অনুবাদ: ফারহানা রহমান
(দশম পর্ব)
মোমা তিন বার বিয়ে করেছিলেন। এই শতাব্ধির শুরুর দিকেই আমার দাদা মিস্টার জনসন দাদিকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তিনি দাদির ঘাড়ে তার ছোট দুটো ছেলেকে লালনপালনের দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে কেটে পড়েছিলেন। তার দ্বিতীয় স্বামী মিস্টার হেন্ডারসনের সম্পর্কে আসলে আমি কিছুই জানি না (ধর্ম বিষয়ক প্রশ্ন ছাড়া মোমা অন্য কোনো প্রশ্নের উত্তর কখনো দেন না)। তার শেষ স্বামী মিস্টার মারফি। মাত্র একবার তাকে ক্ষণিকের জন্য দেখেছিলাম। কোনো এক শনিবার রাতে তিনি স্ট্যাম্পে এসেছিলেন। কুচকুচে কালো রঙের মানুষটি জর্জ র্যা ফটের মতো করে মাথায় স্ন্যাপ-ব্রিম টুপি পরে ছিল। পরেরদিন সকালে আমরা চার্চ থেকে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত তিনি স্টোরের মধ্যে ঘুরে বেড়ালেন।
আমার জানা মতে, সেটিই ছিল প্রথম রোববার, যেদিন আংকেল উইলি কাজে আসেননি। বেইলি বলেছিল, সে বাসায় ছিল শুধু মিস্টার মারফিকে পাহারা দেওয়ার জন্য। যেন আমাদের অনুপস্থিতিতে তিনি কিছু চুরি করে ভেগে যেতে না পারেন। মোমার রবিবারের বিশাল আয়োজনের আড়ম্বরপূর্ণ রাতের খাবার খেয়ে তিনি সন্ধ্যায় বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। তিনি তার মাথার হ্যাটটি পেছনের দিকে ঠেলে দিয়ে শীষ বাজাতে বাজাতে ঢালুপথ বেয়ে নিচের রাস্তার দিকে হেঁটে গেলেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি বিশাল শুভ্র চার্চের বাঁক ঘুরে পেছনের দিকে চলে না গেলেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি তার দেহের চওড়া পেছন দিকটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
তিনি কি বছরের পর বছর তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াননি? তিনিই কি স্ট্যাম্পসের একমাত্র নিগ্রো নারী নন, যাকে সবাই মিসেস বলে সম্বোধন করেন?
মোমাকে সবাই খুব সুশ্রী বলতো। আর যারা তাকে অল্পবয়সে দেখেছিল, তারা সবাই বলতো, মোমা অপরূপা সুন্দরী একজন নারী ছিলেন। আমি শুধু তার শক্তি ও সামর্থ্যই দেখেছিলাম। আমার জীবনে দেখা নারীদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে লম্বা নারী ছিলেন। ওঁর হাতের পাঞ্জা এতই বড় ছিল যে, সেটা আমার এক কান থেকে অন্য কান স্পর্শ করতে পারতো। তার গলার স্বর ছিল ভীষণ কোমল ও মসৃণ। কারণ তিনি ইচ্ছে করেই স্বরকে সেভাবেই ব্যবহার করতেন। কিন্তু চার্চে যখন তাকে গান গাইতে বলা হতো, মনে হতো তার চোয়াল থেকে কেউ যেন প্লাগগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে। তখন বাতাসে ভেসে আসতো ভয়ানক একটা রুক্ষ স্বর। স্রোতাদের কানেও তা বেখাপ্পা ঠেকতো।
প্রতি রোববার মোমা তার সিটে গিয়ে বসা মাত্রই মিনিস্টার ঘোষণা দিতেন, আমরা এখন সিস্টার হেন্ডারসনের পড়া দোয়াদুরুদ শুনবো। আর প্রতি রবিবারেই তিনি বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করতেন, ‘আমাকে ডাকা হচ্ছে?’ তাকেই যে ডাকা হচ্ছে সেটা আবারও নিশ্চিত করা হলে তিনি ধীরেসুস্থে হাতের ব্যাগটি বেঞ্চের ওপরে রেখে রুমালটি ভাঁজ করতেন। খুব গুছিয়ে পরিচ্ছন্নভাবে ভাঁজ করা রুমালটি পার্সের ওপর আস্তে করে রেখে তিনি অত্যন্ত ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়াতেন। তারপর তিনি মুখ খুলতেন এবং হঠাৎ করেই দোয়া পরা শুরু করে দিতেন। যেন তিনি ঠিক সময়ের জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষায় ছিলেন। সপ্তাহের পর সপ্তাহ, এমনকি বছরের পর বছর ধরে তিনি একই পারফর্মেন্স করে যেতেন। কোনোকিছু একটুও বদলাতো না। তবে তার আন্তরিকতা নিয়ে কেউ কখনো কোনো সন্দেহ প্রকাশ করেছিল বা প্রশ্ন করেছিল বলে মনে পড়ে না।
আমাকে ও বেইলিকে তিনি এমনভাবে গড়ে তুলতে চাইতেন আর এমন সব নৈতিক শিক্ষা দিতে চাইতেন, যা তিনি ও তার পূর্বপুরুষরা মেনে চলেছিল। তার সমসাময়িকরা ও অন্য নিগ্রোরা সেইসব আচরণকেই সবচেয়ে নিরাপদ ব্যবস্থা বলে মনে করতো। তাদের জীবনের জন্য হুমকি হওয়া ছাড়াও যে সাদারা তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারে, সেটা তিনি কখনোই মনে করতেন না। তিনি বলতেন যেকোনোভাবেই যেন সাদাদের সঙ্গে কোনরকম উদ্ধত বা অশিষ্ট আচরণ করা না হয়। এমনকি তাদের অনুপস্থিতিতেও যেন তাদের সম্পর্কে কোনো রুঢ় কথাবার্তা বলা না হয়। যদি তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়ম সে ভীতু কি না? তাহলে সে এই উত্তর দেবে যে সে আসলে বাস্তববাদী। তিনি কি বছরের পর বছর তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াননি? তিনিই কি স্ট্যাম্পসের একমাত্র নিগ্রো নারী নন, যাকে সবাই মিসেস বলে সম্বোধন করেন?
কিন্তু নিগ্রোরা বিশ্বাস করতো, এই ঘটনাটি থেকে প্রমাণি হয়, আমার দাদি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ-মূল্যবান ও একজন মহিমান্বিত নারী।
আর সেই ঘটনাটি তো একসময় একটি কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিল। এটি সেই সময়ের ঘটনা, যখন কয়েক বছর আগে আমি ও বেইলি এই শহরে প্রথম এসেছিলাম। একজন সাদা নারীর সতীত্ব হরণের কারণে একটি নিগ্রোকে পশুর মতো করে শিকার করা হয়েছিল। সেই লোকটিকে মোমা আর আংকেল উইলি সারারাত ধরে আলমারির ভেতর লুকিয়ে রেখেছিলেন। আর তারপর তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন। যাই হোক, তিনি একসময় গ্রেফতার হলেন। কোর্টে তার কাছে জানতে চাওয়া হলো, অপরাধ সংঘটিত হওয়ার দিন তিনি কী কী করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যখন তিনি জানতে পারলেন, তাকে খোঁজা হচ্ছে, তখন তিনি মিসেস হেন্ডারসনের স্টোরে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
জজসাহেব কোর্টে মিসেস হ্যান্ডারসনকে হাজির করতে হুকুম দিলেন। যখন মোমা হাজিরা দিয়ে জানালেন, তিনিই মিসেস হ্যান্ডারসন। তখন তাকে দেখে জজসাহেব ও কোর্টের অন্য সাদা সদস্যরা বিস্মিত হয়ে হেসে দিয়েছিলেন। একজন নিগ্রো নারীকে মিসেস বলে সম্বোধন করেছিলেন সেই জজসাহেব। যিনি আরাকান্সাসের পাইনব্লাফ শহর থেকে এসেছিলেন। তিনি সত্যি সেদিন একটি অসমীচীন কাজ করে ফেলেছিলেন। কল্পনাই করতে পারেননি যে, এই নিগ্রো নারী গ্রামের ভেতরের একটি স্টোরের মালিক। সেই স্টোরটি এতসব মুখরোচক কাহিনির জন্ম দিতে যাচ্ছে। এরপর বহুদিন পর্যন্ত সাদারা এই ঘটনাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করেছে। কিন্তু নিগ্রোরা বিশ্বাস করতো, এই ঘটনাটি থেকে প্রমাণি হয়, আমার দাদি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ-মূল্যবান ও একজন মহিমান্বিত নারী।
চলবে…
আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-৯॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু