাল সম্পাদনা করে থাকেন। ‘পোয়েট্রি স্প্রিং’ ও ‘ বেস্ট ইয়াং পোয়েট অব দ্য ইয়ার’ শিরোনামে দুটি সাহিত্য পুরস্কারও তিনি অর্জন করেছেন।
আসাদ বাবাচেক: পনেরোটি কাব্যগ্রন্থে প্রণেতা স্লোভেনিয়ার অত্যন্ত নন্দিত কবি আসাদ বাবাচেকের জন্ম ১৯৬৫ সালে, লুবলিয়ানা নগরীতে। কর্মজীবনের প্রথম দিকে তিনি কারখানায় কাজ করতেন। সেনাবাহিনীতেও তাঁকে কাজ করতে হয় কিছু দিন। কাব্যচর্চার প্রথম দিকে তিনি কবিতাকে সংগীতের মতো করে গাইতেন। কবিতা ছাড়া অনুবাদ ও ফিল্মের স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসাবে তিনি আবদান রেখেছেন, এমনকী একটি ফিল্মে অভিনয়ও করেছেন। পেশাগতভাবে কবি বর্তমানে টেলিভিশন সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত। ১৯৮২ সালে কবি জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত হন।
ডান সোচু: রোমানিয়ার কবি ডান সোচু এর জন্ম ১৯৯৮ সালে বটোসানী শহরে। শতাব্দ ২০০০ এর কবি বলে পরিচিত ডান সোচু ‘মিজারাবলিজম’ নামক একটি সাহিত্য বিষয়ক অন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। ২০০৬ সালে তাঁর একটি পুস্তক অর্জন করে ‘ বেস্ট বুক অব দি ইয়ার’ পুরষ্কার। ২০০৭ সালে কবি ‘মোস্ট প্রমিনেন্ট ইয়াং রাইটার’ অভিধায় ফের স্বীকৃতি লাভ করেন। সাতটি কাব্যগ্রন্থের প্রণেতা ডান সোচু অনুবাদক ও সম্পাদক হিসাবেও বর্তমানে স্বনামধন্য।
মানজোলা নাসি: মানজোলা নাসির জন্ম আলবেনিয়ার তিরানা নগরীতে। তিরানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কবি পিএইচডি ড্রিগ্রি লাভ করে ওখানে প্রভাষক হিসাবে নিয়োগ পান। এক পর্যায়ে ফুলব্রাইট স্কলার হিসাবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেন। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা দুই। কবিতা ছাড়া অনুবাদে দক্ষতার জন্য তিনি বিশেষভাবে খ্যাতিমান। ২০১৯ সালে কবি মানজোলা নাসি তাঁর কাব্যকীর্তির জন্য ‘ক্রিস্টাল ভিলেনিকা’ পুরস্কার অর্জন করেন।
এখানে উপস্থাপিত চারটি কবিতায়, উল্লিখিত গ্রীষ্ম-বিষয়ক থিমগুলোর সমান্তরালে চার জন কবির বয়ানে প্রতিফলিত হয়েছে প্রতীকী প্রকাশ ও জাদুবাস্তবতাময় অভিব্যক্তি। কবিতাগুলো, ভূমিকা ও কবিদের বায়ো-বিষয়ক তথ্যের সূত্র ইন্টারনেট। প্রতিটি কবিতায় কবির নামের নিচে ইংরেজি অনুবাদকের নামও উল্লেখ করা হলো।
সাঁতারের পুকুরে ॥ গিদরে কাঝলুসকাইটা
ইংরেজিতে অনুবাদ: রিমাস উঝগিরিস
পালানগা গ্রামের ব্যাঙ-ভাসা পুকুরে নামার অনুমতি দেয় তারা,
উদ্দেশ্য—আমাকে শেখাবে সাঁতার কাটা আজ।
প্রশিক্ষক—খুবই কড়া ধাঁচের মানুষ
তিনি চাচ্ছেন—আমি যেন ডুবুরির মতো জলতল থেকে তুলে আনি শঙ্খ-ঝিনুক,
চাবিটি ছুড়ে দিয়ে তিনি আমাকে বোর্ডে বুক চেপে সাঁতার শুরু করতে বলেন,
তারপরই নির্দেশ আসে—ডুবসাঁতারে তলদেশ থেকে চবিটি তুলে আনার।
মাথা ডোবাই জলতলে
কিন্তু আমার কোনো ধারণাই নেই ওখানে আমার সঞ্চরমান শরীর কী করছে?
বেশ কিছু দিন পর, নিবিড়ভাবে সাহিত্য পাঠের সময়—
আমি আলব্যার কাম্যুর নোটবুকে প্রাপ্ত
একটি আপ্তবাক্যকে ভিত্তি করে রচনা করছিলাম একটি নিবন্ধ:
লিখতে লিখতে মনে হচ্ছিল, যেভাবে কেটেছি সাঁতার একদিন
সেভাবেই আমার লিখে যাওয়া উচিত—
দেহমনের অবচেতন থেকে উত্থিত চাহিদা মোতাবেক।
কৈশরে আমার শরীর যথেষ্ট মাত্রায় তৈরি ছিল সাঁতারের জন্য
তরঙ্গবহুল হ্রদের সঙ্গে তাল মেলাতে অসুবিধা হয়নি কোনো।
আমার মেয়েটির ছোট্ট শরীর ভাসে নির্ভারভাবে
কিন্তু পারে না অতিক্রম করতে শিশুদের জন্য নির্মিত চৌবাচ্চার ব্যাসার্ধ।
বইপুস্তকের হ্রদগুলো আমি চেষ্টা করি—
কখনো সখনো সাঁতরে অতিক্রম করতে,
মাঝেমধ্যে মনে হয় ডুবতে ডুবতে কায়ক্লেশে ভেসে আছি
আর যখনই পৌঁছাই পাড়ে
নাটুকীয়ভাবে আমার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে শ্বাস-প্রশ্বাস
হাঁফ ছেড়ে বাঁচি আমি।
ছোট্ট মেয়েটি আমার শিখছে বর্ণমালা
চেষ্টা করছে লিখতে পুরো খাতার প্রতিটি পৃষ্ঠাজুড়ে
তার আচরণে যেন ফুটছে
প্রশিক্ষণ, ব্যাকরণ ও শিক্ষকের শিক্ষাপদ্ধতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ।
সাঁতারের পুকুরে আমাদের সকলের আছে সতন্ত্র সন্তরণ-সহায়ক জুতো—
শুধু আমাদের দেহ ও শোণিত
যেন বেদিমূলের তৈজসে উৎসর্গীকৃত অর্চনার উপাচার।
একটি কবিতা রচনার জন্য যা জরুরি ॥ আসাদ বাবাচেক
ইংরেজীতে অনুবাদ: আন্দ্রেজ প্লিটারস্কি
বাতাস।
খোলামেলা সুপ্রচুর হাওয়া।
আলো-হাওয়ার বাতাবরণে অগ্নিকুন্ডের পাশে বসে
একজন মানুষ,
উষ্ণ করে নিচ্ছে তার দু-হাত।
সংবেদনশীল ও সরল কবিতা থেকে ॥ ডান সোচু
ইংরেজীতে অনুবাদ: ওয়ানা সানজিয়ানা মারিয়ান
গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি আমরা দুজনে
আমার উদ্দেশ্য—খোলা হাওয়ায় দাঁড়িয়ে খানিক ধুমপান করা
তুমি সন্ধান করছিলে লেডিবাগ নামে এক ধরনের চিত্রিত পতঙ্গ।
বৃক্ষের একটি কাটা গুঁড়ির কাছে এসে আমারা থেমে পড়ি,
ওখানেই কেটে যায় যায় আমাদের বহতা জীবনের প্রচুর সময়
জন্ম নেয় অতঃপর দুটি শিশুসন্তানও।
এদিকে—বছরের একটা সময় ঝড়-তুফান হয় তুমুল
একবার আমাদের চালাঘরটির ছাদ উড়ে গিয়েছিল।
পরের বছর খরা হয় প্রচন্ড—
জ্বলেপুড়ে ছারখার হয় আমাদের গ্রীষ্মকালীন ছোট্ট রান্নাঘরটিও।
শীতকালের তুমুল তুষারপাতকে উপেক্ষা করে টিকে থাকি আমরা,
আমাদের শরীরে চামড়ার সাথে সেঁটে লেগে থাকা তুষারকুঁচিকে
কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারি না ।
গুরু গুরু গর্জনে ভেসে যায় মেঘমালা
বিজুলির বঙ্কিম রেখা স্পর্শ করে আমার দীর্ঘ দাড়ি
শিউরে ওঠে দেহমন।
শিশুরা বেড়ে ওঠে, কিন্তু আমাদের দৃষ্টিপাত থেকে তিরোহিত হয় না তারুণ্য।
আমি ছুড়ে ফলি জমে ওঠা সিগ্রেটের শেষাংশ,
চুপিসারে তুমি পকেটে পুরো কিছু পতঙ্গ
গাছের গুড়ি ঘিরে গড়ে ওঠা আমাদের নিরিবিলি বসতবাড়িটিকে
পেছন ফেলে চলে আসি রাজপথে
মৃদুপায়ে হেঁটে হেঁটে অবশেষে উঠে পড়ি
পথের ধারে আমাদের ফেলে যাওয়া গাড়িটিতে।
সেতু ॥ মানজোলা নাসি
ইংরেজিতে অনুবাদ: কবি নিজে
এই তো এইখানে—লোহিত বর্ণের লোহার পুল,
ওখানে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আমি দুলছি
প্রতিফলনে আমি নিজেকে দেখে নেই ফের,
দেখি—নিচে বহতা জল,
অপরাহ্ণের মৃদু আলোয় ছায়াময় হয়ে আছে বৃক্ষরাজি,
জল সস্নেহে স্পর্শ করছে আধডোবা পাথর
গাঢ় ছায়াতলে শ্যাওলায় মোড়া কালচে অন্ধকার শিলাখন্ড
উড়ছে ফড়িংগুলো—মৃদু হাওয়ায় কাঁপছে তাদের ডানা।
না, নদী পাড়ে কেউ নেই—সম্পূর্ণ নির্জন,
নিখাদ নিঃসঙ্গতায় ছেয়ে আছে চরাচর
এই তো সেতুটি এইখানে
আর এতে দাঁড়িয়ে আমি দুলছি
দোলানায় চড়ে দোল খাওয়া শিশুটির মতো
ঘুমপাড়ানি গানে নিমগ্ন— ঢলে পড়ছি নিদ্রায়
বেড়ে ওঠছি নীরবে।
কিন্তু আমি তো গড়ে ওঠেছি
চলে গেছে যে যুগ এবং যা নেই তার সংমিশ্রনে
আমাতে অবলীলায় মিশে আছে
অস্বাচ্ছন্দকর অতীত ও বিগতভাবে বিব্রত হওয়ার মতো বর্তমান।
মগ্ন হয়ে আছি ঘোষিত বিষয়-আশয় নিয়ে
প্রচ্ছন্ন অঙ্গিকার নিয়ে হালফিল ভাবি না আর তেমন।
সেতুটি হচ্ছে আদতে আমি
আর আমি-ই তো সেতু
বন্দীত্বের প্রতীকে যা ছিলো আদিতে মানুষের বলিদান,
যাতে মজবুত হয় সেতুটির ভিত্তি এবং কাঠামোটিও ভারবহনে সক্ষম,
পরিশেষে আমাকে দিচ্ছে, যা আমার কাঙ্খিত সারা জীবন ভর—
দিচ্ছে অঢেল স্বাধীনতা,
আমিও যেন ভারাক্রান্ত না হই, ধ্বসে না পড়ি,
এখন তো নাগালের মধ্যেই আছে আঁকড়ে ধরার মতো শিলাপাথর—
এদিকে আজকাল আর আসে না তেমন কেউ
সড়কটি নির্জন— নিঃসঙ্গতায় হয়ে আছে নিঝুম
তারপরও দাঁড়িয়ে আছে অবলীলায় সেতুটি।