অনুবাদ: ফারহানা রহমান
ঘটনাটি ঘটার পর মিস্টার ফ্রিম্যান আবারও বেশ কয়েক মাসের জন্য আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিলেন। আমি ভীষণ কষ্ট পেলাম। এর আগে জীবনে কখনো নিজেকে এতটা নিঃসঙ্গ মনে হয়নি। এভাবে দিনের পর দিন কষ্ট পেতে পেতে একসময় তাকে চিরতরে ভুলে গেলাম। এমনকি তার সেই গভীর আলিঙ্গন, যা আমার কাছে একদিন পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান একটি উপহার মনে হয়েছিল, তাও একসময় ছেলেবেলার এক মুহূর্তের কল্পনার মতোই ধূসর অন্ধকারের মধ্যে চিরতরেই মিলিয়ে গেলো।
আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে বইয়ের ভেতর ডুবে যেতে লাগলাম। মনপ্রাণ দিয়ে এই কামনা করতাম, যদি ছেলে হয়ে জন্মাতাম, তাহলে কতই না ভালো হতো। ওই সময় হোরেশিও এলজার ছিলেন পৃথিবীর বিখ্যাত লেখকদের একজন। তার গল্পের সব হিরোই ছিল ভীষণ শক্তিশালী আর মহান ব্যক্তি। তারা সবসময় সবকিছুতেই জিতে আসতো। আর সবচেয়ে বড় ব্যপার হলো, তারা প্রত্যেকেই ছিল ছেলে। কোনো নারীকে তিনি গল্পের প্রধান চরিত্রে রাখতেন না। আমি জানি যে, চেষ্টা করলেই একজন মহান ও বিজেতা অবশ্যই হতে পারবো। কিন্তু আমি ছেলে হবো কী করে? এটা তো অসম্ভব। তাই না?
প্রতি রোববারে মজার মজার কমিকসের বইগুলো হাতে পেয়ে দারুণ উৎসাহিত বোধ করতাম। কমিকসের সব দারুণ শক্তিশালী নায়কের ভীষণরকম ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ এইসব শক্তিশালী নায়ক যা কিছুই হয়ে যাক না কেন, সবসময়ই শেষপর্যন্ত জয়ী হয়েই ফিরতো। তাদের কেউ কখনো হারাতে পারতো না। এদিকে দেখা গেলো, একসময় সবাই আমাকে টাইনি টিম নামে ডাকতে শুরু করেছে। আমার অভ্যেস ছিল টয়লেটে গেলেই সঙ্গে পেপারটি নিয়ে যেতাম। পত্রিকার অপ্রয়োজনীয় পৃষ্ঠাগুলোকে বাদ দিয়ে দিয়ে টয়লেটের ওপর বসে শুধু কমিকসের প্রয়োজনীয় অংশটুকু পড়ার চেষ্টা করা একসময় রীতিমতো জঘন্য অত্যাচারে পরিণত হলো। নায়করা কী করে নানা কীর্তিকলাপ করে শেষপর্যন্ত শত্রুদের ঘায়েল করে, সেটা জানাই আসলে আমার একমাত্র উদ্দেশ্য থাকতো। ফলে পুরো পত্রিকা থেকে সব বিষয় বাদ দিয়ে শুধু কমিকসের অংশটুকু পড়ার জন্য আমাকে অনেক কসরত করতে হতো। প্রতি রোববারেই এইসব কমিকসের কাহিনি পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতাম। একসময় সব উত্তেজনা ও দুঃখকষ্টের উপশম হলে শান্ত হয়ে যেতাম।
কমিকসে সবসময় বদমায়েশ শত্রুদের বুদ্ধি দিয়ে সুকৌশলে দারুণ সব অভাবনীয় উপায়ে হারিয়ে দিতো নায়করা। গল্পের এই হিরোদের শক্তিমক্তা আর বুদ্ধির জন্য আমি খুব গর্ব বোধ করতাম। তখন ‘ক্যাটসজেমার কিডস’ নামের আরেকটি কমিকসের সিরিজ বের হতো, যেখানে বাচ্চাদের খুব হাস্যরসাত্মক এবং বুদ্ধিমান হিসেবে দেখানো হতো। বড়দের দেখানো হোতো হাবাগোবা হিসেবে। আমার জন্য এই কমিকসগুলো খুব একটা উপযুক্ত ছিল না। কারণ এসব বাচ্চাকে আমার অতি ধুরন্ধর মনে হতো। আর আমি আসলে ঠিক ওদের মতো করে বেড়ে উঠিনি। ছোটবেলা থেকে আমাকে বড়দের সম্মান করতে শেখানো হয়েছিল। ফলে বড়দের ব্যাপারে আমি এসব বোকা-বোকা ব্যাপার ভাবতেও পারতাম না।
এভাবেই হঠাৎ একদিন সেন্ট লুইসে বসন্ত এসে যেতেই জীবনের প্রথম লাইব্রেরি কার্ডটা ড্রয়ার খুলে বাইরে বের করে আনলাম। জীবনের এই পর্যায়ে এসে আমি আর বেইলি যেহেতু একবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদাভেবে বেড়ে উঠতে লাগলাম, ফলে শনিবারগুলোয় একেবারেই নিরবচ্ছিন্নভাবে লাইব্রেরিতে সময় কাটাতে শুরু করলাম। এই বিশাল লাইব্রেরিতে এসে আমি যেন অভাবনীয় এক পরিবেশে বুক ভরে দম নেওয়ার সুযোগ পেলাম। এখানে এসে এমন সব মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেলাম, যারা সবাই তাদের ধৈর্য, অধ্যাবসায় ও মানবিকতার জোরে একেবারে কপর্দকহীন বুটপালিশওয়ালার পর্যায় থেকে উঠে এসে সমাজের উঁচুস্তরের জ্ঞ্যানি-গুণী ও সম্পদশালী ব্যক্তিতে পরিণত হতে পেরেছেন। আর এসব গণ্যমান্য ধনী ব্যক্তিই এখন ছুটির দিনগুলোয় গরিবদের মাঝে ঝুড়ি ভরে ভরে খাবার বিতরণ করে।
মিস্টার ফ্রিম্যান খুব ধীরস্থির কণ্ঠে আমাকে বললেন, ‘শোনো রিটি, আমার এই জিনিসটা কিন্তু এখন তোমাকে খুব একটা বেশি ব্যথা দেবে না। তুমি এটাকে আগেও খুব পছন্দ করেছিলে, তাই না?’
এদিকে গৃহকর্মীদের ষড়যন্ত্রের ফলে যে সব ছোট্ট রাজকন্যা রাজপরিবারে বেড়ে না উঠে পথশিশু হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ায়, তাদের জন্য আমার মন ক্যামন হুহু করে কাঁদতে থাকে। আর তারাই আমার কাছে হয়ে ওঠে বাস্তবের মানুষদের চেয়েও অনেক বেশি বাস্তব। আমার ঘরবাড়ি, আমার মা, স্কুল, মিস্টার ফ্রিম্যান, সবাই আমার কাছে সেসময় অলীক কল্পনা হয়ে ওঠে। আমি বুঝতে পারি, আমার নিজের ভেতর অন্য এক জগৎ গড়ে উঠেছে। আর দিনরাত ডুবে থাকি সেই বইয়ের প্রাসাদের ভেতরেই।
এদিকে বসন্তের এই মাসগুলোতে নানানানি এবং এক মামা আমাদের সঙ্গে থাকতে শুরু করেছিলেন। আর আমাদের একমাত্র খালামনি ছিলেন। যিনি কিনা ক্যালিফোর্নিয়াতে তার ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার গড়ে তোলার জন্য চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের সঙ্গে দেখা হলেই তারা সবাই আমাকে আর বেইলিকে একই প্রশ্ন বারবার করতেন। তারা বলতেন, ‘আচ্ছা ঠিক করে বলো তো, এতদিন তোমারা দুজন কি সত্যি সত্যি লক্ষ্মীবাচ্চা হয়ে ছিলে?’ আর এই প্রশ্নের উত্তর তো একটাই হতে পারে। সেটা হচ্ছে, হ্যাঁ। এটা তো সবার ভালো করেই জানা আছে। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, বেইলির মতো দুষ্টু বাচ্চারও সাহস ছিল না এই প্রশ্নের উত্তরে ‘না’ বলার।
শেষ বসন্তের কোনো এক শনিবারে, দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর (যদিও বা এখানে কখনোই স্ট্যাম্পের মতো ভুঁরিভোজ হতো না) বেইলি মাঠে চলে গেলো বেইসবল খেলতে। আমি যথারীতি তৈরি হলাম প্রিয় জায়গা লাইব্রেরিতে গিয়ে বইয়ের স্তূপের মাঝে সময় কাটাবো বলে। এদিকে বেইলি দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচতলায় নেমে যেতেই মিস্টার ফ্রিম্যান আমাকে বললেন, ‘রিটি, দৌড়ে যাও তো দোকানে আর বাসার জন্য একটু দুধ কিনে আনো।’
আমাদের মা’ই সবসময় রাতে বাসায় ফেরার সময় দুধ কিনে নিয়ে আসতেন। কিন্তু সেদিন সকালবেলা আমি আর বেইলি যখন লিভিংরুমটা গুছাচ্ছিলাম, তখনই খেয়াল করেছিলাম যে মা’র শোয়ার ঘরের দরজাটা হাট করে খোলা। আমি বুঝতে পেড়েছিলাম যে, মা গতরাতে বাসায় ফেরে্ননি।
মিস্টার ফ্রিম্যান আমাকে টাকা দিতেই আমি দৌড়ে দোকানে গিয়ে দুধ কিনে আনলাম। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছিল লাইব্রেরিতে যেতে। বরফের বাক্সের ভেতর দুধটা রেখেই আমি দৌড়ে দরজার কাছে পৌঁছালাম। কারণ এরইমধ্যে অনেক দেরি করে ফেলেছি। কিন্তু হায়! ঠিক তখনই আমার কানে ভেসে এলো মিস্টার ফ্রিম্যানের আওয়াজ, ‘রিটি এদিকে এসো তো।’ তিনি তার নিজের বিশাল চেয়ারটিতে রেডিও হাতে নিতে বসে ছিলেন। আবারও বললেন, ‘রিটি এদিকে এসো তো তাড়াতাড়ি।’ আমি আসলে একটুও বুঝতে পারিনি যে, তিনি আমার সঙ্গে জড়াজড়ি করার জন্যই কাছে ডাকছেন। আর এটি যে জড়াজড়ি করার সময়, সেটাই বা আমি বুঝবো কী করে? আমি তার কাছে যেতেই দেখলাম, তার প্যান্টটি হাঁটুর কাছ পর্যন্ত নামানো। তার ওই জিনিসটি প্যান্ট থেকে বের হয়ে আছে। দেখলাম জিনিসটি ভীষণ বড় হয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
‘না, না স্যার! মিস্টার ফ্রিম্যান প্লিজ! আমার সঙ্গে এমন করবেন না।’ আমি ভয়ে পিছিয়ে আসি। আমি কিছুতেই তার ওই লাঠির মতো মাংসল জিনিসটা ধরতে চাই না। তিনি আমাকে আবারও আগের মতো করে জড়িয়ে ধরুক, সেটাও আর চাই না। পালিয়ে যাচ্ছি দেখে তিনি খপ করে আমার হাত ধরলেন। আর মুহূর্তের মধ্যে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তার দুপায়ের ভেতর নিয়ে এলেন। অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। দেখলাম তার মুখটি গম্ভীর হয়ে আছে। তবু তাকে খুব দয়ালু মনে হচ্ছিল। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি দেখেও তিনি আমার দিকে তাকিয়ে একটুও হাসলেন না। এমনকি একবারের জন্যেও তার চোখের পলকটুকুও পড়লো না। তিনি একেবারে কিছুই করলেন না। শুধু বাম হাতটি বাড়িয়ে রেডিওর পুরো ভলিউমটা বাড়িয়ে দেওয়া ছাড়া আক্ষরিক অর্থেই কোনো কিছুই করলেন না। এমনকি রেডিওর দিকেও একবারের জন্যেও ফিরে তাকালেন না। ভীষণ জোরে জোরে গান বাজার মধ্যেও মিস্টার ফ্রিম্যান খুব ধীরস্থির কণ্ঠে আমাকে বললেন, ‘শোনো রিটি, আমার এই জিনিসটা কিন্তু এখন তোমাকে খুব একটা বেশি ব্যথা দেবে না। তুমি এটাকে আগেও খুব পছন্দ করেছিলে, তাই না?’
আমি কিছুতেই তার কথার সঙ্গে একমত হতে চাইনি। আর কখনোই ওটা ধরতে পছন্দও করিনি। তবে তিনি যে আমাকে ভীষণ আপন করে জড়িয়ে ধরতেন, সেটা পছন্দ করতাম। কারণ, তখন মনে হতো তিনি আমার সত্যিকার বাবা। আর তার গায়ের মিষ্টি গন্ধ আর আমাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরার ফলে তার বুক ধড়পড় বেড়ে যাওয়ার যে ব্যাপারটি ঘটতো, আমি সেগুলোকে পছন্দ করেছিলাম। কিন্তু এসব কথা বলার মতো কোনো সাহস আমার তখন ছিল না। ফলে আমি চুপ করে থাকলাম।
চলবে…
আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-২৩॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু