অনুবাদ: ফারহানা রহমান
[পর্ব: ৯ ]
যেই না বুড়োটা (রেভারেন্ড থমাস) মুখ খুলে তার গোলাপি জীব বের করে কাঁপতে কাঁপতে বলতে লাগলো, ‘হে, মাউন্ট নিবোর দয়ালু ঈশ্বর’, অমনি সিস্টার মনরোর পার্স এসে পরপর দুবার তার মাথায় আঘাত হানলো। মুখটা পর্যন্ত বন্ধ করার সুযোগ সে পেলো না। তার আগেই মুখের ভেতর থেকে দাঁতগুলো লাফিয়ে পড়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে লাগলো।
আমার ডান পায়ের জুতোর কাছে এসে দাঁতের ওপরের ও নিচের পাটি হা হা করে হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। সবকিছু খালি খালি লাগছিল। আর একইসঙ্গে সারা দুনিয়াই মনে হচ্ছিল খালি হয়ে গেছে। পা বাড়িয়ে ফুটবলের মতো লাথি মেড়ে আমি ওগুলোকে বেঞ্চের নিচে বা টাকা তোলার টেবিলের নিচে পাঠিয়ে দিতে পারতাম।
সিস্টার মনরো তার কোটটি গায়ে চাপানো নিয়ে মহাঝামেলায় পড়লেন। কিন্তু এরইমধ্যে কয়েকজন ষণ্ডামার্কা লোক এসে তাকে সবসহ পাঁজাকোলা করে বিল্ডিংয়ের বাইরে বের করে আনলো। বেইলি আমাকে চিমটি মারতে লাগলো। আর ফিসফিস করে বলতে লাগলো, ‘আমি এখন দেখতে চাই যে, এই ব্যাটা দাঁত ছাড়া কী করে ডিনার করে?’
সেও দুপা ছুড়ে ছুড়ে বেদম হাসিতে ফেটে পড়ছে। প্রতিবার আমরা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আরও জোরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে লাগলাম।
আমি ব্যাকুল হয়ে রেভারেন্ড থমাসের দইকে তাকালাম। যদি তাকে সামান্যতম দুঃখিত বা বিপর্যস্ত দেখতাম! সত্যি বলছি. আমি হাসাহাসি বাদ দিয়ে তার জন্য ভীষণ কষ্ট পেতাম। তার প্রতি আমার সেই সহানুভূতিই আমাকে হাসতে বাধা দিতো। আমি চার্চের ভেতর হাসতে ভয় পাচ্ছিলাম। তবে যদি আমি নিজের প্রতি কন্ট্রোল রাখতে না পারতাম, তাহলে অবশ্যই হাসতে হাসতে সেখানে হিস্যু করে দিতাম। আর বেতের বাড়ি একটাও নিচে পড়তো না। সবই এসে আমার পিঠে পড়তো। আর আমি তখন হাসতে হাসতে মরেই যেতাম। কারণ সবকিছু সেখানে ভীষণ হাস্যকর ছিল। মোমা ভয়ানকভাবে রেগে রেগে তাকিয়ে সিস্টার মনরোকে শান্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আর এদিকে বেইলি ফিসফিস করে ভ্যাঙিয়েই যাচ্ছিল, ‘পড়! পড়! তোকে পড়তে বলছি পড়।’ আর শ্রদ্ধেয় থমাসের দাঁতহীন ঠোঁটগুলো ঢিলা ইলাস্টিকের মতো ঢলঢল করছিল।
এদিকে রেভারেন্ড থমাস চার্চে ঘটানো সিস্টার মনরোর সব কীর্তিকলাপকে তুড়ি মেড়ে উড়িয়ে দিয়ে নিজের নোংরা দাঁতগুলোর ওপর একটি সাদা রুমাল বিছিয়ে দিলেন। জঘন্য জিনিসগুলোকে পকেটে ভরতে ভরতে তিনি ভ্যানভ্যান করতে লাগলেন, ‘আমি এই পৃথিবীতে উলঙ্গ হয়ে এসেছি। আর যাওয়ার সময়ও উলঙ্গ হয়েই ফিরে যাবো।’
বেইলি সারা শরীর কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে হাসতে হাসতে হিসহিস করে ঘোড়ার হ্রেষার মতো নাক দিয়ে শব্দ করতে লাগলো। আমি হাসি থামানোর আর কোনো চেষ্টা করলাম না। আমি হা হা করে শব্দ করে হাসতে লাগলাম। আমি চার্চের আকাশে-বাতাসে, বেদীতে এমনকী জানালার ওপারেও চাপাহাসির শব্দ শুনতে পেলাম। মোমা আমার দিকে তাকিয়ে ধমক দিলেন, ‘সিস্টার!’ কিন্তু আমি থামতে গিয়ে থতমত খেয়ে পিছলা বেঞ্চি থেকে ঘড়িয়ে মাটিতে গিয়ে পড়লাম। এতে আমি আরও হাসিতে ফেটে পড়লাম। আমি জানতাম না এরচেয়ে বেশি হাস্যকর ব্যাপার পৃথিবীতে আর কী থাকতে পারে? আমি এমনভাবে হাসতে লাগলাম যে আমার নিজের শরীরের ওপর আমার আর কোনোই কন্ট্রোল রইলো না। ফলে আমার শরীরের সব পথ যেন খুলে গেলো। আমি তারস্বরে চিৎকার করে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগলাম। এতে করে আমার হিস্যু হয়ে গেলো। পায়ুপথ থেকে গ্যাস বের হতে লাগলো। আমি এতক্ষণ খেয়াল করিনি যে বেইলিও মেঝেতে বসে পড়েছে। সেও দুপা ছুড়ে ছুড়ে বেদম হাসিতে ফেটে পড়ছে। প্রতিবার আমরা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আরও জোরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে লাগলাম।
ভাবছিলাম সে হয়তো আরও কিছু হাস্যকর কথা বলবে। কিন্তু সে শুধু হাসতে হাসতে এমনভাবে গড়িয়ে পড়তে লাগলো যে শুধু মুখ ফুটে একটা কথাই বলতে পারলো, ‘আমি বলছি তোকে তুই পড়!’ আমি হাসতে হাসতে আর মেঝেতে গড়াতে গড়াতে গিয়ে পড়লাম আংকেল উইলির রাবারের হাতলওয়ালা বেতের ওপর। বেতের বাঁকের কাছে ঝুলে থাকা তার সুন্দর বাদামি হাতটার ওপর আমার নজর পড়লো। আর তার মুখের পাশেই আরও অনেকের সাদা সাদা হাত ঝুলছে। যখন আংকেল উইলি কাঁদতে বা হাসতে থাকে তখন তার একপাশের হাতটি অবশ হয়ে নিচে ঝুলে থাকে। তিনি তোতলাতে লাগলেন, ‘এখন থামো! তা নাহলে কিন্তু আমি বাধ্য হবো তোমাকে বেত দিয়ে পেটাতে।’
প্রতিবার যখন বেইলি দুষ্টুমি করে আমার কাছে এসে বলতো, ‘আমি বলছি, পড়’, তখনই ওকে বেদম পেটাতাম। আর হাউমাউ কান্না শুরু করে দিতাম।
আমি এখন আর কিছুই মনে নেই যে কী করে আমরা ওই সময় চার্চ থেকে বেড়িয়ে পাশের বাসায় অর্থাৎ যাজকের বাড়িতে ঢুকেছিলাম। তবে সেইদিন জীবনে প্রথমবারের মতো সেই হাউকাউয়ের মধ্যে আমরা বেতের বাড়ি খেয়েছিলাম। আংকেল উইলি আমাদেরকে বাধ্য করেছিলেন থামতে। আমি খুব চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বেইলি কথা শুনছিল না। পরে সে আমাকে বলেছিল যে যখন কেউ কাউকে বেত দিয়ে পেটায়, তখন তার উচিত এমনভাবে চিৎকার চ্যাঁচামেচি করা, যেন অন্যদের কানে সেই শব্দ পৌঁছায়। তাদের মনের মধ্যে মার খাওয়া লোকটির জন্য করুণা তৈরি হয়। তারা তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসে। আমাদের উদ্ধারকারী অবশ্যই এসব কোনো কারণেই আসেনি। বেইলি তারস্বরে চিৎকার করেছে। তার সেই চিৎকারে সবার মধ্যে বিরক্তির উদ্রেক হয়েছিল। তাদের নিজস্ব কাজে বাধা সৃষ্টি করছিল। এ কারণে মিনিস্টারের স্ত্রী বাধ্য হয়ে এগিয়ে আসেন। আর আমাদের চুপ করানোর জন্য আংকেল উইলিকে অনুরোধ করেন।
কল্পনাপ্রবণ শিশুদের জন্য অট্টহাসি কত সহজেই না হিস্টেরিয়ার (মৃগীরোগ) কারণ হয়ে পারে। এরপর বেশ কয়েক সপ্তাহের জন্য আমি ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আমার শরীরের সম্পূর্ণ শক্তি ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত আমি এমন একটি ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে পড়েছিলাম যে, যেকোনো ধরনের হাসিঠাট্টার ব্যাপারই ওই সময় আমাকে মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারতো।
প্রতিবার যখন বেইলি দুষ্টুমি করে আমার কাছে এসে বলতো, ‘আমি বলছি, পড়’, তখনই ওকে বেদম পেটাতাম। আর হাউমাউ কান্না শুরু করে দিতাম।
আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-৮॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু
চলবে…