(পর্ব-৩৭)
অনুবাদ: ফারহানা রহমান
টেক্সাসের এক সাদা ভদ্রমহিলা যিনি নিজেকে ইদানীং সবার কাছে একজন উদার মানুষ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেলেন, তিনিই কিনা একদিন আমার ব্যাপারে অতি উৎসাহিত হয়ে জানতে চাইলেন যে, আমার বাড়ি আসলে কোথায়? আমি যখন তাকে বললাম যে আমি স্ট্যাম্পসে থাকি এবং আমার দাদি হচ্ছেন সেই নারী, যিনি স্ট্যাম্পসের একমাত্র নিগ্রো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান জেনারেল স্টোরের মালিক। এই শতাব্দীর একেবারে প্রথম থেকেই তিনি স্ট্যাম্পসে এই স্টোরটি পরিচালনা করে আসছেন। তিনি বিরক্তির সঙ্গে চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘বুঝতে পারি না তোমরা কী কারণে এত সম্ভ্রান্ত মানুষ?’
মহিলাটির এসব কথা খুবই উদ্ভট ও হাস্যকর। কিন্তু এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে, দক্ষিণের ছোট ছোট শহরের নিগ্রো মেয়েরা প্রকৃত অর্থেই দারিদ্র পীড়িত। দুঃখ-দুর্দশায় জর্জরিত হয়ে দিন কাটায়। তারা এমনকি নিত্যপ্রয়োজনীয় ছোটখাটো বিষয় নিয়েও অভাবনীয় দুর্দশায় দিন অতিবাহিত করে। অথচ এসব সত্ত্বেও পরিবারের ছোট মেয়েদের বড়রা এত বেশি আদর আহ্লাদ ও অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে বড় করে তোলে, যা সাদা বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এমন দৃশ্য শুধু ম্যাগাজিনের ছবিতেই দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা সবাই জানি যে আসল ব্যাপারটা মোটেও সে রকম নয়। যে বয়সে সাদা মেয়েরা মিউজিকের তালে তাল মিলিয়ে যুগলবন্দি হয়ে নাচের ফ্লোরে নাচ শেখে। চায়ের কাপ হাঁটুতে নিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করার কায়দা শিখতে থাকে ঠিক সেই সময়টিতেই আমরা নিগ্রো মেয়েরা সবকিছু থেকে পিছিয়ে থাকি। নিতান্ত দারিদ্র্যের মধ্যে মধ্যযুগের ভিক্টোরিয়ান মূল্যবোধগুলোকে আয়ত্ত করে কোনো রকমে সমাজের সঙ্গে তাল মেলানোর চেষ্টা চালাই।
{আচ্ছা তাহলে আপনারা এসে দেখে যান, যে এডনা লোম্যাক্স (একজন নিগ্রো নারী) কিভাবে ইক্রুট্যাটিং সুতোর পাঁচটি বল বিক্রি করে তুলাতুলে কতইনা টাকা পেয়েছেন এবং সেটা ওড়াচ্ছেন? কিন্তু এটাই সত্যি যে তার হাতের পাঁচটি আঙুল দিনরাত এক করে কাজ করতে একেবারেই বাধ্য থাকে এবং তাকে দিনের পর দিন বারবার করে একই জিনিস সেলাই করতে হয়। সে এটিও খুব ভালো করে জানে যে কখন তার সুতো ফুরিয়ে যাবে আর তাকে আবারও সুতো কিনে একই কাজ করে উপার্জন করতে হবে।}
দুপুর ১২:১৫ মিনিটে মিসেস ভায়োলা কুলিন্যান খাবার খেতে বসেন (সে সময়ের মধ্যে তার স্বামী খেতে আসুক বা না আসুক তাতে তার কিছুই এসে যায় না)। ঠিক ১২: ১৬ মিনিটে মিস গ্লোরি খাবার পরিবেশন করেন।
আমাদের অ্যাম্রোয়ডারির কাজ করতে হতো। আমার ট্রাংক ভরা ছিল অসংখ্য রঙিন রান্নাঘরের তোয়ালে, বালিশের কভার, টেবিল ও মেঝেতে বেছানোর ম্যাট। রুমাল দিয়ে। আমি ছোট ছোট সুগন্ধিযুক্ত ব্যাগ ও কারুকার্যময় সেলাইয়ের কাজ করতে ভীষণ পারঙ্গম হয়ে উঠেছিলাম। আমার ড্রেসার ড্রয়ারসের মধ্যে সারাজীবন ধরে ব্যবহার করার মতো যথেষ্ট পরিমাণে ডেন্টি ডইলিস (প্লেটবাসন রাখার লেসওয়ালা গোল ম্যাট) প্যাকেটের মধ্যে যত্ন করে ভরে রাখা হয়েছিল। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সব মেয়েরাই আসলে ধোয়াপাকলা আর জামাকাপড় ইস্ত্রি করতে পারে। কিন্তু একটি বাড়িকে স্বয়ংসম্পূর্ণ রূপ দিতে হলে যেমন একটি টেবিলকে পুরোপুরি রূপালি সাজসজ্জায় সজ্জিত করতে বা মাংস ছাড়াই রোস্ট বেইক করতে বা ভ্যাজিটেবল রান্না করতে কিন্তু অবশ্যই বাইরে থেকেই প্রশিক্ষণ নিতে হয়। প্রকৃতপক্ষে সবকিছুর উৎসই হচ্ছে অভ্যেস। আর আমি আমার দশ বছর বয়সে এসবকিছুরই শিক্ষা পেয়েছিলাম একজন সাদা নারীর রান্নাঘর থেকে।
পোস্ট অফিসের পেছনে তিন বেডরুমের একটি বাসায় মিসেস ভায়োলা কুলিন্যান নামের একজন বেশ মোটাসোটা সাদা নারী থাকতেন। তিনি হাসলেই শুধু তাকে কিছুটা আকর্ষণীয় মনে হতো। হাসির সঙ্গে সঙ্গে তার চোখমুখের বিচ্ছিরি কুঁচকানো দাগগুলো যা তার চেহারাকে বাজেভাবে বুড়োটে করে তুললো সেসব দূর হয়ে যেতো। তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠতো। তার মুখটি দেখলে মনে হতো যেন তিনি একটি ছোট্ট শয়তানের (বাইবেলে বর্ণিত ছোট্ট শয়তান) মুখোশ পড়ে আছেন। শেষ অপরাহ্ণে তার নারী বন্ধুরা তাকে দেখতে আসার আগ পর্যন্ত এবং তার আঙিনার ঘেরাটোপে বসে বসে আড্ডা দিতে দিতে তার বাবুর্চি মিসেস গ্লোরির পরিবেশিত ঠাণ্ডা পানীয়তে চুমুক দেওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি স্বাভাবিক মুখভঙ্গিতেই থাকতেন। তার মুখ মণ্ডলটিকে অকারণে অভিনয় করে হাসতে থাকা থেকে বিরত রেখে বিশ্রাম দিতেন।
তার বাড়িটি কোনো স্বাভাবিক বাড়ি ছিল না। এটি ছিল প্রকৃতপক্ষেই অমানবিক একটি বাড়ি। বাড়িটির ভেতর যে গ্লাসটি যেখানে থাকার কথা সেটি শুধু সেখানেই থাকবে অন্য কোথাও নয়। কাপ-পিরিচ রাখারও নির্দিষ্ট জায়গা আছে। আর তা যদি ভুলক্রমে দৈবাৎ অন্য কোথাও রাখা হয় তাহলেই বাড়িতে একটি অঘোষিত যুদ্ধবিগ্রহ হওয়ার উপক্রম হয়। কাটায় কাটায় দুপুর বারোটায় টেবিলে খাবার পরিবেশন করা হয়। দুপুর ১২:১৫ মিনিটে মিসেস ভায়োলা কুলিন্যান খাবার খেতে বসেন (সে সময়ের মধ্যে তার স্বামী খেতে আসুক বা না আসুক তাতে তার কিছুই এসে যায় না)। ঠিক ১২: ১৬ মিনিটে মিস গ্লোরি খাবার পরিবেশন করেন।
এখানে এসে কোনটা সালাদ রাখার প্লেট আর কোনটা রুটি রাখার প্লেট আর কোনটা মিষ্টি জিনিস খাওয়ার প্লেট সেটির পার্থক্য বুঝতে বুঝতে আমার এক সপ্তাহ লেগে গেলো।
এ কারণেই আসলে প্রচুর পরিমাণে মদ পান করার মাধ্যমে তিনি তার হতাশা দূর করে নিজেকে সচল রাখেন। একটি স্বাভাবিক জীবনযাপন করার চেষ্টা চালাতে থাকেন।
মিসেস কুলিন্যান তার ধনী পিতামাতার ঐতিহ্য ধরে রেখেছিলেন। তার আদি বাড়ি ছিল ভার্জিনিয়াতে। এদিকে মিসেস গ্লোরি তাদের ইতিহাস বলতে গিয়ে আমাকে বলেছিলেন যে তাদের বংশধরেরা বছরের পর বছর ধরে মিসেস কুলিন্যানদের গৃহদাশ হিসেবে কাজ করে আসছেন। তিনি আরও বললেন যে মিসেস কুলিন্যান তার চাইতে নিচু বংশের একজনকে বিয়ে করেছেন। ফলে তার স্বামী যথেষ্ট সম্পদশালী নন। তাদের যে পরিমাণে সহায় সম্পত্তি থাকার কথা সেটা না থাকায় তা দিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে শানশত কত করা সম্ভব না।
আমি মনে মনে ভাবলাম যে মিসেস কুলিন্যান যে একজন স্বামী পেয়েছেন এটাই বেশি। সেখানে তার স্বামীর বংশ উঁচু কী নিচু সেটা মোটেই কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কিন্তু আমি একটা ব্যাপার মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করলাম যে মিসেস গ্লোরিতার মনিব মিসেস কুলিন্যানের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের নিন্দামন্দ করার কোনো সুযোগই আমাকে দেন না। তিনি তার মনিবের প্রতি ভীষণ অনুগত ও বিশ্বস্ত। ফলে তিনি নিঃসন্দেহে আমার আচরণ ও গৃহকর্মের প্রতি যথেষ্ট ধৈর্য দেখাতেন। তিনি আমাকে বাসনকোসন সম্পর্কে, রুপোর তৈজসপত্র সম্পর্কে এবং গৃহকর্মীদের ডাকার বেল সম্পর্কে যথেষ্ট বিবরণ দিয়ে বিশ্লেষণ করতেন।
যে বিশাল আকারের বাটিটিতে স্যুপ পরিবেশন করা হতো সেটা কোনো স্যুপের বাটি ছিল না। সেটি ছিল একটি টুরিন (ঢাকনা দেওয়া এক ধরনের বিশেষ প্রকারের বাটি)। সেখানে গব্লেটস (মদ বা এ জাতীয় পানীয় খাওয়ার গ্লাস), শেরবেট (মিষ্টান্ন খওয়ার ডাণ্ডাওয়ালা বাটি), আইসক্রিম খাওয়ার গ্লাস, মদের গ্লাস, কফি খাওয়ার সবুজ রঙের কাপ এবং তার সঙ্গে ম্যাচিং করা পিরিচ ও পানি খাওয়ার গ্লাস থরে থরে সাজানো থাকতো। ওখানে আমার একটি পানি খাওয়ার নির্দিষ্ট গ্লাস ছিল এবং সেটা ছিল মিসেস গ্লোরির জন্য নির্ধারিত আলাদা একটি সেলফ থেকে দেওয়া। অন্যদের ব্যবহারের জন্য দেওয়া একটি গ্লাস। স্যুপের চামচ, গ্রেইভি বোট (চা/কফির সঙ্গে দুধ মেশানোর জন্য ব্যবহৃত ছোট জগ), মাখন কাটার ছুরি, সালাদ খাওয়ার কাঁটাচামচ এবং কারভিং প্ল্যাটার (সব্জি/মাছমাংস কাটার জন্য ব্যবহৃত কাঠের বা প্লাস্টিকের বোর্ড) এসবই ছিল আমার জন্য নতুন নতুন শব্দের ভাণ্ডার। সত্যি বলতে এই শব্দগুলো আমার সামনে একটি অভিনব ভাষার দুয়ার উন্মোচিত করে দিলো। মিসেস কুলিন্যানের এইসব অভিনবত্ব ও আভিজাত্যপূর্ণ জীবনযাপন এবং তার এলিস ইন দ্য ওয়ান্ডারল্যান্ডের মতো বাড়িটির প্রতি আমি যার পর নেই আসক্তি অনুভব করতে শুরু করেছিলাম।
আমার অতীত স্মৃতিতে মিসেস কুলিন্যানের স্বামীর কোনো স্পষ্ট ছবি নেই। পরবর্তীতে আমার সারাজীবন ধরে আমি যত অযাচিত সাদা পুরুষ দেখেছি এবং সেসব তুচ্ছ পুরুষ মানুষ যাদের আমি কখনোই দেখতে বা মনে করতেও চাইনি, মিসেস কুলিন্যানের স্বামীকে আমি তাদের মধ্যেই গুলিয়ে ফেলেছি। তার ভেতর এমন কোনো বিশেষ ব্যাপার ছিল না, যেন তাকে মনে রাখা যায়।
একদিন সন্ধ্যায় মিসেস গ্লোরির সঙ্গে বাসায় ফেরার পথে তিনি আমাকে বললেন যে মিসেস কুলিন্যান নিঃসন্তান। তিনি গর্ভে সন্তান ধারণ করতে পারেন না কারণ তার শরীরের হাড়গুলো অত্যন্ত অপুষ্ট ও ভঙ্গুর। মিসেস কুলিন্যানের থলথলে মাংসল শরীরের ভেতরে অবস্থিত তার লুকানো হাড়গোড়ের কথা কল্পনা করাও আমার পক্ষে সেসময় বেশ কষ্টকর কাজ ছিল। মিসেস গ্লোরি অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে আমাকে বলেছিলেন যে ডাক্তাররা মিসেস কুলিন্যানের সমস্ত নারী অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অপারেশন করে ফেলে দিয়েছেন। আমি আমার সে বয়সের বুদ্ধিবিবেচনা এবং যুক্তি দিয়ে এতটুকু বুঝতে পারলাম যে, একটি শুয়োরের শরীরের ভেতরেও তো ফুসফুস, হৃদপিণ্ড, যকৃৎ ইত্যাদি নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থাকে। তাহলে মিসেস কুলিন্যানের শরীরের ভেতরে যদি এসব প্রয়োজনীয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ না থেকে থাকে। এগুলো ছাড়াই যদি তাকে স্বাভাবিক জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়, তাহলে তো তার পক্ষে বোতল ভরে ভরে গাদাগুচ্ছের মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আর আমি এটাও বুঝতে পারলাম যে, এ উপায়েই হয়তো তিনি তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গহীন শরীরটিকে রক্ষা করে থাকেন। এ কারণেই আসলে প্রচুর পরিমাণে মদ পান করার মাধ্যমে তিনি তার হতাশা দূর করে নিজেকে সচল রাখেন। একটি স্বাভাবিক জীবনযাপন করার চেষ্টা চালাতে থাকেন।
চলবে…
আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-৩৬ ॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু