বিকল্প
আমি মনে করি,মডার্নিটি ও তার প্রকল্পকে ব্যর্থ হিসেবে পরিত্যাগ করার বদলে আমরা সেসব অসংযত কর্মসূচির ভুল থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারি—যে কর্মসূচি আধুনিকতাকে অস্বীকার করার চেষ্টা করেছে। বস্তুত, শিল্পের বিভিন্ন প্রকার অন্তর্ভুক্তি একটা উদাহরণ হতে পারে যা বেরিয়ে এসে অন্ততঃপক্ষে একটা দিক-নির্দেশনা দেবে। বুর্জোয়া শিল্প থেকে তার দর্শকদের একইসঙ্গে দু’টি প্রত্যাশা থাকবে। একদিকে যেসব অজ্ঞ ব্যক্তিশিল্প উপভোগ করছে, তারা নিজেদের বিশেষজ্ঞে পরিণত করার জন্য নিজেকে শিক্ষিত করে তুলবে। অন্যদিকে,তারা শিল্পবোদ্ধা যোগ্য সংগ্রাহক হিসেবে আচরণ করতে থাকবে এবং নন্দনতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতাকে নিজের সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত করে নেবে। আপাত নির্দোষ শিল্প অভিজ্ঞতার এই দ্বিতীয় আচরণ তার মৌলিক নিহিতার্থ সত্যিই হারিয়ে ফেলেছে। কেননা এর দক্ষ ও প্রফেশনাল হওয়ার প্রবণতার সঙ্গেএকটা দ্বিধার সম্পর্ক রয়েছে।
বাস্তবিকই শৈল্পিক সৃজন শুকিয়ে যাবে, যদি এটা স্বায়ত্তশাসিত সমস্যার বিশিষ্ট ব্যবস্থাপত্র মতো পরিচালিত না হয়। যদি এটা সেসব বিশেষজ্ঞের গোচরে না আসে, যারা জনপ্রিয় প্রশ্নগুলোকে তেমন আমল দেন না। শিল্পী ও সমালোচক উভয়েই ক্রমেক্রমে বিষয়গুলো গ্রহণ করে, যেন এসব সমস্যা সংস্কৃতি জগতের ‘অভ্যন্তরীণ যুক্তিরত’ খপ্পরে পড়ে। কেবল আইনসিদ্ধতার এই একটি দিকের প্রতি একচেটিয়া মনোযোগ এবং সত্য ও ন্যায়বিচারের প্রসঙ্গে বাধা দান, নন্দনতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতাকে ব্যক্তি জীবনের ইতিহাসে টেনে আনার সঙ্গে সঙ্গে এই সুক্ষ্ম সীরারেখা ভেঙে যায় এবং সাধারণ জীবনে অঙ্গীভূত হয়। সাধারণ লোকের কিংবা ‘প্রাত্যহিক দক্ষ ব্যক্তি’র শিল্পকে গ্রহণ অবশ্যই প্রফেশনাল সমালোচকদের শিল্পকে গ্রহণের চেয়ে ভিন্ন।
আলব্রেস্ট ওয়েলমার (Albrecht Wellmer) একটা বিশেষ দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন—এক্সপার্টদের রুচির সূক্ষ্ম বিচার দিয়ে তৈরি হয়নি যে নন্দনতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা তার গুরুত্ব পাল্টে যেতে পারে। যখনই তেমন কোনো অভিজ্ঞতা জীবন-ইতিহাসের একটি অবস্থাকে আলোকিত করতে ব্যবহৃত হয় এবং জীবনের সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়,তখন তা একটা ভাষার খেলায় প্রবেশ করে, যা আর কিছুতেই নন্দনতাত্ত্বিক সমালোচনা থাকে না। নন্দনতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা তখন আমাদের প্রয়োজনের পরিভাষাকেই কেবল নবায়ন করে না,তার আলোকে আমরা বিশ্বকেও উপলদ্ধি করতে পারি। সেই সঙ্গে এটা আমাদের বোধের অর্থবাচকতা ও স্বাভাবিক প্রত্যাশাকে অনুমোদন করে এবং এই সবসময় পারস্পরিক আচরণকে পাল্টে দেয়। আসুন, এই প্রক্রিয়ায় একটা উদাহরণ দেখা যাক।
শিল্পের সঙ্গে সম্পর্কায়ন ও গ্রহণের এই আচরণ জার্মান-সুইডিশ লেখক পিটার ওয়েইস এর প্রতিরোধের নন্দনতত্ত্ব (The Aesthetics of Resistance) এর প্রথম খণ্ডে প্রস্তাব করা হয়েছে। ওয়েইস শিল্পকে পুনরোপযোগী করার এই প্রক্রিয়াকে বর্ণনা করেন ১৯৩৭ সালে বার্লিনের একদল রাজনীতি-সচেতন জ্ঞানপিপাসু কর্মীকে উপস্থাপনার মাধ্যমে। তারা ছিল এমন কিছু যুবক, যারা বৈকালিক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় শিল্পের সাধারণ ও সামাজিক ইতিহাস অনুধাবনের বুদ্ধি অর্জন করে। এই বিষয়ে মনের স্থিতিস্থাপক অট্টালিকার বশবর্তী হয়ে তারা শিল্পকর্মের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে। তারা সবাই মিলে যে পাথর একত্রিত করেছিল এবং আপন পারিপার্শ্বিকতার আদলে পুনরায় জোড়া দিয়েছিল,বার্লিনের মিউজিয়ামে বার বার শিল্পকর্মের মূর্তকরণ দেখতে দেখতে তারা নিজেদের টুকরো টুকরো পাথর সরাতে শুরু করে। সেই পারিপার্শ্বিকতা ছিল ঐতিহ্যগত শিক্ষা থেকে অনেক দূরে, একইসঙ্গে তৎকালীন শাসনব্যবস্থা থেকে দূরবর্তী। এই তরুণ কর্মীরা ফিরে গিয়েছে ইউরোপীয় শিল্পের প্রাসাদ ও তাদের নিজস্ব পারিপার্শ্বিকতার মধ্যবর্তী অবস্থানে,যতক্ষণ না তারা উভয়কেই আলোকিত করতে সক্ষম হয়েছে।
জীবন-বিশ্বের মূলবিন্দু থেকে এক্সপার্টদের সংস্কৃতির যথার্থতা তুলে ধরতে পারে, এমন উদাহরণে আমরা ব্যর্থ—স্যুররিয়ালিস্ট বিদ্রোহের প্রণোদনার বিচারকারী একটি উপাদান দেখতে পাই; যদিও ব্রেশট ও বেনজামিনের অধিক আগ্রহ,আভা হারাচ্ছে এমন শিল্প কোন উপায়ে এখনো পথকে আলোকিত করার ক্ষেত্রে গ্রহণীয়—তার ওপর। মোট কথা, মডার্নিটির প্রকল্প এখনো পরিপূর্ণ হয়নি। শিল্পের গৃহীত হওয়া কেবল তার তিনটি সম্ভাবনার একটি মাত্র। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য আধুনিক সংস্কৃতির সঙ্গে প্রতিদিনের প্রথাকে পুনঃসংযোগ করা, যে প্রথা এখনো প্রধান উত্তরাধিকারের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সামান্য ঐতিহ্যবাদিতার জন্য হতদরিদ্র হয়ে পড়ে। যাই হোক,এই নতুন যোগাযোগ একমাত্র এই শর্তে স্থাপিত হতে পারে যে, সামাজিক আধুনিকীকরণ হবে একটা ভিন্নতর পথে। জীবন-বিশ্বকে এমন এক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত হতে হবে, যার মধ্য থেকে অভ্যন্তরীণ গতিময়তা এবং প্রায় স্বায়ত্তশাসিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থ্যার অনুজ্ঞাগুলো ও তার প্রশাসনিক সৌজন্য একটা রূপরেখা পাবে।
আমি যদি ভ্রান্ত না হই, এই বিষয়ে আজকের এই সুযোগ তেমন ভালো কিছু নয়। আজ পশ্চিমা বিশ্বে ধনবাদী আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক আধুনিকতার সূক্ষ্মধারার প্রসার ঘটার এমন একটা পরিবেশ কমবেশি তৈরি হয়েছে। শিল্প ও দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করার কর্মসূচির ব্যর্থতার ফলে রক্ষণবাদী অবস্থানে ছলনার মোহমুক্তি ঘটেছে। এখন তরুণ রক্ষণবাদীদের প্রতি আধুনিকতাবাদ থেকে প্রবীণ রক্ষণবাদীদের প্রাক-আধুনিকতাবাদ ও নব্য রক্ষণবাদীদের আধুনিক-উত্তরবাদের পার্থক্য সংক্ষেপে চিহ্নিত করা যাক।
তরুণ রক্ষণবাদীরা নন্দনতাত্ত্বিক আধুনিকতার মূল অভিজ্ঞতাকে পুনরালোচনা করে। তারা বিকেন্দ্রীভূত মানসিকতার উদঘাটিত রহস্য,কাজ ও ব্যবহার্যতার অনুজ্ঞা থেকে মুক্তিকে নিজস্ব বলে দাবি করে এবং এই অভিজ্ঞতাসমূহের মধ্য দিয়ে তারা আধুনিক বিশ্বের বাইরে পা রাখে। তারা আধুনিকতাবাদী প্রবণতার ওপর ভিত্তি করে খাপ খাওয়ানোর অযোগ্য এক প্রতি-আধুনিকতাকে সমর্থন দান করে। তারা দূরবর্তী কোনো এক জগতে সরে গিয়ে কল্পনা শক্তি, আত্ম-অভিজ্ঞতা ও আবেগকে সে কেলে করে তোলে। যান্ত্রিকতার কারণে তারা এমন এক মূল নীতিকে পাশে রাখে, যা কেবল স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলার মাধ্যমে সম্ভব। ফ্রান্সে এই ধারা অগ্রসর হয় জর্জ বাতাইলে (George Bataille) থেকে মিশেল ফুকো (Michel Faucault) হয়ে জাঁকদেরিদা (Jaeques Derrida) পর্যন্ত।
‘প্রবীণ রক্ষণশীলেরা’ নিজেদের সাংস্কৃতিক আধুনিকতা দ্বারা কলুষিত করে না। তারা বিষণ্নতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বিশিষ্ট কারণগুলোর অবক্ষয়; বিজ্ঞান, নৈতিকতা ও শিল্পের পৃথকায়ন; আধুনিক বিশ্ব-বীক্ষা ও তার ন্যূনতম পদ্ধতিগত যৌক্তিকতা; প্রত্যায়ন করে আধুনিকতার সম্মুখবর্তী একটি অবস্থানের সরে যাওয়াকে। নব্য অ্যারিস্টটলবাদীরা বিশেষত আজ এক বিশেষ বিজয় উপভোগ করে। পরিবেশ বিজ্ঞানের অমীমাংসিত দৃষ্টিতে, এটা সৃষ্টি তত্ত্বসংক্রান্ত এক নীতির আহ্বান করে। লিও স্ট্রাস (Leo strauss) কেদিয়ে আরম্ভ যে স্কুলের, তার দলভুক্তদের মধ্যে হান্স জোনাস (Hans jonas) ওরবার্ট স্পেইমান (Robert Spaemann)-এর আকর্ষণীয় কাজগুলোকে নিঃসন্দেহে গণ্য করা যায়।
সর্বোপরি, নব্যরক্ষণবাদীরা আধুনিক বিজ্ঞানের উন্নতিকে স্বাগত জানায়, যতদিন এটা তার জগতের বাইরে থেকে কেবল টেকনিক্যাল অগ্রগতি, ধনবাদী প্রসার ও যৌক্তিক প্রশাসন চালিয়ে যায়। পরন্তু, তারা সাংস্কৃতিক আধুনিকতায় বিস্ফোরক উপাদানগুলো মুছে ফেলার একটি রাজনীতির সুপারিশ করেছে। একটি থিসিস অনুসারে, বিজ্ঞানকে যখন সঠিকভাবে বোঝা যায়, তখন তা জীবন-বিশ্বের সঙ্গে পরিচিতির কারণে চূড়ান্তভাবে অর্থহীন হয়ে পড়ে। আরেকটা থিসিস বলছে,রাজনীতিকে নৈতিক-ব্যবহারিক যুক্তির প্রয়োজনীয়তা থেকে যত দূরে সম্ভব, অবশ্যই তত দূরে রাখতে হবে। একটি তৃতীয় থিসিস শিল্পের অন্তর্নিহিত বিশুদ্ধতা দাবি করে। তর্ক করে যে এর একটা ইউরোপীয় উপাদান রয়েছে; নন্দনতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতাকে গোপনীয়তায় সীমাবদ্ধ করার জন্য কাল্পনিক চরিত্রকে নির্দেশ করে। কিন্তু জীবন-বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ও এক্সপার্ট-শাসিত বিজ্ঞান, নৈতিকতা ও শিল্পের স্বতন্ত্র জগতে চূড়ান্ত বন্দিদশা, সাংস্কৃতিক আধুনিকতার অবশেষ কেবল তা-ই, আমরা আধুনিকতার প্রকল্পকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করলে যতটা অবশেষ থাকতো। এর বদলি হিসেবে ট্র্যাডিশনকে দেখানো যায়, যা স্বাভাবিক যৌক্তিকতা ও আইনসিদ্ধতার প্রয়োজনীয়তার প্রতি নির্মোহ থাকতে পারে। এই প্রকারভেদ অবশ্য অন্যগুলোর মতোই সরলীকরণ। কিন্তু এটা সাম্প্রতিক বুদ্ধিবৃত্তিগত ও রাজনৈতিক সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণে একেবারে অসার নয়। আমার ভয় হচ্ছে, প্রতি-আধুনিকতার ধারণাগুলো প্রাক-আধুনিকতার অতিরিক্ত স্পর্শে বিকল্প সংস্কৃতির বলয়ে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে পড়েছে। জার্মানির রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চেতনার রূপান্তর পর্যবেক্ষণ করলে একটা নতুন আদর্শের দিকে তাদের সরে আসা স্পষ্ট হয়। এটা হচ্ছে আধুনিক-উত্তরবাদীর সঙ্গে প্রাক-আধুনিকদের ঐক্য। এতে মনে হয়, বস্তুত বুদ্ধিজীবীদের অন্যায় সুবিধা গ্রহণ ও নব্য রক্ষণবাদের অবস্থানকে একচ্ছত্রতা দেবে তেমন কোনো দল নেই। ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের উদার তেজস্বী ভাবের প্রতি আমার কৃতজ্ঞ থাকার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কেননা এ শহর আমাকে থিওডার অ্যাডর্নো ((Theodor Adorno) নামের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য দিয়েছে। তিনি এ শহরের একজন গুরুত্বপূর্ণ সন্তান। তিনি দার্শনিক ও লেখক হিসেবে আমাদের দেশে অতুনলীন উপায়ে বুদ্ধিজীবিতার এক ইমেজ দাঁড় করিয়েছেন, এমনকী তিনি বুদ্ধিজীবিতা ছাড়িয়ে যাওয়ার সাধনায় মারাত্মক ইমেজে পরিণত হয়েছেন।
- শেষ
-
আধুনিকতা একটি অসম্পূর্ণ প্রকল্প-২॥ ইয়রগেন হ্যাবারমাস
-
আধুনিকতা একটি অসম্পূর্ণ প্রকল্প-১॥ ইয়রগেন হ্যাবারমাস