পর্ব-১৮
[ড. মায়া অ্যাঞ্জেল্যু—আমেরিকান কবি। তার জন্ম ১৯২৮ সালের ৪ এপ্রিল। মিসোরি রাজ্যের সেন্ট লুইস শহরে। ছিলেন একাধারে, কণ্ঠশিল্পী, অভিনেত্রী, নাট্যকার, শিক্ষক ও একজন জীবনীকার। তার পুরো নাম মার্গারেট অ্যানি জনসন।
১৯৯৩ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি তার নিজের লেখা কবিতা ‘পালস অব মর্নিং’ আবৃত্তি করেন। এজন্য পরে গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডও পান। ইতোপূর্বে ১৯৬১ সালে একমাত্র কবি রবার্ট ফ্রস্টই প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘দ্য গিফট আউটরাইট’ কবিতাটি আবৃত্তি করার সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন।
১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা নিজের অভিষেক অনুষ্ঠানে মায়া এঞ্জেলোর কবিতা পাঠ করে তাকে সম্মান দেখান। কর্মজীবনে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। সমগ্র পৃথিবীর ৭০টিরও বেশি ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি সম্মাননা পান। প্রায় ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট বা ডক্টর উপাধি পান।
১৯৬৯ সালে তার প্রথম আত্মজীবনী ‘আই নো হোয়াই দ্য কেজড বার্ড সিংস’ বইটি প্রকাশিত হলে বিশ্বব্যাপী তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। বইটি পরবর্তী দুবছর ধরে নিউ ইয়র্ক টাইমস এর বেস্ট সেলার তালিকায় সর্বোচ্চ স্থান দখল করে ছিল। ২০১৪ সালের ২৮ মে সকালে অ্যাঞ্জেল্যু চিরনিদ্রায় চলে যান। চিন্তাসূত্রের জন্য এই মহান লেখকের আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড ‘আই নো হোয়াই দ্য কেজড বার্ড সিংস’-এর বাংলা অনুবাদ করেছেন কথাশিল্পী-কবি-অনুবাদক ফারহানা রহমান। নাম দিয়েছেন, ‘আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়’। আজ প্রকাশিত হলো ১৮তম পর্ব]
জার্মান স্কুল টুসন্ট লউভারটুরে ভর্তি হওয়ার পর আমাদের স্কুলের বন্ধুরা নির্দয়ভাবে আমাদের উপেক্ষা করতে শুরু করেছিল। আমাদের টিচাররা আমাদের সঙ্গে ভীষণ অভদ্র, কর্কশ ও কঠোর ব্যবহার করতেন। আমরা ওদের এই ধরনের ব্যবহারে খুব কষ্ট পেতাম। শুধু স্কুলটির বিশার ক্যাম্পাস দেখে আমরা যারপরনাই মুগ্ধ হয়েছিলাম। স্কুলটি এতই বড় ছিল, এমনকী স্ট্যাম্পের সাদাদের স্কুলও এত বিশাল আয়তনের ছিল না।
কিন্তু সে যাই হোক না কেন, এখানকার ছাত্রছাত্রীরা ছিল খুবই অনগ্রসর, পিছিয়ে পড়া। স্টোরে কাজ করার ফলে আমি আর বেইলি বড়দের লেভেলের পাটিগণিত করতাম। তাছাড়া আমরা স্ট্যাম্পসে অনেক বেশি লেখাপড়া করতাম। কারণ আসলে ওখানে আর অন্য কোনো কিছু করার কোনো সুযোগ ছিল না। সেন্ট লুইসের টুসন্ট লউভারটুর স্কুলে আমাদের উঁচু গ্রেডে প্রমোশন দিয়ে দেওয়া হোলো। কারণ এখানকার টিচাররা ভাবছিল যে, আমরা গ্রামের ছেলেমেয়েরা যারা অনেক বেশি পড়ালেখা করেছি, তারা যদি এই ক্লাসে থাকি, তাহলে শহরের বাচ্চারা আমাদের দেখে হতাশায় ভুগতে পারে। আর সত্যি সত্যি এমনটাই ঘটছিল। বেইলি কম পড়াশোনা জানা ওর ক্লাসের বন্ধুদের নিয়ে খোঁচাখুঁচি করতো আর ওদের খ্যাপাতে ছাড়তো না। লাঞ্চ পিরিয়ডে বিশাল ধূসর কংক্রিটের খেলার মাঠটিতে দাঁড়িয়ে থেকে সিনিয়র ছেলেদের ঠিক মাঝখানে অবস্থান নিতো বেইলি। তাদের জিগ্যেস করতো, ‘বলো তো ন্যাপনিয়ন বোনাপারট কে ছিল? তোমরা কেউ কি জানো? কেউ কি বলতে পারবে কত ফুটে এক মাইল হয়?’ আর এটাই ছিল ওদের বিরুদ্ধে বেইলির প্রতিযোগিতা করার একমাত্র উপায়। আর ওটাই ছিল ওর স্টাইল। যে কেউ বেইলির সঙ্গে কুস্তাকুস্তি করেই ওকে হারিয়ে দিতে পারতো। অবশ্য ওরা যদি সেটা করতো তাহলেই। আর অবশ্যই তাদের সেটা করলে করতে হতো শুধু পরের দিনেই। কিন্তু বেইলি ঝগড়াঝাঁটি করার পথ কখনোই প্রশস্ত করতো না। ও কখনোই কোনো ঝামেলায় যেতে চাইতো না। আমি একবার ঝগড়াঝাঁটিতে জড়িয়ে গেলে ও আমাকে শিখিয়েছিল কী করে এসব পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়। ও বলেছিল এইসব পরিস্থিতিতে বলটা দখল করেই মুহূর্তের মধ্যে দৌড়ে পালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আমি যখন ওকে জিগ্যেস করলাম যে, আমি যদি কোনো ছেলের সঙ্গে মারামারি না করে কোনো মেয়ের সঙ্গে করি, তাহলে কী হবে? বেইলি আমাকে আমার সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর কখনো দেয়নি।
অথবা বেইলির সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি শুরু করে তাকে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারতাম। কিন্তু আমি কখনোই সেসব কিছুই করিনি। কারণ আমার মনের ভেতরের সেই উচ্চতর শক্তিটি বরং আমাকে তার প্রতি আরও বেশি করে নম্র ও কোমল করে তুলেছিল।
ওখানে আমরা পুরো বছরজুড়েই স্কুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু শোনা কথা যতটুকু আমার মনে পড়ে আর যা আমি আগে কখনো শুনিনি তা হচ্ছে, এক হাজারটা ডিমের শেপের মতো করে গোল গোল আঁকতে পারলেই লেখালেখির কৌশল উন্নত করা যায়!
আমরা যেসব শিক্ষকদের স্ট্যাম্পসে চিনতাম, তাদের তুলনায় এখানকার টিচাররা অনেক বেশি ফর্মাল আচরণ করতো। যদিও সেন্ট লুইসের টিচাররা যখন-তখন স্টুডেন্টদের বেত দিয়ে পেটাতেন না। কিন্তু তারা বাচ্চাদের হাতের তালুতে রুলার দিয়েআঘাত করতেন। স্ট্যাম্পের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কিন্তু শিক্ষকদের অনেক বেশি বন্ধুত্ব ছিল। আর এর একটি বড় কারণ হলো তারা আসতেন আরনকানসরের নিগ্রোদের কলেজ থেকে। আর যেহেতু ওখানকার শহরে শিক্ষকদের থাকার জন্য কোনো হোটেল বা রুমের ব্যবস্থা ছিল না, তাই তাদের থাকতে হতো কোনো না কোনো পরিবারের সঙ্গে তাদের সদস্যের মতো করে। আর যদি কোনো শিক্ষিকা এভাবে কোনো পরিবারের সঙ্গে থাকতেন, অথচ তাদের নামে কোনো চিঠিপত্র না আসতো অথবা রুমে বসে বসে একা একা নির্জনে কান্নাকাটি করতেন, তাহলেই হোলো। সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই তাকে নিয়ে সবাই চায়ের কাপে আলোচনার ঝড় তুলতো। এমনকী ছোট বাচ্চারাও তার সততা, তার একাকিত্ব বোধ আর তার অন্যান্য নানা বিষয়ের ব্যর্থতা নিয়েও কথা চালাচালি শুরু করে দিতো। আর স্ট্যাম্পের মতো এমন একটা ছোট্ট শহরে এভাবে একা একা গোপনীয়তা রক্ষা করার নামে সব ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় থাকাটা এক কথায় বলতে গেলে অসম্ভব একটি ব্যাপার ছিল।
অন্যদিকে সেন্ট লুইসের টিচাররা খুব দাম্ভিক ছিল। তারা ছাত্রছাত্রীদের কিছুটা হেয়-প্রতিপন্ন করে সাদা মানুষদের উচ্চারণে কথাবার্তা বলতো এবং তাদের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলতো যেন তারা খুব উচ্চ শিক্ষিত ও সবজান্তা। শিক্ষক-শিক্ষিকা প্রত্যেকেই আমাদের বাবার মতো এর বা এরের উচ্চারণ করে করে কথা বলতেন। তারা তাদের দুই হাঁটু একসঙ্গে করে হাঁটুর সঙ্গে হাঁটু লাগিয়ে হাঁটতেন। দুই ঠোঁট চেপে চেপে এমনভাবে কথা বলতেন, যেন তারা শব্দ করতে এতই ভয় পাচ্ছেন যে, কোনো শব্দ উচ্চারণ করলেই দুর্গন্ধময় বাতাস তাদের ফুসফুসে ঢুকে যাবে। আর এমন ভাব দেখাতেন, যেন সেই দুর্গন্ধ আসলে যারা কথা শুনছে, তাদের মুখ থেকেই বের হচ্ছে।
ইটের দেয়ালঘেরা স্কুল প্রাঙ্গণের মধ্যেই আমরা ঘোরাঘুরি করতাম। একটি অসহ্য অস্বাস্থ্যকর শীতকালজুড়ে কয়লা ও ধুলোবালিযুক্ত বাতাস শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করলাম। আমরা হ্যাঁ ম্যাম, না ম্যাম বলার বদলে শুধু হ্যাঁ এবং না বলা শিখে ফেললাম।
সেন্ট লুইসে থাকার সময়ে শুধু হঠাৎ কোনো একটি অনুষ্ঠান হলেই আমরা আমাদের মা’কে বাসায় দেখতে পেতাম। আমাদের স্কুলের খুব কাছের ব্রিজটির শেষপ্রান্তে একটি অন্ধকার বিশালাকার পানশালা ছিল। এটার মালিক ছিল সিরিয়ান দুই ভাই।
আমরা পেছনের দরজা দিয়ে মাঝেমাঝে ওটার ভেতরে যেতাম। আর ওটার ভেতরের কাঠের গুঁড়োর গন্ধ, বাসি বিয়ারের গন্ধ ও ধূমায়িত সেদ্ধ মাংসের মৌ মৌ গন্ধে মনে হতো, আমরা যেন ন্যাপথলিনের গোল গোল বলগুলো প্লেটে করে নিতে খাচ্ছি। ওই সময় আমার মা তার নিজের চুলের স্টাইলের মতো করে আমার চুলগুলোকে বব ছাঁট করে সোজা করে দিয়েছিলেন। ফলে আমি খুব হালকা বোধ করতাম। আর আমার পেছনের দিকটা নিজের কাছে এতই খালি খালি লাগতো যে, পেছনে কেউ হাঁটলে খুব লজ্জা পেতাম। স্বভাবতই নিজেকে এমনভাবে বদলে ফেললাম, যেন মনে হয় শিগগিরই বিশেষ কিছু একটা পেতে চলেছি।
লুইসে আমাদের মায়ের বন্ধুরা আমাদের আদর করে, ‘বিবিস ডার্লিং বেবিস’ বলে ডাকতেন। ওঁরা আমাদের দুজনকে কোমল পানীয় আর সেদ্ধ চিংড়ি খেতে দিতেন। যখন আমরা শক্ত কাঠের বেঞ্চে বসে থাকতাম, মা তখন সিবার্গ (এক ধরনের মিউজিক সিস্টেম) থেকে গান শুনে শুনে একা একা আমাদের সামনে নিজের মনে নেচে চলতেন। আমি মাকে এভাবে দেখতেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম। তিনি যেন একটি অপূর্ব সুন্দর ঘুড়ি হয়ে আমার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে দূরে কোথাও ভেসে যেতেন। আমি জানি, তখন যদি চাইতাম, তাহলে টয়লেটে যাওয়ার অজুহাতে তাকে ওই সময় তার নাচ থামিয়ে দিয়ে আমার পাশে বসিয়ে রাখতে পারতাম। অথবা বেইলির সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি শুরু করে তাকে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারতাম। কিন্তু আমি কখনোই সেসব কিছুই করিনি। কারণ আমার মনের ভেতরের সেই উচ্চতর শক্তিটি বরং আমাকে তার প্রতি আরও বেশি করে নম্র ও কোমল করে তুলেছিল।
চলছে…
আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-১৭॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু