পর্ব-৪১
আংকেল উইলি ‘মোমা!’ বলে ডাকতেই মোমা বিস্মিত হয়ে লাফিয়ে উঠলেন। স্টোরের উজ্জ্বল আলোতে আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। আর আমি হিংসার জ্বলে পুড়ে মরতে লাগলাম এই ভেবে যে, কেউ একজন আমার ভাই সম্পর্কে খবর নিয়ে এসে মোমা এবং আংকেল উইলির সঙ্গে আলাপ আলোচনা করছেন। অথচ আমি আমার নিজের ভাই সম্পর্কে এ সমস্ত খবর একেবারে সবার পরে জানতে পারবো।
আংকেল উইলি বললেন, ‘মোমা’ তুমি ও ছোট্ট বোনটি, দুজনে মিলে কেন টিলার নিচে নেমে গিয়ে ওর সঙ্গে কথাবার্তা বলছ না?
আমার যতদূর মনে পড়ে, গত কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এই বাড়িতে বেইলির নাম একবারের জন্যেও কেউ উচ্চারণ করেনি। কিন্তু আমরা সবাই জানি যে এখন ঠিক কাকে উদ্দেশ্য করে এসব আলোচনা করা হচ্ছে।
ওহ হো! নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই! কেন যে আমার এই কথাটা এতক্ষণ মনে পড়েনি? আমি বাইরে বের হওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়লাম। ওই সময় মোমা বলে উঠলেন, ‘ওহ, ছোট্ট বাচ্চাটা! একটু অপেক্ষা করো দয়া করে। আর যাও ভেতরে গিয়ে তোমার সোয়েটারটা এবং আমার শালটা নিয়ে আসো আগে।’
আমি যতটা ভেবেছিলাম তারচেয়েও অনেক বেশি আঁধারে ঘিরে আছে বাইরের রাস্তাঘাট। বাইরে চারদিকে এত ঘুটঘুটে অন্ধকার হবে ভাবতেই পারিনি। মোমা রাস্তা, বনজঙ্গল ও ভয়ানক সব বিশাল বিশাল গাছপালাগুলোর গুঁড়ির ওপর টর্চলাইটের আলো ফেলতে লাগলেন। রাতটা হঠাৎ করেই শত্রুদের আস্তানায় পরিণত হলো। আমি বুঝে গেলাম যে বেইলি যদি এখানে একবার হারিয়ে যায়, তাহলে সে চিরতরেই হারিয়ে যাবে। এই ভয়ানক পরিবেশ থেকে ফিয়ে আসা সম্ভব নয়। যদিও সে একজন এগারো বছরের অত্যন্ত স্মার্ট একটি ছেলে! কিন্তু যত যাই হোক না কেন, সে তো নিতান্তই একটি বাচ্চা ছেলে। এই অন্ধকার বনে যদি সে একবার হারিয়ে যায় তাহলে চিৎকার করে সাহায্য চাওয়ার আগেই সে মারা পড়বে। ওকে নিশ্চিতভাবে ব্লু বিয়ারড (পুরাণ লোককাহিনীর একটি চরিত্র যে একাধিক বিয়ে করে একের পর এক স্ত্রীদের খুন করতো।-অনুবাদক), বাঘ অথবা কোনো রিপার (একজন খুনি যে তার শিকারের মৃতদেহ ছিন্নভিন্ন বা বিকৃত করে কাটাছেঁড়া করে।-অনুবাদক) এসে জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে মেরে ফেলবে।
মোমা আমাকে টর্চলাইটটি নিতে বললেন এবং আমার খুব কাছে চলে আসলেন। অনেক উঁচু টিলা থেকে যেন তার কণ্ঠস্বর ভেসে আসছিল। অথচ এই অন্ধকারে আমি তার বাহুর খুব কাছাকাছি ঘেঁষে ঘেঁষে হাঁটছিলাম। মুহূর্তের মধ্যেই আমি তাকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেললাম। মোমা কিছুই বললেন না। ‘চিন্তা করো না বা মন খারাপ করো না ছোট্ট বাচ্চাটা’ এমন কোনো কথাই তিনি বললেন না। শুধু আমার হাতের ওপর তার হাতের মৃদু চাপ দিয়েই বুঝিয়ে দিলেন যে তিনি ব্যাপারটি নিয়ে কতটা উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন।
সচারাচর দিনের আলোতে আমরা যেসব বাড়িঘর দেখি সেগুলোকে একের পর এক ছাড়িয়ে সামনের দিকে হেঁটে যেতে লাগলাম। অথচ রাতের এই বিষণ্ণ আঁধারে তাদের একেবারেই অপরিচিত মনে হতে লাগলো।
আমাকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মোমা বলে উঠলেন, ‘শুভ সন্ধ্যা মিস জেনকিন্স!’
আর কখনোই তিনি আমাদের মারধর করেননি। তবে মনে হচ্ছে তিনি আজকে আমার ভাইকে পিটিয়েই মেরে ফেলবেন। আমি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বেল্টটা আঁকড়ে ধরে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মোমা আমাকে জোর করে আটকে রাখলেন।
‘সিস্টার হ্যান্ডারসন? কোনো সমস্যা হয়েছে?’ আর সেটি ছিল রাতের সীমারেখার চেয়েও ভয়াবহ এক অন্ধকার থেকে উঠে আসা কোনো এক কণ্ঠস্বর।
‘না ম্যাম! কোনোই সমস্যা নেই। সবই ঈশ্বরের দয়া।’ প্রতিবেশীর উদ্বিগ্ন কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার অনেক আগেই আমরা দুজন তাকে পেছনে ফেলে বহুদূর চলে এসেছিলাম।
মিস্টার উইলি উইলিয়ামসের ‘ডু ড্রপ ইন’ রেস্টুরেন্টটি দূর থেকে মোহময় উজ্জ্বল লাল আলোয় ঘেরা মনে হচ্ছিল। আর সেখান থেকে ভেসে আসা পুকুরের মাছ দিয়ে তৈরি মজাদার সব খাবারের গন্ধ আমাদেরকে একেবারে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। আমি খেয়াল করলাম মোমার হাতের বাঁধন একবার আমাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরছিল, আবার সেটা আলগা হয়ে পড়ছিল। দূর থেকে আমি ক্লান্ত, বিধ্বস্ত একজন পরাজিত বৃদ্ধ মানুষের মতো করে হেঁটে আসা একটি বাচ্চার অবয়ব দেখতে পেলাম। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন তার প্রিয় মানুষের কফিনের পিছু পিছু একটি উঁচু পাহাড় পার হয়ে অনির্দিষ্টের পথে হেঁটে চলেছে। তার মাথাটি মাটির দিকে ঝুকে ছিলো আর তার হাতদুটো গোঁজা ছিল পকেটের ভেতর।
‘বেইলি!’ মোমা ‘জু’ উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই আমি লাফিয়ে উঠলাম এবং দৌড়ে ওর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মোমার হাতটা আবারও আমাকে সাঁড়াশির মতো করেই আঁকড়ে ধরলো। আমি প্রাণপণে আমার হাতটা তার হাত থেকে ছুটানোর চেষ্টা করতেই তিনি আমাকে তার পেছনের দিকে টেনে নিয়ে গিয়েবললেন, ‘ছোট্ট বাচ্চাটা! শোনো, আমরা এমনভাবে হাঁটবো যেন মনে হয় যে আমরা এখানে শুধুমাত্র কিছুক্ষণের জন্য হাঁটতেই বের হয়েছি।’
আমি যে বেইলিকে একটু সাবধান করার উদ্দেশ্যে বলবো যে সে আজকে ভয়াবহ রকম দেরি করে রাতে বাড়ি ফিরেছে। এবং তার এই অযাচিত ব্যবহারের জন্য সবাই কী ভীষণভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। আর তার উচিত এমন একটি দারুণ মিথ্যা গল্প বানিয়ে বলা যাতে করে সবাই অন্তত তার কথাটা বিশ্বাস করে। যেন তার শাস্তি কিছুটা লাঘব করে দেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি তাকে এসব কথা বলার কোনো সুযোগই পেলাম না।
মোমা গম্ভীরভাবে ডাকলেন, ‘বেইলি, জুনিয়র!’ কিন্তু বেইলি এতটুকু বিস্মিত না হয়ে তার দিকে তাকালো। ‘তুমি দেখেছ কত রাত হয়েছে আর এই গভীর রাতে তোমার বাড়ি ফেরার সময় হোলো?’
‘ঠিক বলেছেন ম্যাম!’ সে এমনভাবে উত্তর দিলো যেন সে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। কোথায় গেলো তার সব অজুহাত আর ছলচাতুরি?
‘এতক্ষণ তুমি কী করছিলে? কোথায় ছিলে?’ মোমা জানতে চাইলেন।
বেইলি বললো, ‘কিছু না।’
‘তাহলে, কি তোমার এটুকুই বলার আছে?’
‘হ্যাঁ, ম্যাম!’
মোমা শান্তস্বরে বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আগে বাসায় আসো। তারপর দেখছি।’
এরপর মোমা আমার হাতটি ছেড়ে দিতেই দৌড়ে গিয়ে বেইলির হাত আঁকড়ে ধরলাম। কিন্তু ও হেঁচকা টানে আমার হাতটি ছাড়িয়ে দিলো। আমি অনেক আশা নিয়ে বললাম, ‘অ্যাই বেইল কী হয়েছে?’ আমি এমনভাবে তাকে ভরসা দেওয়ার চেষ্টা করলাম যে আমিই তার একমাত্র বোন ও কাছের বন্ধু। কিন্তু সে মহাবিরক্তি নিয়ে খেঁকিয়ে উঠলো, ‘আমাকে একা থাকতে দাও। বিরক্ত করো না।’
ফিরে আসার পথে মোমা আর টর্চলাইট জ্বালালেন না। এমনকি তিনি ফেরার পথের অন্ধকারাচ্ছন্ন বাড়িগুলো থেকে ভেসে আসা ‘শুভসন্ধ্যা!’ সম্ভাষণটিরও কোনো উত্তর দিলেন না পর্যন্ত।
সবকিছু নিয়ে আমি ভীষণ দ্বিধাগ্রস্ত ও বিস্মিত বোধ করছিলাম। বুঝতে পারলাম যে বেইলির ওপর চাবুকের আঘাত পড়তে চলেছে। হয়তো সে সত্যি সত্যিই কোনো জঘন্য অপরাধ করে ফেলেছে। নিশ্চয়ই খুব সাংঘাতিক কোনো কিছু ঘটেছে। আর সেজন্যই সে আমার সঙ্গে কোনো কথাই আর বলছে না। তবে তাকে নিয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাস করার মতো আর কোনো অবকাশই ছিল না। বেইলিকে ভীষণরকম বিষণ্ণ মনে হচ্ছিল। আর আমি আসলে কী চিন্তা করবো, সেটাই বুঝতে পারছিলাম না।
আংকেল উইলি বললেন, ‘অনেক বাড় বেড়েছে তোমার তাই না? খুব পাছা ভারী হয়েছে তোমার। না?’ তোমার বাড়ি ফিরতে এখন আর ইচ্ছে হয় না? তাই না? তুমি এটাই চাচ্ছ তো? যে তোমার নানি যেন তোমার জন্য দুশ্চিন্তা করতে করতে একেবারে কবরেই চলে যাক? কিন্তু বেইলিকে এসবের কিছুই স্পর্শ করতে পারলো না। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল ও এই সবকিছুর অনেক ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। ওকে ভয়শূন্য মনে হচ্ছিলো। আংকেল উইলি তার ভালো হাতটি দিয়ে একটি চামড়ার বেল্ট আঁকড়ে ধরে ছিলেন, কিন্তু বেইলি কোনো কিছুই খেয়াল করলো না আর পাত্তাও দিলো না।
তিনি বললেন, আমি এখন বাধ্য হচ্ছি তোমাকে বেল্ট দিয়ে পেটাতে।
আজ পর্যন্ত শুধু একদিনই পিচ গাছের বেত দিয়ে আংকেল উইলি আমাদের পিটিয়েছিলেন। আর কখনোই তিনি আমাদের মারধর করেননি। তবে মনে হচ্ছে তিনি আজকে আমার ভাইকে পিটিয়েই মেরে ফেলবেন। আমি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বেল্টটা আঁকড়ে ধরে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মোমা আমাকে জোর করে আটকে রাখলেন।
তিনি রাগান্বিত স্বরে বললেন, শোনো এখন এত দরদ দেখিও না। তাহলে তোমার পিঠেও ওর মতো কিছু বেত্রাঘাত পড়বে। ও ওর কাজের শাস্তি পাচ্ছে। যাও তুমি গিয়ে তোমার স্নান সেরে আসো।
আরও পড়ুন: আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-৪০॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু