[কেনিয়ান লেখক নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গোও একজন ঔপন্যাসিক, উত্তর-ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিক ও সমাজকর্মী। গত শতকের সত্তরের দশকে তিনি ‘উইপ নট চাইল্ড’ (১৯৬৪) উপন্যাসর মাধ্যমে সারাবিশ্বের ইংরেজিভাষী পাঠকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। মাও বিদ্রোহ নিয়ে লেখা ওই উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি এক বছর জেল খাটেন ও নির্বাসিত হন। একুশ শতকের শুরুতে আবার কেনিয়ায় প্রত্যাবর্তন করেন। ২০১৩ সালে সুইডিশ নিউজ এজেন্সি টিটির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কাকে সাহিত্যে নোবেল দেওয়া উচিত। নগুগি তখন নিজের নাম বলেছিলেন। ২০১৫ সালের জুনে কেনিয়াটা বিশ্ববিদ্যালয় ও নাইরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেন তিনি। চিন্তাসূত্রের জন্য ওই দুটি বক্তৃতার সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর করেছেন অজিত দাশ ]
১৯৬৯ সালে নাইরবি থেকে প্রায় একশ মাইল দূরে নেইরি শহরে একজন সাইকেল মেরামতকারি একটি ইঞ্জিন আবিষ্কার করেছিলেন। পরিত্যক্ত একটি স্কুটারের ইঞ্জিন মেরামত করে এরোপ্লেন বানিয়েছিলেন, যার নাম দিয়েছিলেন কেনিয়া। উড়োজাহাজটি মাইলের পর মেইল উড়েছিল কিন্তু নিচে নামতে গিয়ে গাছের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। গাকাম্বার আবিষ্কৃত উড়োজাহাজটি বর্তমান উড়োজাহাজগুলোর মতো আধুনিক পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়নি। ফলে তৎকালীন কেনিয়ার এটর্নি জেনারেল চার্লস এনজনজো কোনো রকম বৈধ কাগজপত্র ছাড়া উড়োজাহাজ চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
যদিও গাকাম্বাকে উড়োজাহাজ উড়ানোর জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করার ঘটনায় আমি ততটা আগ্রহী নই, তবু নিজের মাতৃভূমির প্রতি দুজন কেনিয়ানের অবদান কতটুকু, এই বিষয় নিয়ে বিচলিত হয়েছিলাম। গাকাম্বা হয়ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি অতিক্রম করেননি কিন্তু এনজনজো সাউথ আফ্রিকার হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করে পরবর্তী সময়ে ব্যারিস্টার হয়েছেন। এনজনজো ইংরেজি ভালো জানতেন এবং ব্রিটিশদের মতো ইংরেজি উচ্চারণ করতে পারতেন। অন্যদিকে গাকাম্বা মাতৃভাষা কিকুইয়ো ছাড়া ইংরেজি অতটা জানতেন না। কিন্তু মূল বিষয় হলো, সাইকেল মেরামতকারী গাকাম্বা উড়োজাহাজ তৈরি করে এটা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, কেনিয়ানরাও কিছু করতে পারে কিন্তু সেই ইংরেজি ভালো জানা এটর্নি বলেছিলেন যে, কেনিয়ানরা পারে না। উড়োজাহাজ তৈরির স্বপ্নটিই ছিল গাকাম্বার সারাজীবনের স্বপ্ন। কিন্তু এনজনজো অন্যের স্বপ্নের মধ্য দিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। গাকাম্বা অসম্ভবকে সম্ভব করতে চেয়েছিলেন কিন্তু ইংরেজি জানা সেই উচ্চ শিক্ষিত সেই কেনিয়ান নিখুঁত ব্রিটিশ উচ্চারণে ঘোষণা দিলেন- আপনি এমনটি চেষ্টাও করবেন না।
আমি বলব, এটা ছিল কেনিয়ার পরস্পর বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি। গাকাম্বার লক্ষ্য বলবে ‘আফ্রিকা কিছু তৈরি করতে পারে’ আর এনজনজো বলবে, ‘এগুলো বাদ দাও ইউরোপ তৈরি করবে’। যদিও কেনিয়ার সক্ষম লোকজন সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন যেন গাকাম্বার মতো প্রতিভা ধ্বংস হয়ে না যায়। তারপরও এনজনজো সেই প্রতিভা ধ্বংস করে দিলেন। গাকাম্বার আবিষ্কারের ঘটনাটি সাধারণ কেনিয়ানদের মধ্যে কোনো লক্ষ্য হিসেবেই কাজ করেনি যে, কেনিয়ানরা আসলে কী করতে পারে। গাকাম্বার ঘটনাটি আমাকে ষাটের দশকের আরেকটি ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯৬৯ সালের দিকেই আমি নাইরুবি বিশ্বাবিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে যোগ দিয়েছিলাম। তখনকার ইংরেজি সিলেবাসে স্পেনসার থেকে শুরু করে শেকসপিয়র, টিএস ইলিয়টদের রচনাই প্রধান ছিল। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন ইংরেজি সাহিত্য কেনিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান বিষয় হিসেবে পড়ানো হবে? আমরা ইংরেজি বিভাগ বাতিল করার জন্য বলেছিলাম। প্রকৃত অর্থে আমরা ইংরেজি বিভাগের বিলুপ্তি চাইনি, চেয়েছিলাম আমাদের বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যেন বিভাগটি চালু করা হয়। আমরা কি সেখানে থেকে শুরু করতে পেরেছি? আমরা কি একটা ঔপনৈবেশিক প্রক্রিয়া থেকে সরে এসেছি? একটা স্ব-নেতিবাচক প্রক্রিয়া, কিংবা ঔপনৈবেশিক অবস্থার বিরুদ্ধে যেতে পেরেছি? আমরা আমাদের সাহিত্য দিয়ে কেনিয়াকে তৈরি করতে চেয়েছিলাম। যার মধ্য দিয়ে আফ্রিকানরা সমগ্র পৃথিবীর সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করতে পারবে। আমরা চেয়েছি ইংরেজি সাহিত্য বিভাগকে বিনির্মাণ করে শুধু সাহিত্য বিভাগ চালু হোক। যেখানে কেনিয়াসহ, সমগ্র আফ্রিকার সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করার পাশাপাশি এশিয়া, লাতিন আমেরিকা এবং ইউরোপসহ অন্যান্য সাহিত্য নিয়ে জানার সুযোগ থাকবে। সেই সময়ে ইংরেজি সাহিত্য বিভাগ ইংরেজি সাহিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমরা সাহিত্য বিভাগটিকে ইংরেজির হাত থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলাম।
‘যখন চাই তখন বিয়ে করব’ কর্মসূচিটি বন্ধ হয়ে যায়
আমাদের বিভাগ থেকে সেই সময়ে বেশ কিছু নামকরা বুদ্ধিজীবীরও জন্ম হয়েছে: সিমন গিকান্দি, যিনি এখন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক, জেমস ওগোদি, যিনি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়া বিশ্বাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক তাছাড়া আরও অনেকেই আছেন। যারা আফ্রিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত আছেন। ১৯৭৪ সাল থেকে কেনিয়ার স্কুলগুলোতে সাহিত্য শিক্ষা শুরু হয়ে পরবর্তী সময়ে আফ্রিকাসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে তা প্রসার লাভ করে। আর তার মধ্য দিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করার আগ-পর্যন্ত একজন কেনিয়ান তার সাহিত্য সম্পর্কে অবগত হতে পারে। কিন্তু এই মুই শাসন এই পাঠ্যক্রমের পরিবর্তন করতে গিয়ে কেনিয়ান সাহিত্যের সঙ্গে ইংরেজির গোলমাল বাঁধিয়ে দিয়েছে। ইংরেজি সাহিত্যকে এমনভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, যেখানে কেনিয়ার নিজস্ব সংস্কৃতি ইংরেজি ভাষার কাছে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। শুধু কেনিয়ান সাহিত্য পাঠ্যক্রম ধ্বংস করেই থেমে থাকেনি।
কামিরিথু প্রদেশের আরেকটি গল্প আছে। আমি তা নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছিলাম। নাইরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বুদ্ধিজীবী কামিরিথু প্রদেশের জনগণের উদ্যোগে ভূমিহীন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘যখন চাই তখন বিয়ে করব’ নামে একটি নাটক তৈরি করেছিলেন। কারিমুথি জনগোষ্ঠীর গ্রামীন জনপদের কথা চিন্তা করে গিকুইয়ো ভাষায় নাটকটি লেখা হয়েছিল, যা একশরও বেশি গ্রামে প্রদর্শিত হয়। ১৯৭৭ সালে ‘যখন চাই তখন বিয়ে করব’ কর্মসূচিটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন নাটকটির সহকারী লেখক হওয়ার জন্য আমাকে একবছরের জন্য কারাগারে পাঠানো হয়। এটা খুব সাধারণ বিষয় যে, তুমি যদি কোনো অঞ্চলের উন্নতির প্রধান হাতিয়ার মানুষ হয়ে থাকো, তাহলে সর্বপ্রথম তুমি তাদের ভাষা নিয়ে কাজ করবে। কামিরুথিরা বলছে, আফ্রিকান ভাষাই তাদের জন্য সহজ। কিন্তু আমাকে যারা কারাগারে পাঠালো। তারা বললো ইংরেজি ভাষা তাদের জন্য সহজ হবে। আর এই গল্পের মধ্য দিয়ে আমার আবারও গাকাম্বার কথা মনে পড়ে গেল। প্রতিটি গল্পেই দেখা যায় একটি জাতীয় উদ্যোগকে অস্বীকৃতি দেওয়া হয়। যার প্ররোচনা আসে ইউরোপ থেকে। এবং যাকে কোনো সমালোচনা ছাড়াই স্বাগত জানানো। এটা কি একটা দুর্ঘটনা?
এই প্রশ্নটি আবার আমাকে আরেকটি গল্পের কথা মনে করিয়ে দিল। ১৯৩৮ সালের দিকে আরেকজন কেনিয়ান কনিয়ানজি যুক্তরাষ্ট্রের হ্যাম্পটন ইন্সটিটিউট এবং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরেছিলেন। তার বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল তাকে ঘিরে। বাবা চেয়েছিলেন তার ছেলে একটি পাথরের ভবন তৈরি করুক। অবশেষে বাবার সহযোগিতায় সেই কেনিয়ান গিথাংগুরি টিচার্স কলেজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। কনিয়ানজির উদ্দেশ্য ছিল কেনিয়ানদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলা। তৎকালীন ঔপনৈবেশিক কেনিয়ার উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল এটি।
হ্যাম্পটন ইন্সটিটিউটের একজন স্নাতক এবং তাস্কিজি ইন্সটিউটের প্রতিষ্ঠাতা বুকার টি ওয়াশিংটনে দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন কনিয়ানজি। যদিও বুকার টি ওয়াশিংটন এর সামাজিক মর্যাদা সন্দেহজন ছিল কিন্তু তার অর্থনৈতিক অবস্থান কনিয়ানজিকে অনুপ্রাণিত করেছে। গিথাংগুরি তৈরি হয়েছিল সাধারণ কেনিয়ান নারী পুরুষের পরিশ্রমের ফলে। এটা কোনো ঔপনৈবেশিক প্রদেশ ছিল না।
পরাজয় আর গ্লানির মুকুট পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল
স্বাধীন স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষক তৈরি করার লক্ষ্যেই গিথাংগুরি টিচারস কলেজের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। প্রথম ঔপনৈবেশিকবিরোধী ধর্মীয় আন্দোলন এবং স্বাধীন স্কুল আন্দোলন একটি বড় প্রপঞ্চ ছিল। যা মার্কাস গারভেই দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ছিল। এই আন্দোলনের মূল স্লোগান ছিলো ‘দেশে কিংবা বিদেশে আফ্রিকানরা শুধু আফ্রিকানদের জন্য’। যখনই এই স্বাধীন স্কুল আন্দোলনের নেতারা কোথাও সাক্ষাৎ করতেন, নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী যতটুকু পারতেন আন্দোলনের জন্য অর্থ সহযোগিতা দিতেন । গিথাংগুরি ঠিক একই মূলনীতি নিয়ে তৈরি হয়েছিল। সেখানকার সাধারণ জনগণ যতটুকু সামর্থ্য হয়েছে, ঠিক ততটুকুই সহযোগিতা করেছে। স্বাধীন স্কুল আন্দোলনের নেতারা এবং গিথাংগুরির সাধারণ জনগণ সেই স্বপ্নই দেখেছিলেন, যা পূর্বে কোনো আফ্রিকান দেখেননি। কেনিয়ানরা জোর দিয়ে এটাই বলার চেষ্টা করেছে, ‘আমরা কেনিয়ানরাও কিছু করতে সক্ষম’ কিন্তু ঔপনৈবেশিক রাষ্ট্র বলেছে, ‘আমরা কেনিয়ানদের কিছু করতে দেব না।’
১৯৫২ সালের দিকে গিথাংগুরি এবং আফ্রিকার সকল স্বাধীন স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। আফ্রিকান ভাষায় রচিত সংবাদপত্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। অনেক পত্রিকার সম্পাদককে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। এই ঘটনা বন্দি শিবিরে থাকা আফ্রিকান ভাষার কবি গাকার ওয়ানজাও এবং স্ট্যানলি কাগিকাকেও উদ্বিগ্ন করেছে। বঞ্চনাকে মুকুট পরিয়ে সেদিন ঔপনৈবেশিক প্রদেশ গিথাংগুরিকে একটি কারাগারে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। আফ্রিকার আত্মনির্ভশীলতার প্রতীককে পরাজয় আর গ্লানির মুকুট পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
কেনিয়াকেন্দ্রিক আফ্রিকান ভাষায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার আন্দোলনটি ইংরেজি অভিজাতদের সুপরিকল্পিত নিয়মানুসারেই সংঘটিত হয় এবং ১৯৫২ সালের পরেই আইন করা হল যে, অন্যান্য যেকোনো বিষয়ে যতই ভালো ফল করা হোক না কেন, ইংরেজিতে উত্তীর্ণ না হলে তাকে পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করা হবে না। ইংরেজি শিক্ষা ধীরে-ধীরে জ্ঞান লাভের মাধ্যম এবং প্রতিভা বিকাশের মাধ্যম হিসেবে রূপ লাভ করে। ১৯৬৪ সালে সদ্যস্বাধীন আফ্রিকান সরকার দ্বারা গঠিত শিক্ষা কমিশন প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আফ্রিকান ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করে ঔপনৈবেশিক সরকারের চিন্তাকেই জাতীয়করণ করেছে।
বিশ শতকের দিকে অলিয়াসঁ ফ্রসেসের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াল্টার রোডনি তার বই ‘হাউ ইউরোপ আন্ডার ডেভেলপড আফ্রিকা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ঔপনৈবেশিক দেশগুলোকে একটি মজবুত মনস্তাত্ত্বিক বন্ধনে এমনভাবে আবদ্ধ করতে হবে, যদি কোনো সংগঠনরূপেও তাদের প্রগতিশীল বন্ধনমুক্তি ঘটে, তারা যেন তাদের ভাষায় এবং চিন্তায় ফরাসিই থেকে যায়।’
যখন আফ্রিকান ভাষায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, তখন তাদের স্পিকার রীতিমতো অপরাধীতে পরিণত হয়েছিল। বিদ্যালয়ে আফ্রিকান ভাষায় কথা বলতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীরা ধরা খেয়ে গেলে তাকে সবার সামনে দাঁড়িয়ে ‘আমি অপদার্থ’ এই শব্দটি উচ্চারণ করতে হতো। পশুকেও ঠিক একইভাবে পালন করা হয়। অপ্রত্যাশিত আচরণ করলে তাকে শাস্তি দেওয়া হয় এবং প্রত্যাশিত আচরণ করলে বাহবা দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে অবশ্য শাস্তি দেওয়ার এই বিধান একটি সাধারণ আচরণে পরিণত হয়েছে ইংরেজদের কাছে। এনজোনজো এবং তার ইংরেজিপ্রীতি কোনো দুর্ঘটনা ছিল না। আসলে বাস্তবটা হলো অনেক আফ্রিকান মধ্যবিত্তই এখন এনজনজোর মানসিকতা ধারণ করেন। এনজোনজোবাদ এখনো আফ্রিকার জন্য বড় সমস্যা। ইউরোপ আফ্রিকাকে ইংরেজি উচ্চারণের একটি খনি দিয়েছিল আর বিনিময়ে আফ্রিকা ইউরোপকে এই মহাদেশের খনিতে যত্রতত্র প্রবেশ করার সুযোগ দিয়েছে। এটা সত্য যে খড়্গ হাতেই ইউরোপ তাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জন করেছিল। অপরদিকে নিখুঁত ইংরেজি উচ্চারণ আর মৌনসম্মতির মাধ্যমে আফ্রিকা তাদের বিজয় অর্জন করেছে ।
আমাকে আমি হতে দাও
গতবছর নাইরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্রমণে বেশ ভালো লেগেছে। বিশুদ্ধ পানি এবং দই; এই দুটি জিনিস তারা নিজেরা তৈরি করেছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি করা দই খেয়েছি এবং বিশুদ্ধ পানি পান করেছি। আমার ভালো লাগছে এই কারণে যে, এই দুটো জিনিসই কেনিয়া উৎপাদন করেছে। জার্মানির মোই বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি গ্রহণের সময় তারা আমাকে একখণ্ড কাপড় উপহার দিয়েছিল, যা কেনিয়ায তৈরি। ওই বছর আমার পাওয়া এটি ছিল শ্রেষ্ঠ উপহার। কী হত যদি এনজনজো আরেকটি নতুন বিমান তৈরির জন্য ঘোষণা দিতেন?
আমার বন্ধুরা চল নাইরবি বিশ্ববিদ্যালয় পথে। আমরা শুধু পোশাক, দই কিংবা বিশুদ্ধ পানি তৈরি করে থেমে থাকব না। কেন বাইসাইকেল তৈরি করব না? কেন গাড়ি তৈরি করব না? কেন অস্ত্র তৈরি করব না? কোনো রাষ্ট্রের স্থায়ী বন্ধু থাকে না, শুধু স্থায়ী স্বার্থ থাকে। তুমি আজ যার ওপর নির্ভর করবে, কাল সে তোমাকে বিতাড়িত করবে। প্রতিটি রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে সর্বপ্রথম নিজেদের চাহিদা মেটানো। অধীনতা, অনুকরণ কিংবা ভিক্ষাবৃত্তি নয় বরং আমাদের প্রতিমুহূর্তে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে হবে, মহত্বের জন্য সংগ্রাম করতে হবে। আমাদের এই সংস্কৃতিই আমাদের কেনিয়া কিংবা আফ্রিকার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে সহযোগিতা করবে। একজন অনুকারক শুধু অন্যকে অনুসরণ করেন এবং নিজের মধ্যে লালিত অবিশ্বাসের দ্বারাই পরিচালিত হন। যার সূত্রপাত হয় তার নিজ ভাষার মধ্য দিয়ে। যদি তুমি পৃথিবীর সবগুলো ভাষাও জানো, কিন্তু নিজের মাতৃভাষা না জানো, তাহলে সেটা হবে সবচেয়ে বড় দাসত্ব। আর যদি তুমি তোমার নিজের সংস্কৃতির ভাষা জানো, তাহলে পৃথিবীর অন্য ভাষার সঙ্গে সহজে যুক্ত হতে পারবে। আর এটাই হবে ক্ষমতায়ন।
তাদের কাছ থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত, যারা আফ্রিকায় গিথাংগুরি টিচার্স কলেজ এবং স্বাধীন স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তারা নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী জনগণের কল্যাণে ব্যয় করতে চেয়েছিলেন। আর তাদের অবদানের জন্যই বর্তমানে জনগণের নিকট নেতৃত্বের একটি আস্থা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক অফিস ব্যক্তিগত বিশ্বাসে জায়গা দখল করেছে। যদিও এখনো ঔপনৈবেশিক আইন অব্যাহত রয়েছে তবু যারা ক্ষমতায় আছেম তারা কেনিয়ানদের নিজের জ্ঞাতি ভাইয়ের মতোই পরিচর্যা করেন এবং বহিরাগত শক্তির হাত থেকে কেনিয়াকে রক্ষা করার প্রতিজ্ঞায় ব্রত। কখনো যদি আমরা কেনিয়াকে একজন বহিরাগতের দৃষ্টি দিয়ে দেখি, তাহলে আমরা চরম বিশ্বাসঘাতকতা করব।
আমার উপন্যাস ‘তুমি কেদনা শিশু’ পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমি একদল মানুষের আত্মদানের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখিয়েছি। তারা তাদের যন্ত্রণা এবং মৃত্যুর মাধ্যমে সংগ্রামের গৌরব অর্জন করেছে। তারা প্রতিরোধের এক নান্দনিক দৃশ্যকাব্যের সূচনা করেছেন। এবং তারা গান গেয়েছেন, ‘আমাকে আমি হতে দাও’। যদি তুমি আমাকে আমি হতে শিক্ষা দাও, তাহলেই তুমি আমাকে দেখতে পাবে। যদি তুমি আমাকে আমি হতে শিক্ষা দাও তাহলেই আমি মুক্তি পাব। অথবা তুমি কি আমাকে মুক্ত করতে ভয় পাও?