(পর্ব-৩৯)
অনুবাদ: ফারহানা রহমান
মিসেস র্যান্ডলের গৃহ পরিচালিকা আমার হাত থেকে স্যুপের বাটিটা নিতে নিতে বললেন, ‘মিসেস কুলিন্যান সত্যিই একজন ব্যতিক্রমি নারী। তিনি সত্যি একজন ভীষণ দয়ালু মানুষ।’
আর আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছিলাম যে এই নারীটির আগে প্রকৃত নাম কী ছিল এবং এখন আসলে তাকে কী নামে ডাকা হয়, কে জানে?
পরবর্তী এক সপ্তাহে মিসেস কুলিন্যান যখনই আমাকে ম্যারি বলে ডেকেছে আমি তার মুখের দিকে ভীষণ বিরক্তি নিয়ে সরাসরি তাকিয়ে থাকতাম। সে সময়টিতে আমি প্রতিদিন অনেক দেরি করে তার বাসায় যেতে লাগলাম এবং হাতের কাজ ফেলে রেখেই তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরে আসতে লাগলাম। কিন্তু তিনি এসব দেখেও না দেখার ভান করতে লাগলেন। কিন্তু মিস গ্লোরি আমার ওপর যারপরনাই বিরক্ত হতে শুরু করলেন। কারণ আমি সবকিছু নোংরা করে ফেলে রাখছিলাম। ডিমের কুসুমসহ বাসনকাসন ফেলে রাখতাম এবং রূপালি পলিস করা ডিসগুলো চকচকে করে পরিষ্কার না করেই নোংরা করে ফেলে রাখতাম। আমি আশা করছিলাম এবং সত্যি সত্যি মনেপ্রাণে চাইতাম, যেন তিনি মিসেস কুলিন্যানের কাছে আমার নামে বিচার দেন। কিন্তু তিনি কিছুই করছিলেন না।
পরবর্তী সময়ে বেইলি আমার এই সমস্যা সমাধান করেছিল। সে, কাবার্ডের (রান্নাঘরের বাসনকোসন রাখার আলমারি) মধ্যে কী কী জিনিসপত্র আছে সে সম্পর্কে আমার কাছে বিস্তারিত জানতে চাইলো। মিসেস কুলিন্যানের সবচেয়ে প্রিয় ও সুন্দর বাসনগুলো সম্পর্কেও ও আমার কাছ থেকে জেনে নিল। তার সবচেয়ে প্রিয় ছিল মাছের আকৃতির খুব সুন্দর দেখতে একটি ক্যাসালোর (একটি বড় ও গভীর ডিশ যা ওভেনে দিয়ে রান্না করা যায়। পরিবেশনও করা যায়) এবং একটি সবুজ রঙের কাঁচের কফি পান করার মগ। আমি বেইলির দেওয়া নির্দেশনার কথা সারাক্ষণ মনে রাখতাম। ফলে সৌভাগ্যক্রমে ঠিক পরের দিনই মিস গ্লোরি যখন বাইরে গিয়ে কাপড়চোপড় রোদে শুঁকাতে দিচ্ছিল। সেদিন আমার প্রতি আবারও নির্দেশ আসলো বাড়ির পেছনের বারান্দায় আড্ডারত বুড়ো ধাড়ি মহিলাগুলোকে নাস্তা পরিবেশন করার জন্য। এই সুযোগটি আমি কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইনি। ফলে আমি ওদের সামনে একটি খালি ট্রে পরিবেশন করেই রান্নাঘরে চলে এলাম। আমি আগে থেকেই রান্নাঘরে এসে তার প্রিয় ক্যাসারোলটি এবং সবুজ কাঁচের কফির মগগুলো আলমারি থেকে বের করে সামনের টেবিলের ওপর রেখেছিলাম। যেই শুনতে পেলাম মিসেস কুলিন্যান ম্যারি ম্যারি বলে চিৎকার করতেকরতে রানাঘরের দিকে এগিয়ে আসছেন। আমি তৎক্ষণাৎ ক্যাসারোলটি এবং কফি মগগুলোকে তার চকচকে টাইলসের মেঝের ওপর উঁচু থেকে ফেলে দিলাম।
আমি ওই সময় সবার চোখের ওপর দিয়েই বাড়ির সামনের দরজাটি হাট করে খুলে ঘর ছেড়ে বের হয়ে এলাম। দরজাটিকে এত জোরে খুললাম, যেন আশেপাশের সমস্ত প্রতিবেশী দরজা খোলার শব্দ শুনতে পায়।
পরবর্তী সময়ে অনেক চেষ্টা করেও আমি বেইলিকে সেইদিনের সমস্ত ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে পারিনি। কারণ যতবারই আমি কাঁচের মগ আর ডিশ ভাঙার পর মিসেস কুলিন্যানের মেঝের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে গিয়ে কাঁচের ভাঙা টুকরোগুলোকে জড়িয়ে ধরে মুখ বিকৃত করে হাউমাউ করে কাঁদার অভিনয় করে দেখাতে যেতাম। প্রত্যেকবারই আমি সেসময় হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে শুরু করতাম। এসব অভিনয় করে দেখাতে দেখাতে আমরা দুজনই হো হো করে হাসতে হাসতে ফেটে পড়তাম। প্রকৃতপক্ষেই মিসেস কুলিন্যান মেঝেতে গড়াগড়ি খেয়ে খেয়ে কাঁচের ভাঙা টুকরোগুলো জড় করে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্নাকাটি করছিলেন। তিনি চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, ‘ওহ মাম্মা! ওহ আমার প্রিয় ঈশ্বর! এগুলো আমার মাম্মার বড় শখের জিনিস ছিল। তিনি এগুলো সুদূর চায়না থেকে ভার্জিনিয়াতে বয়ে বয়ে নিয়ে এসেছিলেন। ওহ মাম্মা! আমাকে ক্ষমা করো। আমি সত্যি ভীষণ দুঃখিত!তোমার শখের জিনিসগুলোকে রক্ষা করতে পারলাম না।’
ওই মুহূর্তেই বারান্দা থেকে দৌড়ে এসে মিস গ্লোরি রান্নাঘরের ভেতর এসে ঢুকলেন। পেছনের বারান্দায় আড্ডারত মহিলাগুলোও হৈ হৈ করতে করতে রান্নাঘরে এসে প্রবেশ করলেন। মিস গ্লোরিও তার মনিবের মতোই হাহাকার করতে করতে বুক চাপড়াতে লাগলেন। তিনি বললেন, ‘ও আমাদের ভার্জিনিয়ার ডিসগুলো ভেঙে ফেলেছে এটাই কি আপনি বলতে চাচ্ছেন? হায়হায়! এখন আমরা কী করবো তাহলে? আমাদের কী উপায় হবে?’
মিস গ্লোরির এসব কথা শুনে মিসেস কুলিন্যান আরও তারস্বরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। জোরে জোরে চিল্লিয়েচিল্লিয়ে বলতে লাগলেন, ‘ওহ দেখ, দেখ ওই আনাড়ি নিগ্রোটার কাজ এটা! ওই পিচ্চি কালো ফাজিল নিগ্রোটার কাণ্ড এসব!’
মুখের মধ্যে অসংখ্য দাগযুক্ত বয়স্ক মহিলাটি মেঝের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে জানতে চাইলেন, ‘আচ্ছা এমন কে করলো ভায়োলা? এগুলো কে ভেঙেছে ম্যারি? কে করলো বলো তো এসব কাজ?’
ওই সময় সবকিছু এতই দ্রুত ঘটে যাচ্ছিল যে এখন আর আমি কিছুতেই মনে করতে পারি নামিসেস কুলিন্যান সেসময় চিৎকার করার সঙ্গে সঙ্গে আর ঠিক কী কী করেছিলেন। কিন্তু এতোটুকু স্পষ্ট করেই মনে আছে যে তিনি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেই বলেছিলেন, ‘হায় ঈশ্বর রক্ষা করো। ওর নাম আসলে ম্যারি না, ওর নাম মার্গারেট। বুঝলে ওর নাম হচ্ছে মার্গারেট!’ এসব বলতে বলতেই হঠাৎ করে মেঝে থেকে একটি ভাঙা প্লেটের টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে আমার দিকে ছুড়ে মারলেন। তিনি ওই সময় হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রুগীর মতো আচরণ করছিলেন। ফলে সম্ভবতই আমার দিকে ছুড়ে মারা তার হাতের নিশানাটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই উড়ে আসা ভাঙা প্লেটের কাঁচের টুকরোটি এসে আঘাত হানলো মিস গ্লোরির ডান কানের ওপর। ফলে তিনি ব্যথায় চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লেন।
আমি ওই সময় সবার চোখের ওপর দিয়েই বাড়ির সামনের দরজাটি হাট করে খুলে ঘর ছেড়ে বের হয়ে এলাম। দরজাটিকে এত জোরে খুললাম, যেন আশেপাশের সমস্ত প্রতিবেশী দরজা খোলার শব্দ শুনতে পায়।
পরবর্তী সময়ে একটি ব্যাপার মনে করে সান্ত্বনা পেতাম যে, মিসেস কুলিন্যান অন্তত সেদিন একটি বিষয়ে ঠিকই বলেছিলেন। আমার নাম কখনোই ম্যারি ছিল না। আমি হচ্ছি মার্গারেট!
চলবে…
আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-৩৮ ॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু