(পর্ব-৩৮)
অনুবাদ: ফারহানা রহমান
বেইলির কাছে মিসেস কুলিন্যানের দুঃখ-দুর্দশাময় দুর্বিষহ জীবনের বিবরণ দিতেই ও জানালো যে আমি তার সম্পর্কে যা ভাবছি, তা সবই ঠিক আছে। কিন্তু মিস্টার কুলিন্যানের দুইটি মেয়ে আছে। তাদের মা হচ্ছেন একজন কালো মহিলা। বেইলি আরও বললো যে ও তাদের খুব ভালো করে চেনে। ওরা দুই বোন একেবারেই ওদের বাবার মতো দেখতে হয়েছে। যদিও মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই আমি মিস্টার কুলিন্যানকে দেখেছি। তবু অনেক চেষ্টা করেও তার চেহারাটা ওই সময় মনে করতে পারলাম না। আমি তখন কোলম্যানের মেয়েদের চেহারাগুলো মনে মনে ভাবার চেষ্টা করছিলাম। তাদের দুজনের ত্বকই অবশ্য বেশ উজ্জ্বল ছিল। যদিও তাদের মা একজন কালো নারী ছিলেন কিন্তু তারা কেউ মায়ের মতো দেখতে হয়নি (এখানে কেউ কখনো মিস্টার কোলম্যানের নামটির কথা উল্লেখই করেনি। তাকে সবাই মিস্টার কুলিন্যান বলেই ডাকে)।
মিসেস কুলিন্যানের প্রতি আমার করুণা ও মায়া এতই বেড়ে গিয়েছিল যে, পরেরদিন সকালে আমি আমার মুখে সারাক্ষণ আত্মতুষ্টির হাসি ঝুলিয়ে রাখলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম যে মেয়েগুলো যদি মিসেস কুলিন্যানের নিজের হোতো তাহলে নিশ্চয়ই তারা দেখতে আরও অনেক বেশি সুন্দর হতো। তাদের কখনো আলাদাভাবে কোঁকড়া চুল সোজা করতে হতো না। এমনকি দৈবাৎ কখনো যদি হঠাৎ বৃষ্টিতে ওদের চুলের বেণীগুলো ভিজেও যেতো, তাহলেও ওগুলো পোষা সাপের মতোই সোজা হয়ে পড়ে থাকতো। তাদের মুখগুলোতে ঝুলে থাকতো দৈব শিশুদের ধনুকের মতো আহ্লাদি ঠোঁট। মিসেস কুলিন্যান হয়তো জানতেনই না যে, তিনি আসলে কী হারিয়েছেন। কে জানে হয়তো বা তিনি জানতেন! আহারে দুঃখী মিসেস কুলিন্যান! খুব কষ্ট হয়।
পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ ধরে আমি খুব ভোরে গিয়ে মিসেস কুলিন্যানের বাসায় পৌঁছাতে লাগলাম। সন্ধ্যায় কাজ শেষ করে অনেক দেরি করে ফিরতে লাগলাম। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম যেন মিসেস কুলিন্যানের এই অসহনীয় নিঃসঙ্গতা ও বন্ধ্যাত্বের কষ্ট দূর হয়। আহারে বেচারি মিসেস কুকিন্যান! তার যদি নিজের একটি সন্তানও থাকতো তাহলে তিনি কখনোই আমাকে এভাবে তার নিজের ও তার বন্ধুদের দোরে দোরে ঘুরে ঘুরে হাজারও ফাইফরমাশ খাটতে দিতেন না। তিনি আমার কষ্টগুলো অন্তত বুঝতেন! হায়রে ব্যাচারি মিসেস কুকিন্যান! ভীষণ মায়া হয় উনার জন্য।
এভাবেই চলতে চলতে হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় মিসেস গ্লোরি আমাকে বললেন বারান্দায় বসে আড্ডারত মিসেস কুলিন্যানের বন্ধুদেরকে খাবার পরিবেশন করতে। খাবারসহ ট্রে টিকে টেবিলের ওপর রেখে আমি রান্নাঘরের দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ঠিক সেই সময় মুখের মধ্যে ছোপ ছোপ দাগযুক্ত একজন ভদ্রমহিলা আমাকে ডেকে জানতে চাইলেন, ‘অ্যাই ছোট্টমেয়ে তোমার নাম কী?’ কথাটি শুনে মিসেস কুলিন্যান বললেন, ‘মেয়েটা বেশি কথা বলে না। খুব চুপচাপ স্বভাবের। ওর নাম মারগারেট।’
‘আচ্ছা মেয়েটা কি বোবা?’
মিসেস কুলিন্যান বললেন, ‘না। আমি যতটুকু বুঝতে পারি যে ও বোবা নয় তবে যখন ওর ইচ্ছে হয় ও শুধু তখনই কথা বলে। অন্যান্য সময় ও ছোট একটি আদুরে ইঁদুরের মতো চুপচাপ ঘোরাফেরা করতে থাকে। কী বল তাই না মারগারেট?’
আর একজন সাদা মহিলা তার নিজের উচ্চারণের সুবিধার জন্য তাকে অন্য একটি নাম দিলো।’ আমি রাগে ফেটে পড়া থেকে নিজেকে কোনোরকম ভাবে রক্ষা করলাম।
আমি মিসেস কুলিন্যানের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। আহারে বেচারি! কতই না দুঃখী একটা মানুষ! শরীরের ভেতরে এমনিতেই কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই। তার ওপর আমার নামটাও শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করতে পারছেন না। কতই না কষ্ট বেচারির?
‘তবে যত যাই হোক না কেন, ও কিন্তু ছোট্ট একটা মিষ্টি মেয়ে!’ মিসেস কুলিন্যান বললেন।
উত্তরে সেই ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আচ্ছা ভালো তো! সে নাহয় বুঝলাম তবে সেটি যাই হোক না কেন ওর নামটা কিন্তু খুব বেশিরকম বড়। আমি হলে কিন্তু কষ্ট করে কখনই ওকে এতো বড় নামে ডাকতাম না। আমি তোমার জায়গায় থাকলে কিন্তু ওকে মার্গারেট না ডেকে বরং ম্যারি বলেই ডাকতাম।’
আমি রাগে জ্বলতে জ্বলতে রান্নাঘরে ঢুকলাম। ওই ভয়ানক মহিলাটি কখনোই আমাকে ম্যারি বলে ডাকার কোনো সুযোগই পাবে না। কারণ আমি যদি না খেতে পেয়ে মরেও যেতাম তবুও ওই মহিলার বাসায় কখনোই কাজ করতাম না। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে মহিলাটি যদি আমার জন্য মনের দুঃখে পাগল হয়ে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে মরেও যায় তবু আমি তার কাছে এমনকি হিস্যু করতেও যাবো না। মহিলাদের খিলখিল হাসি পেছনের বারান্দা থেকে ভেসে এসে মিস গ্লোরির রান্নাঘরের পাত্রগুলোর মধ্যে ঢুকে যেতে লাগলো। এসব মহিলাদের এত হাসাহাসির পেছনে কী এমন কারণ থাকতে পারে তা নিয়ে আমি অবাক বিস্ময়ে ভাবতে লাগলাম।
সাদা মানুষগুলো সত্যি খুব বিচিত্র একটা জাতি। তারা কি আমার মতো একজনকে নিয়েও এমন রসালো গপ্প ফাঁদতে পারে? দুনিয়ার সবাই জানে যে সাদারা নিগ্রোদের তুলনায় অনেক ভালো অবস্থানে আছে।
এমনটা অবশ্য হতে পারে যে মিসেস কুলিন্যানের যে সমস্ত বন্ধুবান্ধব সেইন্ট লুইসে থাকেন তাদের মধ্যেই কেউ একজন হয়তো বা আমার কথা উল্লেখ করে তাকে চিঠি লিখেছিলেন। সেই বন্ধুটি হয়তো জেনে গিয়েছিলেন যে স্ট্যাম্পসের একটি ছোট মেয়ে কোর্ট পর্যন্ত উঠেছে। এমনও তো হতে পারে যে তিনি মিস্টার ফ্রিম্যানকেও চিনতেন।
জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো আমার পেটের সব খাবার বমির সঙ্গে উগ্রে উগ্রে আসতে লাগলো। আমি ঘর ছেড়ে বের হয়ে এলাম। এরপর বিকেল চারটার দিকে নিজেকে বিছানার ওপর এলিয়ে দিলাম। মিস গ্লোরি ভেবেছিলেন আমি হয়তো কোনো কিছু সঙ্গে নিয়ে নিচে নেমে এসেছি। তিনি আমাকে বাসায় চলে যেতে বললেন। বললেন যে মোমার কাছ থেকে ভেষজ চা আনলে তিনি তার মিস্ট্রেসকে কিভাবে সেই চা খেতে হয় সেটা বুঝিয়ে বলবেন।
পুকুর পাড়ের দিকে হেঁটে যেতে যেতেই বুঝতে পারলাম, আমি কতটা বোকা। আমি নিশ্চিত যে, মিসেস কুলিন্যান আসলে কিছুই জানেন না। তিনি যদি এতকিছু সত্যিই জানতেন, তাহলে কখনোই আমাকে অপূর্ব সুন্দর সেই ফ্রক দুটো দিতেন না। যেগুলোকে কিছুদিন আগে মোমা কেটে ছোট করে আমার সাইজের করে দিয়েছিলেন। আর তিনি যদি আমার সম্পর্কে ওসব কথা জানতেনই তাহলে নিশ্চয়ই আমাকে ‘ছোট্ট মিষ্টি মেয়েটা’ বলে ডাকতেন না। এতক্ষণ পর আমার পাকস্থলীর ভেতরটাতে একটু ঠাণ্ডা বোধ করতে লাগলাম। আমার মনে শান্তি ফিরে এলো। তাই মোমাকে এ ব্যাপারে আর কোনোকিছুই বললাম না।
সেই বিকেলেই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে ফর্সা, মোটা এবং বয়স্ক একজন বন্ধ্যা মহিলাকে নিয়ে আমি একটি কবিতা লিখব। এটি অবশ্যই একটি বিরহের গীতিকাব্য হবে। ঠিক করলাম এখন থেকে আমাকে খুব মনোযোগ সহকারে তাকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে, যেন পরবর্তী সময়ে আমি তার একাকিত্ব ও যন্ত্রণার বিবরণ দিয়ে বিরহের গীতিকবিতাটি লিখতে পারি।
ঠিক তার পরদিনই তিনি আমাকে ভুল নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। আমি ও মিস গ্লোরি যখন দুজন মিলে একসঙ্গে দুপুরের খাবারের পর নোংরা হয়ে থাকা হাঁড়িপাতিলগুলো মাজাঘষা করছিলাম, তিনি রান্নাঘরের দরজার কাছে এসে আমাকে ম্যারি ম্যারি বলে ডাক দিতে লাগলেন।
মিস গ্লোরি জানতে চাইলেন, ‘কাকে আপনি ম্যারি বলে ডাকছেন?’
মিসেস কুলিন্যান একটু মাথাটা ঝাঁকিয়ে আমার দিকে ইশারা করলেন। আমি জানতাম যে, তিনি আমাকেই বোঝাতে চাচ্ছেন। তিনি বললেন, ‘আমি চাই ম্যারি একটু নিচে গিয়ে মিসেস র্যান্ডলের বাসায় তার জন্য স্যুপ দিয়ে আসুক (মিসেস কুলিন্যানের বাসাটি ছিল টিলার ওপর অবস্থিত। মিসেস র্যান্ডনের বাসাটি টিলার নিচে)। মিসেস র্যান্ডল কয়েকদিন থেকে বেশ অসুস্থ বোধ করছেন।’
মিস গ্লোরি বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে বলতে লাগলেন, ‘ওহ ম্যাম! আপনি তাহলে মার্গারেটের কথা বলছেন। কিন্তু ওর নাম তো ম্যারি নয়। ওর নাম হচ্ছে মার্গারেট।’
মিসেস কুলিন্যান মহাবিরক্তির সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘ওহহো! ওর ওই নামটা ভীষণ বড়। এখন থেকে আমরা সবাই ওকে ম্যারি বলেই ডাকবো। বুঝতে পেরেছ? আচ্ছা শোনো তুমি স্যুপটাকে একটু গরম করে তুরিনে ভরে দাও। আমি চাই ম্যারি খুব সাবধানে তুরিনে করে স্যুপ নিয়ে গিয়ে নিচে গিয়ে মিসেস র্যান্ডলের বাসায় সেটি দিয়ে আসবে।’
আমি খুব ভালো করেই জানি যে কারও নাম বিকৃত করে তার সামনে উচ্চারণ করলে তার কী ভয়ানক নরক যন্ত্রণা হয়। আর কোনো নিগ্রোর নামকে তো এভাবে বিকৃত করা একটি ভয়াবহ অপরাধ। সেটি একটি ভীষণ ভয়ঙ্কর বিষয়। কারণ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাদের নিগার, জিগস, ডিঙ্গেস, কালোপাখি, কাক, বুটজুতা এবং ভুত নামে সাদারা ডেকে আসছে। ফলে নাম ঠিক মতো করে উচ্চারণ না করলে একজন নিগ্রো কিন্তু চরম অপমান বোধ করে।
মিস গ্লোরিকয়েক মুহূর্তের জন্য আমার দিকে বিব্রত হয়ে দুঃখী দুঃখী চোখে তাকালেন। তারপর গরম স্যুপসহ তুরিনটা আমার হাতে দিয়ে তিনি বললেন, ‘প্লিজ কিছু মনে করো না। একেবারেই এসব পাত্তা দিও না। কেউ কোনো লাঠি দিয়ে আঘাত হানলে বা পাথর ছুঁড়ে মারলে হয়তো তোমার শরীরের হাড়গোড় ভেঙে যেতে পারে। কিন্তু মানুষের কথাতে কী এসে যায় বলো? তুমি তো বুঝতেই পারছ যে আমি এখানে গত কুড়ি বছর ধরে কাজ করছি।’
আমার নিচে নেমে আসার জন্য তিনি বাড়ির পেছনের দরজাটাকে খুলে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। ‘কুড়ি বছর হয়ে গেলো এখানেই কাজ করছি। প্রথম যখন এসেছিলাম তোমার বয়সীই ছিলাম। আমার নাম কিন্তু ছিল হ্যালিলুজাহ। এই নামটিই আমার মা আমার জন্য রেখেছিলেন। কিন্তু আমার মনিব আমাকে গ্লোরি নামটি দিলেন। এটাই কিন্তু চমৎকার একটি নাম। এই নামটিকেও আমার খুব ভালো লাগে।’
পরবর্তী কয়েক মুহূর্ত আমি হতবিহব্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বুঝতেই পারছিলাম না যে আমি হাসবো নাকি কাঁদবো? (চিন্তা করে দেখুন একজন মানুষ যার নাম ছিল হালিলুজাহ। আর একজন সাদা মহিলা তার নিজের উচ্চারণের সুবিধার জন্য তাকে অন্য একটি নাম দিলো।’ আমি রাগে ফেটে পড়া থেকে নিজেকে কোনোরকম ভাবে রক্ষা করলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমাকে এই চাকরিটা অবশ্যই ছাড়তে হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সেটা কিভাবে করবো? মোমা কোনোকিছুর বিনিময়েই এই চাকরিটা আমাকে ছাড়তে দেবেন না।
আরও পড়ুন: আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-৩৭ ॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু