ফারহানা রহমান
পর্ব-৩২
একটি পুরাতন বিস্কুট বা পাউরুটির মতো করেই আমি প্রায় এক বছর ধরে আমার আশেপাশের সমস্ত ইংগিতপূর্ণ কথাবার্তা আর নোংরামিগুলো নিজের মধ্যে শুষে নিতে লাগলাম। আমি আমাদের বাড়ির, স্টোরের, স্কুলের ও চার্চের সব সমালোচনা এবং অশোভন আচরণ শোষণ করে নিয়ে নিজের ভেতরে এক অসহনীয় যন্ত্রণার অনুভূতি জমাট বাঁধতে দিচ্ছিলাম। আর ঠিক সেই সময়ই এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটলো! যা আমার এই ক্ষুদ্র জীবনকে একেবারে বদলে দিয়েছিল। আমি পরিচিত হলাম অথবা বলা যায়, আমার সঙ্গে পরিচয় হলো এমন একজন অসাধারণ রমণীর, যিনি প্রকৃতপক্ষেই ওই সময় আমার জীবনের প্রথম পদপ্রদর্শক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
মিসিস বেরথা ফ্লাওয়ার ছিলেন স্ট্যাম্পসের কালো মানুষের মধ্যে একজন অভিজাত নারী। তার ভেতর এমনই এক মহিমান্বিত ব্যাপার ছিল, যা তার চারপাশের শীতলতম পরিবেশকেও ভীষণভাবে উষ্ণতায় ভরিয়ে দিতে পারতো। আরকান্সাসের গ্রীষ্মের দিনগুলোতে তাকে দেখলে মনে হতো যেন তার নিজের ভেতরেই এমন এক মৃদুমন্দ বাতাসের গতি প্রবাহিত হতে দিতেন, যা গ্রীষ্মের অসহনীয় গরমেও তাকে এবং তার চারপাশের পরিবেশকে সুশীতল ছায়ায় ঢেকে রাখতে পারতো। মিসেস বেরথার শারীরিক গড়ন ছিল বেশ হালকা-পাতলা ধরনের। কিন্তু তাকে দেখে কখনোই খেলোয়াড়দের মতো টানটান পেশীবহুল বা রুক্ষ একজন মানুষ বলে মনে মনে হতো না। তিনি দেখতে ছিলেন প্রকৃতপক্ষেই ভীষণ স্নিগ্ধ ও কোমল। তার প্রিন্টেড ভয়েল কাপড়ের পোশাক এবং নানা রঙের ফুলযুক্ত মাথার হ্যাটটা তাকে এতটাই মানাতো, ঠিক যেমন করে একজন কৃষককে ডেনিম পরিহিত অবস্থায় খুব মানায়। এই শহরের সাদা নারীদের মধ্যেকার সবচেয়ে ধনী শুভ্র সুন্দরী রমণীকে টেক্কা দেওয়ার মতো সব গুণ মিসেস বারথারের মধ্যে ছিল।
বরইয়ের খোসা ছেলার পর ঠিক যেমন মসৃণ ও জ্বলজ্বল করতে থাকে ঠিক তেমনই ছিল মিসেস বারথারের ত্বকের অদ্ভুত ধরনের মসৃণ-সমৃদ্ধ কালো রঙটি। কিন্তু এতকিছুর পরেও কারোই সাধ্য ছিল না তার পোশাক নিয়ে সমালোচনা করার বা তার ত্বকের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করার। ব্যক্তিত্ব তার গাম্ভীর্য তাকে এতটাই সমৃদ্ধ করেছিল যে, তিনি অন্যদের গায়ে পরা ভাবকে কখনোই পাত্তা দিতেন না। তিনি সবসময়ই একজন স্থিতধী সম্ভ্রান্ত নারীর মতোই দু’হাতে গ্লাভস পরে চলাফেরা করতেন।
আমার কখনো মনে পড়ে না যে মিসেস ফ্লাওয়ারকে আমি কোনোদিন হা হা করে অট্টহাসি দিয়ে হাসতে দেখেছিলাম। তবে তার ঠোঁটে সবসময় স্মিত হাসি ঝুলে থাকতো। মাঝে মাঝে তার কালো অথচ অদ্ভুত সুন্দর পাতলা দুই ঠোঁটের ভেতর দিতে ছোট ছোট মসৃণ শুভ্র দাঁতগুলো বেরিয়ে আসতো। আবার মুহূর্তের বিরতিতে ঠোঁট দুটো বুজেও যেতো। তিনি মাঝেমাঝে আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসি হাসতেন। তার সেই হাসি দেখে আমার মনপ্রাণ জুড়িয়ে যেতো। আমি তার প্রতি ভীষণ কৃতজ্ঞবোধ করতাম। আমাদের ভেতরের এই সৌজন্যের আদানপ্রদান ছিল সম্ভ্রান্ত, সৌম্য ও কোমল।
আমি সে ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিত ছিলাম, কারণ হচ্ছে আমার দাদি কখনোই মুখ চেপে মুচকি হাসি হাসতেন না। আর একসময় এভাবেই দুজনের খোশগল্প শেষ হলে, মিসেস ফ্লাওয়ার সুস্থিরভাবে ধীরেধীরে হেঁটে হেঁটে নিজের বাড়ির দিকে রওনা হতেন।
পরবর্তী সময়ে আমি আমার সারাজীবন ধরে খুব অল্প যে সব উচ্চশিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত, বিনয়ী ভদ্রমহিলার সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছিলাম, নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে মিসেস ফ্লাওয়ার ছিলেন তাদের অন্যতম। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত আমার জীবনে তার অবদানের কথা সবসময় মনে করেছি আর সবার কাছে তা স্বীকারও করেছি। একজন মানুষ আরেকজন মানুষের জীবনে ঠিক যতটা ইতিবাচক অবদান রাখতে পারেন, তিনি আমার জীবনে ততটাই রেখেছিলেন।
মোমার সঙ্গে মিসেস ফ্লাওয়ারের সম্পর্কটা ভীষণ অদ্ভুত ছিল। যখনই তিনি স্টোরের সামনে দিয়ে রাস্তার ওপর দিয়ে হেঁটে যেতেন, অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে মৃদুস্বরে মোমাকে অভিবাদন করে বলতেন, ‘সুপ্রভাত মিসেস হ্যান্ডারসন!’
মোমাও সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিতেন, ‘শুভ সকাল! সিস্টার ফ্লাওয়ার! কী খবর তোমার?’
মিসেস ফ্লাওয়ার কিন্তু আমাদের চার্চের সঙ্গে খুব একটা যুক্ত ছিলেন না, এমনকি তিনি যে মোমার খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন ছিলেন, তাও কিন্তু নয়! তাহলে কেন যে মোমা তার মতো একজন সম্ভ্রান্ত ভদ্রমহিলাকে সারাক্ষণ সিস্টার সিস্টার বলে ডাকেন, সেটাই আমি বুঝতে পারতাম না। এসব ঘটনা দেখে খুবই বিব্রতবোধ করতাম আর লজ্জায় মুখ দেখাতে পারতাম না। মোমা তো তাকে সিস্টার না বলে অন্য কিছু বলেও সম্বোধন করতে পারেন। মিসেস ফ্লাওয়ারের তো আরও বেশি সম্মান পাওয়ার যোগ্যতা আছে। তাহলে মোমা কেন তাকে জিগ্যেস করেন না যে, ‘আপনি ক্যামন আছেন মিসেস ফ্লাওয়ার?’ কেন শুধু শুধু সিস্টার সিস্টার বলে তাকে অসম্মান করেন? অল্পবয়সের অস্থিরতা, মোহ, অনুরাগ ও আসক্তি নিয়ে আমি ওই সময় মিসেস ফ্লাওয়ারের প্রতি মোমার উপেক্ষা ও অনাগ্রহকে মনে মনে ভীষণ ঘৃণা করতাম। পরবর্তী সময়ে আমার বহুবছর লেগেছিল এটা বুঝতে যে, তারা দুজন আসলেই একেবারেই আপন বোনের মতোই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। যদিও বা তাদের একজন ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই উচ্চশিক্ষিত এবং আরেকজন ছিলেন স্বশিক্ষিত একজন মানুষ।
যদিও বা আমি ওই সময় সবকিছু নিয়েই ভীষণভাবে বিষণ্ণতায় ভুগতাম তথাপি সেই দুজন সম্মানিত নারীর কেউ আমার সেই মানসিক বিপর্যয়ের আঁচ পেতেন না। আমার ভেতরে যে আমি একজন নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও অনুরক্তি বয়ে বেড়াচ্ছি আর আরেকজনের প্রতি অশ্রদ্ধা এবং ঘৃণা, সেটা কিন্তু তারা দুজনের কেউই টের পাননি। মিসেস ফ্লাওয়ার খুব সহজ স্বাভাবিক ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতেই স্টোরে আসা-যাওয়া করতে লাগলেন। একইভাবে পাহাড় বেয়ে উঠে তার ছোট্ট বাংলোতে ফিরে যেতে লাগলেন। মোমাও প্রতিদিন নিয়ম করে সামনের বারান্দায় এসে বসে বসে তার প্রয়োজনীয় নানা কাজ করতেন। ঝুড়ি থেকে নিয়ে নিয়ে ছিল্কা ছিলে মটরশুঁটির দানাগুলো বের করে বাটিতে রেখে দিতেন।
কখনো কখনো হঠাৎ হঠাৎ মিসেস ফ্লাওয়ার রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যাওয়ার পরিবর্তে আমাদের স্টোরের ভেতরে এসে বসতেন। আর সেই সময়গুলোতে মোমা আমাকে কাছে ডেকে বলতেন, ‘আমার ছোট্ট আপুটা, শোনো, এখন তুমি একটু স্টোরের বাইরে গিয়ে খেলাধুলো করো গে যাও, সিস্টার ফ্লাওয়ার এসেছেন, আমরা দুজন একটু নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলি।’ ওই সময় আমি যেতে যেতে পেছন থেকে ভেসে আসা তাদের ভেতরের অন্তরঙ্গ কথাবার্তার কিছু কিছু অংশ শুনতে পেতাম। পেছন থেকে শুনতে পেতাম মোমা অবিরত ভুলভাল শব্দ ব্যবহার করে সিস্টার ফ্লাওয়ারের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা চালিয়ে যাচ্ছেন।
মোমা বলছেন, ‘অবশ্যই ব্রাদার উইলকক্স এবং সিস্টার উইলকক্স হচ্ছে সে একজন খুব গড়পড়তা মানুষ।’ আমি তার ভুলভাল কথা শুনে মনে মনে বলতাম, ‘ওহহো! মোমা! এখানে কি সে একজন হবে? এখানে তো ওরা দুজন তাহলে আপনি কেন ওঁদের দুই ভাইবোনকে একজন মানুষ বলছেন? ওহ মোমা! প্লিজ বোঝার চেষ্টা করুন এখানে কিন্তু দুজন হবে, একজন নয়।’
কিন্তু মোমা তো আমার কথা শুনতে পেতেন না। ফলে তিনি ওভাবেই কথা চালিয়ে যেতেন। আর সিস্টার ফ্লাওয়ার কোনো উচ্চবাচ্য না করেই সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। এদিকে আমি স্টোরের দেয়ালের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মোমার এসব ভুলভাল কথাবার্তা শুনতাম আর মনে প্রাণে চাইতাম যে আমার পায়ের নিচের মাটি যেন ফাঁক হয়ে দুভাগ হয়ে যায় আর আমাকে গিলে ফেলে। আর চাইতাম আমি যেন এই দ্বিখণ্ডিত মাটির ভেতরেই ডুবে মরি। আমি দূর থেকে স্পষ্ট শুনতে পেতাম, মিসেস ফ্লাওয়ারের কোমল কণ্ঠস্বর আর আমার দাদির গমগমে কণ্ঠস্বর মিলেমিশে একেবারে একাকার হয়ে যাচ্ছে। মাঝেমাঝে মিসেস ফ্লাওয়ারের চাপা হাসির শব্দে তাদের জমজমাট আলোচনার ছন্দপতন ঘটতো। আমি নিশ্চিতভাবেই জানতাম যে, আমার দাদির উল্টোপাল্টা কথা শুনে মিসেস ফ্লাওয়ারই মুখচাপা দিয়ে মিচকি-মিচকি হাসছেন। আমি সে ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিত ছিলাম, কারণ হচ্ছে আমার দাদি কখনোই মুখ চেপে মুচকি হাসি হাসতেন না। আর একসময় এভাবেই দুজনের খোশগল্প শেষ হলে, মিসেস ফ্লাওয়ার সুস্থিরভাবে ধীরেধীরে হেঁটে হেঁটে নিজের বাড়ির দিকে রওনা হতেন।
চলবে…
আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-৩১॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু