অনুবাদ: ফারহানা রহমান
(পর্ব-৩৩)
মিসেস ফ্লাওয়ারসকে আমার কাছে সবসময়ই ভীষণ আকর্ষণীয় এবং আবেদনময়ী মনে হতো। তার একটি কারণ অবশ্য আমি তার মতো অন্য কারও সঙ্গে আগে কখনো ব্যক্তিগতভাবে মেলামেশা করিনি। এমনকি তার মতো কারও সঙ্গে আমার কখনো আসলে দেখাই হয়নি। তাকে দেখে মনে হতো তিনি যেন ইংরেজি উপন্যাসে বর্ণিত সেইসব সম্ভ্রান্ত রমণীর একজন, যিনি কিনা একটি গৃহপালিত-বিশ্বস্ত ছুটন্ত কুকুর নিয়ে ভ্রমণে বের হওয়া এক ভৃত্যের সঙ্গে সম্মানজনক দূরত্ব নিয়ে হেঁটে চলেছেন। তাকে সেইসব সম্ভ্রান্ত রমণীদের মতো মনে হতো, যারা জ্বলন্ত ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে বসে অবিরাম রুপোর ট্রে থেকে নিয়ে চা-বিস্কিট, হালকা মিষ্টি কেক বা ডিম দিয়ে তৈরি পিঠা খেয়েই চলেছেন। তিনি ছিলেন সেই ব্যতিক্রমধর্মী নারীদের মতো, যারা সুস্বাস্থ্য রক্ষা করার জন্য প্রতিদিন নিয়ম করে হাঁটেন এবং মরক্কো থেকে বাঁধাই করে আনা দামি দামি বই পড়েন। তিনি তাদের মতোই ছিলেন, যে সব নারীর নামের শেষের দুটি উপাধি হাইপেন দিয়ে বিভক্ত করা থাকে। এত কিছু বলার চেয়ে একটি মাত্র কথা বলাই যথেষ্ট, মিসেস ফ্লাওয়ারস এমনই একজন মানুষ ছিলেন, যাকে দেখে আমার নিগ্রো হিসেবে জন্ম নেওয়া নিয়ে গর্বিত বোধ করতাম।
তার আচার-আচরণ এতটাই নিখুঁত ছিল, ঠিক যেমন থাকে বইয়ের ভেতরের বর্ণিত নায়কনায়িকাদের আচরণের বিবরণ। যেমন আমরা দেখতে পাই সিনামায় অভিনয় করা সাদা নায়ক-নায়িকাদের নিখুঁত আচরণ। সত্যি কথা বলতে কী, আমার মনে হয় তিনি আসলে তাদের চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর ছিলেন। কারণ হচ্ছে আমার ধারণা, তাদের যদি সাজসজ্জাহীনভাবে আমাদের চোখের সামনে দেখতে পাই, তাহলে আর তাদের আসলে এত সুন্দর লাগবে না।
আসলে আমি আমার নিজের জন্য আর সংসারের জন্য যেভাবে নিরলস কাজ করে চলেছি একইভাবে আমি বাইরের কাজও কিন্তু সমালতালে সামলাই। তুমি স্টোরের ভেতরে এসে বস না সিস্টার! দূরে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
আমার সৌভাগ্য যে আমি তাকে কখনোই সাদা মানুষদের সঙ্গে ঘেঁষতে বা ভিড় করতে দেখিনি। যেহেতু সাদা মানুষরা তাদের শরীরের এই শ্বেত রঙের জন্য নিজেদের সবার থেকে ব্যতিক্রমী এবং পবিত্র বলে মনে করে, সেহেতু তিনি যদি সাদাদের এইজন্যই গুরুত্বপূর্ণ মনে করে তাদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন বা কথা বলতেন, তাহলে কিন্তু তাকে শুধু একজন বেরথা নামক মহিলা হিসেবেই ভাবতাম। তার প্রতি আমার যে বিশেষ শ্রদ্ধা ও ভক্তিপূর্ণ আচরণ ছিল, তাহলে সেটা আর কখনোই থাকতো না। আর তার ভাবমূর্তি আমার কাছে শুধু বিখ্যাত হামটিডামটি’র চরিত্রের মতোই হাস্যকর অবস্থায় পরিণত হতো।
এখনো আমার স্মৃতিতে মিষ্টি দুধের সরের মতোই সতেজ হয়ে আছে গ্রীষ্মের সেই মায়াবী বিকেলটি, যেদিন মিসের ফ্লাওয়ার কিছু প্রয়োজনীয় রসদ কিনতে আমাদের স্টোরে এসেছিলেন। তারই বয়সী এবং একই ধরনের স্বাস্থ্যের অধিকারী অন্য যে কেউ হলেই কিন্তু মোমা পেপারের ব্যাগে করে সব জিনিসপত্রসহ বিলটি তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিদায় করে দিতেন। কিন্তু মিসেস ফ্লাওয়ারসের বেলায় তিনি তা না করে বরং বললেন, সিস্টার ফ্লাওয়ারস, তোমাকে এসব বহন করে নিতে হবে না। আমি তোমার রসদগুলো প্যাকেট করে বেইলিকে দিয়ে তোমার বাসায় পাঠিয়ে দিচ্ছি।
তিনি এমনই অদ্ভুতভাবে মৃদু হেসে উঠলেন, যা দেখে আমরাও সবাই হেসে দিলাম। তিনি মোমাকে বললেন, অনেক অনেক ধন্যবাদ মিসেস হ্যান্ডারসন! তবে আমি খুব খুশি হতাম যদি আপনি বেইলিকে না পাঠিয়ে মার্গারেটকে দিয়ে রসদগুলো আমার বাড়িতে পাঠাতেন। আমি আসলে বোঝাতে চাচ্ছি যে, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে আমি ওর সঙ্গে একটু গল্পগুজব করতে চাই। ওকে আসলে আমি খুব পছন্দ করি। কথাগুলো বলেই তারা দুজন দুজনের দিকে দূর থেকে খুব অর্থবোধক দৃষ্টিতে তাকালেন। আর এদিকে আমার মন প্রশান্তিতে ভরে গেলো। আহা! আমার নামটা কতই না মধুর শোনায়, যখন তিনি আমাকে মার্গারেট বলে ডাকেন।
আমার দিকে তাকিয়ে মোমা বললেন, ঠিক আছে কোনো অসুবিধা নেই। তাহলে তাই হোক। ছোট্ট আপুটা তাহলে তুমি যাও এখন জামাকাপড় বদলে নাও। খুব সুন্দর একটি ফ্রক পরে তুমি সিস্টার ফ্লাওয়ারসের বাসায় ওর সাথে সাথে যাও।
এরপর জামা বদলাতে এসে আমার কাছে মনে হতে লাগলো যে, আমি যেন কোনো ওয়ারড্রবের ভেতরের কাপড়চোপড় দেখছি না। বরং কাপড়-জামা দিয়ে তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ানক গোলকধাঁধায় আমি আটকে গেছি। এই পৃথিবীতে এমন কোনো ড্রেস এখন পর্যন্ত তৈরি হয়েছে, যা পরে আমি মিসেস ফ্লাওয়ারসের বাড়িতে যেতে পারি? আমি এতটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে, রবিবারের ফর্মাল পোশাক পরে অন্তত তার বাসায় যাওয়া যাবে না। তাহলে ব্যাপারটা খুব উদ্ভট ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। রবিবারে পরার জামাকাপড়গুলোতে আসলে বাসায় পরার মতো ড্রেস নয়। ওগুলো পরে বেড়াতে বা কোনো পার্টিতে যাওয়া যায়। তাছাড়া যেহেতু আমি তখনো একটি নতুন পরিষ্কার জামাই পরে ছিলাম, ফলে অন্য কোনো বাসায় পরার ড্রেস না পরে আমি স্কুল ড্রেসটাই পরলাম। মিসেস ফ্লাওয়ারসের বাসায় যাওয়া আর গির্জায় প্রার্থনা করতে যাওয়া যেহেতু আমার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র একটি ব্যাপার ছিল, তাই সেখানে যাওয়ার জন্য স্কুল ড্রেসটাকেই বেছে নিয়েছিলাম।
আর তারপর সেই ড্রেস পরে নিজের ওপর পুরোপুরি ভরসা রেখেই স্টোরে ফিরে এসেছিলাম। তিনি আমাকে দেখেই বললেন, বাহ! তোমাকে তো খুব সুন্দর লাগছে! এই প্রথমবারের মতো আমি তাহলে একেবারে সঠিক জিনিসটাকেই বেছে নিয়েছিলাম বলে নিজেকে ধন্যবাদ দিলাম।
এবার শুরু হলো মোমা ও মিসেস হ্যান্ডারসনের কথোপকথন।
-মিসেস হ্যান্ডারসন! বাচ্চাদের বেশির ভাগ ড্রেসই তো আসলে আপনি নিজের হাতেই তৈরি করে দেন। তাই না?
-হুম। সেটা অবশ্য একেবারে ঠিক কথাই বলেছ তুমি ম্যাম! আমি নিজের হাতেই ওঁদের সব পোশাক তৈরি করে দেই কারণ দোকান থেকে কেনা রেডিমেইড ড্রেসগলোর সেলাই দু’দিনেই খুলে যায়।
-আমি অবশ্যই স্বীকার করছি, আপনি কিন্তু দারুণ একটা কাজ করছেন। আপনি যে এত সুস্থ্-সুন্দরভাবে চিন্তাভাবনা করতে পারেন সেটা ভাবতেই খুব ভালো লাগে। সত্যিই আপনাকে নিয়ে গর্ব হয় মিসেস হ্যান্ডারসন। ড্রেসগুলো দেখে মনে হচ্ছে যেন একজন প্রফেশনাল দর্জিই এগুলো তৈরি করেছে। সত্যি দারুণ! ভীষণ ভালো।
মোমা এভাবে খুব কমই প্রশংসা পান ফলে তিনি মিসেস ফ্লাওয়ারসের কাছে থেকে প্রশংসা পেয়ে ভীষণ খুশি হয়ে উঠলেন। যেহেতু এখানকার আমাদের চেনাজানা সবাই খুব ভালো সেলাই করতে পারে। ফলে (তবে অবশ্যই মিসেস ফ্লাওয়ারস ছাড়া) খুব নিখুঁত শিল্পকর্ম ছাড়া এখানে কেউ কাউকে কখনো অন্যের কাজের জন্য প্রশংসা করে না। প্রশংসার জবাবে মোমা বললেন, আমি তো সবসময় আল্লাহ্র উপর ভরসা রেখেই যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাই সিস্টার ফ্লাওয়ারস। আসলে আমি আমার নিজের জন্য আর সংসারের জন্য যেভাবে নিরলস কাজ করে চলেছি একইভাবে আমি বাইরের কাজও কিন্তু সমালতালে সামলাই। তুমি স্টোরের ভেতরে এসে বস না সিস্টার! দূরে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
আর মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলাম যেন এই অসহ্য গরমের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি সানস্ট্রোক করে মরে পরে থাকি। আর তারা দুজন বাইরে এসে যেন দেখে যে আমি বাড়ির সামনের এই তিনকোণা বারান্দার মাঝখানে মরে পড়ে আছি।
সিস্টার ফ্লাওয়ারসের বাসায় যাওয়ার জন্য আমি আমার সার্টের কলারের বোতামটাও আঁটকে নিয়েছিলাম। এপ্রোন পরার মতো করে বেল্টটাকে পেছনে নিয়ে টাইট করে পরেছিলাম। মোমা আমাকে ঘুরে দাঁড়াতে বললেন। ঘুরে দাঁড়াতেই তার এক হাত দিয়ে টান দিয়ে আমার বেল্টের ফিতে খুলে দিলেন। এরপর তার বিশাল বড় বড় দুই হাত দিয়ে আমার জামার সামনের বোতামগুলো খুলে দিতে লাগলেন। এসব কী হচ্ছে আমার সঙ্গে? আমি আতঙ্কে একেবারে নীল হয়ে গেলাম।
আমার জামার হেমের ওপর হাত দিয়ে ধরে তিনি আমাকে বললেন, জামাটা খুলে দাও তো ছোট্ট সোনামণিটা!
মিসেস ফ্লাওয়ারস মোমার উদ্দেশে বললেন, আমি বলি কী, মিসেস হ্যান্ডারসন! আমি আসলে জামাটার ভেতরটা এখন দেখতে চাচ্ছি না।
কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। মোমা টান দিয়ে ড্রেসটা আমার মাথার ওপর দিয়ে টেনে খুলে ফেলেছেন। শুধু আমার দু’হাতে তখনো জামার হাতাগুলো ঝুলে ছিল।
মোমা আমাকে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে এতটুকু খুললেই হবে। আর শোনো সিস্টার ফ্লাওয়ারস, এদিকে এসে দেখে যাও যে কিভাবে আমি জামাটার হাতার চারপাশে ফ্রেঞ্চ সেলাই করে দিয়েছি, যাতে হাতাটা কক্ষনো খুলে না যায়। জানোই তো এখনকার বাচ্চারা ক্যামন সারাদিন পাগলের মতো লাফঝাঁপ দিতেই থাকে। বাচ্চাগুলোর এই অসহ্য লাফালাফি দেখে মনে হয় ওরা যেন কাপড়ের পোশাক নয় বরং স্পাতধাতু দিয়ে তৈরি কোনো পোশাক পরে লাফাচ্ছে। ওরা আসলে পোশাকের সাথে ভীষণ উগ্র আচরণ করে, বুঝলে!
তখনো আমার মুখের ওপর ফ্রকটা ঝুলে ছিল। আর আমি কাপড়ের পর্দার ভেতর দিয়ে ছায়ার মতো করে তাদের আচরণ ও শরীরের নড়াচড়া সব দেখতে লাগলাম।
-এটা তো আসলে সত্যি খুবই আনন্দের কথা। তোমার এত অসাধারণ কাজের জন্য তো তোমার গর্ব করা উচিত। আচ্ছা ঠিক আছে মারগারেট, তুমি এখন তোমার জামাটা পরে নিতে পারো।
-না না, ম্যাম! গর্ব করা বা অহঙ্কার করা মনেই তো পাপ! আর আমাদের পবিত্র গ্রন্থে তো এটা লেখাই আছে যে, অতি বাড় বেড়ো না, ঝড়ে ভেঙে যাবে।
-তা অবশ্য ঠিকই বলেছ। আর বাইবেলে যখন এটা লেখাই আছে তাহলে তো কথাটা সবসময় মনে রাখা উচিত, তাই না মিসেস হ্যান্ডারসন!
আমি তাদের দুজনের কারও দিকেই তাকাতে পারছিলাম না। মোমা আসলে কল্পনাই করতে পারেননি যে, মিসেস ফ্লাওয়ারসের সামনে এভাবে আমার ড্রেসটা খুলে নেওয়ার মানে হচ্ছে আমাকে জ্যান্ত গলা টিপে মেরে ফেলা। আমি ওদের সামনে জীবন্মৃত হয়ে পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি যদি তখন মোমাকে জামাটা খুলতে বাধা দিতাম, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি ভেবে নিতেন, আমি সেন্ট লুইসের সেই দুর্ঘটনার কথা মনে করেই একজন বয়স্ক নারীর মতো তার সামনে আচরণ করছি। আর তাই হয়তো তাকে জামাটা খুলতে বাধা দিচ্ছি। তাছাড়া মিসেস ফ্রাওয়ারসও তো বুঝে যেতেন যে তার সামনে জামাটা খুলতে আমি প্রকৃতপক্ষে বিব্রতবোধ করছি। আর সেটা হতো আমার জন্য আরও অনেক বেশি লজ্জাজনক।
আমি চুপচাপ মাটি থেকে সব রসদের প্যাকেটগুলো তুলে নিয়ে সোজা বাইরে চলে গেলাম। গ্রীষ্মের ভয়াবহ রোদের তাপের নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুড়তে লাগলাম। আর মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলাম যেন এই অসহ্য গরমের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি সানস্ট্রোক করে মরে পরে থাকি। আর তারা দুজন বাইরে এসে যেন দেখে যে আমি বাড়ির সামনের এই তিনকোণা বারান্দার মাঝখানে মরে পড়ে আছি।
চলবে…
আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-৩২॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু