অনুবাদ: ফারহানা রহমান
পর্ব-৪২
রান্নাঘর থেকে আমি, বেইলির খালি গায়ের উপর চটাং চটাংকরে পড়া আংকেল উইলির বেল্টের শুষ্ক ও কর্কশ শব্দ ভেসে আসতে শুনতে পেলাম। তিনি, ওকে পেটাতে পেটাতে ক্লান্ত হয়ে দম নেওয়ার জন্য হাঁপাচ্ছিলেন। কিন্তু বেইলি একটি শব্দও করলো না। আর আমি ভয়ে আতংকে পানি ছাড়তে এমনকি কাঁদতেও ভুলে গেলাম। আমি ভেবেছিলাম হয়তো বেইলি এভাবে মার খাওয়া সহ্য করতে না পেরে সাহায্যের জন্য কাকুতিমিনতি করবে। কিন্তু সেই আকুতির শব্দ আর কখনোই শোনা গেলো না। এবং অবশেষে একসময় আংকেল উইলি বেইলির খোলা পিঠে চাপকানো থামালেন।
আমি রাতে অনন্ত সময়ের জন্য জেগে থাকতে লাগলাম। আমি আশা করছিলাম পাশের রুমে জেগে থাকা দুঃখী বেইলির গুনগুন গানের শব্দ বা কান্নার গোঙানি শব্দ অথবা অন্তত ফিসফিস করে আমাকে ডাকার মৃদু কোনো শব্দ শুনতে পাবো। অথচ ক্লান্তবিধ্বস্ত হয়ে ঘুমেঢলে পড়ার আগে শুধুমাত্র শুনতে পেলাম বেইলি প্রার্থনা করছে, ‘হে ঈশ্বর! আমার পিতা! এখন আমি ঘুমাতে যাবো। আমি আমার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি যেন আমি ঘুমের মধ্যে মারা গেলে তিনি যেন আমার আত্মাটিকে তাঁর কাছে উঠিয়ে নিয়ে যান। হে ঈশ্বর আপনি আমার আত্মাকে আপনার কাছে উঠিয়ে নিয়ে যান!’
সেই রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে শুধু একটি প্রশ্নই আমার মাথায় ঘুরছিল আর সেটা হচ্ছে কেন? কেন বেইলি শিশুর মতো করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছে? ও তো বলতে পারতো, ‘আমাদের পিতাকে,যিনি স্বর্গে একটি শিল্প হয়ে আছেন’ বছরের পর বছর ধরে।
যে কিনা তার চোখদুটো গোল গোল করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সারাক্ষণ মাথা আঁচড়াচ্ছিল। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম যে কে ফ্রান্সিস কি তাঁর সুন্দর গাড়িগুলো দেখাশোনা করার জন্য এই হাবাগোবাটিকে ছাড়া পৃথিবীতে কি আর কোনো মানুষকে খুঁজে পাননি?
পরবর্তী বেশ কিছুদিনের জন্য স্টোরটি একটি ভিনদেশে পরিণত হোলো। আর আমরা সবাই ওখানে নতুন অভিবাসীদের মতো ব্যবহার করতে লাগলাম। বেইলি কোনোকথাই বলল না। এমনকি একবারের জন্যও একটু হাসলও না। বা কারও কাছে ক্ষমাও ভিক্ষা করলো না। ওর চোখদুটো কী যে ভীষণ এক শূন্যতায় ভরে ছিল। ওকে দেখে মনে হোতো ও একজন আত্মা শূন্য মানুষ মাত্র। যেন ওর দেহ থেকে আত্মাটা অন্য কোথাও উড়ে চলে গেছে। খাবার খাওয়ার সময় আমি বেইলিকে মাংসের সবচেয়ে ভালো টুকরোটা অথবা মিষ্টি খাওয়ার সময় সবচেয়ে বড় কেক পেস্ট্রির টুকরোটা ওর পাতে উঠিয়ে দিতাম। কিন্তু ও পাথরের মূর্তির মতো নির্বিকার হয়ে খাবার সহ প্লেটটা পাশে নামিয়ে রাখতো।
এভাবেই দিনের পর দিন কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন সকালে বেইলি কোনোরকম পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই বিস্ফোরণের মতো বলে উঠলো, ‘আমি আমার প্রিয় মা’কে দেখেছি।’
যেহেতু ও কথাটি বলল সেহেতু এখানে সন্দেহের কোনোই অবকাশ নেই যে বেইলি সত্যি কথাই বলছে। কারণ ও কখনোই মিথ্যে বলে না। আমার মনে পড়ে না যে আমি ওর কাছে কখন বা কোথায় মা’কে দেখেছে সে ব্যাপারে কোনো কিছু জানতে চেয়েছিলাম। বা এ ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করেছিলাম।
কাঠের রেলিঙয়ের উপর মাথা ঠেকিয়ে দিয়ে ও উদাস নয়নে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি প্রিয় মা’কে সিনামার মধ্যে অভিনয় করতে দেখেছি। তবে তিনি আসলেই আমার প্রিয় মা ছিলেন না। তিনি কে ফ্রান্সিস নামের একজন নায়িকা ছিলেন। যিনি সিনামার একজন সাদা নায়িকা এবং একেবারেই আমাদের প্রিয় মায়ের মতো দেখতে।’
এতে বিস্ময়ের কিছুই নেই যে একজন সিনামার সাদা নায়িকা যিনি একেবারেই আমাদের মা’য়ের মতোই দেখতে এবং বেইলি তাকেই দেখেছে।
ও বলল যে এই সিনামা হলগুলোতে প্রতি সপ্তাহে সিনামা বদলে যায়। ফলে স্ট্যাম্পে যখন এই কে ফ্র্যাঞ্চিস সিনামাটি আবার দেখান হবে তখন ও আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে সিনামাটি দেখবে। ও আরও প্রমিজ করলো যে সে আমার পাশে বসেই সিনামাটি দেখবে।
সেই শনিবারে সিনামাটি বারবার দেখেছিল বলেই বেইলির বাড়িতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। ওর সব কথাই আমি বুঝেছিলাম। আর এটাও খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলাম কেন ও সেই সিনামাটির কথা মোমা এবং আংকেল উইলির সামনে বলতে পারেনি। সেই নারীটি আমাদের মা ছিলেন। এবং তিনি একান্তভাবেই শুধু আমাদেরই মা। তাঁর কথা আমরা কখনোই কাউকে বলিনি কারণ সত্যি কথা বলতে কী তাঁর সম্পর্কে বলার মতো যথেষ্ট তথ্যও আমাদের কাছে ছিল না।
স্ট্যাম্পসের হলে কে ফ্রাঞ্চিস দেখার জন্য আমাদেরকে এরপর আরও দুইমাস অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এরই মধ্যেবেইলির মনমেজাজ আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসছিলো । কিন্তু যে কারণেই হোক না কেন সবকিছু নিয়ে ওর আশা আকাংক্ষা দিনদিন বেড়ে যাওয়াতে ওকে আগের চেয়ে অনেক বেশি অস্থির মনে হোতো। তবে বেইলি যেদিন আমাকে জানালো যে সিনামাটি কয়েকদিনের মধ্যেই হলে দেখানো হবে, তখন থেকেই আমরা দুজন অন্যান্য সবার সঙ্গে খুবই ভালো ব্যবহার করা শুরু করলাম। এবং আমাদের দাদির কল্পনার মধ্যে যে লক্ষ্মী দুজন নাতিনাতনি আছে যাদেরকে তিনি অন্যদের সামনে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করতে চান। আমরা দুজন ঠিক তেমনভাবেই আচরণ করতে লাগলাম।
এটি ছিল সমকামীদের নিয়ে একটি হাসির সিনামা। কে ফ্রান্সিস সাদা সিল্কের একটি ফুলহাতা সার্ট পরে ছিল। যার হাতার আস্তিনে ছিল বড় বড় কাফ্লিংক্স ( শো বোতাম)। তাঁর বেডরুমটা ছিল সার্টিনের কাপড় দিয়ে সুজজ্জিত এবং ফুলদানীগুলো নানা ধরণের তাজা ফুল দিয়ে সাজানো ছিল। সেখানে তাঁর বাড়িতে তাঁর সঙ্গে একজন কালো নিগ্রো গৃহকর্মী ছিল সে সারাক্ষণ লাউজি মিসি বলে তাঁকে সম্ভাষণ করছিল। সেখানে একজন নিগ্রো ড্রাইভারও ছিল। যে কিনা তার চোখদুটো গোল গোল করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সারাক্ষণ মাথা আঁচড়াচ্ছিল। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম যে কে ফ্রান্সিস কি তাঁর সুন্দর গাড়িগুলো দেখাশোনা করার জন্য এই হাবাগোবাটিকে ছাড়া পৃথিবীতে কি আর কোনো মানুষকে খুঁজে পাননি?
সামনের দিকের সিটে বসে সিনামাটা দেখতে দেখতে সাদা মানুষগুলো সারাক্ষণই বিচ্ছিরিভাবে হাহাহিহি করতে লাগলো। এবং বাজারড রুষ্টের নিগ্রোদের নিয়ে তারা নানাধরণেরব অবজ্ঞাপূর্ণ কটূক্তি ছুঁড়ে দিতে লাগলো। আর যতক্ষণ পর্যন্ত না ব্যালকোনির লোকজন এসব কুরুচিপূর্ণ অবজ্ঞাগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে অট্টহাসি দিয়ে তাদের মন্তব্যগুলো প্রকাশ না করছিল, ততক্ষণ পর্যন্ত সেখানে বিশাল দেয়াল দিয়ে ঘেরা আমাদের থিয়েটার রুমটির বাতাসকেপ্রতিটি দ্বিধান্বিত মুহূর্তের মধ্যে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দগুলো হুল হয়ে ফুটে চারপাশটা ভারি করে রাখল।
ট্রেনটি দূরে চলে যেতেই সে এতক্ষণ যে থাম্বাটির সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সেখান থেকে উঠে হাঁটতে হাঁটতে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। এবং আমি যে এতক্ষণ ভয়াবহ আতঙ্কে পাগলের মতো চিল্লাচিল্লি করছিলাম সে জন্য খুব বকাঝকা দিতে লাগলো।
আমিও অনেক হেসেছিলাম কিন্তু সেটা কখনোই আমাদের নিজেদের মানুষদের প্রতি ঘৃণা দেখানোর জন্য নয়। আমি হেসেছিলাম কারণ সেই সুন্দরী মুভি স্টারটি একেবারেই আমার মায়ের মতোই দেখতে ছিলেন এবং সর্বোপরি তিনি ছিলেন একজন সাদা মানুষ। আর আমার আরও হাসি পাচ্ছিল কারণ আমার নিজের মা’য়ের মতোই তিনিও নিজের বাড়িতে অনেক কাজের লোক এবং কর্মচারীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে ছিলেন। এবং এটা আরও হাস্যকর লেগেছিল আমার কাছে যে যেই সুন্দরী নায়িকাকে নিয়ে সাদাজাতের মানুষগুলো এতো আদিখ্যেতাদেখাচ্ছে সেই নারীটি হয়তো আমার মায়ের জমজ বোন। শুধু এতোটুকুই পার্থক্য যে এই নায়িকাটি একজন সাদা মানুষ আর আমাদের মা হচ্ছেন তারচেয়ে অনেক অনেক বেশী সুন্দর একজন নারী। তিনি সত্যিঅনেক সুন্দরী!
সিনামার নায়িকাকে দেখে আমি ভীষণ খুশি হলাম। এটি আমার জন্য একেবারে অবিশ্বাস্যরকম সৌভাগ্য ছিল যে আমি টাকা জমিয়ে সিনামা দেখতে পারবো। এবং যখন খুশি সিনামতে আমার মাকে দেখতে পারবো। থিয়েটার থেকে এতোটাই উচ্ছ্বাস নিয়ে বের হয়ে আসলাম যেন আমি একটি অপ্রত্যাশিত উপহার পেয়েছি। কিন্তু বেইলি সিনামাটি আবারও দেখার জন্য টিকেট কাটল। (আমি ওর কাছে অনুনয়বিনয় করে প্রার্থনা করেছিলাম যাতে ও পরের শো’টি আর না দেখে)। বাড়িতে ফেরার পথে রাস্তায় বেইলি রেললাইনের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাতের মালবাহী ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। গাড়িটি আসার ঠিক আগের মুহূর্তে ও রেললাইন ছেঁড়ে সড়ে গিয়ে ট্রেনের ওঠার জন্য ট্রেনের পিছু পিছু দৌড়াতে লাগলো।
ট্রেনের আরেকপাশে আমি হিস্টেরিয়াগ্রস্ত রোগীর মতো আতঙ্কিত অবস্থায় পড়ে রইলাম। আমি ভাবছিলাম হয়তোবা ট্রেনের দৈত্যের মতো বড় বড় চাকাগুলো ওর হাড়গোড় সব পিশে রক্তের সঙ্গে মিশিয়ে পিণ্ড বানিয়ে ফেলেছে। এমনও হতে পারে ও হয়তো ট্রেনের একটি বক্সকারে উঠতে চেয়েছিল কিন্তু ঠিক সময় উঠতে না পেরে কোনো পুকুরের মধ্যে উড়ে গিয়ে পড়েছে এবং শেষপর্যন্ত ডুবে মরেছে। অথবা আরও ভয়ানক কিছুও হতে পারে। যেমন ও হয়তো সত্যি সত্যি কোনো ট্রেনের কামড়ায় উঠে পড়েছে এবং চিরদিনের জন্যই হারিয়ে গেছে।
ট্রেনটি দূরে চলে যেতেই সে এতক্ষণ যে থাম্বাটির সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সেখান থেকে উঠে হাঁটতে হাঁটতে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। এবং আমি যে এতক্ষণ ভয়াবহ আতঙ্কে পাগলের মতো চিল্লাচিল্লি করছিলাম সে জন্য খুব বকাঝকা দিতে লাগলো।
এবং এর ঠিক এক বছর পরেই বেইলি হঠাৎ একদিন রাতে এমনই একটি মালবাহী ট্রেনে চেপে বসলো। কিন্তু যেহেতু সে নিতান্তই একজন বালক বই কিছু নয় এবং তার ভাগ্যের অদৃষ্ট লেখনীর ফলে সে ক্যালিফোর্নিয়াই খুঁজে পেলো না। আর তাই তার প্রিয়তম মায়ের সঙ্গেও আর তার দেখা হোলো না। আর এভাবেই সে লুসিয়ানার ব্যাটন রুজে দুই সপ্তাহের জন্য আঁটকে পড়েছিল।
চলবে…
আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-৪১॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু