(পর্ব-৩৫)
অনুবাদ: ফারহানা রহমান
মিসেস ফ্লাওয়ারসের বানানো কুকিসগুলো একেবারে মজাদার ওয়েফারের মতই গোল ও চ্যাপ্টা ছিল। ওগুলোর চারপাশ ছিল মিষ্টি হালকা খয়েরি রঙের। মাঝখানে ছিল একেবারে হলুদ রঙের মাখনে ঠাসা। ঠাণ্ডা ল্যামোনেড দিয়ে যখন ওই বিস্কুটগুলো খাচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল সারাজীবনে আমি এত মজার কোনো খাবার খাইনি। এমন মজার কুকিস অতীতেও কখনো খাইনি। ভবিষ্যতেও হয়তো বা কখনো খাবো না। সেই দিনের সব স্মৃতি এখনো স্পষ্ট মনে করতে পারি। আমি লক্ষ্মী ছোট্ট মেয়ের মতোই একটি কুকির এক কোণায় খুব আস্তে করে দাঁত দিয়ে কেটে ছোট একটি টুকরো মুখের ভেতর নিয়েছিলাম।
আমার সঙ্গে গল্প করতে করতে মিসেস ফ্লাওয়ারস বলেছিলেন, এইসব কুকিস তিনি একমাত্র আমার জন্যই বানিয়েছেন। আর তিনি রান্নাঘরে বেশ কয়েকটি আলাদা করে তুলে রেখেছেন। যেন আমি বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় ওই বিস্কুটগুলো বেইলির জন্য নিয়ে যেতে পারি। আমার জন্য এত কিছু বানিয়েছেন বলে আমি একটি পুরো কেক নিয়ে মুখের ভেতর পাচার করে দিলাম। কেক থেকে গুঁড়ো ঝুরঝুরিগুলো পড়ে আমার সারা গালে মেখে গেলো। আর সেদিন যদি আমাকে মুখের ভেতরে থাকা কেকগুলো গিলতে না হতো তাহলে হয়তো আমার মনে মনে দেখা বহুদিনের একটি গোপন স্বপ্ন সেদিন পূরণ হয়ে যেতো।
আমি যখন খুব মনোযোগ দিয়ে কুকিগুলো একের পর এক খেয়ে যাচ্ছিলাম, মিসেস ফ্লাওয়ারস সেই সুযোগেই আমাকে আমার জীবনের পথে চলার জন্য অতি আবশ্যক প্রথম শিক্ষাটিতে দীক্ষিত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, আমাকে সারাজীবন ধরে একটি ব্যাপারেই অসহিষ্ণু হতে হবে। আর সেটা হচ্ছে অজ্ঞতা। কোনোকিছুর বিনিময়েই অজ্ঞতাকে জীবনে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। তবে মানুষের নিরক্ষরতা ও দারিদ্র্য সম্পর্কে সবসময়ই সহানুভূতিশীল হতে হবে। তিনি আরও বলেছিলেন, এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ তো আর স্কুলে গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া করার সুযোগ পায় না। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেলেই কেউ অশিক্ষিত রয়ে যায়।
হাজার হাজার বার যাজকদের বাইবেলের স্তবক পাঠ শুনে শুনে অভ্যস্ত আমার কান মুহূর্তের মধ্যেই বুঝে গেলো যে, তার কবিতা পড়া শেষ হতে চলেছে। আমি আসলে কবিতাটির কোনোকিছুই বুঝতে পারিনি। একেবারে আক্ষরিক অর্থেই একটি শব্দও বুঝতে পারিনি।
এই পৃথিবীতে এমন অনেক নিরক্ষর মানুষ রয়েছেন, যারা তাদের জীবনে হয়তো স্কুলে যাওয়ার কোনো সুযোগই কখনো পাননি। কিন্তু তারা কোনো কোনো কলেজের প্রফেসরের চেয়েও অনেক বেশি বোদ্ধা ও শিক্ষিত। তিনি সেই দিন আমাকে একটি বিশেষ জ্ঞান সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন, যা আমার পরবর্তী জীবন-চলাকে সহজ করে দিয়েছিল। সেটা হচ্ছে মনোযোগ দিয়ে সাধারণ মানুষের কথা শোনার অভ্যেস গড়ে তোলা। তিনি আমাকে উৎসাহিত করেছিলেন যেন আমি সাধারণ জনগণের স্বাভাবিক বোধবুদ্ধির ওপর সবসময় ভরসা রাখি। কারণ তাদের বোধবুদ্ধি ও কমনসেন্স প্রখর থাকে।
আমার কুকিস খাওয়া শেষ হতেই তিনি ঝটপট টেবিলটা পরিষ্কার করে ফেললেন। বই রাখার বুককেস থেকে ছোট অথচ দৃঢ় একটি বই বের করে দিলেন। আমি আগেই ‘অ্যা টেল অব টু সিটিস’ বইটি পড়েছিলাম। বইটি বেশ রোম্যান্টিক ছিল এবং আমার খুব ভালো লেগেছিল। তিনি বইটির প্রথম পৃষ্ঠা খুলে একটি অপূর্ব সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করে আমাকে শোনালেন। আমার জীবনে এই প্রথম কবিতার সঙ্গে পরিচিত হলাম। জীবনে এই প্রথমবারের মতো একটি অদ্ভুত কবিতা শুনলাম, ‘একদিকে এটি জীবনের সেরা সময় ছিল, অন্যদিকে এটিই ছিল জঘন্যতম সময়।’
প্রতিটি শব্দের সঙ্গে তার কণ্ঠস্বর পাহাড়ি রাস্তায় ভ্রমণের মতো করেই একবার ওপরের দিকে উঠছিল, আরেকবার তা যেন খাদের নিচে গড়িয়ে পড়ছিল। তার কবিতার আবৃত্তি শুনে মনে হচ্ছিল, তিনি যেন গান গাইছেন। তার আবৃত্তি থেকে কেমন যেন এক অপূর্ব সুরের মূর্ছনা ভেসে আসছিল। আমি বইয়ের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করেছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম মিসেস ফ্লাওয়ারস যে মধুর মূর্ছনা ছড়িয়ে দিয়ে কবিতাটির আবৃত্তি করেছিলেন, প্রকৃতপক্ষেই কি কবিতাটি তেমনভাবেই লিখিত ছিল? না কি তিনি নিজে থেকেই এমনভাবে মনের মাধুরী মিশিয়ে পড়ছিলেন? না কি ওই বইটির ভেতরে আসলে নানারকম তথ্য ও বিবরণ নোট করা ছিল? না কি একটু পরপর সেখানে কবিতার সঙ্গে গানও লেখা ছিল? না কি লেখার মাঝখানে লাইন দিয়ে রুল টানা ছিল? ঠিক যেমন থাকে পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলোতে? ধীরেধীরে তার স্বরের গতি কমতে লাগলো। হাজার হাজার বার যাজকদের বাইবেলের স্তবক পাঠ শুনে শুনে অভ্যস্ত আমার কান মুহূর্তের মধ্যেই বুঝে গেলো যে, তার কবিতা পড়া শেষ হতে চলেছে। আমি আসলে কবিতাটির কোনোকিছুই বুঝতে পারিনি। একেবারে আক্ষরিক অর্থেই একটি শব্দও বুঝতে পারিনি।
পড়া থামিয়ে খুব কোমল স্বরে আমার দিকে তাকিয়ে তিনি জানতে চাইলেন, ‘কেমন লেগেছে তোমার কাছে কবিতাটি?’ একটা ব্যাপার আমি স্পষ্টতই বুঝতে পারলাম যে, তিনি আসলেই আমার অভিমত জানতে চাইছেন। কেকের ভেতরের ভ্যানিলার সেই অপূর্ব মিষ্টি গন্ধের স্বাদ তখনো আমার জিভে লেগে ছিল। আর তার আবৃত্তির অভাবনীয় সুরের মূর্ছনা বেজে চলেছিল আমার কানের গভীরে। আমার তখন উত্তর না দিয়ে আর কোনো উপায় ছিল না। আমাকে কথা বলতেই হতো। বললাম, ‘খুব সুন্দর, ম্যাম!’ এরচেয়ে সংক্ষিপ্ত কোনো উত্তর আমার জানা ছিল না। আর অনেক আগে থেকেই তো আমি এরচেয়ে বেশি কথা বলার মতো ভাষাও হারিয়ে ফেলিছিলাম।
আমার এই ভালো লাগার পেছনের মূল কারণ হচ্ছে, আমি সেদিনই প্রথম নিজেকে নিজে সম্মান করার ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম, যা পরবর্তী সময়ে আমার জীবনে আমাকে মহিমান্বিত করেছিল।
তিনি মিষ্টি করে হেসে বললেন, ‘আচ্ছা শোনো। আরেকটি জরুরি কথা আছে কিন্তু তোমার সাথে। তুমি কিন্তু এই বইটি বাসায় নিয়ে যাবে এবং এর ভেতর থেকে অন্তত একটি কবিতা অবশ্যই মুখস্ত করে ফেলবে। এরপর যেদিনই তুমি আমাকে দেখতে আসবে, আমি চাই তুমি অবশ্যই এখান থেকে অন্তত একটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনাবে।’
পরবর্তী সময়ে আমার এই বহুল অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, আভিজাত্যপূর্ণ ও গৌরবান্বিত জীবন অতিবাহিত হওয়ার সময়গুলোতে আমি বহুবছর ধরে বোঝার চেষ্টা করেছি, বলা যায় গভীরভাবে অনুসন্ধান করেছি যে, কী এমন জাদুকরী ব্যাপার ছিল সেই ছোট্ট উপহারগুলোর ভেতরে, যা আমাকে আর আমার এই জীবনটাকে সম্পূর্ণরূপে বদলে দিয়েছিল? আসলে মানুষের জীবনে যাপিত সময় থেকে বহু রঙ বহুসময় মুছে যায় কিন্তু সেই রঙের আভা জীবনে আসলে রয়েই যায়। অপরিচিত মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে প্রবেশ করতে দেওয়ার অনুমতি পাওয়া এবং তাদের দুঃখবেদনা, আনন্দের ভাগীদার হওয়া কিন্তু মানুষের জীবনে অভিজ্ঞতা আদানপ্রদানের সুযোগ এনে দেয়। এই ধরনের অভিজ্ঞতা আদানপ্রদানকে এমন কিছুর সঙ্গেই তুলনা সম্ভব, যেন বেওউলফের এক কাপ মধুময় মদের তৈরি ককটেলের সঙ্গে অথবা অলিভার টুইস্টের এক কাপ দুধ-চায়ের সঙ্গে দক্ষিণের ঔষধি হজমির আদান-প্রদান হচ্ছে।
এইসব বিষয় বোধগম্য হওয়ায় তখনই আমি চিৎকার করে বলে উঠেছিলাম, ‘এটি অনেক অনেক দারুণ একটি ঘটনা আমার সঙ্গে ঘটে গেলো। এতই অসাধারণ একটি ব্যাপার হয়ে গেলো আমার সঙ্গে, যা জীবনে আগে কখনোই হয়নি।’ অভাবনীয় আনন্দের অশ্রুতে আমার দুচোখ একেবারে টইটুম্বর ভরে উঠেছিল।
সেইদিনই প্রথম আমি পাহাড়ের ওপর থেকে নাচতে নাচতে একেবারে দৌড়ে দৌড়ে একদম নিচের রাস্তায় নেমে এসেছিলাম। আমি নিশ্চিত যে, আমার মতো এত দ্রুত গতিতে পাহাড় থেকে নেমে আসা কোনো গাড়ির পক্ষেও সম্ভব নয়। আর আমি যেভাবে পাহাড় থেকে দ্রুত গতিতে নেমে নিচে অবস্থিত আমাদের স্টোরের ভেতর এসে নিজের গতি রোধ করেছিলাম, সেটাও নিশ্চিতভাবে কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।
আমি সবচেয়ে বেশি অভিভূত হয়েছিলাম এটা ভেবে যে, আমি আসলে মিসেস হ্যান্ডারসনের নাতনি বা বেইলির বোন হিসেবে সম্মানিত হইনি। বরং আমি নিজেই যে মার্গারেট জনসন সেজন্যই সম্মানিত হয়েছিলাম। আমার এই ভালো লাগার পেছনের মূল কারণ হচ্ছে, আমি সেদিনই প্রথম নিজেকে নিজে সম্মান করার ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম, যা পরবর্তী সময়ে আমার জীবনে আমাকে মহিমান্বিত করেছিল।
চলবে…
আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-৩৪॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু