চিত্রকর ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের অনুকরণে স্থপতিরা ১৯৮০ সালে ভেনিসের দ্বি-বার্ষিকউৎসবে যোগ দেন। এই প্রথম স্থাপত্য দ্বি-বার্ষিককে যে ঘোষণা শব্দিত হয় তা আশাভঙ্গের, নৈরাশ্যের। আমি বলব, ভেনিসে যারা প্রদর্শনী করেছেন, তারা উল্টাফ্রন্টের এক আভাঁগার্দ সংগঠিত করেছে। অর্থাৎ তারা একটি নতুন ঐতিহাসিকভাবাদের জায়গা তৈরি করার জন্য আধুনিকতার ট্রাডিশনকে উৎসর্গ করেছেন। এই উৎসবের ওপর ভিত্তি করে জার্মান পত্রিকা Frankfurter AllgemeineZeitung- এর এক সমালোচক একটা থিসিসের দিকে অগ্রসর হন, যা নানা ব্যাপারে গুরত্বপূর্ণ। আমাদের সময়ে এটি একটি যথার্থ মূল্যায়ন যে ‘আধুনিক-উত্তরবাদ অবশ্যই প্রতি-আধুনিকতাবাদ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে।’ এই বক্তব্য আমাদের সময়ের এক আবেগী ধারাকে বর্ণনা করে যা বৌদ্ধিকজীবনের সব ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে। এটা উপস্থাপন করেছে আধুনিকোত্তর ও ইতিহাস-উত্তর আলোচ্য বিষয়গুলোকে।
ইতিহাস থেকে আমরা প্রাচীন ও আধুনিক (The Ancients and the Moderns) প্রবাদটি জানতে পারি। এখন এই ধারণাগুলো সংজ্ঞায়িত করে শুরু করা যাক। মডার্ন (‘Modern’) অভিধাটির এক লম্বা ইতিহাস আছে, যার একটি হান্স রবার্ট যাস (Hans Robert Jauss) অনুসন্ধান করেছেন। ‘মডার্ন’ শব্দটি তার ল্যাটিন ফর্ম মডার্নাস (Modernus) হিসেবে সর্বপ্রথম পঞ্চমশতাব্দীর শেষাংশে ব্যবহৃত হয় বর্তমানকে আলাদা করার মানসে, পরবর্তী সময়ে যারোমান ও প্যাগান অতীত থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে খ্রিস্টান হয়েছে। বিভিন্ন পরিবর্তনীয় বিষয়ে ‘মডার্ন’ অভিধাটি বারবার একটা যুগের সচেতনতাকে প্রকাশ করে, যা নিজেকে পুরনো থেকে নতুনে পরিবর্তনের ফল হিসেবে দেখানোর উদ্দেশ্যে অতীত-প্রাচীনত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
কিছু লেখক মডার্নিটি ‘(Modernity)’-র ধারণাকে রেনেসাঁসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চান। কিন্তু তা ঐতিহাসিকভাবে খুবই সংকীর্ণ। মানুষ তাদের দ্বাদশ শতকে চার্লস দ্য গ্রেটের সময়ে আধুনিক মনে করেছে। সেইসঙ্গে ফ্রান্সে সতেরো শতকের শেষাংশে বিখ্যাত প্রাচীন ও আধুনিকের বিরোধ (‘Querelle des Anciens et des Modernes’)-এর কালেও। কাজেই বলা যায়, যখন প্রাচীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে একটি নতুন যুবচেতনা তৈরি হয়েছে তখনই ‘মডার্ন’ তথা ‘আধুনিক’ অভিধাটি ইউরোপে উচ্চারিত হয়েছে—বিশেষত যখন কোনো ধরনের অনুকৃতির পুনরুদ্ধারের জন্য প্রাচীনত্বকে একটা মডেল হিসেবে ধরা হয়। প্রাচীন বিশ্বের ক্ল্যাসিকগুলো পরবর্তী সময়ের যে মেজাজের ওপর ভিত্তি করে উচ্চারিত, তা প্রথমে ফ্রান্সের Enlightenment বা আলোকনের আদর্শের সঙ্গে সংমিশ্রিত হয়। বস্তুত প্রাচীনের দিকে ফিরে তাকিয়ে ‘আধুনিক’ হয়ে ওঠার ধারণা আজ আধুনিক বিজ্ঞানের মদদে, জ্ঞানের অশেষ উন্নতিতে এবং সামাজিক ও নৈতিক হিতসাধনার অবিস্মরণীয় অগ্রগতিতে বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত। রোমান্টিক মডার্নিস্টরা ক্ল্যাসিকপন্থীদের প্রাচীন আদর্শকে অস্বীকার করতে চায়। তারা নতুন ঐতিহাসিক যুগের অপেক্ষায় ছিল এবং তা পেয়েও ছিল আদর্শায়িত মধ্যবয়সে। যাই হোক, ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে প্রতিষ্ঠিত এই নতুন আদর্শকাল কোনো একটি নির্ধারিত আদর্শে থিতু ছিল না। ঊনিশ শতকের সময়প্রবাহে বেরিয়ে এসেছে আধুনিকতার সচেতনতাকে আমূল বদলে দেয়, এমন এক রোমান্টিক মেজাজ, যা নিজেকে সব বিশিষ্ট ঐতিহাসিক বন্ধন থেকে মুক্ত করে। এই অতিসাম্প্রতিক আধুনিকতা কেবল ঐতিহ্যে ও বর্তমানের মধ্যে বিমূর্ত বিরোধ সৃষ্টি করে। আমরা এখনো এক প্রকারে ঊনিশ শতকের ধোঁয়াশার মধ্যে আবির্ভূত নন্দনতাত্বিক আধুনিকতার সমসাময়িক। সেই থেকে যা ‘নতুন’ ও যা পরবর্তী নতুনত্বের স্টাইল দ্বারা অতিক্রান্ত ও বাতিল হয়ে যাবে তেমন কাজকে আধুনিকহিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু যখন কেবল তার স্টাইলিশ অংশটুকু পুরনো ও বাতিল হয়ে যাবে, তখন যেটুকু আধুনিক তা ক্ল্যাসিকালের গোপন বন্ধনে সংরক্ষিত হবে। সময়কে অবশ্যই সব সময়েই ক্ল্যাসিক হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু কষ্টকৃত আধুনিক ডকুমেন্ট আর কিছুতেই ‘বিগত যুগের অধিপতি’ থেকে ক্ল্যাসিকে পরিণত হওয়ার ক্ষমতা রাখে না। বরং একটা আধুনিক কাজ তখনই ক্ল্যাসিকে পরিণত হয়, যখন তা প্রকৃত অর্থেই আধুনিক হয়ে থাকে। আমাদের আধুনিকতা বোধই তার ক্ল্যাসিক হওয়ার আত্মমগ্ন বিধিনিষেধ তৈরি করে। এ জন্যই আমরা উদাহরণ স্বরূপ বলি, আধুনিক শিল্পের ইতিহাস মানে ক্ল্যাসিকাল মডার্নিটির ইতিহাস। ‘মডার্ন’ ও ‘ক্ল্যাসিক্যাল’-এর মধ্যকার সম্পর্ক সত্যিই একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক অনুষঙ্গ হারিয়েছে।
নন্দনতাত্ত্বিক আধুনিকতার শৃঙ্খলা
বোদলেয়ারের (Boudelaire) কাজে নন্দনতাত্ত্বিক আধুনিকতার মেজাজ ও শৃঙ্খলা একটা পরিষ্কার অবয়ব ধারণ করে। আধুনিকতা তখন বিভিন্ন আভাঁগার্দ আন্দোলনে উন্মেচিত এবং শেষ পর্যন্ত তার ক্লাইম্যাক্স দাদাবাদীদের ক্যাফে ভলতেয়ার ও স্যুররিয়ালিজমে গিয়ে পৌঁছায়। নন্দনতাত্ত্বিক আধুনিকতা সেই সব প্রবণতা দ্বারা বিশিষ্ট, যারা পরিবর্তিত সময়ের চেতনায় কিছু সাধারণ ফোকাস খোঁজে। ভ্যানগার্ড ও আভাঁগার্দের রূপকের মাধ্যমে এই সময়-চেতনা নিজেকে প্রকাশ করেছে। আভাঁগার্দ নিজেকে এক অজানা অনুপ্রবেশকারী মনে করে, যা অনর্জিত ভবিষ্যৎকে জয় করার জন্য প্রতিনিয়ত আকস্মিক আঘাতকারী বিপদের সম্মুখীন। আভাঁগার্দকে অবশ্যই একটি ল্যান্ডস্কেপের নির্দেশনা খুঁজে নিতে হয়, এখনপর্যন্ত দৃশ্যত কেউ যার ঝুঁকি নেয়নি। কিন্তু এই অগ্রবর্তী দলাদলি, এই অচিহ্নিত ভবিষ্যতের পূর্বাভাস এবং নতুন ধরনের বিশ্বাস বস্তুত বর্তমানের বিজয়। এই নতুন সময়-চেতনা বার্গসনের (Bergson) লেখায় দর্শনশাস্ত্রে অভিজ্ঞতায়, ইতিহাসের ত্বরণে, দৈনন্দিন জীবনের যতিতে। দ্রুত বিলীয়মান এই নতুন মূল্যবোধ ছলনাময় ও ক্ষণজীবী। গতিশীলতার এই প্রবল আয়োজন একটি পবিত্র, নিষ্কলঙ্ক ও স্থায়ী বর্তমানের জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে।
এটা বরং একটি বিমূর্ত ভাষাকে ব্যাখ্যা করে, যেখানে মডার্নিস্ট চেতনাকে ‘অতীত’ বলা হয়েছে। প্রতিটি যুগকেই তার নিজস্ব শক্তিকে হারাতে হয়। বর্তমানের নায়কোচিত আকর্ষণের সঙ্গে ইতিহাসের চূড়ান্ত পর্যায়গুলো ঐতিহাসিক স্মৃতির স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে—বর্তমানের এমন এক কালপর্বে, যখন অধঃপতন তার নিজের বর্বরতা, বন্যভাব ও আদিমতাকে তৎক্ষণাৎ চিহ্নিত করে। আমরা পর্যবেক্ষণ করি—ইতিহাসের ধারাবাহিকতাকে উড়িয়ে দেওয়ার নৈরাজ্যবাদী এ প্রবণতা, যাকে এই নতুন নান্দনিক সচেতনতার ক্ষতিকর শক্তি হিসেবে গণ্য করা যায়। মডার্নিটি ট্রাডিশনকে স্বাভাবিকীকরণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। মডার্নিটি বেঁচে থাকে এ সব সাধারণের বা স্বাভাবিকের বিরুদ্ধাচরণের অভিজ্ঞতার ওপর। এই নন্দন তাত্ত্বিকচেতনা প্রতিনিয়ত গোপনীয়তা ও পাবলিক স্ক্যান্ডালের মধ্যে একটি দ্বান্দিক নাটিকা মঞ্চস্থ করছে। এটা সেই অবজ্ঞাকারী ভয়াবহতার প্রবণতা দ্বারা নেশাগ্রস্ত; এখনো অবজ্ঞা করার মামুলি ফলাফলে সর্বদা শূন্যে ধাবমান।
অন্যপক্ষে আভাঁগার্দের শিল্পে সংশ্লিষ্ট সময়-চেতনা বিন্দুমাত্র অনৈতিহাসিক নয়। বরং এটা ইতিহাসের ভুল স্বাভাবিকত্বের বিপরীতে ধাবিত। আধুনিক আভাঁগার্দ-চেতনাতীতকে একটা ভিন্ন পথে ব্যবহার করতে চেয়েছে। এটা ঐতিহাসিকবাদের বাস্তবায়নের মাধ্যমে সুলভ অতীতকে পুঞ্জীভূত করে। কিন্তু একই সময়ে তা ঐতিহাসিকবাদের জাদুঘরে বন্দি নিরপেক্ষ ইতিহাসের বিরোধিতা করে।
স্যুররিয়ালিজমের চেতনাকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ওয়াল্টার বেনজামিন (Walter Benjamin) ইতিহাসের সঙ্গে মডার্নিটির একটা সম্পর্ক স্থাপন করেন, আমি যাকে ইতিহাস-উত্তর প্রবণতা বলতে চাই। তিনি ফরাসি বিপ্লবের আত্মোপলব্ধির কথা মনে করিয়ে দেন। ‘বিপ্লব প্রাচীন রোমের নজির দেখিয়েছে, যেভাবে ফ্যাশন তুলে আনে কোনো সেকেলে পোশাককে। ফ্যাশন যখনই কোনো প্রাচীনের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়, তখনই তার গায়ে একটা চলমানতার গন্ধ লেগে যায়।’ এটা হচ্ছে চমকপ্রদ উদ্ঘাটনের কাল হিসেবে বর্তমানের মানসিকতা সম্পর্কে বেনজামিনে ধারণা। এটা এমন এক সময়, যখন মানবজাতির ত্রাণকারী স্প্লিন্টারসমূহ বিধ্বস্ত। এভাবে রোবে স্পিয়েরের (Robespierre) ক্ষেত্রেও প্রাচীন রোম ছিল অতীতাশ্রয়ী। চমকপ্রদ উদঘাটন।
এখন, এই নন্দনতাত্ত্বিক আধুনিকতার চেতন সম্প্রতি বয়স্ক হতে শুরু করেছে। ষাটের দশকে একদা এটা খুবই আলোচিত ছিল। সত্তর দশকের পর, আমরা অবশ্য এটা মেনে নেব যে, আধুনিকতা পনের বছর আগে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করতো, এখন আর তেমন করে না। ষাট দশকের মাঝামাঝি আধুনিকতার এক তীর্থযাত্রী অক্টাভিও পাজ (Octavio Paz) বলেছেন, ‘১৯৬৭-র আভাঁগার্দ ১৯১৭-র কর্মকাণ্ড ও অঙ্গভঙ্গিকে পুনরাবৃত্তি করে। আমরা আধুনিক শিল্পের শেষ দশার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।’ পিটার বার্গারের (Peter Burger) কাজ আমাদের ‘আভাঁগার্দ পরবর্তী’ শিল্পের কথা বলতে শিখিয়েছে। এই অভিধাটি স্যুররিয়ালিস্ট বিদ্রোহের ব্যর্থতাকে ইঙ্গিত করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু এই ব্যর্থতার মানে কী? এটা কি আধুনিকতার বিদায় সংবর্ধনার ইঙ্গিত বহন করে? আরও বিস্তৃতভাবে ভাবলে, আভাঁগার্দ পরবর্তী শিল্পের উপস্থিতি কি সেই পোস্টমডার্নিটি-খ্যাত বিস্তৃত কর্মকাণ্ডে উত্তরণ বোঝায়?
বস্তুত, এটা কিভাবে ঘটে, তা আমেরিকার খুব ব্রিলিয়ান্ট নব্য রক্ষণবাদী ডানিয়েল বেলের (Daniel Bell) কাগজপত্র বুঝতে সাহায্য করে। ‘পুঁজিবাদের সাংস্কৃতিক বৈরিতা (The Cultural Contradictions of Capitalism) গ্রন্থে বেল বলেন—‘পশ্চিমের উন্নত সমাজের সংকট খুঁজতে গেলে শিল্প ও সমাজের অতীত খুঁড়তে হবে। আধুনিক সংস্কৃতি প্রাত্যহিক জীবনের মূল্যবোধ-সমূহের ভেতর ঢুকে পড়ে।’ আজজীবন-বিশ্ব তাই আধুনিকতায় আক্রান্ত। আধুনিকতার শক্তির জন্যই আত্মোপলদ্ধির মূলনীতি, খাঁটি আত্ম-অভিজ্ঞতার প্রয়োজনীয়তা এবং অতি স্পর্শকতার আত্মবাদপ্রভাব বিস্তার করেছে। বেলের মতে এই মানসিকতা আনন্দবাদী প্রবণতাকে সমাজের পেশাগত জীবনের নিয়ম শৃঙ্খলার দৃঢ় বন্ধন থেকে ছড়িয়ে নিয়েছে। উপরন্তু, আধুনিক সংস্কৃতি জীবনের ফলপ্রসু ও যৌক্তিক আচারের আত্মিক ভিত্তির সঙ্গে খাপ খায় না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বেল প্রোটেস্ট্যান্ট নৈতিকতার (মেক্স ওয়েবার আগেই যেন ব্যাঘাত ঘটিয়েছেন) অবসানের দায়িত্বের গুরুভাব ‘উপদেশক সংস্কৃতি’র (advisary culture) ওপর অর্পণ করেন। সংস্কৃতির এই আধুনিক রূপ অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তৃত্বের চাপে যৌক্তিকতায় পরিণত দৈনন্দিন জীবনের প্রথা ওসদ্গুণ-সমূহের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করে।
এখন একটি জটিল কুঞ্চনের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। বলা হয় যে, আধুনিকতার স্পন্দন আজ পরিশ্রান্ত। এখন নিজেকে আভাঁগার্দ ভাবা অনেকটা নিজের মৃত্যু পরোয়ানা পড়ার শামিল। যদিও আভাঁগার্দকে সম্প্রসারণশীল ভাবা যায় না, তবু এর আর কোনো সৃজনশীলতা নেই। আধুনিকতা প্রভাবশালী, কিন্তু মৃত। নব্য রক্ষণবাদীদের জন্য তখন কানুনের উৎপত্তি সমাজে কিভাবে হয়? কিংবা শৃঙ্খলা ও কাজের নৈতিকতাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে এমন কানুন? নতুন কোন আদর্শ কল্যাণকামী রাষ্ট্রের মাধ্যমে এর চিহ্নিতকরণে বাধা দেবে, যার ফলে অর্জনের জন্য ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতার উৎকর্ষ পুনরায় পাবে? বেল দেখেন, ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনই হচ্ছে একমাত্র সমাধান। ঐতিহ্যে আস্থাবান ধর্মীয় বিশ্বাস ব্যক্তিকে বিশুদ্ধ পরিচিতি ও অস্তিত্বের নিরাপত্তা দিতে পারে।
সাংস্কৃতিক আধুনিকতা ও সামাজিক আধুনিকীকরণ
কর্তৃত্বকে যে বিশ্বাস নির্দেশনা দেয়, তার জাদুতে কারও মন্ত্রমুগ্ধ হওয়া অবশ্যই উচিত নয়। অতএব, বেল-এর মতে, বিশ্লেষণের একমাত্র ফল সে রকম এক মানসিকতা, যা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে জার্মাননীতিও ছড়িয়ে পড়ছে; সাংস্কৃতিক আধুনিকতার বাহনের সঙ্গে একটা বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক সহাবস্থান। নতুন স্টাইলের নিরীক্ষক পিটার ফেলস (Peter Stein fels) থেকে আমি একটা উদ্ধৃতি দিচ্ছি। এটা নব্য-রক্ষণবাদীরা সত্তর দশকের বৌদ্ধিক ধারণার সঙ্গে মিলিয়ে নেয়:
‘‘সংগ্রাম বিরুদ্ধবাদী মানসিকতা হিসেবে বিবেচিত প্রতিটি উপসর্গ উন্মোচনকারীর রূপ নেয় এবং তার ‘যুক্তি’কে অনুসন্ধান করার ফলে বিভিন্ন ধরনের চরমপন্থাকে সংযুক্ত করে; মডার্নিজম ও নিহিলিজমএর মধ্যে যোগসূত্র অঙ্কনের মাধ্যমে, সরকারি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও সমগ্রবাদের মধ্যে, অস্ত্র প্রতিযোগিতার সমালোচনা ও সমাজতন্ত্রের প্রতি বশ্যতার মধ্যে, নারী স্বাধীনতা বা সমকামিতার অধিকার ও পরিবার ধ্বংসের মধ্যে,সাধারণভাবে বাম ও সন্ত্রাসবাদ, প্রতি সেমেটিকতা ওফ্যাসিজমের মধ্যে।’’
এই ধরনের উপস্থাপনা ও এসব বুদ্ধিবৃত্তিক অনুযোগের তিক্ততা পর্যন্ত জার্মানিতে এই ধরনের সোরে উচ্চারিত হচ্ছে। তারা নব্য রক্ষণবাদী লেখকদের মনস্তত্ত্বেরদ্বারা ব্যাখ্যা করা উচিত নয়। বরং তার শেকড় নব্য রক্ষণবাদী মতবাদের বিশ্লেষণের দুর্বলতার মধ্যে প্রোথিত। নব্য রক্ষণবাদ পরিবর্তিত হয় সাংস্কৃতিক আধুনিকতাবাদে, যা অর্থনীতি ও সমাজের কমবেশি সার্থক ধনবাদী আধুনিকায়নের ওপর অস্বস্তিকর বোঝা স্বরূপ। নব্য রক্ষণবাদী মতবাদ একদিকে সামাজিক আধুনিকীকরণের স্বাগত পদ্ধতি ও অন্যদিকে অনুশোচিত সাংস্কৃতিক উন্নয়নের মধ্যকার সম্পর্ককে ঝাপসা করে দেয়। নব্য রক্ষণবাদীরা কর্ম, গ্রহণ, অর্জন ও অবসরের প্রতি পরিবর্তিত মানসিকতার অর্থনৈতিক ও সামাজিক কোনো কারণই খোলাসা করে না। সঙ্গে সঙ্গে তারা ‘সংস্কৃতি’র জমিদারিতে আরোপ করে-ভোগবাদ, সামাজিক পরিচয়ের অভাব, নার্সিসিজম, প্রতিষ্ঠা থেকে প্রত্যাহরণ ও অর্জনের প্রতিযোগিতা। বস্তুত সংস্কৃতিই একটি ঘোরালো ও মধ্যস্ততাকারী পন্থায় এসব সমস্যা সৃষ্টিতে অবদান রাখে।
নব্য রক্ষণবাদী দৃষ্টিতে, যে সব বুদ্ধিজীবী এখনো নিজেদের মডার্নিস্ট প্রকল্পের প্রতিদায়বদ্ধ ভাবেন, তারা ওইসব অবিশ্লেষিত কারণগুলোর জায়গা দখলকারী হিসেবে পরিবেশিত। যে মানসিকতা আজ নব্য রক্ষণবাদকে পোষণ করে, তা কিছুতেই মিউজিয়াম থেকে সাধারণ জীবনের প্রবাহের দিকে সংস্কৃতিকে ভাঙার জন্য নীতিশাস্ত্র বিরোধের পরিণতি সম্পর্কে অতৃপ্তি থেকে উৎপন্ন হয়নি। আধুনিকতাবাদী বুদ্ধিজীবীরা এই অতৃপ্তি তাদের জীবনে গ্রহণ করেননি। এটার শেকড় সামাজিক আধুনিকীকরণ মানব অস্তিত্বের পূর্ববর্তী রূপের গভীর থেকে গভীর প্রবেশ করে। আমি নিয়মের অনুজ্ঞার প্রতি জীবন-বিশ্বের এই অধীনতাকে দৈনন্দিন জীবনের সংযোগকারী অবকাঠামোতে ব্যাঘাত ঘটানো বলে বর্ণনা করতে চাই।
দৃশ্যত, নব্য জনবাদী (Neopopulist) প্রতিবাদে গ্রাম ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ধ্বংস ও মানুষের সঙ্গপ্রিয়তার রূপ সম্পর্কে বিস্তৃত ভীতি একটি বিশেষ বিন্দু হিসেবে প্রকাশ পায়। এসব প্রতিবাদ সম্পর্কে নব্য রক্ষণবাদ নামে একটি বিশেষ শ্লেষও বিদ্যমান। সামাজিক কর্মকাণ্ড একটা সংশ্লিষ্টতা দাবি করে, যাকে ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে যাওয়ার কর্মকাণ্ড একটা সংশ্লিষ্টতা দাবি করে, যাকে আমি সংযোগকারী যৌক্তিকতা বলে থাকি। প্রতিবাদ ও অতৃপ্তির জন্য ঘটনাগুলো যখন মূল্যবোধ ও সৌজন্যের পুনরুৎপাদন ও সঞ্চালনে কেন্দ্রীভূত যোগাযোগকারী কার্যাবলির জগতে যথাযথভাবে সৃষ্ট হয়, তখন সেখানে অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক যৌক্তিকতার অভিভাবকত্বে এক ধরনের আধুনিকায়ন অনুপ্রবেশ করে। অর্থাৎ, যোগাযোগকারী যুক্তি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক যুক্তিদানকারী স্ট্যান্ডার্ডের ওপর এসব জগৎ নির্ভর করে। কিন্তু নব্য রক্ষণবাদী মতবাদগুলো ঠিকই আমাদের মনকে এ ধরনের সামাজিক পদ্ধতি থেকে সরিয়ে নেয়; তারা নাশকতামূলক সংস্কৃতি ও তার দোসরদের সামনে কারণগুলো তুলে ধর, যা তারা সাধারণত প্রকাশ করে না।
বস্তুত সাংস্কৃতিক আধুনিকতা নিজের মূল্যায়ণ সঙ্গে সঙ্গেই তৈরি করে নেয়। স্বাধীনভাবে সামাজিক আধুনিকায়নের পর্যায়গুলো থেকে ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের নিজস্ব অনুষঙ্গগুলোর মধ্যে আধুনিকতার প্রকল্পকে এক মৃদু প্রকারভেদকে নাড়াচাড়া করে আমরা এখন আলোচনা করব—আধুনিকতা ও বিভিন্ন চিন্তার জগতে তার অতৃপ্তি নিয়ে, যা এসব সাংস্কৃতিক আধুনিকতার মূল্যায়নকে ছুঁয়ে যায় সেসব নিয়ে। এর মধ্যে রয়েছে যেসব প্রকাশনা হয় পোস্টমডার্নিটিকে ডেকে আনে অথবা কোনো এক ধরনের প্রাক-আধুনিকতাকে প্রত্যায়ন করে, অথবা আধুনিকতাকে সম্পূর্ণরূপে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, কেবল তেমন অবস্থানে থাকার ছল করে।
চলবে…