পর্ব-২৭
অনুবাদ: ফারহানা রহমান
বয়স্ক মানুষদের মতো পরিপক্ব মগজ নিয়ে জন্ম নেওয়া বেইলি (সেই সময় সে নিজেকে তেমনই মনে করতো), আমাদের নানি ব্যাক্সাটারের কাছে আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে দিয়েছিল। ফলে কোনোপ্রকার কাল বিলম্ব না করেই মিস্টার ফ্রিম্যানকে অ্যারেস্ট করে জেলে ভরা হয়েছিল। পিস্তল নিয়ে পইপই করে ঘুরে বেড়ানো আমাদের মাস্তান মামারা তাকে একদিন পরেই জেলখানা থেকে বের করে এনে গুলি করে মেরে ফেলেছিল।
এই অল্প কিছুদিনের মধ্যে ঘটে যাওয়া ভয়ানক সব ঘটনার ঘনঘটা আমাকে একরকম উন্মাদপ্রায় বানিয়ে দিলো। আমি শুধু একটা কথাই ভাবছিলাম যে, আমি চাই, যে-কটা দিন আর বেঁচে আছি, যেন এই হাসপাতালেই থেকে যেতে পারি। মা আমার জন্য নানা ধরনের চকলেট, ক্যান্ডি আর ফুল নিয়ে আসতেন। এদিকে নানি ফলমূল এনে আমার ঘরটি প্রায় ভরিয়ে দিতে লাগলেন। আর আমার বিখ্যাত মাস্তান মামারা হাসপাতালে আমার বিছানার চারপাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্রমাগত চক্কর খেতে লাগলেন এবং হিংস্র বুনো মোষের মতো নাকমুখ দিয়ে গোঁ-গোঁ আওয়াজ বের করতে লাগলেন। এতকিছুর পরে যখন ওঁরা বেইলকে একটু সুযোগ দিতেন আমার কাছে আসার, তখন বেইলি পাশে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বই পড়ে শোনাতো।
কথায় আছে ‘নেই কাজ তো খৈ ভাঁজ!’ আমার মনে হয় না যে, কথাটি সর্বোতভাবে সত্যি নয়। যার নিজের কোনো কাজ নেই অর্থাৎ যে তার নিজের জগৎ নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারে না, সে যে সবসময় অন্যের পেছনে লেগে থাকে, অন্যদের সমালোচনায় ব্যস্ত থাকে বা অন্যদের ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলায় কথাটি সবসময় সত্যি নাও হতে পারে। আমার মনে হয়, উত্তেজনা হচ্ছে নিজেই একটি ঘোরগ্রস্ত হওয়ার মহৌষধ! আর যারা সন্ত্রাসের মধ্যেই জীবনযাপন করে, তারা সবসময়ই একটি ঘটনা শেষ হয়ে গেলেই পরবর্তী উত্তেজনার জন্য অপেক্ষা করে থাকে।
সেদিন আদালত কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। এমনকি কিছু মানুষ চার্চের মতো করেই আদালত ঘরের বাইরেও দাঁড়িয়ে ছিল। বয়স্ক মানুষদের কাছ থেকে অতি উৎসাহী গপ্পবাজ ভক্তদের আলাদা করে ফেলা হলো। আর আমাদের নানি ব্যাক্সটারের সমস্ত ভক্ত-সমর্থক-মক্কেলকে বসান হলো সমকামী, ফুর্তিবাজ ও রংবাজ বাচালগোছের মানুষের জন্য নির্ধারিত বসার স্থানে। ফ্যাশানেবল পিন দিয়ে আটকানো চেক স্যুট পরা জাঁদরেল জুয়াড়িরা এবং সারা মুখের পরতে পরতে গাঢ় করে মেকআপ করা তাদের স্ত্রী এবং বান্ধবীরা তাদের রক্তের মতো টকটকে লাল ঠোঁট দিয়ে ফিসফিস করে আমাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় মগ্ন হয়ে রইলো। আমি আমার নিজের সম্পর্কে যা কিছু জানতাম এবং আমার সঙ্গে এই পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে, তারা তার সবকিছুই জেনে গিয়েছিল। যদিও আমার বয়স মাত্র আট বছর কিন্তু আমি বয়সের তুলনায় বড় হয়ে গিয়েছিলাম। এমনকি আমাকে দেখাশোনা করতো যেসব নার্স, তারাও আমাকে আশ্বস্ত করেছিল এই বলে যে, আমার এখন থেকে আর ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তারা বলেছিল, ‘একদম দুশ্চিন্তা করবে না। কারণ যা কিছু খারাপ হওয়ার ছিল, তা শেষ হয়ে গেছে। এখন থেকে তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে।’ ফলে আমি মুখ ফুটে সবই বলে দিয়েছিলাম, যা আমার সঙ্গে ঘটেছে।
আমি আমার পরিবারের লোকজনদের সঙ্গে একটি বেঞ্চিতে বসেছিলাম (কোনো একটি বিশেষ কারণে বেইলি আসতে পারেনি)। আর তারা সবাই ধূসর ঠাণ্ডা সমাধিস্তম্ভের মতো দৃঢ় আর শক্ত হয়ে সেখানেই বসে রইলো। তারা এমনভাবে অনড় হয়ে সেখানে বসে ছিল, যেন তারা অনন্তকাল ধরে স্থির ও জমাট বেঁধে সেখানেই বসে থাকবে।
হায়রে বেচারা মিস্টার ফ্রিম্যান! তিনি চেয়ারটা কিছুটা বেঁকিয়ে নিয়ে আমার দিকে ঘৃণা ভরে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তিনি আসলে বুঝতেই পারেননি যে, তার পক্ষে বেইলিকে খুন করা কখনোই সম্ভব নয়। বেইলি আমাকে মিথ্যা বলেনি। ও কখনোই মিথ্যা বলে না।
মিস্টার ফ্রিম্যানের উকিল আমার কাছে জানতে চাইলেন, আসামি সেদিন কী পোশাক পরে ছিল?
-আমি জানি না।
-তুমি কি আমাকে এটাই বলতে চাইছ যে, যে লোকটি তোমাকে ধর্ষণ করেছে সে কি পরে ছিল তুমি জানো না? তিনি এমনভাবে বিদ্রূপ করে ফ্যাসফ্যাস করে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিলেন, যেন মিস্টার ফ্রিম্যান আমাকে নয় বরং আমিই মিস্টার ফ্রিম্যানকে ধর্ষণ করেছি। এরপর তিনি বললেন, তুমি কি বুঝতে পারছ কী বলছ? সত্যি সত্যিই যদি তুমি ধর্ষণের শিকার হতে? হায়!
আমি যে এভাবে ওর কাছে এত কথা গোপন রেখেছি, যা আগে কখনোই করিনি, সেটা জানতে পারলে ও আমাকে কী ভাববে, সেটা কল্পনা করে ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। আর তাই আমি কোনো কথা স্বীকার না করেই উকিলের সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
পুরো আদালতের ভেতর বিচিত্র একটি হ্যাসহ্যাসে শব্দে বাতাস ভারী হয়ে উঠলো (আমি নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারলাম সবাই আমাকে নিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে শুরু করেছে)। মা যে আমাকে ব্রেস বোতামওয়ালা গাঢ় নীল রঙের একটি শীতের কোর্ট পরিয়ে দিয়েছিলেন, সেজন্য আমি সত্যি খুব খুশি হয়েছিলাম। যদিও কোর্টটা আমার শরীরের তুলনায় খুবই ছোট সাইজের ছিল এবং সেন্ট লুইসের আবহাওয়াও যথারীতি তখন বেশ গরম ছিল। তবু এই নির্বান্ধব, বিষণ্ণ ও বৈরি পরিবেশে এই কোর্টটিকেই আমি একজন প্রিয় বব্ধুর মতো করে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করলাম।
-লোকটা কি এবারই প্রথম তোমার সাথে এমন কাজ করলো, না কি আগেও তোমার সাথে এসব করেছে? এমন ভয়াবহ প্রশ্নের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আমি একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কোনো সন্দেহ নেই যে, মিস্টার ফ্রিম্যান আমার সঙ্গে যারপরনাই খারাপ কাজ করেছেন। কিন্তু এটাও তো সত্যি যে তিনি আমাকে এই কথা বলে বুঝিয়েছেন যে, আমি আসলে আগেও তাকে আমার সঙ্গে এসব কাজ করতে সাহায্য করেছি্লাম।
আমি কখনোই মিথ্যা কথা বলতে চাই না। আমি একটু সময় নিচ্ছিলাম ভাবার জন্য যে, এখন কিভাবে এসব কথা সবার সামনে খুলে বলবো? কিন্তু উকিল সাহেব আমাকে ভাবার জন্য একটুও সময় না দিয়েই উত্তর দেওয়ার জন্য চাপ দিতে লাগলেন। ফলে আমি হার মেনে নিলাম এবং আগের মতোই মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
-উত্তর দাও। এই লোকটা কি আগেও তোমার সারা শরীর হাতিয়েছে বা এসব কাজ করেছে বা করার চেষ্টা করেছে, যাকে তুমি ধর্ষণ বলছ? চুপ করে থেকো না। উত্তর দাও।
আমি ‘হ্যাঁ’ বলতে পারলাম না। আর আমি সবার সামনে একথাও বলতে পারলাম না যে, মিস্টার ফ্রিম্যান আগেও আমাকে কয়েক মিনিটের জন্য জড়িয়ে ধরে আদর করেছিলেন। আর সেদিন তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে অনেক অনেক ভালোবেসেছিলেন, যেদিন তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, আমি আসলে বিছানায় হিস্যু করে দিয়েছি। কিন্তু তিনি তো জানতেন যে, আমি বিছানায় আসলে হিস্যু করিনি। কিন্তু আমি যদি এসব গোপন কথা সবার সামনে বলে দিতাম, তাহলে আমার মামারা আমাকে তো খুন করে ফেললো আর আমার নানি ব্যাক্সটার আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিতেন। যা তিনি আগেও বহুবার করেছেন। তিনি যখনই রেগে যান, তখন প্রথমেই সবার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন। আর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটাতো আদালতে বসে থাকা জনগণ। ওদের সামনে এসব কথা স্বীকার করলেই ওরা নিশ্চিতভাবে আমাকে পাথর ছুড়ে মেরে ফেলতো যেভাবে বাইবেলে ওরা হারলটকে পাথর ছুড়ে খুন করেছিল। আমি তো সেটা জানতামই। আমার মা, যিনি আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে লক্ষ্মী মেয়ে ভাবেন, তিনিও এসব শুনলে একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে ভেঙে পড়তেন। আর সবচেয়ে বড় কথা বেইলি! ওর সামনে আমি মুখ দেখাতাম কী করে? আমি যে এভাবে ওর কাছে এত কথা গোপন রেখেছি, যা আগে কখনোই করিনি, সেটা জানতে পারলে ও আমাকে কী ভাববে, সেটা কল্পনা করে ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। আর তাই আমি কোনো কথা স্বীকার না করেই উকিলের সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
চলবে…
আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-২৬॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু